“ধরাতলে ধন্য সে কুমারহট্ট গ্রাম।/তত্রমধ্যে সিদ্ধপীঠ রামকৃষ্ণ ধাম।।/শ্রীমণ্ডপ জাগ্রত শৈলেশপুত্রী যথা ।/নিশাকালে চরিতার্থ শ্রীরঞ্জন তথা।”
গ্রামের নাম কুমারহট্ট। অধুনা হালিসহরের আদি নাম। উত্তর ২৪ পরগনার ঠিক শেষ প্রান্তে গঙ্গার পূর্ব দিকে গড়ে উঠা এই স্থানেই ভক্তি-কাব্য-সঙ্গীত-লোকধর্মে — লোকায়ত এক মহাপুরুষ আবির্ভূত হন। রামপ্রসাদ সেন। শাক্ত সাহিত্যের আদি স্রষ্টা সাধক কবি রামপ্রসাদ অষ্টাদশ শতাব্দীর শাক্ত গানে এমন ভক্তির জোয়ার আনলেন যে, ভক্তিমার্গে আগমনী, বিজয়া ও শ্যামা সঙ্গীতে তার নাম প্রধান হয়ে উঠলো।
রামপ্রসাদ সেনের জন্ম সময় নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। আনুমানিক ১৭১৮ থেকে ১৭২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হালিশহরের (কুমারহট্ট) এক বৈদ্য সুশৃঙ্খল পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম রামরাম সেন ও মাতা সিদ্ধেশ্বরী দেবী।
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ও সংস্কৃত পণ্ডিত নিত্যদিন ভোরে গঙ্গা স্নান ও চণ্ডীপাঠ করতেন। একদিন স্বপ্নে রামরাম সেন এক দেবী মূর্তিকে দেখেন, যেন তিনি বলছেন, — ‘তোর ঘরে এমন একজন আসছেন যে আমার পূজা আরাধনায় সকলের মধ্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ রামরামের এই স্বপ্ন দেখার পরেই রামপ্রসাদের জন্ম হয়।
মাত্র তিন বছর বয়সেই আঙ্গুলের কর গুনে রামপ্রসাদ ধ্যানমগ্ন হয়ে বিশ্বমায়ে জপ করতেন। শোনা যায়, আট নয় বছর বয়সেই মায়ের তিরস্কারে অভিমানহত হয়ে বাড়ির দক্ষিণ দিকের পুকুরে ডুব দিয়েছিলেন। তিনদিন কুম্ভকের আশ্রয়ে থেকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাকে জল থেকে উদ্ধার করা গেল। দেখা গেল রামপ্রসাদের দেহ অবিকৃত রয়েছে। এই অলৌকিক লীলা রামপ্রসাদের সমগ্র জীবন পরিক্রমায় আমরা বারংবার দেখতে পাই।
বাল্যকালে শিক্ষা লাভের জন্য তাকে সংস্কৃত টোলে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ, সাহিত্য, ফারসি,হিন্দি ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। নতুন ভাষার আগ্রহ ছিল তার প্রবল। কিন্তু পাঠে বাধ সাধলো যখন তার মাথার উপর থেকে পিতার ছায়া সরে যায়।রামপ্রসাদের পিতার প্রয়াণের পর সংসারের অভাব চেপে বসলো মাথায়। তিনি লিখলেন, — ‘নুন মেলে না আমার শাকে’। সাংসারীক দায়িত্ব রামপ্রসাদকে চাকরি নিতে বাধ্য করলো।
কলকাতার এক ধনাঢ্য জমিদার গৃহে ধনরক্ষকের অধীনে মুহুরীর কাজ পেলেন রামপ্রসাদ।খিদিরপুরের ভূকৈলাশ রাজবাড়ি বা গরানহাটার দুর্গাচরণ মিত্রের বাড়ি বা বাগবাজারের মদনমোহন মূর্তি প্রতিষ্ঠাতা মিত্র পরিবার — কে যে রামপ্রসাদের মনিব ছিলেন তা সঠিক জানা যায় না। তবে এটুকু জানা যায় রামপ্রসাদ হিসেবের খাতায় হিসেব না করে মা কালীর গান লিখতে শুরু করেন।
খাজাঞ্চি ও নিন্দুকেরা ভাবলেন মনিবকে রামপ্রসাদের কথা জানালে, কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য মুহুরীর কাজটা তার চলে যাবে কিন্তু ঘটলো অন্য কিছু। মনিব দেখেন হিসেবের খাতায় সুন্দর পদ লেখা, “আমায় দেও মা তবিলদারি /আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী।।/পদরত্ন ভান্ডার সবাই লুটে, ইহা আমি সইতে নারি।/ভাঁড়ার জিম্মা আছে যার, সে যে ভোলা ত্রিপুরারি।।”
পুনরায় মালিক হিসেবের খাতা নিরীক্ষা করার জন্য উল্টোপাল্টে দেখলেন — প্রতিটি পাতায় শ্রীদুর্গা শ্রীদুর্গা নাম লেখা আছে আর খাতার শেষের পাতায় এই গান। খাজাঞ্চি ভেবেছিল মালিকের কাছে রামপ্রসাদের নামে অভিযোগ করে তাকে পাগল প্রতিপন্ন করলে কিছু বকশিশ সে পাবে। কিন্তু মালিক বুঝতে পারলেন, এ কোন সাধারন মানুষ নন। ভগবৎ প্রেমের মদিরাপানে মাতোয়ারা রামপ্রসাদের জন্য মালিক মাসিক বৃত্তি ৩০ (ত্রিশ) মুদ্রা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন এবং বললেন, যতদিন তিনি সংসার কাননে বিচরণ করবেন, ততদিন তিনি এই মাসিক বৃত্তি প্রদান করবেন। এরপর মালিক তাঁকে বাড়ি ফিরে গিয়ে মা কালীর সাধনায় মনোনিবেশ করতে বলেন।
রামপ্রসাদ নিজের পৈত্রিক ভিটে হালিশহরে চলে আসেন। হালিশহর তখন নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত। তরুণ রামপ্রসাদ হাতে পেলেন ১২৬ বিঘা জমি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, দর্পনারায়ন রায়, সুভদ্র দেবীর কাছ থেকে এবং মনিবের কাছ থেকে মাসিক বৃত্তি ৩০ টাকা। এতে রামপ্রসাদের পরিবার সুন্দরভাবে চলে যেতে পারত। কিন্তু যার মন মা কালীর ভাবরসে পূর্ণ, তার মন কখনো সংসারের তুচ্ছ চাওয়া পাওয়ায় প্রভাবিত হয়!!
হালিশহরেই সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর সাধনপীঠ “রামকৃষ্ণধামে” রামপ্রসাদ তার সাধন ভজন শুরু করেন।” ডুব দে মন কালী বলে/হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।” এখানেই আধ্যাত্ম্য সাধনা, বাস্তব জীবন ও কাব্যরসের ত্রিবেণী সঙ্গমে রামপ্রসাদের গান আলাদা মাত্রা পেয়েছিলো — প্রসাদি সংগীত রূপে।
কারো অভাবে রামপ্রসাদ মুক্ত হস্তে দান করে গেছেন। পদ লিখেছেন, — ‘তুমি ভালো করেছো মা/আমারে বিষয় দিলে না/এমন ঐহিক সম্পদ কিছু,/ আমারে দিলে না।। ‘রামপ্রসাদের সহধর্মিনী যশোদাদেবী, যার মূল নাম সর্বানী, স্বামীর মতই ভক্তির অধিকারী ছিলেন। তার প্রতি স্বপ্নে প্রত্যাদেশ আসে রামপ্রসাদ যেন কাব্য রচনা করে।
সাধক রামপ্রসাদের মধ্যে ছিল এক অলৌকিক শক্তি। যখন যা চোখে দেখতেন তাই লিখতেন। মুখ থেকে যে শব্দ উচ্চারিত হতো সঙ্গে সঙ্গে তাই লিখে ফেলতেন। মা কালীর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করেছিলেন। শক্ত কবিতায় অসাধারণ শব্দ চয়ন ছিল তার। মায়ের কাছে অসহায় শিশুর মতো আত্ম সমর্পন শাক্ত পদাবলীকে মাধুর্য্য দিয়েছে, ঐতিহ্য মন্ডিত করেছে। বর্তমানে তাঁর লেখা এক লক্ষ শ্যামাসঙ্গীত আছে বলে শোনা গেলেও তার বেশিরভাগই বিলুপ্তির পথে।
রামপ্রসাদের জীবনের নানান ঘটনা জনশ্রুতির মতো ছড়িয়ে রয়েছে ভক্তকুলের মধ্যে। শোনা যায়, রামপ্রসাদ নিজে মাটির কালি মূর্তি নির্মাণ করতেন। শেষবার কার্তিকী কৌশিকী অমাবস্যায় মা কালীর পূজা করে ছিলেন। একটি পদ্মফুল (মতান্তরে রক্ত জবা ফুল) কম পড়ল। সর্বাণী দেখতে পেলেন পঞ্চবটির পাশের গাবগাছে পদ্মফুল ফুটে রয়েছে। সে পদ্মফুল এনে মায়ের চরণে নিবেদন করা হলো।
পুজা শেষে, “ওমা আমার দফা হল রফা, দক্ষিণা হয়েছে”, গাইতে গাইতে মৃন্ময়ী মায়ের মূর্তি মাথায় করে গঙ্গাগর্ভে মাকে নিয়ে জীবন বিসর্জন দিলেন রামপ্রসাদ। কারো মতে রামপ্রসাদের ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে প্রাণ বায়ু নির্গত হয়েছিল। মহাপুরুষের প্রাণত্যাগ মহাপুরুষের মতোই হয়েছিলো।
১৭৮১ রামপ্রসাদ গঙ্গাগর্ভে স্বেচ্ছায় বিসর্জিত হওয়ার পর তার সিদ্ধপীঠ আগাছায় জঙ্গল ও জীবজন্তু বাসভূমিতে পরিণত হয়। হালিশহরবাসীর উদ্যোগে রামপ্রসাদের মৃত্যুর শতবর্ষ পরে তার ভিটে পঞ্চবটি ও পঞ্চমুন্ডাসন সংস্কারে উদ্যোগ নেয় স্থানীয় পূর্ণিমা ব্রত সমিতি। রামপ্রসাদের ভিটে সংস্কারের, জঙ্গল কাটার কোন মজুর পাওয়া যাচ্ছিল না। ভয় পাচ্ছিল তারা। কিন্তু মা জগদম্বা ও সাধক রামপ্রসাদের কৃপায় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চবটি ও পঞ্চমুন্ডাসন খুঁজে পাওয়া গেল। তারপর ঠিক হল রামপ্রসাদের ভিটেয়, সিদ্ধপীঠে প্রসাদকালীর আরাধনা হবে।
নানান ঘটনার মধ্যে দিয়ে ১৯৫৭ সালে মন্দির, গর্ভগৃহ, নাট্যমণ্ডপ নির্মান, পঞ্চবটি, পঞ্চমুন্ডাসনের সংস্কার ও প্রসাদ কালীর প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ন হয়। সাধকের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রচুর মানুষ দান করেছিলেন। তাদের নাম মন্দিরের নাট-মেঝেতে ফলকে লিখিত আছে।
প্রতি বছর ২৬ জানুয়ারী তারিখে এখানে অন্নকূট উৎসব পালন করা হয় । এই উৎসবকে কেন্দ্র করে এক বিরাট মেলার আয়োজন হয়। মহালয়ার অমাবস্যা, মাঘ মাসের রটন্তী কালীপুজো, ভাদ্রের জন্মাষ্টমী, আষাঢ় মাসের বিপদতারিনী এবং প্রতি অমাবস্যায় রামপ্রসাদের কালীমন্দির উৎসবের চেহারা নেয়। বহু দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন আসেন এই উৎসবে যোগদানের জন্য।
আজ ২৬ ডিসেম্বর সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের জন্মের তিনশত বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান চলছে হালিশহরে, রামপ্রসাদের ভিটায়। ‘মানব জমিন’ শব্দবন্ধের কথা ও ভাবনা যিনি আমাদের মধ্যে চারিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এই উদ্যোগ। রামপ্রসাদের ভিটেয় প্রতিষ্ঠিত মা কালীকে দর্শন করে ভক্তকুলের অমৃতলাভ হোক।
খুব ভালো
ধন্যবাদ 🌹
অনবদ্য লেখা,, আপনাকে কুর্নিশ জানাই এত সুন্দর করে আপনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখেন,,,👏👏👏👏
মতামত পেয়ে খুব খুশি হলাম।