তখন গভীর রাত। অযোধ্যার মানুষজন গভীর নিদ্রায় মগ্ন। রামচন্দ্র এলেন তাঁর জন্মভূমিতে। একা নন। তাঁর সঙ্গে আছেন সীতা, লক্ষণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন। শত্রুঘ্ন মাঝে মধ্যে মর্ত্যভূমিতে আসেন। ভারতবর্ষের খোঁজ-খবর রাখেন। তিনিই রামচন্দ্রকে জানিয়েছিলেন অযোধ্যায় তৈরি হচ্ছে রামমন্দির। তাই রামচন্দ্র তাঁর স্ত্রী ও ভাইদের নিয়ে এসেছেন গভীর রাতে। দিনের বেলায় আসতে নিষেধ করেছিলেন শত্রুঘ্ন। বলেছিলেন রামকে সশরীরে দেখতে পেলে পাগলের মতো মানুষ ছুটে আসবে। শত্রুঘ্ন বলেছিলেন রামায়ণ সিরিয়াল হচ্ছিল যখন, তখন জনজীবন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছিল। দূরদর্শন নামক যন্ত্রের সামনে ধুপ-ধুনো জ্বালিয়ে পুজো করত মানুষ। রামের অভিনয় যিনি করেছিলেন, মানুষ তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করত। রামকে দেখতে পেলে মানুষ তাঁকে জাপ্টে ধরবে। শত্রুঘ্ন রামকে রবীন্দ্রনাথ নামে এক কবির কাহিনি শুনিয়েছিলেন। তিনি মারা যাবার পরে রবীন্দ্র-ভক্ত মানুষ নাকি তাঁর দাড়ির চুল ছিঁড়ে নিয়েছিল। সুতরাং রিস্ক নিয়ে কাজ নেই।
যেখানে রামমন্দির তৈরি হচ্ছে, তার থেকে কিছুটা দূরে বসলেন তাঁরা। ভরত বললেন, আমি শুনেছি ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর এখানে শিলান্যাস হয়েছিল। তার উদ্যোক্তা ছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা দল-এরা সব। ৩৫ বছর পরে সেখানে তৈরি হচ্ছে রামমন্দির। রাম জন্মভূমি নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান নৃপেন্দ্র মিশ্র বলে দিয়েছেন এ বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে গর্ভগৃহ। এদের কাছে আপনি রাম রতন ধন।
শুনে রামচন্দ্র মৃদু হাসলেন। বললেন, এই ‘রাম রতন ধন’ কথাটা বলেছিল তুলসীদাস। সে ছিল আমার পরম ভক্ত। লিখেছিল ‘রামচরিতমানস’। এরা কি তারই মতো ভক্ত ?
হো হো করে হেসে উঠলেন শত্রুঘ্ন। সীতা অবাক হলেন। ভরত দেশের হাল হকিকত জানতেন কিছুটা। তাই তিনি শত্রুঘ্নকে বললেন সবিস্তারে সব জানাতে। রোঁমা রোঁলা যেমন ফ্যাসিস্টদের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে রবীন্দ্রনাথের চোখ খুলে দিয়েছিলেন, শত্রুঘ্ন তেমনি চোখ খুলে দিন রামচন্দ্রের।
রামচন্দ্র ও সীতা অবাক বিস্ময়ে শুনে যেতে লাগলেন শত্রুঘ্নের কথা। ভারতীয় জনতা দলটি সত্যই ‘রাম রতন ধন পায়ো’। তাদের কাছে রামচন্দ্র বিরাট একটা মূলধন। লোকসভায় যাদের দুটি মাত্র আসন ছিল, রামজন্মভূমির শিলান্যাস করে তাদের লোকসভায় আসন সংখ্যা হয়ে গেল ৮৫টি। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয় নি। শুধু ধাও শুধু ধাও শুধু বেগে ধাও। পাঁচ বছর রাজত্বও করল তারা। এদিকে রামমন্দির-বাবরি মসজিদ নিয়ে আইনি লড়াই তো চলছে। ভেঙে ফেলা হল বাবরি মসজিদ। ‘বিশ্বাসের ভিত্তিতে’ সুপ্রিম কোর্টের রায়। কেল্লা ফতে। প্রধান বিচারক এসে গেলেন সংসদে। দিল্লির মসনদে পাকাপাকি আসন।
ব্যথিত চিত্তে রামচন্দ্র বললেন, কতকাল আগে মহাকাব্য লিখেছিল বাল্মীকি। এতকাল পরে আমি হলাম দুর্দৈবের শিকার, নেমে এলাম রাজনীতির ঘোলাজলে।
শত্রুঘ্ন বললেন, সামনের বছর জানুয়ারিতে মকরসংক্রান্তির সময় খুলে দেওয়া হবে রামমন্দির। কেন জানেন? তার ঠিক পরেই লোকসভার ভোট। কয়েকটা রাজ্যে বিধানসভারও ভোট। হিন্দি হার্টল্যাণ্ড সে মন্দির দেখে ফিদা হয়ে যাবে। প্রভাব পড়বে অন্যত্রও। তারজন্যও পরিকল্পনা আছে। রামমন্দিরের পাশে হচ্ছে আরও সাতটি মন্দির। মহর্ষি বাল্মীকির মন্দির, শবরী মন্দির, নিশাদ রাজ মন্দির, আচার্য বশিষ্ট মন্দির, ঋষি বিশ্বামিত্র মন্দির, অহল্যা মন্দির আর অগস্ত্য মুনির মন্দির। এর ফলে আরও বিপুল মানুষ ভারতীয় জনতা দলকে ভোট দেবে। বাল্মীকি আর শবরীর জন্য দলিতরা গলে জল হবে, নিশাদ রাজের জন্য ভোট দেবে জেলে সম্প্রদায়, বশিষ্টের জন্য ভোট দেবে ব্রাহ্মণরা। ক্ষত্রিয়রা ভোট দেবে বিশ্বামিত্রের জন্য। অহল্যা আর অগস্ত্যেরও ভক্ত আছে নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে। রামের পাশে এঁদের মন্দির। তার মানে রাম সর্ব সম্প্রদায়ের। তার আসল মানে ভারতীয় জনতা দলও সব সম্প্রদায়ের জন্য। তাই সব সম্প্রদায় তাকে ভোট দিন।
সীতা বললেন, বাবাঃ, এ যে নিখুঁত পরিকল্পনা। এতে যে বিবমিষা উদ্রেক হচ্ছে।
রাম অত্যন্ত বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে বললেন, আর এক দণ্ডও মর্ত্যভূমিতে থাকতে চাই না আমি।
লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক