শনিবার | ৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:৪৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
সাদা কালোয় কুমোরটুলি : বিজয় চৌধুরী জেল খাটাদের পুজো, মাইক আসছে মাইক, ছুটছে গ্রাম : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কাশ্মীর নির্বাচনে বিপুল সাড়ার নেপথ্যে কি ৩৭০ বিলোপের জবাব : তপন মল্লিক চৌধুরী তর্পণের তাৎপর্য : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় মহালয়ার চন্ডীপাঠ মন্ত্র, মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্র : বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৪ সুকুমার রায় মানেই শৈশব ও কৈশোর : রিঙ্কি সামন্ত অমৃতা প্রীতম-এর অনুবাদ গল্প ‘বুনোফুল’ মিল অমিলের মানিক ও মার্কেজ : রাজু আলাউদ্দিন কলকাতা ছিল একসময় ভেড়াদের শহর : অসিত দাস নিরাপদর পদযাত্রা ও শিমূলগাছ : বিজয়া দেব তোলা বন্দ্যো মা : নন্দিনী অধিকারী বাংলার নবজাগরণ ও মুসলমান সমাজ : দেবাশিস শেঠ সৌরভ হোসেন-এর ছোটগল্প ‘সালাম’ বঙ্গের শক্তি-পূজা : সুখেন্দু হীরা পুজোর পরিবর্তন, পরিবর্তনের পুজো : সন্দীপন বিশ্বাস পিতৃপক্ষের মধ্যে পালিত একাদশী — ইন্দিরা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত অরণ্যের অন্তরালে তাম্বদি সূরলা : নন্দিনী অধিকারী ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হীরালাল সেন : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্যাসাগরের অন্তরালে ঈশ্বরচন্দ্র, পূর্ব পুরুষের ভিটে আজও অবহেলিত : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব সুধীর চক্রবর্তী স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার : দীপাঞ্জন দে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে দুর্গা রূপে আরাধনা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালির নিজস্ব দুর্গা : শৌনক দত্ত সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার : দিলীপ মজুমদার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘প্রাতঃভ্রমণ’ বন্যায় পুনর্জীবন বেহুলার : রিঙ্কি সামন্ত গরানহাটা কি ছিল ভেড়ার হাট : অসিত দাস ডিভিসি-র ছাড়া জলে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ নাজেহাল, দায় কার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা : দীপাঞ্জন দে
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই পিতৃপক্ষের সমাপ্তি মাতৃপক্ষের শুভ সূচনা-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

তর্পণের তাৎপর্য : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় / ৫৭ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০২৪

মহালয়া শব্দটির আভিধানিক অর্থ, ‘হিন্দুদের পিতৃ-তর্পণের জন্য নির্দিষ্ট শারদীয় দুর্গাপুজোর অব্যবহিত পূর্ববর্তী অমাবস্যা তিথি।’ সংস্কৃতে মহ শব্দের অর্থ উৎসব, পিতৃপুরুষের। আলয় হল আশ্রয়। স্ত্রী লিঙ্গে ‘আ’ যুক্ত হল। অর্থাৎ মহা+আলয়+আ= মহালয়া। পিতৃপুরুষের উৎসব। আমরা যারা জীবিত, তাদের তো কিছু করার নেই। পৃথিবীর রঙ্গভূমি ছেড়ে যাঁরা জীবিতদের অজানা প্রবাসে চলে গিয়েছেন তাঁরা এই নির্দিষ্ট দিনে তাঁদের ছেড়ে যাওয়া রঙ্গভূমিতে ফিরে আসবেন, মিলিত হবেন। ‘গেট টুগেদার’! তাঁরা আসেন কোথা থেকে, কোথায় যান! অতি দুর্ভেদ্য রহস্য! মানুষ, তুমি কোথা থেকে এলে, এতটুকু বীজের আকারে? বড় হলে, বুড়ো হলে, তারপর একদিন নেই হয়ে গেলে। তোমার খোলটা পুড়িয়ে ছাই করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হল। পঞ্চভূতের শরীরের পাঁচটি উপাদান, উপাদানেই মিশে গেল। বসুন্ধরার কোনও কিছু নিয়ে কোথাও পালানো যাবে না। শ্রীকৃষ্ণ যেন এই কথাই বললেন, এই তোমার সাজঘর, আর ওই তোমার মঞ্চ। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তের পালাটা তুমিই লেখো। দর্শন দর্শনেই থাক। মোটা আর ভোঁতা বুদ্ধিতে যা দেখেছি, যা বুঝেছি, যে ছিল, সে নেই, যে ছিল না, সে হাত-পা ছুঁড়ছে।

বেদ-বেদান্ত থাক। দেখি আমাদের পুরোহিতরা কী বলছেন! প্রথমেই বেশ যুক্তসঙ্গত সহজ একটি প্রশ্ন, ‘তোমার পিতা ছিলেন?’

—অবশ্যই।

—পিতার পিতা তস্য পিতা?

—অবশ্য।

তাহলে তোমার এই পরিবারের একজন আদিপিতা ছিলেন প্রথম আদি।

—তা তিনি কোথায়? আছেন না কি?

—অবশ্যই আছেন ‘পিতৃলোকে’। এইবার বাস্তব থেকে বেরিয়ে এস। আগে পরলোকের ভূগোলটা জানা। চিতার ধূম ঊর্ধ্ব দিকেই ওঠে, সুতরাং সাধারণ বুদ্ধিতে মাথার ওপর আকাশ ভেদ করে আরও আরও উপরে সেই স্বর্গ, আর পায়ের নীচে নরক। ‘আণ্ডার গ্রাউন্ডে’ সাতটি তল, প্রত্যেকটাই এক একটা নরক। ভিন্ন ভিন্ন নাম ‘কুম্ভীপাক’, ‘রৌরব’ ইত্যাদি। পাতালের একাধিক তল— ‘তল’, ‘অতল’, ‘সূতল’, ‘বিতল’। নরকের খবরে আমাদের প্রয়োজন নেই। উড়ো খবর যেটুকু শোনা যায়, কালো কুচকুচে যমদূত। বড় বড় লোহার কড়ায় তেল ফুটছে, এক একটা পাপীকে সেই তেলে ভাজা হচ্ছে। আমাদের রান্না ঘরে যে প্রসেসকে বলা হয়, ‘ছাঁকা তেলে ভাজা’। যমদূতদের হাতে ডাঙ্গশ।

মাথার ওপরে যে দিব্যলোক, অমৃতলোক, সেই লোকের বিভাজন, শাস্ত্রমতে এইরকম ‘পিতৃলোক’  ‘চন্দ্রলোক’, ‘দেবলোক’, ‘ব্রহ্মলোক’। মৃত্যুর পর কী হয়! ধরা যাক আমি এই মাত্র মরেছি, দেহের বাইরে এসে ইতস্তত করছি, কী করব? কোন দিকে যাব! সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বংশের প্রথম পিতা, আদিপিতা এসে আমাকে ‘পিতৃলোকে’ নিয়ে যাবেন। আমি মানে আমার আত্মা।

বৌদ্ধরাও অনেকটা এইরকম বিশ্বাস পোষণ করেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাঁর গুরু এসে শিয়রে দাঁড়ান। দেহ থেকে আত্মাকে নিষ্ক্রান্ত করার কসরত চলে। সহজে কি বেরতে চায়! জীবনের আঠা ভীষণ চটচটে। দেহমুক্ত আত্মাকে যদি কেউ গ্রহণ না করেন পরম পিতা, কী গুরু, তাহলে এই বেওয়ারিশ আত্মা ঘুরপাক খেতে খেতে কাটা ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে প্রেত-যোনিতে পরিণত হবে। সোজা কথা ভূত হবে। সেই কারণে হঠাৎ আচমকা মৃত্যু, দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা নিজের পক্ষে এবং অন্যের পক্ষে সমস্যার কারণ। ঝামেলার একশেষ, গয়ায় গিয়ে প্রেতশিলায় পিণ্ডদান করতে হবে। জীবতকালে পিতাকে অবহেলা করলেও অবসানের পর শ্রদ্ধার তর্পণ না করলে জীবনপথে স্বস্তিলাভের সম্ভাবনা কম।

হিন্দু দর্শনে জীবনের চেয়ে মৃত্যুর ব্যাপ্তি অনেক বেশি। জীবন শৃঙ্খলিত, অনেক বাঁধনে বাঁধা। মৃত্যু সম্পূর্ণ মুক্ত। আমাদের শ্রাদ্ধে ও তর্পণে শাস্ত্রকারদের কল্পনার ব্যাপ্তি ও উদারতায় বিস্মিত হতে হয়। অনন্ত অস্তিত্বকে অসাধারণ উদারতার মন্ত্রে বেঁধে ফেলছেন। জীবনের সীমা অতিক্রম করে অসীমে যাত্রা। তর্পণান্তে কিছুক্ষণের জন্য মনে হবে অসীমে ভ্রমণ করে এলাম। আমার উত্তরাধিকার এতটা বিরাট!

প্রথমেই বলা হল, নদীর তীরে সম্ভব না হলে জলাশয়ে তর্পণ করা বাঞ্ছনীয়। একটি পা থাকবে জলে, আর একটি পা স্থলে। দক্ষিণ মুখী হয়ে দু’বার আচমন। সেই মন্ত্রে তর্পণকারীর মন সমগ্র ভারত ঘুরে আসবে। সমস্ত তীর্থ স্পর্শ করবে। শুরুতেই বিষ্ণুকে স্মরণ। তিনি এই তর্পণকর্মের সাক্ষী থাকুন এবং সব শেষে তাঁরই চরণে কর্মটি সমর্পণ করব। পাঁচটি তীর্থকে আবাহন করব— কুরুক্ষেত্র, গয়া, গঙ্গা, প্রভাস, পুষ্কর। গঙ্গা নদী হলেও পুণ্যতীর্থ। গঙ্গা নদীতেই তর্পণ বিধেয়। গঙ্গা গঙ্গৈব পরমা গতি। তর্পণের শুরুই হবে এই পঞ্চতীর্থকে আবাহন করে।

তারপর পূর্বমুখী হয়ে দৈব তীর্থ দ্বারা (দৈব তীর্থ তর্পণকারীর হাতেই আছে সমস্ত আঙুলের অগ্রভাগই দৈবতীর্থ) দেবতাদের জলদান। দেবতারা হলেন, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, প্রজাপতি (বিধাতা), সমস্ত দেবতা, নাগ গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর ইত্যাদি। মন্ত্রটি কত উদার!

ভ্রূরা সর্পাঃ সুপর্ণাশ্চ তরবো জিক্ষগাঃখগাঃ

বিদ্যাধরা জলধারস্তথৈবাকাশগামিনঃ

গ্রহণ কর আমার তর্পণ, এমনকী, যারা অনাহারে রয়েছে এবং পাপে ধর্মে রতাশ্চ যে, যার কর্মদোষে ব্রাত্য আসা গ্রহণ করো এক অঞ্জলি জল। এরপর পশ্চিমমুখী হয়ে আমাদের সর্বকালের পাঁচজন মুনিকে জলদান— সনক, সনন্দ, সনাতন, কপিল, বোঢ়ু। এঁরা সকলেই ব্রহ্মার মানসপুত্র, তাঁর প্রথম সৃষ্টি। আমাদের আদি পিতা।

এবার ফিরব পূর্বমুখে। ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা ব্রহ্মের ধ্যানমগ্ন মন থেকে জন্ম হয়েছিল তাঁর ছ’জন মানসপুত্রের মরীচি, অঙ্গিরস, অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ আর ত্রুতু। এই ছয় পুত্রকে জল অঞ্জলি দেব নিজের বুকের দিকে। আত্মাভিমুখে দুই অঞ্জলি জল। এই সমাবেশে থাকবেন আরও তিনজন বশিষ্ঠ, ভৃগু ও নারদ এবং সব দেবতা।

দেবলোক ঋষিলোক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দক্ষিণে ফিরব যমের দক্ষিণ দুয়ার। শুরু হবে তিল সহযোগে জলদান। নিজের বংশের পিতারা এসেছেন। এক একজনের এক এক স্বভাব জীবনচর্যা নিশ্চিতভাবেই ছিল, নিজস্ব রুচি ছিল, কেউ অগ্নিষ্বাত্তা, কেউ সৌম্যা। হবিষ্মন্ত, উষ্মপা, সুকালীনাঃ, বহির্ষদঃ আজ্যপা। যমরাজও বঞ্চিত হবেন না। তাঁর কত নাম নীলয়ে পরমেষ্ঠিনে। অতঃপর শুরু হবে পিতৃতর্পণ, মহালয়া, মহা উৎসব। পিতৃলোক থেকে পিতৃপক্ষে তাঁরা এসেছিলেন। মা আসছেন যে, এইবার তাঁর পক্ষ দেবীপক্ষের শুরু। আজই তাঁরা ফিরে যাবেন নিজ লোকে পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধ প্রপিতামহ। মাতামহ, প্রমাতামহ, বৃদ্ধ প্রমাতামহ, ষট পুরুষের তর্পণ। তারপর মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহী। মাতামহীরও একই ক্রম।

জানা অজানা যে আছে যেখানে আজ এই অঞ্জলি গ্রহণ করো। বিরাটের কতটুকুরই বা তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারি! আমাদের শাস্ত্র যে বিশ্বকে কোলে নিতে চায়। একটি মন্ত্র তিনবার—

ওঁ আব্রহ্মস্তব পর্যন্তং জগত্তৃপ্যতু

হঠাৎ শাস্ত্রের চোখ পড়ল সেই নির্জন দিকে, ‘কে তুমি বসি নদীকূলে একেলা।’ তোমার বংশে তোমাকে স্মরণ করার মতো উত্তরপুরুষ কেউ নেই! এই যে আমি আছি শাস্ত্র আমার হাত ধরে রেখেছেন জল নাও। শোনো মন্ত্র,

ওঁ যে চাস্মাকং কুলে জাতা অপুত্রা গোত্রিণো মৃতাঃ।

তে তৃপ্যন্তু ময়া দত্তং…

সব শেষে ছোট্ট এই প্রণাম

ওঁ প্রীয়তাংপুণ্ডরীকাক্ষঃ সর্ব যজ্ঞেশ্বরো হরিঃ।

তস্মিংস্তুষ্টে জগৎস্তুষ্টং প্রীণিতে প্রীণিতং জগৎ।।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন