সুধীভূষণ ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত দ্বিজ মাধব রচিত মঙ্গলচণ্ডীর গীত বইটির ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে বাসিরী ও বাসুলী (বাশুলী) অভিন্ন। বইটি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত।
প্রাচীন শাস্ত্রে দেবী বাসুলীর উল্লেখ যৎসামান্য।
কেউ বলেন, বাসলী দেবী আদ্যাশক্তির রূপ। দক্ষিণা কালিকা স্তোত্রে আছে —
‘বারাহী বাসলীচণ্ডী ত্বং জগুর্মুনয়ঃ সদা’।
বাসলী বা বাশলী বিশালাক্ষীও হতে পারেন।
পৌরাণিক কাহিনীতেও তেমনভাবে খোঁজ মেলে না। নিতান্তই লোকবিশ্বাসে ভর করে জন্ম হয়েছে দেবী বাসুলীর। তবে অন্যান্য লৌকিক দেবীর তুলনায় তিনি কিছুটা আলাদা।
কারণ বছরের একটা নির্দিষ্ট দিন নয়, এই দেবীর পুজো চলে বারোমাস। রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন এবং স্থায়ী মন্দিরও।
লৌকিক দেবতা মাত্রেই, বেশ কিছু মিল বর্তমান। তার না আছে নির্দিষ্ট পূজা পদ্ধতি, না আছে গুরুগম্ভীর মন্ত্র। কিছুক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করা নেই পুজোর নিয়মকানুনও। তবে দেবী বাসুলী এইসবের বতিক্রম। পুজোর ব্যাপকতা ও প্রাচীনত্বের কারণেই তাঁকে স্রেফ আঞ্চলিক দেবীর আওতায় ফেলা যায় না।
সবার আগে জেনে নেওয়া যাক, দেবী বাসুলী-র শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ঠিক কেমন। আসলে দেবীর পুজো পদ্ধতি ও নামের সঙ্গে শাস্ত্রীয় দুর্গার বেশ মিল পাওয়া যায়। তাই মনে করা হয় ইনিও দুর্গা আকৃতি ভেদে বা চণ্ডীস্বরূপা। সেইসঙ্গে দেবীর আরেক নাম বিশালাক্ষী। তার থেকেই আরও স্পষ্ট হয় শাস্ত্রীয় ধারণা। অন্যদিকে এঁকে চৌষট্টি যোগিনীর অন্যতমা, রঙ্কিনীও মনে করেন অনেকেই। মনসা হিসেবেও তিনি কোথাও কোথাও পূজিত। এমনটাও মনে করা হয়, আর্য-আর্যেতর কৃষ্টির সমন্বয়ে দেবীর সৃষ্টি। পরে হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। যদিও লৌকিক বিশ্বাসে দেবীর মান্যতা রয়েছে যথেষ্ঠই।
দেবী মূর্তিও বিশেষভাবে আলাদা নয়। তবে মূর্তির ধরণ দুটি। প্রথমটি দ্বিভূজা, আর দ্বিতীয়টি চতুর্ভূজা। প্রথম ধরণ, অর্থাৎ দেবীর দ্বিভুজা মূর্তি অনেকটা লক্ষ্মী , সরস্বতীর প্রতি রূপ বলা চলে। গায়ের রং হলুদ। মাথায় মুকুট থাকতে পারে, তবে বেশিরভাগ মূর্তিতেই দেবী এলোকেশী। সুদীর্ঘ ত্রিনয়ন বর্তমান। এক্ষেত্রে দেবীর এক হাতে বরাভয় অন্য হাতে প্রহরণ মূদ্রা থাকে। তবে চতুর্ভুজা মূর্তিটি খানিকটা আলাদা। সে ক্ষেত্রে প্রহরণ ও মুদ্রা ভিন্নরূপ। দেবীর গলায় নরমুণ্ড। পরনে রক্তবস্ত্র। দেবীমূর্তি মাতৃস্বরূপা হলেও তা উগ্র। দক্ষিণভারতের বিভিন্ন মন্দিরে দেবীর এই রূপের দেখা মেলে। তবে লৌকিক মতে এই দেবীর স্রেফ মুণ্ড পুজোরও চল রয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই দেবীর পুজো পদ্ধতিতেও ভিন্নতা ধরা পড়ে। একদিকে তিনি তান্ত্রিক দেবী। তাই কিছু মন্দিরে সম্পূর্ণ গুহ্য তন্ত্রমতে তাঁর পুজো করা হয়। আবার কোথাও তান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ মিশ্রিত পদ্ধতিতে পুজো হয়। তবে লৌকিক মতে পুজো হলে সেখানে কোনও নির্দিষ্ট মন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে না। সেক্ষেত্রে দেবীর নিত্যপূজারও চল নেই। বার্ষিক উৎসব বা জাতের পুজো হয় বৈশাখ মাসে। সুতরাং একথা বলাই বাহুল্য, এই দেবী লৌকিক আধারে থাকলেও, এঁকে স্রেফ লৌকিক দেবীর তকমা দেওয়া যায় না।
বাঁকুড়ার ছাতনায় যে বাসুলীমাতার মন্দিরটি আছে, তা বহুযুগের প্রাচীন।
বাঁকুড়ার পাত্রসায়রের দাসপাড়ায় বাসুলী মন্দির একেবারেই সাদামাটা।জেলে সম্প্রদায়ের লোক পুজো করেন। আশপাশে গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের লোকজনের বাস। তাই জলপথে বাণিজ্যের একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কি লবণ ব্যবসায়ের সঙ্গেই জড়িত ছিল এই বণিকেরা?
তাই কি লবণের দেবী বাসিরী তথা বাসুলীর আরাধনা করতেন?
ভেবে দেখার মতো বিষয়।
গ্রিকদের লবণের দেবী অ্যাম্ফিট্রাইট, রোমানদের লবণের দেবী স্যালাজাক, প্রাচীন ইরানের লবণদেবী তিয়ামাত, আজটেকের পৌরাণিক কাহিনীতে আছে, Huixtocihuatl ছিলেন একজন দেবী, তিনি লবণ এবং নোনা জলের তত্ত্বাবধায়ক।
ভারতে হিন্দুদের কোনও লবণদেবীর খোঁজ পাওয়া যায় না কেন, সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। কর্ণাটক ও বিহারের গয়ায় বাসিরী (বাশুলী) বলে এক দেবীর সন্ধান পাওয়া গেছে। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতো পণ্ডিত সেই দেবীকে সরস্বতী বা বাগীশ্বরীর একটি রূপ বলে মনে করেন। তাঁর মতে তান্ত্রিক সরস্বতী প্রথমে বাসুলী ও পরে মঙ্গলকাব্যের যুগে মঙ্গলচণ্ডীতে পরিণত হন। অনেকের মতে এই দেবী বিশালাক্ষীর রূপান্তর।
আমার মতে বাসিরী (অপভ্রংশে বাসুলী) একজন লবণের দেবী। সংস্কৃত শব্দ বসির-এর অর্থ সামুদ্রিক লবণ। লবণের দেবী তাই বাসিরী। সরস্বতী মূলত জলের দেবী। তিনি পদ্মাসনা, হংসবাহনা, মুক্তাহার ধারিণী, কচ্ছপী বীণার অধিকারিণী। তাঁর সঙ্গে সামুদ্রিক লবণের দেবীর কিছুটা সাদৃশ্য তো থাকবেই! তাই লবণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বাসিরীর সঙ্গে সরস্বতীকে গুলিয়ে ফেলেছেন অনেকে। আবার লক্ষ্মী সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠে এসেছিলেন। তাই তিনি লবণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দক্ষিণ ভারতে তিনি লবণের ধারক ও বাহক হিসেবে স্বীকৃতা। তাই লবণের দেবী বাসুলী যেন সরস্বতী ও লক্ষ্মীর মিলিত রূপ।