ছোটদের অনিন্দ্যসুন্দর ভুবনের এক অপরূপ স্রষ্টা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তাঁর লেখা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ কিংবা ‘টুনটুনির বই’ যে না পড়েছে তার জীবন ‘ষোলো আনাই মিছে’। বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকাটি তিনিই বের করেছিলেন, ছোটদের জন্যে। পরবর্তীতে এই ধারায় এসে যুক্ত হয়েছেন তাঁর পুত্র সুকুমার রায় এবং সুকুমারের পুত্র সত্যজিৎ রায়। রায়চৌধুরী পরিবার তিন পুরুষ ধরে বাংলা শিশুসাহিত্যের ভুবনটিকে রঙে-রেখায় রাঙিয়ে তুলেছেন। এই ধারায় সত্যজিৎ রায় সংযোজন করেছেন এক নতুন মাত্রা। তিনি নির্মাণ করেছেন ছোটদের জন্যে চলচ্চিত্র। রায়চৌধুরী পরিবারটির কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই।
আমাদের জন্যে বাড়তি আনন্দের অনুষঙ্গ হয়ে আছে কিশোরগঞ্জের মসূয়া গ্রামটি। এখানেই জন্মেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। জীবনে একবার হলেও মসূয়া গ্রামে যাবো, তাঁর বসতভিটায় খানিকক্ষণ হাঁটবো ঘুরবো এরকম একটা স্বপ্ন ছিলো আমার। কিন্তু যাওয়া হচ্ছিলো না। আমি কানাডায় চলে আসবার পর সেই স্বপ্নটা ক্রমে ক্রমে দূরবর্তী হয়ে পড়ছিলো। ২০১৭ সালে বইমেলা উপলক্ষ্যে দু’মাসের জন্যে বাংলাদেশে যাবার পর মসূয়া গ্রাম এবং উপেন্দ্রকিশোরের বসতভিটা দেখার সুযোগটা এসে গেলো।
২০ ডিসেম্বর উপেন্দ্রকিশোরের প্রয়াণ দিবস। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার নৈবেদ্য হিশেবে আমার মসূয়া গ্রাম এবং তাঁর বসতভিটা পরিদর্শনের স্মৃতিটা এখানে তুলে ধরছি—
দুই
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে কিশোরগঞ্জ গিয়েছিলাম ওখানকার ছড়া সংসদ আয়োজিত পঞ্চম ছড়া সম্মেলনে অংশ নিতে। সম্মেলন শেষে ২৯ জানুয়ারি সকালে ঢাকা ফিরছিলাম। সহযাত্রী খালেক বিন জয়েনউদ্দীন, আসলাম সানী, আহমাদ মাযহার, সিরাজুল ফরিদ ও নূর উদদীন শেখ। ফেরার পথে পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে সিরাজুল ফরিদের পথ-নির্দেশনায় আমাদের ক্ষণিক যাত্রাবিরতি কটিয়াদি উপজেলার মসূয়া গ্রামে, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীদের বসতভিটায়! সে এক অন্য রকম অনুভূতি। রাস্তার পাশে মূল ফটক পেরিয়ে একটু এগোতেই আমাদের চোখে পড়লো—ধ্বংস ও ক্ষয়প্রাপ্ত জরাজীর্ণ একটা ভবনের সামনে কোনো মতে দাঁড়িয়ে থাকা শাদাকালো একটা সাইনবোর্ড ঘোষণা করছে—”অস্কার বিজয়ী সত্যজিৎ রায়ের পৈত্রিক বাড়ি/গ্রাম-মসূয়া, উপজেলা-কটিয়াদী, জেলা-কিশোরগঞ্জ. Ancestral Home of Oscae Winner Satyajit Ray. Vill-Mashua. Upazila-Katiadi. District-Kishoregonj.”
অযত্ন অবহেলা অনাদরে থাকা ইট-সুরকি খসে পরা সত্যজিৎ-সুকুমারের পূর্বপুরুষের বসতভিটায় গিয়ে একই সঙ্গে মনটা প্রফুল্ল ও বিষণ্ণ হয়ে উঠলো। সকালের নরম রোদের সোনালি আলো এসে আছড়ে পড়ছিলো ভাঙা ইট-সুরকির দেয়ালের ওপর এবং সেই রোদ খানিকটা আহলাদের প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছিলো আমার চোখে-মুখেও। আহারে! কোথায় এসেছি আমি!
আশপাশে তাকিয়ে কেমন একটা দখল দখল পরিস্থিতি মনে হলো। মূল ফটক পেরিয়ে জীর্ণ-শীর্ণ ঐতিহাসিক বাড়ির আঙিনায় ঢুকতেই বাঁ দিকে একটা টিনশেড মসজিদ। স্থানীয় একজন জানালেন, আপাতত এটা অস্থায়ী চেহারা মসজিদের। স্থায়ী বা পাকাপাকি হবে কিছুদিনের মধ্যেই। অর্থাৎ কী না এটা পাকা বিল্ডিং-এ রূপান্তরিত হবে অচিরেই। দখলের সেই চিরপুরাতন পদ্ধতির চিত্রনাট্য।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীদের বসতভিটার গা ঘেঁষে ডানদিকে, একেবারে ছুঁয়ে দেওয়া দুরত্বে ছোট্ট একটা একতলা দালান উঠে গেছে ‘ভূমি অফিস’-এর নামে। আর বসতভিটার পেছনেই গড়ে উঠেছে একটা পীরের মাজার। পেছনদিকে, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীদের বসতভিটার অনেকটাই ইতোমধ্যে দখল করে নিয়েছে ল্যাংটা বাবা পীর ছমেদ। রীতিমতো দখলের মহোৎসব চলছে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীদের বসতভিটায়, প্রকাশ্যে।
কিন্তু জেলা কর্তৃপক্ষ দেখেও দেখে না। অথচ এই বাড়িটাকে হেরিটেজ ঘোষণা করার কথা!
‘অস্কার বিজয়ী সত্যজিৎ রায়ের পৈত্রিক বাড়ি’ শিরোনামের সাইনবোর্ডের খানিক সামনেই গরু-ছাগলের স্বাচ্ছন্দ্য আনাগোনা। ছবিতে আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি, আমি থাকতে থাকতেই সেখানে বিচরণ করছিলো কয়েকটা গোবেচারা গরু। আমার বিপুল আগ্রহ দেখে স্থানীয় এক যুবক ফিসফিস করে বললেন, সন্ধ্যে নামলেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীদের এই নির্জন ও অরক্ষিত বসতভিটায় নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় মাদক সেবীদের ধোঁয়াচ্ছন্ন উৎসব-সমাবেশ। মনটা বিক্ষুব্ধ আর বিষণ্ণ হলেও নিজেকে শান্ত আর মৌন রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই জীবনে হয়তো আর কোনোদিন আমার আসা হবে না এই বাড়ির আঙিনায়। উত্তেজিত না হয়ে বরং বাড়িটাকে ছুঁয়ে দেখার গৌরব সঞ্চয় করে বাড়িটার সৌরভ মাখিয়ে নিচ্ছিলাম আমার অনুভবের সমস্ত অলিন্দে।
এই মুহূর্তে আমি উপেন্দ্রকিশোরের বসতভিটায়, কথাটা ভাবতেই কেমন একটা শিহরণ খেলে গেলো সমস্ত শরীরে! এক অনির্বচনীয় আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেলো করোটির ভেতরে!
ভাঙা বাড়িটার এই বারান্দায়, এই উঠোনে, এই দরোজায়, এই জানালার সামনে, এই সিঁড়িতে একদা হেঁটেছেন টুনটুনির বই-এর লেখক, গুপী গাইন বাঘা বাইনের লেখক, সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর! আর আজ আমিও কী না সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে! আমিও কী না হাঁটছি উপেন্দ্রকিশোরের পদচিহ্ন মাখা তাঁর হেঁটে যাওয়া পথের ওপর দিয়ে!
অপরিচ্ছন্ন, আবর্জনায় ঠাসা আর জঙ্গলে পরিপূর্ণ বাড়িটার কোনো একটা দেয়ালে খুবই আবছা কিন্তু স্পষ্টই যেনো কারো গমগমে কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হলো–তুমি এসেছো রিটন!
কার কণ্ঠস্বর ছিলো ওটা? উপেন্দ্রর? সুকুমারের? না কি সত্যজিতের?
অটোয়া ১৯ ডিসেম্বর ২০২০
ক্যাপশন/ কিশোরগঞ্জের মসূয়া গ্রামে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বসতভিটার সামনে লুৎফর রহমান রিটন। আলোকচিত্রঃ আহমাদ মাযহার। সময়কাল ২৯ জানুয়ারি ২০১৭
ভালো লাগলো।