তিন
যখন লেখালেখি শুরু করলাম (কিভাবে সে আর এক গল্প, অন্য পর্বে বলা যাবে) প্রথম উৎসাহ দিতেন মহারাজই। বলতেন “লেখ ভাই। আমি বাচ্চাদের পড়ে শোনাব”। আমার লেখা টুটাফুটা হিন্দিতে অনুবাদ করে নেপালী বাচ্চাদের শোনাতেন। হোমসনামা প্রকাশ হলে ওঁকেও এক কপি পাঠিয়েছিলাম। কিছুদিন বাদেই হোয়াটস অ্যাপে লিখলেন —
“হোমসনামা মিলল…৯৭ পৃষ্ঠা পড়াও হলো। বেশ নাম করেছে বইটা এবারের বই মেলায়। তবে এ নামে ভুলে আরও এগিয়ে যাওয়ায় থেমে যাসনা যেন ভাই। জীবনের যাত্রাপথে কলতানের বদলে দাগ রাখে শান্ত নীরব দুরদৃষ্ট পদক্ষেপগুলি, আশা যা তোর মতো বুদ্ধিমানকে বোঝানোর দরকার নেই, এ স্মরণ করানো শুধু!
তোর Subject নিয়ে সহজ সরল করে বাচ্চাদের বোঝানোর অনবদ্য ক্ষমতাটা আরও কাজে লাগালে ভালো। তাতে আগত কালের প্রতিনিধিদের কাছে কঠিনের পথ সহজ করার একটি সামাজিক দায়িত্ববোধও পূরণ করা হয় ভাই!
ভুল কিছু বলা হয়ে থাকলে ক্ষমা।
প্রণাম”
যেখন যেতাম দেখতাম গদাধর প্রকল্পের ছেলেমেয়েরা ঘিরে ধরেছে তাঁকে। তিন তাঁদের মাঝে সমবয়সী হয়ে বসে আছেন। একদিন সেটাও বললাম। বলতেই বললেন “কি যে বলিস! এরাই আমার গুরু। এই যে এঁকে দেখ” বলে একটা ছেলেকে সামনে এনে বললেন “কিছুদিন যে ভূমিকম্প হল, সবাই পালাচ্ছিল প্রাণপণে। আমিও ভাবলাম পালাই। দেখি এই ব্যাটা কোথাও যাচ্ছে না। শুধু মাথা নিচু করে ঈশ্বরকে ডাকছে। ভাবলাম তাই তো! তিনি না চাইলে একটা পাতাও নড়তে পারে না। আমাকে রক্ষা করতে হলে তিনিই করবেন। মারলেও তিনি। আমিও ওঁর পাশে বসে প্রার্থনা শুরু করলাম”
প্রতিবছর যেতাম রায়ভিলায়। দেখতে পেতাম কিভাবে ভূত বাংলো নিবেদিতা শিক্ষা সংস্কৃতি কেন্দ্র হয়ে উঠল। লাইব্রেরি চালু হল। কম্পিউটার ঘর হল। নিয়মিত বাচ্চারা আসতে লাগল। একেবারে জমজমাট। একবার বউ বাচ্চা নিয়ে গেছি। মহারাজ আমার বউকে ডেকে বললেন “দ্যাখ তো রে মা, এই বাচ্চা মেয়েগুলো একেবারে চান করে না। তুই একটু এঁদের চান করিয়ে দে গরম জলে”। সে কি মজা। তিন্নিও সঙ্গে জুটে গেল। একটা ঘরে জল গরম করে চানের ধুম। আমরা যারা বাইরে ছিলাম তাঁদের কানে আসছিল শুধু হাসির হুল্লোড়। ওই একদিনে তিন্নি কত বন্ধু পেয়েছিল তাঁর ইয়ত্তা নেই। দুপুরে মাঝে মাঝে নিজের হাতেই খাইয়েদিতেন বাচ্চাদের। বাচ্চারাও তাঁকে। সবাই তাঁকে ভয় পেলেও বাচ্চারা পেত না। তিনি তো তাঁদের বন্ধু! আর ছিল ছবি তোলার ঝোঁক। প্রায়ই দারুন সব ছবি তুলে পাঠাতেন। বলাতাম দাঁড়ান, আপনার নামে একজিবশান করব। খেপে যেতেন। সাধুর আবার একজিবিশান কি? সাধুকে সবসময় আড়ালে থেকে কাজ করতে হবে। তাঁর আবার একজিবিশান হয় নাকি রে?
একবার ফোন করলেন। বেশ চিন্তিত। বললেন “শোননা, মুর্দাহাটিতে নিবেদিতার একটা স্মৃতিস্তম্ভ আছে। কিন্তু খুব বাজে অবস্থা। আমরা ঠিক করতে চাই, কিন্তু তাও দিচ্ছে না। কি করি বলত?” বুদ্ধি দিলাম আনন্দবাজারে চিঠি লেখা যায়। মহারাজ নিজে ছবি তুলে পাঠালেন। আমি চিঠি লিখলাম। চিঠি ছাপা হল ২৭ অক্টোবর, ২০১৭-তে। নিবেদিতার জন্মদিনের ঠিক আগের দিন। গোটা চিঠিটা উদ্ধৃত করছি —
নিবেদিতার স্মৃতি-মন্দির
১৯১১ সালে হাওয়া-বদলের জন্য জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী লেডি অবলা বসুর সঙ্গে নিবেদিতা দার্জিলিঙে আসেন। কিন্তু স্বাস্থ্য ভাল হল না তাতেও। ডাক্তার নীলরতন সরকার সে সময় ছিলেন দার্জিলিঙে। তিনি বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে চিকিৎসা শুরু করলেন। নিবেদিতা বুঝতে পারছিলেন, শেষ সময় চলে আসছে। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছিল প্রতি দিন। ৭ অক্টোবর, নিজের সব সম্পত্তি উইল করে দিলেন ভারতীয় মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার স্বপ্নে গড়ে ওঠা নিবেদিতা স্কুলের নামে, স্বামী বিবেকানন্দের বেলুড় মঠের মাধ্যমে।
তার পর এল সেই দিন। ১৩ অক্টোবর, ১৯১১, শুক্রবার। দার্জিলিঙের আকাশ মেঘ-কুয়াশায় ঢাকা। সকাল ৭টা। নিবেদিতার মুখ আধ্যাত্মিক সুষমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল, মৃদু স্বরে বলে উঠলেন, ‘তরী ডুবছে, কিন্তু আমি সূর্যোদয় দেখব’। তার পর সবাইকে ফাঁকি দিয়ে নিজের নিষ্প্রাণ শরীরটিকে রেখে পৃথিবী ত্যাগ করলেন এই মহীয়সী।
দার্জিলিঙে খবর ছড়িয়ে পড়ল। রায়-ভিলার সামনে হাজির হলেন দার্জিলিংবাসীরা। দার্জিলিং শহর সেই প্রথম দেখল কোনও শবযাত্রা ঘিরে এত মানুষের উপস্থিতি, এক বিদেশিনীর জন্য মানুষের অফুরন্ত ভালবাসা। বিকেল চারটে পনেরোতে নিবেদিতার মুখাগ্নি করলেন রামকৃষ্ণ মিশনের ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথ। ঠিক ১৪ বছর পরে, স্বামী অভেদানন্দ, আমেরিকায় বেদান্ত প্রচার শেষে দার্জিলিঙে আসেন। তিনি উদ্যোগী হয়ে নিবেদিতার চিতাস্থলে একটি স্মৃতি-মন্দির নির্মাণ করেন (ছবিতে)। লিখে দেওয়া হয়, ‘এখানে শান্তিতে শুয়ে আছেন ভগিনী নিবেদিতা, যিনি, তাঁর সবকিছু ভারতবর্ষকে দিয়ে দিয়েছিলেন’।
দার্জিলিং রেল স্টেশনের ঠিক নীচে, যেখানে টয় ট্রেনগুলো থামে, রয়েছে মুর্দাহাটি বলে অদ্ভুত এক হিন্দু-বৌদ্ধ শ্মশান। শ্যাওলা ধরা, পায়ে-চলা পথ। সেই আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে অনেকটা নীচে নামলে বড় বড় ঘাসের জঙ্গল। ফার্নের বন। আর সেখানেই হেলায় পড়ে আছেন তিনি। কেউ জানে না। খেয়াল করে না। যত্ন দূরে থাক। একশো বছরের অবজ্ঞা তাঁর সমাধির সারা গায়ে। সবার চোখের আড়ালে ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে ভগিনী নিবেদিতার সমাধি। এখানেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল তাঁর ইচ্ছেমত সম্পূর্ণ হিন্দু মতে। কিন্তু সময়ের ঢেউয়ে সে খবর কেউ রাখে না। সে ভগ্নস্তূপকে রক্ষণাবেক্ষণের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে কারও নেই।
লোকাল পার্টি আরও বড় আন্দোলনে ব্যস্ত। নিবেদিতা ব্রাত্য সেখানে। এ বছর চারিদিকে নিবেদিতার দেড়শো বছর পূর্তি নিয়ে এত হইচই, এত সব লেখালিখি। কিন্তু এই ঐতিহাসিক স্মারকটিকে বাঁচিয়ে রাখা নিয়ে সবাই অদ্ভুত নীরব। বাগবাজারে নিবেদিতার বসতবাড়ির সংস্কার হল। কিন্তু এই সমাধিটি নিয়ে সবাই যেন চুপ থাকার শপথ নিয়েছে। মজার ব্যাপার, ঠিক গায়ে লাগা একটা জায়গার নাম আবার নিবেদিতা গ্রাম! নিবেদিতার সমাধির পাশেই রয়েছে মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের সমাধিও। সেটির দশা আরও শোচনীয়। ভোলগা থেকে গঙ্গার লেখকও বিস্মৃতির জালে বাঁধা পড়েছেন! নিবেদিতার দেড়শো বছর পূর্তিতে তাঁর সমাধির এই করুণ দশা বড্ড পীড়া দেয়।”
ভাগ্যভাল এই চিঠি প্রশাসকদের নজরে আসে। নতুন ভাবে সাজানো হয়েছে এই স্মৃতি মন্দির। পরিষ্কার করা হয়েছে, আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে এই সমাধি ক্ষেত্র। গোটাটাই হয়েছে মহারাজের উদ্যোগে। এমন কতশত উদ্যোগ হয়েছিল তাঁর হাত ধরে, ইয়ত্তা নেই। খুব ইচ্ছে ছিল আমার কালিম্পং-এর বাড়িতে এনে ওঁকে দেখানো। সেদিন এক ঐতিহাসিক দিন মুখ্যমন্ত্রী কালিম্পং-এ এসে ঘোষণা করলেন নতুন জেলা হবে কালিম্পং। মহারাজ-ও এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে। সরকারী দামী গেস্ট হাউসে না থেকে কাটিয়েছিলেন আমার দুইকামরার ভাড়া বাড়িতে। সে স্মৃতি অক্ষয় হয়ে থাকবে সারাজীবন। বাথ্রুমের দরজার ছিটকানি আটকাত না। তা নিয়ে এই সেদিনও মজা করলেন। আর করবেন না।
এই লেখা যখন লিখছি, তাঁর ঠিক তিনদিন আগে মহারাজ পার্থিব শরীর ত্যাগ করেছেন। প্রতিদিন সকালে প্রথম মেসেজ পেতাম তাঁর থেকেই। আগের দিনও পেয়েছিলাম। নিবেদিতার বজ্রের ছবি আর সঙ্গে লেখা “This is what is called “longing”. The more it grows, the more will the cloud of obstacles be dispelled, and stronger will faith be established.
সাত ফেব্রুয়ারি সকালে ফোন এল। অতনুদার। মহারাজ আর নেই। অনেকদিন ধরেই বলতেন, এ সাধু ৬০ পেরোবে না। ৫৯ এই চলে গেলেন। ঘরে বসে ছিলেন ধ্যানস্থ অবস্থায়। হাত আঙুলের কড়ে রাখা। কিছুক্ষণ আগেই এক ভক্তকে লিখেছিলেন “লম্বা ছুটিতে যাচ্ছি রে। ভাল থাকিস”। সেই ভক্ত অনেকদিন ধরে একটা সেলফি চাইছিল। দিচ্ছি দেব করে দেওয়া হচ্ছিল না। সেটাও দিলেন। তারপর রামকৃষ্ণলোকে পাড়ি দিলেন।
ওঁকে নিয়ে কোনদিন কিছু লিখি নি। লিখতে চাইলে বলতেন “এখন কি রে ব্যাটা? পুড়বে সাধু, উড়বে ছাই, তখন সাধুর গুণ গাই”। গুণ এত তাড়াতাড়ি গাইতে হবে ভাবিনি কোনদিন।