দুই
টানা বন্ধের মাঝে মাঝে গাড়ি চালু হত এক আধ দিন। তেমনই একদিন ভাড়ার গাড়ি চেপে দার্জিলিং রওনা হলাম। ঠিকানা ঠিকঠাক জানতাম না। শুধু জানতাম দার্জিলিং মোটর স্ট্যান্ড থেকে লেবং-এর গাড়ি ধরতে হবে। সেখান থেকে চিড়িয়াখানা, তেনজিং রক পেরিয়ে একটু এগোলেই ডান দিকে রায়ভিলা। বাস্তবে যেটা দেখা গেল, রায়ভিলা নামে কোন ড্রাইভার চেনে না। শেষে একজন বললে “তপাই ভূত বাংলা যানু সকছ?”খেয়েছে! ভুত বাংলা আবার কি? ড্রাইভারের নাম বুদ্ধিমান তামাং। বয়েস সত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু মাথা পরিষ্কার। সেই জানাল ও বাড়িতে নাকি আদতে ভূত থাকে। দার্জিলিং জেলার প্রথম সিমেন্টের এই বাড়ি নিবেদিতার মৃত্যুর পর বন্ধ ছিল অনেকদিন। ভয়ে কেউ যেত না। রাতে নাকি অদ্ভুত সব আওয়াজ শোনা যেত পাহাড়ের ওপর থেকে। অনেকদিন পরে ১৯৫০ নাগাদ এই বাড়িতেই সরকারি এক ছাত্রাবাস স্থাপন হয়। সে আবাস টেঁকে নি।
১৯৫৪ সালের ৪ নভেম্বর দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের (এইচএমআই) প্রতিষ্ঠা এই বাড়িতেই হয়েছিল। এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, কন্যা ইন্দিরা গান্ধী, মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায়। ১৯৫৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এইচএমআইয়ের ঠিকানা ছিল এই বাড়িই। এর পর আবার নানা রকম ভাবে হাতবদল হয়েছে বাড়িটার। কখনও তিব্বত থেকে আসা শরণার্থীরা এখানে আশ্রয় পেয়েছেন, তো কখনও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রকের কাজ শুরু করেছেন। ১৯৮৬ সালে গোর্খাল্যান্ডকে কেন্দ্র করে হিংসাত্মক আন্দোলনের সময়ে এই বাড়িই ছিল সিআরপিএফের বাসস্থান। মাঝে আবার সব ওলটপালট। এই বাড়ির দখল নিল সমাজবিরোধীরা। ২০০৭-০৮-এ হাতবদল। নবগঠিত গোর্খাল্যান্ড পার্সোনাল (জিএলপি)-এর আস্তানা হয়ে যায় রায়ভিলা। তাঁদের কতজন নিবেদিতার নামটুকু জানে সন্দেহ। ভূতের ভয়টা জাগিয়ে রাখতে চেয়েছিল সমাজবিরোধীরা। হয়তো বিমল গুরুং নিজেও। ২০০৭ থেকে বিমল গুরুংয়ের নেতৃত্বে যখন ফের একবার হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হল, তখন তাঁর পেছনে জিএলপির ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। সেই বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশন আদৌ কিছু করতে পারবে কিনা সে নিয়ে বুদ্ধিমানের ঘোরতর সন্দেহ আছে।
কথায় কথায় তেনজিং রক পেরিয়ে এসেছি। চ্যাটালো এক পাথরের গা বেয়ে দড়ি বেঁধে ওঠে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং এর ছাত্রছাত্রীরা। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখতে না দেখতে গাড়ি এসে থামল এক হলদে বাড়ির সামনে। বাড়ির গায়ে শেওলা ধরা, ফাটলে ফাটলে জীর্ণ। মনে হয় যেন আর বেশীদিন নেই। ভেঙে পড়বে এখুনি। অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। পাকদণ্ডীর উপর থেকে চেনা গলা ভেসে এল “চলে আয় উপরে”। দেখি হাসিমুখে বিশ্বরূপ মহারাজ দাঁড়িয়ে আছেন। উপরে উঠেই দেখি দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। একদল মিস্তিরি সিমেন্ট বালি মাখছে, কাঠমিস্তিরা কাঠ চেরাই করছে, ইলেক্ট্রিকের তার লাগানো হচ্ছে, সে এক হুলুস্থুলু ব্যাপার। মহারাজ বললেন “আগে খেয়ে নে”। তাঁর মধ্যেই এক কোনায় খাবার ঘর বানানো হয়েছে। সেখানে দেদার ডিম পাউরুটি আর কলার বন্দোবস্ত। সেসব খাওয়া হতেই মহারাজ নিজে আমায় বললেন “চল তোকে ঘুরিয়ে দেখাই”। ভিতরে ঢুকে প্রায় আঁতকে উঠলাম। সিঁড়ির রেলিং ভাঙা। দেওয়াল হাতুড়ির বাড়ি মেরে মেরে ভেঙে রাখা। জানলা বলে কিছু নেই। পচা ময়লা, বিষ্ঠার গন্ধে দম আটকানো ভাব। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে একটা ঘরের সামনে দাঁড়ালাম দুজনে। মহারাজ বললেন “এই যে ঘরটা দেখছিস, পুরো রাবিস আর জঞ্জালে ভরা, এখানেই নিবেদিতা দেহ রেখেছিলেন”। চমকে গেলাম। ঘরের সামনেই বড় জানলা। তার পাল্লা নেই। হুহু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘায় খেলা করছে রোদ্দুর। আর আম্নি ভাবছি, এই সেই পাহাড়, এই সেই রোদ্দুর যা দেখে এই ঘরে শুয়ে পাঁচ সাগরের পাড় হতে আইরিশ বাপের বাড়ি থেকে আসা উমা বলেছিলেন “The boat is sinking, still I shall see the sunrise”
টানা পনেরোদিন ছিলাম সেবারে। দেখেছিলাম কি অদ্ভুত মনোযোগে ভূত বাংলা ধীরে ধীরে রায়ভিলা হয়ে উঠছে। সেই পুরোনো দিনের মত। জানলায় জাফরি কেমন হবে? কেউ জানে না। মহারাজ পুরোনো একটা ছবি বার করলেন যাতে জানলার একটা জাফরি দেখা যাচ্ছে। মৌমাছির চাকের আদলে অবিকল সেই রকম জাফরিই করা হল জানলায়। আমায় একটা ভাল কাজ দিয়েছিলেন মহারাজ। একগাদা বই এনেছিলেন সঙ্গে করে। আমায় দিয়ে বললেন সব বই খুঁজে খুঁজে যেখানেই রায় ভিলার নাম পাব, যেন টুকে রাখি একটা খাতায়। বইয়ের নাম, আর পাতার সংখ্যা সহ। ভাল কাজ হল। জুটে গেলাম সেই কাজে। আর তাতেই দারুন দারুন সব তথ্য বেরিয়ে এল। বিশেষ করে নিবেদিতার ঘরখানি ঠিক কেমন ছিল বিভিন্ন মানুষের লেখা ঘেঁটে তার একটা পরিস্কার চিত্র পাওয়া গেল। এখন যে নিবেদিতার ঘরে তার ব্যবহার করা “করোনা” টাইপরাইটার দেখা যায়, সেটা বেশ কিছুদিন আমার নজরদারীতে ছিল। একবার এক লেখায় পড়লাম ওই ঘরে নাকি বিদ্যুতের স্যুইচ ছিল। কিন্তু সে স্যুইচ তো আজকের স্যুইচের মত হবে না। কেমন ছিল? খোঁজ নিয়ে জানা গেল বিশ শতকের শুরুতে পোর্সেলিনের আর পিতলের এক ধরণের স্যুইচ পাওয়া যেত। মহারাজের গোঁ প্রায় অবিকলভাবে তৈরি করবেন ঘরটাকে। ছোট মহারাজদের মধ্যে দুজন ছিলেন তখন। দেবু মহারাজ আর সৈকত মহারাজ। দেবুদা ছটফটে, সৈকতদা ধীরস্থির। আমি আর দেবুদা বাইক চালিয়ে প্রায় গোটা দার্জিলিং চষেও সেই স্যুইচের জোগাড় করতে পারলাম না। শেষে কলকাতার এক অ্যান্টিক ডিলার ব্যবস্থা করে দিলেন।
মজা হত রাতের বেলায়। একটা রুমই পরিস্কার করে থাকার উপযুক্ত করা হয়েছিল। আর দুটো বাথরুম। সেই একরুমেই সবাই একসঙ্গে রাত কাটাতাম। মেঝেতে শুয়ে। মহারাজ তো চিরকাল মেঝেতেই শুতেন। পাশে আমিও। সুদীপ্তদা আমায় বলে দিয়েছিল মহারাজের বাথরুম না ব্যবহার করতে। এটা যে মহারাজ জানেন না, সেটা আমারও জানা ছিল না। একদিন সন্ধ্যাবেলা কী একটা পাঠ হচ্ছে, আমি তড়বড় করে উঠে বাথরুমে যাই বলে অন্যদিকে দৌড়ালাম। মহারাজ ডাকলেন “কি ব্যাপার বল তো? আমার টয়লেটে যাচ্ছিস না কেন?” আমিও তেমনি বোকা। বলে ফেলেছি “ওমা! আপনার টয়লেটে যাওয়া তো মানা!” “কে মানা করেছে?” “সবাই” বলতেই সে কী রাগ। বললেন “এমন করে আমায় তোরা আলাদা করে দিচ্ছিস! জানিস আমি কত দুঃখ পেলাম। তোরা সারাদিন খেটে মরছিস, না দিতে পারছি তোদের কোন স্বাচ্ছন্দ্য, না কিছু। আর আমি স্পেশাল ট্রিটমেন্ট পাব!” প্রায় সারারাত ধরে গল্প চলত। নানা বিষয়ে। সেই এক ঘরে প্রায় দশ বারোজন শুয়ে। সারাদিন নানা কাজের পরে সবাই ক্লান্ত। তাঁদের নাসিকা গর্জন অদ্ভুত সব ধ্বনি তুলছে। মহারাজের মাথার কাছে ব্যাটারিতে জ্বলা টিমটিমে আলো। যতবার ঘুম ভাঙছে দেখি উনি জেগে। “আপনি ঘুমান না সারারাত” জিজ্ঞেস করেছিলাম। “কে বলেছে?” “যতবার তাকালাম রাতে দেখি আপনি জেগে আছেন।” “হ্যাঁ মানে আমরা দুজনেই একসঙ্গে জেগেছি কিনা, তুই ঘুমালেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। তুই জাগলেই জেগে উঠেছি”। কি বলব এই কথায়? মুখ্যমন্ত্রী মাঝে মাঝেই ফোন করতেন। খবর নিতেন সব কেমন চলছে। কোন অসুবিধে হচ্ছে কি না। হলে তাঁকে আলাদা গেস্ট হাউসে থাকার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। নিজের কানে শুনেছি বলছেন “আমার ছেলেরা এত কষ্টে থাকবে আর আমি গেস্ট হাউসে ফুর্তি করব! আমি পারব না” যেকোন কাজে তিনিই সবার আগে। করতে বলেন না। করে দেখান। এমন এক সেনাপতি যিনি তার সৈন্যদের আগলে রাখছেন পরম আদরে। তাঁরা কর্ম থেকে বিচ্যুত হলেই তিরস্কার করছেন কঠোরতম ভাষায় আবার পরমুহুর্তেই “কি রে ব্যাটা, আমার উপরে রাগ করলি নাকি” বলে জড়িয়ে ধরছেন। দুচোখে জল।
একবারই শুধু রাগতে দেখেছিলাম তাঁকে। সে রূপ আমি ভুলব না। কাঠের কর্মচারীদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল কাজ করতেন যিনি তিনি দেখতে অবিকল লালমোহন গাঙ্গুলীর মত। তাঁকে ভালবেসে সবাই ডাকত জটায়ু বলে। মহারাজও স্নেহ করতেন তাঁকে। একদিন জানা গেল তাঁর পানদোষ আছে। মহারাজ তাঁকে পরিস্কার জানালেন মদ্যপান করে মঠে প্রবেশ করা যাবে না। ভদ্রলোক শুনলেন না। পরেরদিন সন্ধ্যেবেলা মহারাজ ঘুরে ঘুরে কাঠের কাজ দেখছেন, এমন সময় তাঁর নাকে কিছু একটা গন্ধ এল। তিনি বুঝলেন। ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে খুব ধীরে ধীরে কাটা কাটা গলায় বললেন “আজ রাত হয়ে গেছে। ফেরার গাড়ি পাবেন না। কাল ভোরের প্রথম গাড়িতে আপনি মঠ ছেড়ে চলে যান। আর কোনদিন যেন আপনার মুখদর্শন না করতে হয়” আমি জানি সেদিন সারারাত মহারাজ দুচোখের পাতা এক করেন নি। ভদ্রলোককে আর কোনদিন কেউ মঠে দেখতে পায় নি। (ক্রমশ)