কবি ঈশ্বর গুপ্ত কবিয়ালদের ইতিহাস লিখতে গিয়ে প্রথম কবিয়াল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গোঁজলা গুঁইকে। তাঁর জন্ম ১৭০০ (১৭০৪?) সালে। কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাম খুঁজে পাননি। সময়কাল অনুযায়ী পঞ্চানন কুশারী হতে পারেন তাঁর কবিগানের প্রতিদ্বন্দ্বী। কারণ ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী পঞ্চানন কুশারী ১৬৯০ থেকে ১৭২০-র মধ্যে কলকাতা-গোবিন্দপুরে বসত গাড়েন কাকা শুকদেব কুশারীকে নিয়ে।
ব্রাহ্মণ কবিয়ালদের পদবি লোকমুখে পালটে ঠাকুর হয়ে যেত। পঞ্চানন কুশারীর পদবি পালটে ঠাকুর হয়। পরবর্তীকালে হরু ঠাকুর, নীলু ঠাকুর, রামপ্রসাদ ঠাকুর, মনোরঞ্জন ঠাকুর, নিমচাঁদ ঠাকুর, সৃষ্টিধর ঠাকুর, নবাই ঠাকুর, রামকানাই ঠাকুর, পদবিবদলের সাক্ষ্য দিচ্ছেন। হরু ঠাকুরের পূর্বাশ্রমের নাম হরেকৃষ্ণ দীর্ঘাঙ্গী। নীলু ঠাকুর ও রামপ্রসাদ ঠাকুরে পূর্বাশ্রমের পদবি চক্রবর্তী। পঞ্চাননের মতো তাঁদেরও মূল পদবি বদলে ঠাকুর হয়ে গিয়েছিল কবিয়াল হওয়ায়।
পঞ্চানন কুশারী একটি শিবমন্দির স্থাপন করেছিলেন গোবিন্দপুরের ধনসায়রে। শিবমন্দিরকে ঘিরে গাজন, বোলান, কবিগানের আয়োজন হওয়ার চল ছিল সেযুগে। পঞ্চাননও সক্রিয়ভাবে সেই কবির লড়াইয়ে অংশ নিতেন। শিবমন্দির চত্বরে কবিগানের সেই ট্র্যাডিশন এখনও বাংলায় চলছে।
মূলত অশ্লীল খেউড় অংশের জন্যে রবীন্দ্রনাথ কবির লড়াই সম্বন্ধে বীতস্পৃহ হলেও স্বীকার করেছিলেন, তিনি যদি গ্রামের দরিদ্র কৃষকের ঘরে জন্মাতেন, তাহলে হয়তো তাঁকে কবিগানের দলে নাম লেখাতে হত, গ্রামে গ্রামে বাউল-বাউন্ডুলের মতো ঘুরতে হত।
তাঁর বিভিন্ন লেখায় পাওয়া গিয়েছে হরু ঠাকুরের উল্লেখ। অর্থাৎ তিনি কবিয়াল হরু ঠাকুরের জীবন সম্বন্ধে অবগত ছিলেন।
বিখ্যাত লেখিকা শান্তা শ্রীমানী তাঁর ‘ঠাকুরবাড়ীর গৃহসজ্জা’ বইয়ে লিখেছেন — “ঠাকুর পরিবারের সূত্রপাত হয়েছিল শুকদেব ও পঞ্চানন কুশারীর হাত ধরেই। স্থানাভাব ও অর্থাভাব লেগেই ছিল তাদের সংসারে। পঞ্চাননের মনে ছিল উচ্চাশা।তাই সংসারের আর্থিক হাল ফেরাবার জন্যই যশোরের বারোপাড়া গ্রাম থেকে সপরিবারে ভাগ্যের অন্বেষণে তাঁরা এসেছিলেন ভাগীরথী তীরবর্তী গোবিন্দপুরে। পঞ্চানন সঙ্গে এনেছিলেন গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন শিলাকেও।
গোবিন্দপুর তখন নিতান্তই একটি গ্রাম। পঞ্চানন গোবিন্দপুরে এলেন সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে।
প্রশান্তকুমার পাল (রবিজীবনী-র লেখক) জানিয়েছেন ‘সময়টা প্রায় জোব চার্নকের কলকাতা পত্তনের সমসাময়িক।তখন গোবিন্দপুরে বাস করতেন কৈবর্তেরা।মাছ বিক্রি তাদের পেশা।এদের পেয়ে কৈবর্তেরা খুব খুশী।তাঁরা পঞ্চানন,শুকদেবকে শুধু আশ্রয়ই দিলেননা।ঠাকুরমশাই বলে ডাকতেও শুরু করে দিলেন।
খালি হাতে বিদেশ বিভুঁইয়ে এসেছেন কুশারী পরিবার। যা হোক কাজ চাই।তাঁরা দেখলেন কৈবর্তেরা পশ্চিম থেকে আসা জাহাজে নানা কাজের জন্য যাতায়ত করে। পঞ্চানন, শুকদেবও তাদের দেখাদেখি বিদেশিদের জাহাজে কাজের জন্য ঘোরাফেরা শুরু করলেন। সাহেবদের ফাইফরমাশ খেটে আর রসদ জুগিয়ে মোটামুটি পেট চালানোর উপায় খুঁজে পেলেন তাঁরা। কিছুটা শিক্ষা ও উপস্থিত বুদ্ধি থাকার জন্য সাহেবদের সঙ্গে কাজ চালানোর মতো ভাষাও শিখে নিলেন তাঁরা। জেলেরা ঠাকুর বলে ডাকতো। জাহাজি ও সাহেবরাও ভাবলেন তাঁদের পদবিই বুঝি ঠাকুর। বিদেশী উচ্চারণে তা দাড়াল টেগোর।
পঞ্চানন গোবিন্দপুরে গঙ্গাতীরে খানিকটা জমি কিনে বসতবাটী বাগান ও শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন।
১৭৫৭ সালে কোম্পানির সিপাইরা আক্রমণ চালায়। তাতে তাদের ভিটেমাটি বাগান মন্দির সব ধ্বংস হয়। পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা নতুন ফোর্ট বানাবে বলে তাঁদের গোবিন্দপুরের জমি, বাগান সব দখল করে। গোবিন্দপুর থেকে দেশীয় বাসিন্দাদের সরিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণ করা হয়। ইংল্যান্ডের তৃতীয় রাজা উইলিয়ামের সম্মানে দুর্গটির নাম রাখা হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম’।”
প্রশান্তকুমার পাল তাহলে স্বীকার করেছেন, জাহাজের সাহেবদের রসদ জোগাতেন পঞ্চানন কুশারী ও তাঁর কাকা শুকদেব কুশারী। আমার অনুমান, এই সুযোগে ইংরেজি দুচারটে বাক্য শুধু নয়, সাহেবদের থেকে কিছু সাংস্কৃতিক জিনিসও তাঁরা শিখে নিয়েছিলেন। জাহাজের ব্যান্ডবাদকদের সঙ্গেও তাঁদের আলাপ হয়েছিল। জাহাজে সাংগীতিক আমোদপ্রমোদ বা অপেরাধর্মী অনুষ্ঠান হত। ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালির ফ্লোরেন্স নগরে যে অপেরার জন্ম হয়েছিল, পরবর্তীকালে তা সারা ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণের জীবনের উপাদান নিয়ে গান গাইত অপেরার শিল্পীরা, জাহাজেও আসত অপেরাশিল্পী ও ব্যান্ডবাদকরা। কলকাতার প্রথম মানচিত্রকার (১৭৯৪) আপটন সাহেব ছিলেন একজন জাহাজের ব্যান্ডবাদক।
জাহাজের অপেরা থেকেই পঞ্চানন কুশারী পান কবির লড়াইয়ের আইডিয়া। অর্থাৎ কবির লড়াইকে যতই দেশজ উপাদান তথা তরজা, টপ্পা, যাত্রার উত্তরসূরী বলা হোক না কেন, এর পেছনে আছে ইউরোপীয় অপেরাসংগীতের প্রভাব। এর শুরু করেছিলেন পঞ্চানন কুশারী, গোঁজলা গুঁই নয়। আর কী আশ্চর্য, আমাদের যাত্রাদলগুলি নামও অপেরা দিয়ে। তাই যাত্রাও মনে হয় অপেরাগুলি থেকে রসদ সংগ্রহ করেছিল। আর গোঁজলা গুঁইকে কবিগানের স্রষ্টার স্বীকৃতি দেন না তার জন্মস্থান বীরভূমের কবিয়ালরাও। তাঁদের মতে কবিগানের আদিগুরু ত্রয়োদশ শতকের বলহরি রায়। তাই গোঁজলা গুঁইকে কবি ঈশ্বর গুপ্ত কবিগানের স্রষ্টা বললে কী হয়, এই মত সর্বজনগ্রাহ্য নয়।
আমার মতে বলহরি রায় আদিগুরু হলেও কবিগানের নব্যশৈলির রূপকার পঞ্চানন কুশারী তথা পঞ্চানন ঠাকুর। তারপরে আসেন গোঁজলা গুঁই।