ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর লিখে গেছেন —
‘শাঁখা, শাড়ি, সিন্দুর,
চন্দন, পান, গুয়া
নাহি দেখি,
আয়তি কেবল আচাভুয়া৷’
সিঁদুরের সঙ্গে আয়তি বা এয়োতি তথা এয়োস্ত্রী রমণীর আবহমান কালের সম্পর্ক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখেছেন,
“আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো- তোমার
অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো- তোমার
ললাটচন্দনে।”
হিন্দুশাস্ত্রমতে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে উল্লিখিত আছে শাঁখা-সিঁদুরের কথা। তুলসী দেবী এবং শঙ্খাসুরের সেই কাহিনী অনেকেরই জানা। সিন্ধুসভ্যতাতেও শাঁখা সিঁদুরের ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে লিঙ্গ নির্বিশেষেই সেখানে সিঁদুরের টিপ পরার প্রচলন ছিল। কিন্তু ইতিহাসের নানান তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাবে, এই রীতির প্রচলন হয়েছে আরো অনেক পূর্বে। এই রীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লিঙ্গ বৈষম্য এবং বর্বরতাও।
একটা সময়, অন্যান্য পণ্যের মতই নারীদেরও পুরুষের সম্পত্তি হিসাবেই চিহ্নিত করত সমাজ। আর অধিকারের চিহ্ন হিসাবে কপালে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষত তৈরি করা হত। হাতে দেওয়া হত লোহার বেড়ি। কোমরে শিকল। যা ছিল নিজের অধিকারের সূচক। ‘নারী-লুঠ’-এর এই চিহ্নগুলিই পরবর্তীকালে সভ্যতা এগনোর সঙ্গে নাকি বদলে যায় শাঁখা-সিঁদুরে। ‘লোহা’ থেকেই আসে ‘নোয়া’ কথাটি। আবার লোহার বেড়-এর আরেক অর্থ আয়স্ত। সেখান থেকেই বিবর্তনজাত শব্দ ‘এয়োস্ত্রী’। অস্যার্থ বিবাহিত মহিলা।
কেউ কেউ বলেন, আদিমকালে কন্যাহরণের সময় যে যুদ্ধ হত, সেই যুদ্ধে জয়লাভকারী যুবক নিজের আঙুল কেটে রক্ত বের করে পরিয়ে দিত কন্যার সিঁথিতে। মূলত কন্যাটির ওপর নিজের অধিকার স্থাপনের জন্যেই এই রীতি। পরবর্তীকালে সেই রক্তফোঁটাই বদলে যায় সিঁদুরে। ইতিহাস ঘাঁটলে উঠে আসে এরকম আরও তথ্য।
মঙ্গলচিহ্ন বা পবিত্রতা কিংবা আয়ুবর্ধক হিসাবে এই রীতি তৈরি হলেও এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অধিকারবোধ এবং বীরত্বের ছদ্মপ্রতীক। সিঁদুর-শাঁখা সেই অধিকারবোধেরই সূচক। সে কারণেই হয়তো নারীদের জন্য এমন রীতির প্রচলন থাকলেও পুরুষদের জন্য তা নেই। পুরুষতন্ত্রেরই অবদান এই সিঁদুরপ্রথা।
একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে যখন গোটা দেশ নারী অধিকারের জন্য সরব হচ্ছে, সরকারের কথায় বার বার উঠে আসছে ‘মহিলাদের ক্ষমতায়ন’-এর কথা, তখন এই সিঁদুর রোমান্টিক সিরিয়াল ও সিনেমা ও যাত্রাপালার নামেও থাবা গেড়েছে। ‘সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক’, ‘সিঁদুর দিও না মুছে’ ইত্যাকার সিনেমাসিরিয়াল দুই বঙ্গেই ভূরি ভূরি তৈরি হচ্ছে।
এই সিন্দুর নিয়ে বাংলা প্রবাদ লালে লাল। অবশ্য মেটে সিঁদুরও ব্যবহার করেন মহিলারা, বিশেষত বিহার ও উত্তর প্রদেশের মহিলারা। এখন দেখা যাক কী কী প্রবাদ আছে সিন্দুর তথা সিঁদুর নিয়ে। তাহলে সিঁদুরের সামাজিক প্রেক্ষাপটটা বোঝা যাবে। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে যে ডরায়, তা সকলেরই জানা।
১. আমানি খেয়ে দাঁত ভেঙেছে, সিঁদুর পরবি কিসে!
(দাঁতের সঙ্গে সিঁদুরের সম্পর্ক বোধগম্য নয় অবশ্য)
২. উটকপালী সিঁদুর চায়, খড়মঠেঙী ভাতার খায়!
৩. খটমটিয়ে হাঁটে নারী, কটমটিয়ে চায়,
মাসেক খানের ভিতর তার সিঁথির সিঁদুর যায়।
৪. তেল দাও সিঁদুর দাও, ভবী ভোলবার নয়।
৫. ধান নেই চাল নেই, গোলাভরা ইঁদুর।
ভাতার নেই পুত নেই, কপালভরা সিঁদুর।।
৬. পাকা মাথায় সিঁদুর পরা।
৭. সধবা কপালে সিঁদুর পরে, বিধবার কপাল চড়চড় করে।
৮. সকলেই সিঁদুর পরে, কপালগুণে ঝলক মারে।
৯. কাকের মুখে সিঁদুরে আম।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সিঁদুর নিয়ে সধবা ও বিধবাদের মধ্যে যেন একটা ‘লাগিয়ে দেওয়ার’ মানসিকতা কাজ করেছে প্রবচনকারদের মধ্যে। সিঁদুর যেন নারীর অঙ্গের শোভা না হয়ে পুরুষতন্ত্রের হাতের অস্ত্র হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।
দুর্গাপূজায় সিঁদুর খেলার চল বঙ্গে আগে ছিল না। যদিও দেবীবরণের অনুষ্ঠান বরাবরই ছিল। ইদানীং দুর্গাপূজার ভাসানের সময় সুবেশা নারীদের সিঁদুরখেলার প্রচলনের পিছনেও মনে হয় পুরুষশাসিত বিপণনজগতের কারসাজি আছে।