কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে আছে, —
ধালিপাড়া মহাস্থান কলিকাতা কুচিনান
দুই কূলে বসাইয়া বাট
পাষাণে রচিত ঘাট দু’কূলে যাত্রীর নাট
কিঙ্করে বসায় নানা হাট।
সল্টলেক বা লবণহ্রদের প্রাচীন নাম নাকি কুচিনান। অনেক কলকাতাবিদ এই দাবি করেছেন। তা কুচিনান নামটি এল কোথা থেকে? যদিও হরিপদ ভৌমিক কাঁকুড়গাছি বেঙ্গল কেমিক্যাল অঞ্চলটিকে কুচিনান ভেবেছেন।
তামিল কোল্লিমালাই উপভাষায় নাঞ্জে মানে ভেজা স্যাঁতসেঁতে জমি। নাঞ্জে থেকেই নান। কুচিনান, বাগনান, পুইনান, পাওনান, খন্নান, এরকম আরও স্থাননাম পাওয়া যায়। বাংলার অনেক স্থাননাম এসেছে দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠী থেকে।
সল্ট লেক তথা লবণহ্রদের উত্থান আমাদের সকলেরই জানা। ডা. বিধানচন্দ্র রায় সল্টলেকের রূপকার। কলকাতার পূর্বাঞ্চলের জলাজমি ভরাট করা হয় গঙ্গার পলিমিশ্রিত কাদা দিয়ে। বেলজিয়ান বিশেষজ্ঞের তদারকিতে এটা সম্ভব হয়েছিল। তবে প্রথমদিকের লবণহ্রদ শেয়ালডাকা গ্রামের মতো। তখনও অকিঞ্চিৎকর উল্টোডাঙা হল্ট স্টেশনে ওয়াগন ব্রেকারদের দাপট। বাস ধরতে কাশবন ঠেলে হেঁটে হাতিবাগান বা গৌরীবাড়ি যেতে হত। লটারিতে নিরানব্বই বছরের লিজে পাওয়া জমির কাঠা সাড়ে তিন হাজার টাকা। জনতার প্রাথমিক অনীহায় তা কমে অর্ধেক করা হয়। বাড়ি করেও লোকজন সেখানে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। ভেড়ির জমি থেকে উৎখাত, লাগোয়া মহিষবাথান গ্রামে পুনর্বাসনপ্রাপ্ত ক’জন মৎস্যজীবীই ভরসা দিলেন। তাঁরাই লবণহ্রদের আদিবাসিন্দাদের উল্টোডাঙা থেকে বাজার করে এনে দিতেন।
হ্যারিকেনের আলো। ইঁদারা-টিপকলের জল। সাপের ভয়। মশার আড়ত। তবু ছবিটা পাল্টাতে থাকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে কংগ্রেসের জাতীয় সম্মেলনের পরে। এসি-বসানো দোতলা খোড়ো বাড়িতে ছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। ১৯৯০-এর দশকে সেখানেই থাকতে শুরু করেন জ্যোতি বসু। শেয়ালের ডাকে তাঁর ঘুম নষ্ট হওয়ার কাহিনীও সল্টলেকের লোকগাথার অংশ।
আমফানে বহু গাছ পড়ে গেলেও, লকডাউনে পাখিরা ফিরে এসেছে। সল্টলেকে ইতিহাসের রোমাঞ্চ নেই, শুধুই পরিবর্তনের স্রোত। তবু শিকড়ের সংযোগ অটুট এখনও।
সল্ট লেক আরা ধাপা আপজনের মানচিত্রেও জায়গা করে নিয়েছে। আছে উডের মানচিত্রেও।
বর্তমানে সল্ট লেক ৫টি সেক্টরে বিভক্ত হলেও সেক্টর ১, ২, ৩ এবং ৫ নম্বর সেক্টরই মূলত বসবাসের জায়গা। উল্টোডাঙা-বাঙুর সংলগ্ন পশ্চিমাংশ হচ্ছে সেক্টর ১। সেন্ট্রাল পার্ক-সংলগ্ন পূর্বাংশ হচ্ছে সেক্টর ২। দক্ষিণ অংশ সেক্টর ৩। অতি পূর্বাংশ হচ্ছে সেক্টর ৫।
‘ধাপা’ মানে বরিশালি বাংলায় নিম্ন জলাভূমি। পরে এর অর্থবিভ্রাট হয়েছে। ইংরেজি Depot থেকে বা বাংলা স্তূপ থেকে নাকি অপভ্রংশে ধাপা, এটাই অনেক পণ্ডিতের মত। দহের পার বা দহপার লোকমুখে ধাপার হয়ে গিয়েছিল। তা থেকেই ধাপার মাঠ বা ধাপা। সল্টলেক বা লবণ হ্রদের পাশের ধাপার মাঠ। ব্রিটিশ আমলে কলকাতার ময়লা-জঞ্জাল ফেলার জায়গা হিসেবে ধাপাকে পছন্দ করা হয়েছিল কলকাতা পৌরসভা গঠনের প্রাথমিক দশায়।