পৌষ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের একাদশী তিথিকে বলা হয় সফলা একাদশী তিথি। এই একাদশী তিথি সাধক বা ভক্তকে পরিপূর্ণ করেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যে এবং ভগবত সাধনাকে সফলকাম করে পৌঁছে দেন বিষ্ণুলোকে তথা পরমধামে। তাই তিনি ‘সফলা একাদশী দেবী’ নামে মর্ত্যলোকে সুখ্যাত।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণ সংবাদে এই তিথির মাহাত্ম বর্ণনা করা হয়েছে। যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে প্রভু পৌষ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথির নাম, বিধি এবং পূজ্যদেবতা বিষয় আমার কৌতূহল নিবারণ করুন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, তবে শুনুন মহারাজ —
পুরানের কথা। সুদূর অতীতে মাহিস্মাতি নামে এক ন্যায় ও ধর্মপরায়ন রাজা রাজত্ব করতেন চম্পাবতী নগরে। রাজার চার পুত্র ছিল, তার মধ্যে জ্যৈষ্ঠপুএ ছিল অত্যন্ত দুরাচারী। পরস্ত্রীগমন, মদ্যপান এবং অসৎ কার্যে সর্বদা লিপ্ত থাকতেন তিনি। তার মুখ সর্বদাই ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব ও দেবতাদের নিন্দায় মুখরিত হয়ে থাকতো। তাই সকলে তাকে ‘লুম্ভক’ বলে সম্বোধন করত।
পুত্রের এহেন আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে একদিন রাজা তাকে রাজ্য থেকে নিঃসরণ করে দিলেন।
পিতা পিতা মাতা আত্মীয়-পরিজন স্ত্রী পুত্র পরিত্যক্ত হয়ে সে মনে দুঃখে এক গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করল। জীবন নির্বাহ করার জন্য কখনো কখনো সে জীবহত্যা করে, কখনও বা চুরি করত।একদিন চুরি করতে গিয়ে নগরের প্রহরীদের কাছে ধরা পড়ে গেল। কিন্তু রাজপুত্র বলে সেই অপরাধ থেকে সে সহজেই মুক্তি পেল। মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় বনে ফিরে গেল।
জীবন অতিবাহিত করার জন্য ফলমূল আহার করে জীবন যাপন করতে লাগলো। ওই বনে বহু বছর পুরনো একটি বিশাল অশ্বত্থ বৃক্ষ ছিল। সেখানে ভগবান বাসুদেব স্বয়ং বিরাজমান ছিলেন বলে, বৃক্ষটি দেবত্বপ্রাপ্ত হয়েছিল। সেই বৃক্ষের নিচেই লুম্ভক দিনযাপন করতো।এইভাবেই বহুদিন কেটে গেল। কোন একদিন পূর্বজন্মের কোন পুণ্যফলে পৌষ মাসের দশমীর দিনে কেবল ফলাহারে লুম্ভকের দিনটি কাটলো। কিন্তু রাত্রিতে অসহ্য শীতের প্রকোপে ক্ষুধায় ছটফট করে মৃত প্রায় হয়ে রাত্রি যাপন করলো। পরের দিন সূর্যোদয় হলেও অচৈতন্য অবস্থায় লুম্ভক পড়ে রইল।দুপুরের দিকে তার চেতনা ফিরলো। ক্ষুধা নিবারণের জন্য অতি কষ্টে কিছু ফলমূল সংগ্রহ করে বৃক্ষ তলে এসে পুনরায় বিশ্রাম করতে লাগলো।
লুম্ভক লক্ষ্য করলেন যে, সেদিন বৃক্ষকে অসংখ্য ব্যক্তি দেবতারূপে পূজা করার জন্য এসেছেন, পুজো করছে দেবতাজ্ঞানে। খোঁজ নিয়ে জানলেন, ওরা সফলা একাদশী ব্রত উপবাস পালন করছেন। সকলের সাথে লুম্ভকও সফলা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য কথা শুনলেন পরমনিষ্ঠার সঙ্গে।
প্রাণ রক্ষার্থে লুম্ভক ভগবান লক্ষ্মীনারায়ণ উদ্দেশ্যে ফলগুলো নিয়ে প্রার্থনা করলেন, ‘হে ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করো। আপনি আমার অঞ্জলি গ্রহণ করে প্রসন্ন হন হে লক্ষ্মীপতি নারায়ণ’।
পাপী লুম্বকের রাত্রি জাগরণকে একাদশী জাগরণ এবং ফল অর্পণকে পূজা বলে গ্রহণ করলেন ঈশ্বর।এইভাবেই অজ্ঞাতসারে লুম্ভকের সফলা একাদশী ব্রত পালন হয়ে গেল। প্রাতঃকালে আকাশে দৈববানি হলো, ‘সফলা একাদশী ব্রতের পুণ্য প্রভাবে, তোমার পুনরায় রাজ্য প্রাপ্তি হবে।’
দৈববাণী শোনা মাত্রই লুম্ভক দৈবরত্ন দ্বারা সুশোভিত এবং মহিমান্বিত হলেন এবং তার বুদ্ধি পাপমুক্ত হলো। তিনি ফিরে গেলেন নিজ রাজ্যে। তার প্রত্যাবর্তনে সকলে তাকে বরণ করলেন সাদরে। ব্রতের পুণ্যফলে ধন্য হলো জীবন মন।
এরপর পনের বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন রাজত্ব উপভোগ করেছিলেন লুম্ভক। এই সময় লুম্ভকের মনোজ্ঞ নামে একটি পুএ হয়েছিল, যিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। মনোজ্ঞ যখন প্রাপ্তবয়স্ক হল তখন রাজ্যভার তার ওপর অর্পণ করে দিয়ে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করলেন লুম্ভক এবং নির্বাণ লাভ করলেন অন্তিমে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথানুসারে, এই একাদশী ব্রত পালন করলে মানুষ মোক্ষলাভের অধিকারী হয় এতে কোন সন্দেহ নেই।
যেমন শেষনাগ, গরুড়জি, শ্রীবিষ্ণু এবং ব্রাহ্মণ যথাক্রমে সাপ, পাখি, দেবতা এবং মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ; সেরকম একাদশীর উপবাস সব উপবাসের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট।
যেমন নিয়মানুবর্তিতা এবং প্রতিদিনের ঘুম শরীর ও মনের ক্লান্তি দূর করে এবং নবজীবন দান করে; একইভাবে, একাদশীর উপবাস আমাদের পরিপাকতন্ত্রকে বিশ্রাম দেয় এবং এর শক্তি ও জীবনীশক্তির দিকে নিয়ে যায়। ব্রতের শৃঙ্খলা ও আত্মসংযম মনকে শক্তিশালী করে।
সফলা একাদশীর সময়কাল: একাদশী তিথি শুরু : ১০ পৌষ, ২৫ ডিসেম্বর, বুধবার, রাত ১০টা ৩১ মিনিট। একাদশী তিথি শেষ : ১১ পৌষ, ২৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, রাত ১২টা ৪৪ মিনিট।
ব্রত পালন : সফলা একাদশীর দিন ভোরে উঠে স্নান সেরে নিন। শুদ্ধ বসনে ব্রত পালনের সংকল্প নিন। পঞ্চামৃত দিয়ে শ্রী বিষ্ণুর অভিষেক করে ফুল, ফল, মিষ্টি, ধূপ, প্রদীপ, চন্দন, অক্ষত, তুলসী, নৈবেদ্য সহযোগে বিষ্ণুর পূজা শুরু করুন। ফলের মধ্যে নারকেল, সুপারি, আমলা, ডালিম, লবঙ্গ ইত্যাদি দিয়ে ভগবান অচ্যুতার পূজা করুন।
পূজা শেষে আরতি করতে হবে। সফলা একাদশীর ব্রত কথা শুনুন বা পড়ুন। তুলসী জপমালা দিয়ে শ্রী বিষ্ণুর পঞ্চাক্ষর মন্ত্র “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” জপ করুন। এর পর সন্ধ্যায় বিষ্ণুর মন্দির বা তাঁর মূর্তির সামনে ভজন-কীর্তনের আয়োজন করতে পারেন। এই একাদশীতে শ্রী বিষ্ণুর সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করলে জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। ধনসম্পদ লাভ হয়।দ্বাদশীর পরের দিন, অভাবী বা ব্রাহ্মণদের খাওয়ান এবং জিনিস দান করুন। এর পরে আপনার ব্রতের পারণ করুন।
নিষ্ঠা সহকারে এই একাদশী ব্রত পালন করলে শ্রীহরির কৃপায় তাঁর সকল পাপমুক্তি ঘটে এবং বিষ্ণুলোকে গমন করে।
“ওম নমো ভগবতে বাসুদেবায়”।