বুধবার | ৩রা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:০২
Logo
এই মুহূর্তে ::
সুলেখা সান্ন্যাল-এর ছোটগল্প ‘ঘেন্না’ সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (শেষ পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী শোভারাম বসাকের লবণের ব্যবসা : অসিত দাস রাখাইনে সংঘাত ও সেন্টমার্টিন পরিস্থিতি : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন খেলার মাঠ থেকে চেম্বারে : রিঙ্কি সামন্ত ছড়া কি শিশুসাহিত্য? : লুৎফর রহমান রিটন কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা দিবস ও ডা: বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মজয়ন্তী পালন : দীপাঞ্জন দে সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (তৃতীয় পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (শেষ পর্ব) : গীতা দাস সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (দ্বিতীয় পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (চতুর্থ পর্ব) : গীতা দাস সাবঅলটার্ন দৃষ্টিতে কলকাতার লবণচিহ্ন : অসিত দাস মোদীকে চাপে রাখতে নীতীশ-নায়ডুর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা দাবি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (প্রথম পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বাঁধে ইঁদুরের তৈরি গর্ত দিয়ে ঢোকে বন্যার জল চলছে সংস্কারের কাজ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (তৃতীয় পর্ব) : গীতা দাস কবি সঞ্জীব প্রামাণিক, আবহমান বাংলা কবিতার পথে হেঁটে-যাওয়া এক কবিতাভিক্ষুক : অমৃতাভ দে সৌমেন দেবনাথ-এর ছোটগল্প ‘বিলাসী’ বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (দ্বিতীয় পর্ব) : গীতা দাস সাত্যকি হালদার-এর ‘ছোটগল্প’ কাজলদিঘি ডায়েটে আনতে হবে কয়েক টুকরো নারকেল তাহলেই কেল্লাফতে : রিঙ্কি সামন্ত বাতাসে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে বাঁশগাছের কদর বাড়ছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (প্রথম পর্ব) : গীতা দাস স্পিকার নির্বাচন থেকেই শুরু হল সেয়ানে সেয়ানে টক্কর : তপন মল্লিক চৌধুরী বাসুলী লবণের দেবী (দ্বিতীয় পর্ব) : অসিত দাস শক্তিপদ রাজগুরু-র ছোটগল্প ‘পাখিরা আর নেই’ বিস্মৃত কথাসাহিত্যিক সুলেখা সান্যাল : আনিসুর রহমান ময়মনসিংহের গৌরব কেদারনাথ মজুমদার (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার লেডি ম্যাকবেথ, ওয়াটার আঙ্কেল ও আমি : সসীমকুমার বাড়ৈ জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা শিক্ষার জনক : মনোজিৎকুমার দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সাত্যকি হালদার-এর ‘ছোটগল্প’ কাজলদিঘি

সাত্যকি হালদার / ১১২ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪

দার্জিলিং ঘোরা শেষ। টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখাও হয়েছে। তাদের দুজনের এবার দেশে ফেরার পালা।

তার আগে হাতে কাজ আছে একটা। খানিকটা অনির্দিষ্ট ভ্রমণের মতো সেই কাজ। তার জন্য শেষের একটা দিন তুলে রাখা। সরিতার ভাবনায় ছিল, তবু সে জানত না কেমন হবে সেই অগোছালো ব্যাপারটা। জানত না আদৌ হবে কি না কিছু। তবে কাজ কিছু যদি নাও হয়, আর একটু বেড়ানো তো হবে। নতুন জায়গা দেখা হবে, হয়তো নতুন কিছু মানুষ।

সরিতা আর জামানের বিয়ে হয়েছে দেড় বছর। এই দেড় বছরে জামান তেমন কোনও বড় ছুটি পায়নি যে খানিকটা লম্বা করে কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসা যায়। দেশের মধ্যে রাঙামাটি কক্সবাজার হয়েছে। ঢাকা থেকে বরিশাল, বরিশাল থেকে ঢাকা দু রাতের শৌখিন স্টিমারে জল-যাত্রা হয়েছে। মংলা হয়ে সুন্দরবন হয়নি।

আগের ডিসেম্বরে জামানের প্রাইভেট কোম্পানির পাঁচ দিনের ছুটি শুক্রবার আর পঁচিশ তারিখ ধরে সাত দিনে দাঁড়াচ্ছিল। সরিতার স্কুলের চাকরিতেও ওই সাত দিনের বিরতি। ফলে বছরের মাঝখান থেকেই পরিকল্পনা তৈরী হয়েছে। সুন্দরবন ভাবা হয়েছিল, পাহাড়পুর আর চলনবিলের কথাও ভেবেছিল ওরা। সেসব অবশ্য তিন-চার দিন হলেই হয়ে যায়। শেষে জামান একদিন বলল, চলো দেখি ইন্ডিয়ায় যাই।

সরিতা বলেছিল, ইন্ডিয়ায়! কোথায়? কলকাতা!

জামানের অফিস, বাড়ি আর সরিতার স্কুল, এসবে সপ্তাহের বেশির ভাগ অংশটা ব্যস্ততায় কেটে যায়। সেসবের ভেতরেই সকাল বা রাতে একটু পরিকল্পনা হত। সরিতা বলেছিল, কলকাতা ভালো, কিন্তু সেখানে তো শুনি আমাদের ঢাকার মতোই অনেক লোক, অনেক গাড়ি, চার পাশে ব্যস্ত ভাব। ছুটি কাটানোর জন্য তেমন জায়গা কি ভালো হতে পারে!

জামান অফিস থেকে ফিরে গোসল সেরে পোশাক পাল্টে চা নিয়ে বসে বলেছিল, ইন্ডিয়ায় গেলে কলকাতাতেই যেতে হবে কেন? সেখানে তো লোকে চিকিৎসার দরকারে যায়। আমরা বরং দার্জিলিং যাই। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে আসি।

দার্জিলিং! সে তো দারুণ! জামানের প্রস্তাবে উৎসাহিত সরিতা। বলেছিল, তবে পথটা অনেক। আমাদের এই বগুড়া শহর থেকে বেনাপোল, তারপর সেখান থেকে সেই কলকাতা হয়েই দার্জিলিং। ছুটির অনেকগুলো দিন পথে পথেই শেষ হয়ে যাবে।

জামান চায়ের কাপ নামিয়ে বলেছিল, ওইখানেই তো মজা। আমরা যাবই না বেনাপোল। আমরা ইন্ডিয়ায় যাব সোনা মসজিদ বা জিরো পয়েন্টে ফুলবাড়ি বর্ডার হয়ে। জিরো পয়েন্ট তো প্রায় ওদিকের শিলিগুড়ি শহরের গায়। সার্চ দিয়ে দেখে নিয়েছি শিলিগুড়ি থেকে যেভাবেই যাও দার্জিলিং ঘন্টা তিনেকের বেশি না।

বল কী তুমি! সরিতা শুনতে শুনতে ছটফটে। তার মানে বলছ আমাদের এই বগুড়া থেকে দার্জিলিং ঘন্টা ছয়েক!

জামান ওকে থামিয়ে দেয়। বলে, বর্ডারের কাজকাম ধরে আর একটু বেশি। হয়তো সাত ঘন্টা। তবে জিরো পয়েন্ট শুনেছি একেবারেই ফাঁকা বর্ডার। চাপ খুবই কম। বেনাপোলের মতো সব সময় হাজার লোক লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে না। কাগজপাতি দেখিয়ে আমরা হেঁটে হেঁটেই পার হয়ে যেতে পারি।

ভিসা? সরিতার ছোট্ট শেষ প্রশ্ন। সে জানে ওই অনুমতিটুকুই ইন্ডিয়ায় যাওয়ার সব চেয়ে জটিল ব্যাপার।

চা শেষ করে জামানের গলা স্থির। সে বলে, সমস্যা আছে। আবার নাইও। ইন্ডিয়ার এমব্যাসিতে আমার অফিস কলিগের এক রিলেটিভ কাজ করে। সেই লোক খানিকটা দেখবে। আর আমরাও মাস চারেক আগে পাসপোর্ট জমা করে দেব।

অফিস কলিগের যোগাযোগেই হোক আর চার মাস আগের কারণেই হোক, ডিসেম্বরের বেশ আগেই হাতে এসে গিয়েছিল ভিসা। তারপর গোছগাছ, কেনাকাটা, চাপা উত্তেজনা। শীতের দার্জিলিং সামলানোর জন্য বাড়তি কিছু গরম পোশাকও কিনে ফেলতে হল। তারপর অন লাইনে দার্জিলিংয়ে তিন আর মিরিকে দুই রাত হোটেল বুকিং। নভেম্বরের শেষ দিক থেকে এক একটা দিন যেন কাটছিলই না ওদের।

পৌঁছনোর দিন বিকেল হল হোটেলে ঢুকতে। ভোরবেলা বগুড়া ছেড়ে শেষ বিকেলে দার্জিলিং, পৌঁছেও কেমন অবিশ্বাস্য লাগছিল। তবে সেদিন তারা বেশ ক্লান্ত। হোটেলের দোতলার ঘরের সামনে দুজনের বসার মতো নির্জন বারান্দা। তার নিচ থেকে রাস্তা বাঁক নিয়ে ওপরে ম্যালের দিকে গেছে। বারান্দায় বসে দুজনে দেখেছিল সেই রাস্তায় নিয়ন আলোয় রংবেরঙেয়ের পোশাক পরা মানুষের যাতায়াত। সন্ধ্যে বাড়তে থাকায় ম্যাল থেকে ফিরে আসা মানুষই সংখ্যায় বেশি। সবার চোখমুখে যেন উৎসব থেকে ফিরে আসার ছাপ।

বারান্দায় বসে সরিতা জামানকে জিজ্ঞাসা করেছিল, দার্জিলিং শহরের বয়স কত জানো?

বেড়াতে যাওয়ার আগে জামান জায়গা নিয়ে যে ঘাঁটাঘাঁটি করে সরিতার তা জানা। কিছু না জেনে নতুন জায়গায় যাওয়া পছন্দ নয় জামানের। সরিতার বাড়তি সুবিধা সঙ্গে ট্যুর গাইড পেয়ে যায়। ওর কথার উত্তরে জামান বলে, দার্জিলিংয়ের হদিশ প্রথম পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন। সেই থেকে গরমের সময় তারা কলকাতার রাজ্যপাট ছেড়ে এখানে এসে থাকত। সব মিলে দার্জিলিং প্রায় দুশো বছরের শৈল শহর।

সরিতা খানিকটা অবাক। তার ধারণা ছিল দার্জিলিং তত পুরনো জায়গা নয়। ছোটবেলা থেকে নাম শুনে আসছে ঠিকই, বইতে পড়েছে, কিন্তু দুশো বছর ভাবতেই যেন কেমন লাগে। আর তাদের বেড়ানোর অভিজ্ঞতায় এ রকম পাহাড়ের পর পাহাড় নিয়ে হিমালয়, তার ভেতর এক-একটা জন বসতি, এ তো একেবারেই আলাদা।

ডিনার রাত নটা বাজতেই পৌঁছে গিয়েছিল ঘরে। ভুটানিজ সস্ আর স্টিমড্ চিকেন মোমো। ভাত রুটির ব্যবস্থাও ছিল। সরিতার আপত্তিতে জামানও তা নেয়নি। নতুন জায়গায় সরিতা সমস্ত রকম নতুনকেই পরখ করতে চায়।

সেই প্রথম রাতের শীতের কামড় বেশ। বগুড়া ঢাকা বা কলকাতায় সেই শীত কল্পনাও করা যায় না। হোটেল থেকে ঘুমানোর জন্য দু জোড়া ভারী কম্বল দেওয়া ছিল। ওদের পরিকল্পনা ছিল নিজেদের আনা বিছানার চাদরের ওপর কম্বল বিছিয়ে দুজনে তার নিচে নগ্ন হয়েই ঘুমোবে। রাতের এই নগ্নতা বাসা ছেড়ে যে কোনও দূরের জায়গায় ওরা গভীরভাবে উপভোগ করে।

কিন্তু শরীর খালি করে কম্বলের নিচে ঢুকেই ওরা বুঝল দুই কম্বলে ডিসেম্বরে দার্জিলিংয়ের রাত পার করা কঠিন। অতঃপর খানিকটা দ্রুততার সঙ্গেই শরীর বিনিময় শেষ করে বাথরুমে গিজারের গরম পানিতে গা ভিজিয়ে আবার পোশাক পরে নিল দুজন। টুপি আর মোজা সমেত কম্বলের নিচে যাওয়ার পর খানিকটা আরাম এল শরীরে। তারপর কখন নিশ্চিন্ত ঘুম। দুজনের ব্যস্ত জীবনে পাশাপাশি এমন আরামের ঘুম যেন বহু দিন পরই হল।

পর দিন সকালে নাস্তা নেওয়ার আগেই এক প্রস্থ হাঁটা হল ওদের। অল্প কিছুটা হাঁটলে যে প্রশস্ত চত্বর সেটাই ম্যাল। সেখানে পৌঁছে হঠাৎই ওদের চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। দুজনের কারও মুখে তখন আর কথা নেই। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার গা মোড়া সাদা বরফে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। বরফের একেকটা খাঁজ কোথাও হলদে কোথাও সোনালী। বাসা থেকে বহু দূরের পৃথিবী তাহলে এত অপরূপ! কেউ দেখুক না দেখুক প্রকৃতিকে এমন আশ্চর্য সেজে থাকতে হয় প্রতি দিন…!

কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ানো সরিতার বেশ কয়েকটা ছবি তুলল জামান। সরিতার জিন্স্, কুর্তা, তার ওপর পুলওভার, হাতে দস্তানা, মাথায় চুড়ো হওয়া লাল টুপি। ফরসা দুই গাল শীতের বাতাসে গোলাপী। এক সঙ্গেও দুজনের ছবি তোলা হল। হোটেলে ফেরার পথে জামান বলেছিল, যখন পৃথিবীতে মানুষ ছিল না তখনও সামনের ওই পাহাড় সেজে উঠত। যখন আমরা কেউ থাকব না তখনও সে এভাবেই থাকবে।

সরিতা কিছু বলল না। চুপ হয়ে হাঁটছিল। জামান বোঝে, আশ্চর্য হিমালয় সরিতার মনের সবটুকু আপাতত দখল করে ফেলেছে।

সেদিন আরও খানিকটা ঘুরে, ভাড়া করা গাড়িতে আশপাশের জায়গাগুলো দেখে  পর দিন ভোরে টাইগার হিল। সেখান থেকে দেখা সূর্যোদয়। দুজনের মনে হল যেন জীবনের প্রথম সূর্য ওঠা দেখে নিল ওরা। ফেরার পথে জামানের অল্প কিছু কথা, কিন্তু সরিতা মুগ্ধতায় চুপ হয়েই রইল।

পাহাড়ে শেষ সন্ধ্যায় মিরিকের লেকের পাশে বেঞ্চে বসে কফি খেতে খেতে জামান বলেছিল, হাতে আরও একটা দিন। এবং আমাদের বুকিং নেই কোথাও। তোমার পরিকল্পনা বলো। পাহাড়েই আর একটা স্পট, না আর কোথাও।

সরিতা ভাবল একটু। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ময়নাগুড়ি। নাম শুনেছ তুমি?

জামান মোবাইল বার করে দেখতে দেখতে বলে, নামটুকু শোনা। তার বেশি কিছু না। জলপাইগুড়ির আশেপাশে হবে। হঠাৎ করে তেমন জায়গার নাম বললে কেন?

সরিতা বলল, এক দিনের জন্য ঘুরে আসা যায়?

জামান মোবাইলে আঙুল চালায় কিছুক্ষণ। এদিক ওদিক করতে করতে বলে, শিলিগুড়ি থেকে পঁয়ষট্টি কিলোমিটার। ট্রেন বা বাসে ঘন্টা দুয়েক হবে। যেতে চাইলে সকালে গিয়ে সন্ধ্যেয় শিলিগুড়িতে ফিরে আসা যায়। ভেবে দেখ।

সরিতা বলে, কাল পাহাড় থেকে নেমে সোজা চল ওখানেই যাই। পরশু তো বর্ডার পার হয়ে ফেরা। কাল রাতেই আবার শিলিগুড়ির হোটেলে ফিরে আসব।

জামান মোবাইল পকেটে ঢোকায়। বলে, চাইছো যখন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ময়নাগুড়ির রহস্যটা কী?

সরিতা মৃদু হাসে। শীতের বিকেলে সেজে থাকা সরিতাকে আরও সুন্দর দেখায়। ওর কানের লম্বা দুলে শেষ বিকেলের আলো। ও বলে, ময়নাগুড়ির কথা তুমি জান না, তাই না!

কী করে জানব?

সরিতা বলে, তুমি তো রংপুর জান। জান আমরা রংপুরের লোক। পরে বগুড়া শহরে চলে গেছি। কিন্তু তার আগেও তো পরিবারের ইতিহাস আছে একটা।

জামান বলে, দূরের সেই ইতিহাসে কি ময়নাগুড়ির নাম!

সরিতা হাসে আবার। বলে, একদম তাই। আমার দাদা রংপুরে গেছিলেন চাকরির কারণে। তার আগে হয়ত সাত-আট পুরুষের ইতিহাসই ময়নাগুড়ির। দেশভাগের পর যখন ওদিকের মানুষ এদিকে আর এদিকের মানুষ ওদিক হচ্ছিল, তখন দাদার ভাইরা সবাই মিলে রংপুরে চলে যায়। আমার আব্বুর কলেজের জীবন এদিকেই।

জামান বলে, ময়নাগুড়িতেই না কি আশেপাশে?

সরিতা বলে, আমার সবটাই শোনা। তবে ময়নাগুড়ির কাছেই কোথাও কাজলদিঘি গ্রাম। সেখানে ইমামবাড়ি বললে লোকে এখনও হয়তো চিনবে।

পাহাড়ের সৌন্দর্য এক রকম। কিন্তু এদিকের এই জায়গাগুলো, সচরাচর যা ডুয়ার্স বলে পরিচিত, তার ভেতর দিয়ে পর দিন সকালে বাসে যেতে যেতে সরিতা আর জামান দেখেছিল দীর্ঘকায় শাল আর মেহগিনির জঙ্গল। দেখেছিল ছবির মতো সাজানো আর ছককাটা চা বাগান। স্বচ্ছ জলের একেকটা নদী ব্রিজের আড়ালে নুড়িপাথর বুকে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। জামান বলে, এই সব নদী আমাদের বাংলাদেশ পৌঁছবে। তারপর ব্রহ্মপুত্র পদ্মা মেঘনা হয়ে মিলিয়ে যাবে সাগরে। এরপর কখনও পদ্মার চরে দাঁড়ালে এখানের কথাও আমাদের মনে হবে নিশ্চয়ই।

জানালার ধারে বসা সরিতা নদী দেখতে দেখতে বলে, নদীরা কাঁটাতার মানে না, তাই না!

জামান বলে, নদীরা মানে না, পাখিরা মানে না, গাছের বীজ মানে না। পৃথিবীর সমস্ত কাঁটাতার শুধু মানুষের জন্য।

ময়নাগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে কাজলদিঘি এমন কিছু দূর নয়। রিজার্ভের টোটোয় পঞ্চাশ টাকা। ওরা যখন পৌঁছল তখন দুপুর। শীতকালের দুপুর। রোদে তেজ নেই। ওরা দুজন টোটো ছেড়ে সামান্য হেঁটে দেখল কাজলদিঘি যেন বাংলাদেশেরই এক গ্রাম। অন্তত বাসে পঞ্চগড় হয়ে বর্ডারে আসার সময় দু পাশে আম-কাঁঠালে ঘেরা টিনের বাড়ির যে গ্রামগুলো দেখেছিল হুবহু তার ছবি। পাহাড়ে এক রকম অভিজ্ঞতা, কিন্তু এখানে এসে মনে হল ওরা যেন দেশেরই কোথাও ঘুরছে।

অর্ধেক ঝাঁপ বন্ধ রাস্তার ধারের মুদি দোকানটার সামনে দাঁড়াল ওরা। দোকানের মাথায় টিনের বোর্ড। সেখানে লেখা, বাবুসোনা স্টোর্স, এখানে মোবাইল রিচার্জ ও অনুষ্ঠানে রান্নার জন্য লোক পাইবেন…।

ভেতর থেকে মাঝ-বয়সী দোকানদার উৎসুক হলে সরিতাই বলে, এখানে ইমামবাড়ি বলে কোনও বাড়ি আছে জানেন?

কোত্থিকা আইছেন? একেবারে দেশীয় গলায় জিজ্ঞাসা।

জামান হেসে বলল, বাংলাদেশ।

দোকানদারের চোখে তখনও কৌতূহল। বলল, সামনে খানিকটা আউগ্গান। ডাইন হাতে মসজিদ। ছাড়াইলেই টিনের বড় বাড়িখান ইমামবাড়ি। তবে হেয়ারা কেও আর এখন নাই।

গ্রামের ছোট্ট মসজিদটা ছাড়ালে ডান হাতে বড় উঠোন। উঠোনের তিন পাশে টিনের এক-একখানা বড় ঘর। মস্ত কাঁঠালগাছখানা উঠোনের এক পাশে। সরিতার মনে হয় সে যেন মুহূর্তে এ জীবন পার হয়ে আগের কোনও জীবনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন ছবির কথাই তো ছেলেবেলা থেকে শোনা। দাদি বেঁচে থাকতে তার মুখে শোনা। আব্বুর মুখে শোনা। এমন ছবির কথা বলতে বলতেই তো তার দাদা আর দাদার ভাইরা গোরে চলে গেছেন।

উঠোনের দড়িতে গামছা আর রঙিন কাপড় শুকোচ্ছে। এক মহিলা হয়তো তুলতে এসেছিলেন। ওদের এগোতে দেখে ঘরে চলে গেলেন। তখন চাদর গায়ে লুঙ্গি পরা বয়স্ক পুরুষ বেরলেন ঘর থেকে। হঠাৎ আসা শহুরে চেহারার দুজনকে দেখে ধীর প্রশ্ন, কারে খোঁজতে আছেন?

জামান কথা বলল হেসে। আপনাকে…।

তিনি একটু বিচলিত। বললেন, ক্যান!

জামান দেখল সরিতা পাশে নেই। সে চলে গেছে কাঁঠাল গাছটার দিকে। যেখানে গাছের ছায়া উঠোনে পড়েছে। সেখান থেকে ঘরের আশপাশ ও পেছন দিকগুলো দেখছে। জামানের উপস্থিতিও সে যেন বিস্মৃত। একের পর এক সে ছবি খুঁজে চলেছে।

জামান একই ভাবে লোকটিকে বলল, ও আমার স্ত্রী। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এই বাড়িতেই ওদের পূর্বপুরুষরা থেকে গেছেন।

সরিতা তখন আবার কাছাকাছি এসেছে। বাড়ির লোকটি সরাসরি সরিতাকেই দেখে বললেন, মতিন মিঞা আপনের কে হন?

দুইটি শব্দ। একটি নাম। জামান দেখল সরিতা রুদ্ধবাক হয়েছে। জামান দেখল সরিতার দুই চোখ ভরে উঠছে পানিতে। সরিতা যেন কাঁপতে শুরু করল।

উত্তরটা জামানই দিয়ে দিতে পারত। কিন্তু সরিতার বলার জন্যই থেমে তাকল ও। সরিতা কোনও রকমে নিজেকে সামলে ধরা গলায় বলল, মতিন মিঞা আমার নিজের লোক, আমার আব্বু… আগের বছর এই মাসে তার এন্তেকাল হয়েছে।

সরিতা সামলাতে পারল না নিজিকে। অস্ফুট কান্না উঠে এল গলায়। রুমালে চোখ ঢেকে দ্রুত হেঁটে কাঁঠালের ছায়ার পাশে চলে গেল।

নিম্নবিত্ত গেরস্থ পরিবার। মতিন মিঞার মেয়ে ও জামাইকে বাড়ির লোকটি সামনের টিনের ঘরটিতে বসতে দিয়েছেন। কাঁচের গ্লাসে ডাবের পানি এসেছে। লোকটি বললেন, মতিন ভাইর হাঁটুর বয়সী ময়। উনার খালাবাড়ির লগে মোগো পাতা-লতায় সম্পর্ক আছিল। উনারা এই দ্যাশ ছাইড়লে পর মোরা আইস্যা উঠছি। এহনও জমির যা কাগজপত্তর উনাদের বাপ দাদাদের নামে। …জলিল নাম শোনলে আপনের বাপে একবারেই বুঝত। এহন মোরে মনে রাখনেরও কেও নাই।

সরিতা অনেকটাই সামলে নিয়েছে নিজেকে। চোখ মুখে পানির ছিটা দিয়ে প্রায় স্বাভাবিক। বলল, আব্বু তো এ দেশে থাকতে কলেজ পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। গ্রামে ওনার চেনাজানা বা বন্ধুরা কেউ আছেন এখনও?

জলিল ভাবলেন খানিক সময়। হাঁটুর ভাঁজে লুঙ্গি গুটিয়ে বসলেন। বললেন, আমার চিনার ভিতর একমাত্র বাঁইচ্যা আছেন পোদ্দার বাড়ির অখিল জ্যাঠায়। সামনের মোড়খান পার হইলেই উনার বাড়ি। আপনেগো বাড়ির কথা, আপনের আব্বুর কথা দ্যাহা হইলে এহনও মোরে কয়।

জামান বলে, উনি তো বয়স্ক মানুষ। আসতে পারবেন? না কি একটুখানি দেখা করার জন্য আমরাই যাব।

জলিল মিঞা বলেন, হাইস্কুলে মাস্টারি করতেন স্যার। অনেক বচ্ছর হইল রিটায়ার নিছেন। তয় এহনও চলাফিরা করেন। আমি গিয়া উনারে খবর দেই।

উনি উঠে যেতে মোবাইল খুলে সময় দেখল জামান। মোবাইল খোলা অবস্থায় ওই ঘরের খাটে পা ঝুলিয়ে বসা সরিতার কয়েকটা ছবি তুলল সে। বলল, শিলিগুড়ি ফেরার বাস আর এক ঘন্টা পর। এই বাস মিস করলে এখানেই রাতে থাকা। কাল কিন্তু দেশে ফেরা বরবাদ।

সরিতা ম্লান হেসে নিচু স্বরে বলল, এও তো আমাদের দেশ, তাই না!

উঠোনে থাকতেই গলা পাওয়া গেল অখিল পোদ্দারের। ধুতি পরা বয়স্ক মানুষ। মাথায় টাক, সামান্য ঝুঁকে যাওয়া চেহারা। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কাঁপা গলায় বললেন, কই মতিনের মাইয়া কই, তারে এট্টু দেখি। সরিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি?

সরিতা নিচু হয়ে ওনাকে কদমবুসি করল।

মুহূর্তে তুমি বদলে গেল তুই-তে। সরিতার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুই তো আমার মা হও…।

আর একবার পানি আসছিল সরিতার চোখে। আর একবার ভেতরে ভেতরে ভাসছিল ও। যত দিন বেঁচে ছিলেন আব্বুও তো তাকে মা বলেই ডাকতেন। সেই ডাক যেন ফিরে আসছে আবার। কাজলদিঘিতে এসে আব্বুর ডাকের অনুরণন শুনছে সরিতা।

অখিল পোদ্দার অনেক কথা বলতে চান। সব কথাই শৈশব আর প্রথম যৌবনের সঙ্গী মতিনকে নিয়ে। এক সঙ্গে দুজনের উঁচু গাছে উঠে দুপুর কাটানো, দুজনের প্রথম সাইকেল শেখা। বর্ষায় পাঁচ মাইল হেঁটে তিস্তায় গিয়ে দুজনের ভরা নদীতে সাঁতার কাটা হয়েছে কত বার।

জামান আড়ালে মোবাইল দেখে বলল, আপনার স্মৃতির শেষ নেই জানি। কিন্তু আমাদের যে চলে যেতে হবে। ফেরার বাস ধরতে হবে কিছুক্ষণ পর।

তিনি বললেন, ফেরবা কই?

জামান হেসে বলল, শিলিগুড়ি। কাল সকালে সেখান থেকে বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশ।

তিনি খানিকটা হতবাক। বললেন, সেইটা হয়? আমার লগে চলো। জামাই এক রাতও শ্বশুরবাড়ি থাকব না!

জামান উঠে দাঁড়ায়। বলে, পরে যেবার আসব তখন সোজা কাজলদিঘি। আপনাদের সবার বাড়িতে এসে থাকব। এবার শুধু চেনা হয়ে থাকল।

উঠে দাঁড়ায় সরিতাও। অখিল পোদ্দার খানিকটা বিস্মিত। এই নিমেষ-মাত্র দেখা আর কথায় তার প্রাণ ভরেনি বোঝা যায়।

তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন উঠোনের কাঁঠাল গাছটার গোড়ায়। জলিল মিঞা ওদের দুজনের সঙ্গে হেঁটে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যান।

বাসের জানালার বাইরে ফুরিয়ে আসছিল শীতকালের বিকেল। ফেরার পথে সেই সব নদী, সামান্য অন্ধকার হয়ে ওঠা জঙ্গলের গাছপালা, পথের ধারে টিনে ছাওয়া ঘর।

জানালার পাশে বসা সরিতা চুপ হয়ে ছিল দীর্ঘ ক্ষণ। এক সময় অস্ফুটে বলল, নদীর কোনও দেশ নেই, পাখিদেরও দেশ নেই, কাঁটাতারে ঘেরা আলাদা আলাদা দেশ শুধু মানুষের।


আপনার মতামত লিখুন :

9 responses to “সাত্যকি হালদার-এর ‘ছোটগল্প’ কাজলদিঘি”

  1. সিরাজুল আজম says:

    দেশভাগে নিয়ে এক অনবদ্য কাহিনী। পরিচিত আখ্যানের উল্টো দিকের এক স্নিগ্ধ করুণ বর্ণনা। চমৎকার।

  2. তপন রায়চৌধুরী says:

    খুব ভালো লাগল। এক অদ্ভুত নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম। ফেলে আসা কত কিছুর কাছে আবার ফিরে যেতে চায় মনটা!

  3. Satyaki Haldar says:

    ধন্যবাদ তপনবাবু।

  4. অমিতাভ সরকার says:

    বাবাহ। অসাধারণ অনুভব। এ লেখা কিভাবে লিখলেন কিভাবে। এ গল্প আমি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের পড়ে শোনাব। ওদের মনেও এই কষ্ট আছে। লাইনগুলো অসাধারণ। অনেক ধন্যবাদ নেবেন মরমি সাহিত্যিকবাবু।

  5. অমিতাভ সরকার says:

    বাবাহ। সুন্দর অনুভব। এ লেখা কিভাবে লিখলেন কিভাবে। এ গল্প আমি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের পড়ে শোনাব। ওদের মনেও এই কষ্ট আছে। লাইনগুলো অসাধারণ। অনেক ধন্যবাদ নেবেন মরমি সাহিত্যিকবাবু।

  6. সৌমেন বসু says:

    ধর্মর থেকেও বড় আইডেনটিটি ভাষা ও সংস্কৃতি। তার প্রমাণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

  7. সৌমেন বসু says:

    বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রমান করেছিল ধর্মের চেয়েও বড় বন্ধন ভাষা ও সংস্কৃতি

  8. Manasi Ganguli says:

    খুব ভাল লাগল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন