দোল উৎসবকে রাধাকৃষ্ণের লীলামাহাত্ম্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। যদিও শ্রীচৈতন্যের সময় থেকে এই উৎসব আপামর জনতার উৎসব হয়ে ওঠে। মদন ও রতির মদনোৎসব থেকে বিবর্তিত হয়েই নাকি দোল বা হোলি উৎসব এসেছে। তবে মদনোৎসব পালিত হত অশোকবৃক্ষ বা দোহলীর নীচে। রাধাকৃষ্ণের লীলাখেলাও কি তাহলে অশোকবৃক্ষের নীচে সংঘটিত হত? চৈতন্যদেবের সময় তো অশোকবৃক্ষ তথা দোহলী অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। কোনও বিবরণেও পাওয়া যায় না অশোকবৃক্ষের কথা। তবে গোপিনীসমভিব্যাহারে রাধাকৃষ্ণের হোলিখেলায় অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে অশোকবৃক্ষের কথা পেয়েছি।
রাধা-কৃষ্ণের ভালোবাসাকে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন বলা হয়ে থাকে। রাধা শুধুমাত্র কৃষ্ণের প্রেমিকাই নন, বরং তাঁর আত্মা ও শক্তি স্বরূপা প্রেমের দেবী।তিনি হ্লাদিনীশক্তির প্রতীক। সর্বদা কৃষ্ণের নামের আগে রাধার নাম নেওয়া হয়। মনে করা হয় রাধার নামমাত্রেই কৃষ্ণের প্রতিটি শিরা প্রফুল্ল ও শিহরিত হয়ে পড়ে। তাই রাধার আশীর্বাদ লাভের জন্য শক্তিশালী ‘শ্রী রাধা কৃপা কটাক্ষ স্তোত্র’ পাঠ করা বাঞ্ছনীয় বলে পণ্ডিতদের বিশ্বাস। কথিত আছে যে, এই স্তোত্রের রচয়িতা স্বয়ং শিব। ধর্মীয় ধারণা অনুযায়ী রাধাকে তুষ্ট করার জন্য শিব এই স্তোত্র রচনা করে পার্বতীকে শুনিয়ে ছিলেন। এই স্তোত্রের মাধ্যমে শিব রাধার শৃঙ্গার, রূপসম্পদ ও করুণা ব্যখ্যা করেছেন।
শ্রী রাধা কৃপা কটাক্ষ স্তোত্র —
রাধা সাধ্যম সাধনং যস্য রাধা, মন্ত্রো রাধা মন্ত্র দাত্রী চ রাধা,
সর্বং রাধা জীবনম্ যস্য রাধা, রাধা রাধা বাচিকিম তস্য শেষম।
মুনীন্দবৃন্দবন্দিতে ত্রিলোকশোকহারিণী, প্রসন্নবক্ত্রপংকজে নিকঞ্জভূবিলাসিনী,
ব্রজেন্দভানুনন্দিনী ব্রজেন্দ্র সূনুসঙ্গতে, কদা করিষ্যসীহ মাং কৃপা-কটাক্ষ-ভজানম্
অশোকবৃক্ষ বল্লরী বিতানমণ্ডপস্থিতে, প্রবালজ্বালপল্লব প্রভারূণাঙ্ঘি কোমলে,
বরাভয়স্ফুরত্করে প্রভূতসম্পদালয়ে, কদা করিষ্যসীহ মাং কৃপা-কটাক্ষ-ভজানম্। (সংক্ষেপিত)
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে জনৈক শিবাচার্য নামক প্রয়াগনিবাসী কবি রচনা করেন ‘শ্রীরাধা কৃপাস্তোত্র’। সেখানে তিনি শ্রীরাধার অঙ্গশোভার বর্ণনা দিতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছেন, —
অশোকবল্লরীসম শরীরোত্তম শোভিতে
প্রবালজ্বালকুসুম প্রভারূণাঙ্ঘি কোমলে।।
বরাভয়স্ফুরত্করে প্রভূতসম্পদালয়ে
কদা করিষ্যসীহ মাং কৃপা-কটাক্ষ-ভজানম্।।
কাজী নজরুল ইসলামের হিন্দু পুরাণ গুলে খেয়েছিলেন। তাঁর কলম থেকে রাধাকৃষ্ণের লীলাখেলার বিবরণও বেরোবে, এটাই প্রত্যাশিত। এই বহুশ্রুত নজরুলগীতিটিতে হোলি খেলায় মত্ত রাধাকৃষ্ণের পারিপার্শ্বিক দৃশ্যে অশোক ফুলও শোভা পাচ্ছে —
ব্রজ–গোপী খেলে হোরী
খেলে আনন্দ নবঘন শ্যাম সাথে।
রাঙা অধরে ঝরে হাসির কুম্কুম্
অনুরাগ–আবীর নয়ন–পাতে।।
পিরীতি–ফাগ মাখা গোরীর সঙ্গে
হোরি খেলে হরি উন্মাদ রঙ্গে।
বসন্তে এ কোন্ কিশোর দুরন্ত
রাধারে জিনিতে এলো পিচ্কারী হাতে।।
গোপিনীরা হানে অপাঙ্গ খর শর ভ্রুকুটি ভঙ্গ
অনঙ্গ আবেশে জর জর থর থর শ্যামের অঙ্গ।
শ্যামল তনুতে হরিত কুঞ্জে
অশোক ফুটেছে যেন পুঞ্জে পুঞ্জে
রঙ–পিয়াসি মন ভ্রমর গুঞ্জে
ঢালো আরো ঢালো রঙ প্রেম–যমুনাতে।।
দোহলী হল অশোকবৃক্ষের আর এক নাম। দোহলী থেকেই দোল ও হোলি কথাদুটির সৃষ্টি হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। জানি না, সংস্কৃত বা প্রাকৃত সাহিত্যে দোলের প্রাকশব্দ হিসেবে দোহলী বা দোঅলি কোনও জায়গায় উল্লিখিত হয়েছে কিনা। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের এদিকটায় একটু আলোকপাত করতে অনুরোধ জানাই।