রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির দেখেন, কিন্তু পুরীর মন্দিরে প্রবেশ করেন নাই শুনিয়াছিলাম। আর-একজন প্রবেশ করেন নাই পুরীর মন্দিরে— তিনি মহাত্মা গান্ধী।”
রবীন্দ্রনাথ কালান্তর-সংযোজন পর্বে হিন্দুমুসলমান প্রবন্ধে সখেদে লিখেছেন, “হিন্দু দেবতা পর্যন্ত জাত বাঁচিয়ে চলেন, স্বয়ং জগন্নাথ পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শনীয় নন। বৈমাত্র সন্তানও মাতার কোলের অংশ দাবি করতে পারে, — ভারতে বিশ্বমাতার কোলে এত ভাগ কেন।”
রবীন্দ্রনাথ শেষবারের জন্য পুরীতে যাত্রা করেন ১৯ এপ্রিল ১৯৩৯। বলাবাহুল্য জমিদারিসূত্রে পুরীতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বসতবাড়ি ছিল। যা পরে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠাকালে তাঁকে বিক্রি করতে হয়েছিল। উড়িষ্যার নবগঠিত প্রদেশে নতুন শাসনব্যবস্থায় কংগ্রেসের শাসন প্রবর্তিত হয়েছে; কবি কংগ্রেস গভর্নমেন্টের অতিথি। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিশ্বনাথ দাস।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উড়িষ্যার সম্বন্ধ বহুকালের। এমনকি উড়িষ্যায় এক সময় দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারি ছিল। মহর্ষির জীবিতকালে বহু বছর সমস্ত জমিদারি একসঙ্গে ছিল, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এস্টেট তখনও পৃথক হয়নি। সেই অখণ্ড জমিদারি তদারক করবার জন্য রবীন্দ্রনাথকে একাধিকবার পুরীতে আসতে হয়। পুরীতে কবির একটি বাড়ি ছিল; ‘পোড়াবাড়ি’ নামে সেটি পরিচিত। কবি তৈরি বাড়ি কেনেন এবং গগনেন্দ্রনাথরা জমি কিনে ‘পাথারপুরী’ নামে অট্টালিকা নির্মাণ করেন। পরে অর্থের প্রয়োজনে কবিকে ওই বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়।
কবির ৭৯তম জন্মোৎসব পালিত হয় পুরীতে। কবি আছেন সার্কিট হাউসে; এখানে বিহারীলাল গুপ্তের সঙ্গে তিনি আসেন প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। কবি এখানে বসে অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন, ‘মনে পড়ছে এইখানেই এই বাড়িতেই লিখেছিলুম— “হে আদি জননী সিন্ধু, বসুন্ধরা সন্তান আমার”— সমুদ্রে তখন বোধ হয় যৌবনের উদ্দামতা ছিল। তার সঙ্গে ছন্দের পাল্লা দেবার স্পর্ধাতেই আমার এ লেখা।’
আজ কবির বয়স আশির কাছাকাছি, আজ তিনি অনুভব করছেন, “এখনকার লেখায় সেদিনকার মত উদ্বেল প্রাণের অচিন্তিত গতিমত্ততা থাকতেই পারেনা, আছে হয়ত আত্মসমাহিত মনের ফলফলানোর নিগূঢ় আবেগ”।
পুরীতে কবি তিন সপ্তাহ ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁর জন্মদিন পড়ে। সেদিন [৮ মে ১৯৩৯] সার্কিট হাউসে উড়িষ্যার কয়েকটি মহিলা সমিতি সমবেতভাবে কবিকে সংবর্ধনা দেয়। পরদিন গভর্নমেন্ট পার্কে মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বনাথ দাসের উদ্যোগে কবির জন্মোৎসব মহা-আড়ম্বরে উদ্যাপিত হয়। বহু সহস্র লোক উদ্যানে জমায়েত হয়। জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতরা কবির আয়ুবৃদ্ধি কামনা করে সংস্কৃতমন্ত্র ও কবির গুণগান করে প্রশস্তি পাঠ করেন। এছাড়া উড়িষ্যার আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মানপত্র পাঠ করা হয়।
এইদিন চার্লস অ্যান্ড্রুজ় পুরীতে ছিলেন। তিনি কবির জন্মদিন উপলক্ষে একটি কবিতা পাঠ করেন—
Time can add to thy majestic brow
The snow-white radiance of the mountain height.
Thou canst look back on all the past years now
Veiled in the clouds below, white azure light
রবীন্দ্রনাথ সর্বশেষে তাঁর ভাষণ দেন। এই দিনে ‘জন্মদিন’ নামে কবিতা লেখা হয়—
তোমরা রচিলে যারে
নানা অলংকারে
তারে তো চিনি নে আমি,
চেনেন না মোর অন্তর্যামী
তোমাদের স্বাক্ষরিত সেই মোর নামের প্রতিমা।
পুরীতে থাকার সময় জন্মদিন সম্বন্ধে কবিতা ছাড়াও কবি আরও কয়েকটি কবিতা লেখেন। যেমন ‘এপারে ওপারে’ [নবজাতক], ‘অত্যুক্তি’ [সানাই]।
অমিয় চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখেছেন, “কল্যাণীয়েষু, পুরীতে এসেছি, সে খবর পূর্বেই পেয়েছ। উড়িষ্যায় যারা নতুন রাষ্ট্রনায়ক আমি তাদের নিমন্ত্রিত অতিথি। ব্যাপারটার মধ্যে নূতনত্ব আছে। …আমার কোনো কর্ম নেই, এখানে আমাকে কারো কোনোই প্রয়োজন নেই, যাঁরা আমাকে যত্ন করে রেখেছেন তারা আমার কাছ থেকে কোনো ব্যাবসায়িক পরামর্শ দাবী করেন নি। আমার শরীর-মনে সমুদ্রের হাওয়া যে শুশ্রূষাশীতল হাত বুলিয়ে দিচ্চে সেটা নূতন দায়িত্বপ্রাপ্ত উড়িষ্যাপ্রদেশের আতিথ্যের প্রতীক”।
যে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে পুরীর মন্দিরের পুরোহিতরা কবির গুণগান করেন ও সংস্কৃত মন্ত্র পাঠ করেন কবির মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায়, সেই রবীন্দ্রনাথকে পুরীর মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, এটা বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না। আসল সত্যিটা সামনে আসাই দরকার।