জোহানা বার্থা জুলিয়া জেনি ভন ওয়েস্টফালেন (Johanna Bertha Julie Jenny von Westphalen) ( ১৮১৪- ১৮৮১) // কার্ল মার্কসের স্ত্রী
জেনি মার্কস। বিশ্বখ্যাত দার্শনিকের স্ত্রী হিসেবে এই নামেই তিনি পরিচিত। তাঁর পারিবারিক নাম হল জেনি ভন ওয়েস্টফালেন। এক অভিজাত পরিবারের সন্তান তিনি। উত্তর জার্মানির সলসভেদেলে তাঁর জন্ম। বাবা ব্যারন, লুডউইগ ভন ওয়েস্টফালেন। ট্রিয়েরের সরকারের কাউন্সিলার। তরুণ জেনির সৌন্দর্যে আবিষ্ট সে শহরের যুবকেরা। জেনি ‘বল কুইন’।
১৮১৬ সালে জেনির পরিবার চলে এলেন ট্রিয়ের শহরে। সেখানেই থাকতেন কার্ল মার্কসের পরিবার। জেনির বাবার সঙ্গে কার্লের বাবার বন্ধুত্ব হয়ে গেলে। সেটা পরিণত হল পারিবারিক বন্ধুত্বে। কার্ল প্রায়ই যেতেন জেনির বাড়ি। জেনির ভাই আবার কার্লের সহপাঠী। জেনির বাবা পছন্দ করতেন কার্লকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন তাঁর সঙ্গে। সেন্ট সাইমনের সমাজতান্ত্রিক আলোচনা গেঁথে যাচ্ছিল কার্লের মনে।
জেনি দেখছিলেন সেসব। দোলা লাগছিল তাঁর মনে। কার্ল ছিলেন তাঁর চেয়ে চার বছরের ছোট। কিন্তু মনে হচ্ছিল, এঁর সঙ্গে যেন জেনির জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। কি ভাবতেন তিনি কার্ল সম্পর্কে? তার চমৎকার উত্তর দিয়েছেন মেরি গ্যাব্রিয়েল, যিনি কার্ল ও জেনির সম্পর্ক নিয়ে লিখেছিলেন এক আশ্চর্য বই ‘লাভ অ্যাণ্ড ক্যাপিটেল’। জেনির মনে হত কার্ল যেন গ্যেটের উইলহেল্ম মেইস্টার, শীলারের কার্ল ভন মুর, শেলির প্রমিথিউস। গ্যাব্রিয়েল বলেছেন জেনি শুধু কার্ল মার্কসের বন্ধু বা প্রণয়ী ছিলেন না, ছিলেন ‘বিশ্বস্ত বৌদ্ধিক আলোচনার সঙ্গী’। জেনি ছাড়া কার্লের মাথা ও হৃদয় অচল ও অসাড় — ‘Neither his heart nor his head functioned without her’. এ যেন আমাদের বৈষ্ণব পদাবলির রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, ‘পরাণে পরাণ বাঁধা’, কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘আমরা দুজন ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে।’
হৃদয় দেওয়া-নেওয়া হয়ে গিয়েছিল, খ্রিস্টানরীতিতে আনুষ্ঠানিক বিয়ে হল ১৮৪৩ সালের ৯ জুন। পাত্র কার্ল মার্কসের বয়েস তখন ২৫, পাত্রী জেনির বয়েস ২৯। তখন অবশ্য কার্ল বা জেনির বাবা কেউ বেঁচে ছিলেন না। বিয়ে যে হবে একথা জেনে গিয়েছিলেন জেনির বাবা, মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন। যদিও তাঁর বাড়ির লোকজন এই বিয়ে খুশিমনে মেনে নিতে পারেন নি। বিয়ে হল ট্রেয়ের শহরের কাছে ক্রোয়েটসনাখ শহরে। ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত ‘মার্কস এঙ্গেলস কালেক্টেড ওয়ার্কসে’র ৩নং খণ্ডে তাঁদের ‘ম্যারেজ কন্ট্রাক্ট’ উল্লিখিত আছে।
No.715
We
Frederic William,
By the Grace of God
King of Prussia,
Grand Duke of Lower Rhine, etc, etc,
Herewith give notice and let it be known that :
Before the Undersigned Wilhelm Christian Heinrich Burger, royal Prussian notary in the residence of the town of Kreuzanch, in the provincial-court district of Coblenz, and in the presence of the two witnesses named below, there appeared Herr Karl Marx, Doctor of Philosophy, resident in Cologne, on the one hand, and Fraulein Johanna Bertha Julia Jenny Von Westphalen, without occupation, resident in Kreuznach, on the other .
The declarants stated that they intended to marry and in view of their future marriage, the celebration of which is to take place as soon as possible, they have mutually agreed and laid down the clauses and conditions and the consequences in civil law as follows :
Firstly. Legal common ownership of property shall be established between the future marriage partners insofar as this is not specially amended by the following articles.
Secondly. This common ownership shall also apply to all future fixed assets of the spouses by the future spouses hereby declaring all fixed assets which they will inherit in the future, or which will later fall to the lot of one or other of them, to be movable property, and putting these future fixed assets, which they give wholly into common ownership, on a par with movable property, whereby in accordance with Article fifteen hundred and five of the Civil Code their transformation into movable assets takes place .
Thirdly. Each spouse shall for his or her own part pay the debts he or she has made or contractd, inherited or otherwise incurred before marriage ; in consequence whereof these debts shall be excluded from the common ownership of property .
Thus everything has been agreed and settled between the future spouses. Concerning which the present marriage contract was adopted, which has been clearly read out to the interested parties.
Done at Kreuznach in the dwelling of the widow Frau Von Westphalen, June twelfth of the year one thousand eight hundred and forty-three, in the presence of the attendant witnesses, personally known to the notary, Johann Anton Rickes, private gentleman, and Peter Beltz, tailor, both resident in Kreuznach. And witness thereof the present document has been signed first by the above-mentiond declarants, the name, position and residence of whom is known to the notary, and after them by the above-mentioned witness and the notary.
The original, which has remained in the possession of the notary, and on which a stamp of two talers has been fixed, has been signed by :
“Dr. Karl Marx, Jenny Von Westphalen, J.A.Rickes, Peter Beltz, and Burger, notary.’’
At the same time We order and instruct all executors of courts of justice on request to put into operation the present act ; Our Procurators — General and Our Procurators at provincial courts of justice to administer the same ; all officers and commandants of the armed forces or their representatives to lend a powerful helping hand if legally requested to do so.
In confirmation thereof the present main copy has been signed by the notary and furnished with his seal of office.
Vouching for the correcting of this main copy.
Burger, notary
বিয়ের পরে প্রথম কয়েক মাস কার্ল জেনির বাড়িতে অতিবাহিত করেন এবং একটি পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। তারপর তিনি জার্মানি থেকে প্যারিসে যাবার চিন্তা করেন, কারণ সেখানে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ আছে। মার্কস দম্পতি চলে আসেন প্যারিসে। রুয়ে ভ্যানিউ ৩৮-এ একটি সাধারণ ফ্ল্যাটে বসবাস করতে থাকেন তাঁরা। এখানেই জন্ম হয় তাঁদের প্রথম সন্তানের। জেনির নামে সে কন্যাসন্তানের নাম কার্ল রাখেন জেনিচেন। আর এখানেই কার্ল মার্কসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের। কিন্তু অনতিবিলম্বে ফরাসি শাসকরা মার্কসকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে। মার্কস পরিবারে নেমে আসে দুর্যোগ। জেনি সমস্ত আসবাবপত্র বিক্রি করে দেনা শোধ করেন।
শুরু হল জেনির দুঃখ দহনের পালা। শুরু হল ভবঘুরে জীবন।
মার্কস দম্পতি এলেন ব্রাসেলসে। লণ্ডনের শ্রমিকদের বস্তি দেখতে মার্কস ও এঙ্গেলস গেলেন লণ্ডনে। পরিচারিকা হেলেন ডেমুথ আর নবজাত কন্যাকে নিয়ে জেনি চলে এলেন ট্রিয়েরে, মায়ের কাছে। বিপর্যয়ের মধ্যেও মন তাঁর সচল। ট্রিয়ের থেকে স্বামীকে লিখছেন চিঠি। সে চিঠিতে প্রকাশ পাচ্ছে সমাজে নারীর স্থান সম্বন্ধে তাঁর ভাবনা। বলছেন, এমনকি যাঁরা সমাজতান্ত্রিক মতামত পোষণ করেন, তাঁরাও নারীকে তার যোগ্য স্থান দিতে চান না।
জেনি ফিরে এলেন ব্রাসেলসে। মার্কসের ‘জার্মান আইডিয়োলজি’ বইটি প্রকাশের জন্য তোড়জোড় শুরু করলেন। এদিকে মার্কস–এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট করসপনডেন্স কমিটি’ গঠনের কাজ শুরু করেছেন। জেনি সেই সংগঠনের সেক্রিটারির কাজ করে যাচ্ছেন। তখন অবশ্য তাঁর দ্বিতীয় সন্তানের আবির্ভাব স্পষ্ট হয়েছে। তিনি ‘লিগ অব দ্য জাস্ট’এর প্রথম সদস্যা, ‘জার্মান ওয়ার্কাস ইউনিয়নে’রও সক্রিয় কর্মী। তার সঙ্গে আছে স্বামীর পাণ্ডুলিপি পুনর্লিখনের কাজ। মার্কসের হস্তাক্ষর দুর্বোধ্য, সেগুলি ভালো করে না লিখে দিলে ছাপায় ভুল থেকে যাবে।
জেনির এই অমানুষিক পরিশ্রম দেখেছিলেন টাইপিস্ট স্টেফান বর্ন। তিনি বলেছেন, ‘Throughout her life, she took the most intense interest in everything that concerned and occupied her husband’. স্বামীর কাজেই তিনি সমর্পণ করেছিলেন মন-প্রাণ। এ যেন ‘তোমার গরবে গরবিনী হাম’। ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ শেষ করতে হবে, স্বামীর সঙ্গে সে কাজেও হাত লাগিয়েছেন জেনি।
তখন তাঁরা বেলজিয়ামে।এখানে থাকার শর্ত হল, কোন রাজনৈতিক ক্রিয়া-কলাপ করা চলবে না। কিন্তু তখন কড়া নাড়ছে ১৮৪৮ সালের বিদ্রোহ। সরকারি নিষেধ মান্য করে চলতে পারলেন না মার্কস দম্পতি। জার্মান বিপ্লবীদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টায় মন দিলেন। তাঁদের গ্রেপ্তার করা হল। বিতাড়িত করা হল বেলজিয়াম থেকে। জার্মানি এলেন তাঁরা। ‘নয়া রাইনিশে সাইতুং’ প্রকাশ করতে লাগলেন। বিপ্লবী কাজকর্মের জন্য জার্মান থেকে মার্কস-এঙ্গেলস বিতাড়িত হলেন। কপর্দকশুন্য অবস্থায় জেনিকে ঘর ছাড়তে হল। তখন তিনি চতুর্থবারের জন্য গর্ভবতী। তিন সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিতে হল মায়ের কাছে ট্রিয়েরে। চতুর্থ সন্তান হেনরি এডওয়ার্ড গুইডো ১৮৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু এক বছরের মধ্যে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।
১৮৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে কার্ল ও জেনি এলেন লণ্ডনে। সোহো নামক অঞ্চলের ৬৪নং ডিন স্ট্রিটের এক বাড়িতে আস্তানা পাতলেন। বিপ্লবের পরাজয়ের পরে মার্কসরা চলে এলেন লণ্ডনে। প্রকাশ করলেন রাজনৈতিক ‘রিভিউ’। আবার অর্থের সমস্যা। সে সব সামলাতে হচ্ছে জেনিকে। সন্তান অসুস্থ। বাড়িওয়ালির তর্জন ভাড়ার জন্য। জেনি ছুটলেন হল্যাণ্ড। আত্মীয়ের কাছে যদি কিছু সাহায্য পাওয়া যায়! লণ্ডন ছেড়ে কার্ল গেছেন অন্যত্র। তাঁকে চিঠি লিখছেন জেনি। সে চিঠির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে তাঁর আর্তনাদ :
‘Meanwhile I sit and go to pieces. Karl, it is now at its worst pitch… I sit here and almost weep my eyes out and can find no help. My head is disintegrating. For a week I have kept my strength up and now I can no more.’
মনের দুঃখের কথা স্বামীকে বলছেন বটে, কিন্তু তাঁর মনোবল অটুট ছিল। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের এক ভাইডেমারের কাছে স্বামীর প্রার্প অর্থের জন্য আবেদন করেও জেনি তাঁকে লিখছেন যে তিনি যেন মনে না করেন যে এইসব ছোটখাটো তুচ্ছ দুঃখের ঘটনা তাঁর মনোবল নষ্ট করে দিয়েছে, ‘সত্যি সত্যি যা আমার আত্মাকে কষ্ট দিচ্ছে এবং হৃদয়কে রক্তাক্ত করছে, তা হল এই চিন্তা যে, ছোট খাটো ব্যাপারের জন্য আমার স্বামীকে কতই না কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে, আমার পক্ষে কত সামান্য পরিমাণেই না তার সাহায্য সম্ভব হচ্ছে।‘
সংসারে টানাটানি, অথচ অতিথি-অভ্যাগত অবিরাম। জেনি তাঁদের আপ্যায়ণে রাখেন নি কোন ত্রুটি। পল লাফার্গ তো বলেইছেন যে নানা দেশের শ্রমিকরা জেনির আতিথেয়তায় ধন্য হয়েছেন। ১৮৫১ সালে পঞ্চম সন্তান জেনি ইভালিন ফ্রান্সিসের জন্ম, কিন্তু একবছরের মধ্যেই তার মৃত্যু হল। ১৮৫৫ সালে ষষ্ঠ সন্তান জেনি জুলিয়া এলিনয়েরের জন্ম। ১৮৫৭ সালে জন্ম নেয় সপ্তম সন্তান, কিন্তু অতি দ্রুত মৃত্যু হয় তার। একদিকে চরম দারিদ্র্য আর অন্যদিকে সন্তান হারানোর কষ্ট বুকে নিয়েও জেনি স্বামীকে আড়াল করে রেখেছিলেন, সহায়তা করে গেছেন স্বামীর কাজকর্মে।
১৮৮১ সালের ২ ডিসেম্বর মৃত্যু হয় জেনি মার্কসের। লণ্ডনের হাইগেট সমাধিক্ষেত্রে কার্ল মার্কসের পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। তাঁর সমাধির উপর মার্বেল পাথরে খোদাই করা লেখায় আছে ‘The Beloved Wife of Karl Marx’. এই কথার মধ্যে একটুও অতিশয়োক্তি নেই।
অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে এঙ্গেলস যা বলেছিলেন তাঁর সম্পর্কে, তার মধ্যেও নেই একটুও অতিরঞ্জন :
‘The contribution made by this woman, with such a sharp critical intelligence, with such political tact, a character of such energy and passion, with such dedication to her comrades in the struggle — her contribution to the movement over almost forty years has not become public knowledge ; it is not inscribed in the annals of the contemporary press. It is something one must have experienced at first hand.’ (ক্রমশ)