বিহারের পর্যটন কেন্দ্র বলতে প্রথমেই যে নামটি মনে আসে তাহলো রাজগীর। রাজগীরের পূর্বের নাম ছিল রাজগৃহ। রামায়ণেও এর উল্লেখ আছে। জরাসন্ধের রাজধানী ছিল এই রাজগৃহ। মহাবীর তার প্রথম ধর্মসভা করেন এই রাজগৃহেই। বুদ্ধের আগমনে মৌর্য সাম্রাট বিম্বিসার তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নেন।
বৈভার, বিপুল, রত্নগিরি, উদয়গিরি আর শোনগিরি — এই পাঁচপাহাড়ির দেশ, সম্রাট অজাতশত্রুর রাজধানী, ভগবান বুদ্ধ এবং ভগবান মহাবীরের স্মৃতিধন্য এই রাজগীর। আর রাজগীরের স্থানীয় স্পটগুলি বলতেই সকলে বোঝেন বিশ্বশান্তি স্তূপ, বেনুবন , উষ্ণপ্রসবন ইত্যাদি। একটু দূরে গেলেই নালন্দা বা পাওয়াপুরী, ককোলা ফলস। অথচ রাজগীরের পর্যটন মানচিত্রে বেশ অজানা এক ছবির মত সুন্দর স্পট আছে — যার নাম ঘোড়াকাটোরা।
চারিদিকে পাহাড় মাঝখানে বয়ে চলেছে ছোট্ট এক নদী। কথিত আছে এটি ছিল নাকি মহাভারতে বর্ণিত জরাসন্ধের রাজ্যের দক্ষিণদ্বার। এখানেই নাকি ছিল তার ঘোড়াশালা। ঘোরাকাটোরা (Aimee Maganda) যার অর্থ “ঘোড়ার বাটি”, এটি রাজগীর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। চার মাইল দীর্ঘ একটি বনের রাস্তা রাজগীরকে ঘোড়াকাটোরার সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছে।
২০০৯ সালে বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ইকো-ট্যুরিজমের জন্য এলাকাটিকে জনপ্রিয় করার প্রয়াস হিসাবে প্রথমবার পরিদর্শন করেছিলেন। ২৯ শে জানুয়ারি ২০১১ হ্রদটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। ২০১৮ নভেম্বরে একটি ৭০ ফুট উঁচু পদ্মাসীন ধ্যানস্থ বুদ্ধ মূর্তি উদ্বোধন করা হয়েছে। মূর্তিটি ৪৫,০০০ ঘনফুট গোলাপী বেলেপাথর দিয়ে তৈরি। হ্রদে প্যাডেল বোটিং, একটি ক্যাফেটেরিয়া এবং অতিথি কক্ষের সুবিধা রয়েছে। এটি রাজগীরের সবচেয়ে পরিষ্কার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি। বোটিং মাথাপিছু ৪০ টাকা, দুজনের ৮০ টাকা।
উজ্জ্বল এবং শান্তিপূর্ণ ও পরিচ্ছন্ন হ্রদটিতে সাইবেরিয়া এবং মধ্য এশিয়া থেকে আসা সাইবেরিয়ান ক্রেন, বার-হেডেড হংস (Bar-Headed Goose), এবং ডালমেটিয়ান পেলিকান (Dalmatian Pelican)-সহ অনেক পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল। দ্য ইন্ডিয়ান রোলার, ব্ল্যাক ড্রংগো, হর্সফিল্ডের বুশ চ্যাট, ব্রিস্টেড গ্রাসবার্ড (Bristled Grassbird) এবং ব্ল্যাক ফ্রাঙ্কোলিন এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি প্রজাতির পাখি সাধারণত ঘোরাকটোরা হ্রদ চত্বরে পাওয়া যায়। পাখিপ্রেমীরা প্রায়শই পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সাইবেরিয়ান ক্রেনের (Siberian Cranes) ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া এক ঝলক দেখতে এই জায়গায় আসেন। বিশ্বশান্তি স্তূপের কাছে একটি শান্ত জায়গায় সেট করা, এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র যা পরিবারের জন্য একটি আদর্শ পিকনিক স্পট হয়ে উঠেছে। যেখানে বাচ্চারা বোটিং উপভোগ করতে পারে অথবা পরিবার ও বন্ধুদের সাথে কিছু শান্ত সময় কাটাতে ঘুড়ে আসুন ঘোড়াকটোরা। গৃধ্রকূট পর্বতের পূর্ব দিকে শোনগিরি এবং গৃধ্রকূটের সংযোগস্থলে অবস্থিত ঘোড়াকটোরা।
বিশ্বশান্তিস্তূপ থেকে প্রায় দু-আড়াই কিলোমিটার গাছ-গাছালি ছায়ায় ঢাকা মোরামের পথ বেয়ে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন ঘোড়াকটোরায়।
পরিবেশ-সংবেদনশীল এলাকা হওয়ায়, এটি বিহার পর্যটন দ্বারা এক ধরনের ইকো-ট্যুরিজম স্পট হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন এখানে পেট্রোল/ডিজেল যানবাহন চলাচল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং শুধুমাত্র ঘোড়ার গাড়ি বা টাঙ্গার অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো। সম্প্রতি ই-রিকশা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এটিকে পলিথিন-মুক্ত অঞ্চল হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে।
ছোট নদীর ওপর একটি বাঁধ আছে পাথরের বোল্ডার দিয়ে নদীকুল বেঁধে রাখা আছে নদীর অপরদিকে পাহাড়ের গায়ে গভীর গুহা। কথিত আছে এই গুহায় নাকি রাজা জরাসন্ধ নৃপতি বিম্বিসারের সৈন্যরা লুকিয়ে থেকে। পাহারা দিত গুহার ভিতরে রয়েছে গভীর সুরঙ্গ পথ। তবে প্রবেশ করা বেশ কষ্টসাধ্য। অজানা এই পথে প্রবেশের ঝুঁকি নেওয়াটা উচিত নয়। কে বলতে পারে। কোথাও লুকিয়ে আছে বিপদের ফাঁদ।
শীতের শুরুতেই নেচার অ্যাডভেঞ্চার অনুভব করতে গেলে আপনাকে যেতে হবে রাজগীরের নব সংযোজন রাজগীর গ্লাস ব্রিজ। বিহারের পর্যটনকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য এই ব্রিজের উদ্বোধন করা হয়েছে। চিনের ঝিয়ানঝাউ ( Hangzhou Glass Bridge) ব্রিজের অনুকরণে নির্মিত ব্রিজটি ৮৫ ফুট লম্বা, ৬ ফুট চওড়া এবং ২৫০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। ব্রিজের আশেপাশে সাফারি পার্ক, আয়ুর্বেদ পার্ক গড়ে তোলার কাজও শুরু হয়েছে।
ইতিহাসে সমৃদ্ধ নালন্দা জেলা ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় অবদানের জন্য প্রাচীন কাল থেকেই বিখ্যাত ছিল। এখন পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে। এই রাজ্য এই কাঁচের সেতুর সাথে একটি জঙ্গল সাফারিও তৈরি করছে যাতে পর্যটনের কারণে এই জায়গাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়।
রাজগীর গ্লাস ব্রিজ দেখতে আসা সমস্ত মানুষ এই কাঁচের সেতুতে প্রায় ১০ থেকে ২০ মিনিট সময় ব্যয় করতে পারেন। নিরাপত্তার কারণে মাত্র ১০ থেকে ১২ জনকে কাঁচের সেতুর শেষ প্রান্তে যেতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। চাইলে আপনি অনলাইনে টিকিট বুকিং করতে পারেন।
রাজগীর কাঁচের সেতু ক্যাম্পাসে আরও অনেক কিছু পাওয়া যায়। জিপলাইন ফ্লাইং ফক্স, জিপ স্কাই বুকিং, ওয়াল শুটিং, ওয়াল ক্লাইম্বিং, বাঁশের ঘর, কাঠের ঘর ইত্যাদির মতো আরও অনেক খেলা রয়েছে। কেউ যদি এই বাঁশ বা কাঠের ঘরের ভিতরে কিছু দিন কাটাতে চান তবে তারা অবশ্যই এখানে থাকতে পারেন। প্রকৃতি উদ্যানের ভিতরে একটি প্রজাপতি পার্কও রয়েছে। গ্লাস ব্রিজ-র সামনে থেকে রোপওয়ে চালু হবে।
Darun laglo..jawar icche o roilo
থ্যাংক ইউ ❤️
খুব ভালো লাগল। তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।
ধন্যবাদ 🌹
রাজগীরের আকর্ষণ* অত্যন্ত আকর্ষক,ইতিহাসের
পাতার বাইরে এসে ভ্রমন প্রিয় মানুষদের আকৃষ্ট
করবে।চমৎকার ইতিবৃত্তে মুগ্ধতা ভালোলাগা।