এই প্রবন্ধে মানব সংজ্ঞার (চিন্ত চেতনা) সমস্যায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যটা হচ্ছে, “মানব সংজ্ঞা তার সামগ্রিক রূপ নির্ধারণ করে না, বরং, মানুষের সামাজিক সত্ত্বা তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে।” জার্মান ভাবাদর্শে মার্ক্স মানব সংজ্ঞার সমস্যা সংক্রান্ত পূর্ণ বক্তব্য হাজির করে।
“বিষয় টা হচ্ছে, যেসব মানুষ উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন নির্দিষ্ট উপায়ে সক্রিয়, তারা ওই নির্দিষ্ট সামাজিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্কে প্রবেশ করে। গবেষণামূলক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অবশ্যই উৎপাদনের সাথে সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবকাঠামোর সম্পর্ক, প্রত্যেকটা ঘটনা কোন প্রকার অতিপ্রাকৃত বা ফটকা দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিয়ে বাস্তব পরীক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি তে দেখতে হবে। ব্যক্তির জীবন প্রক্রিয়ার দ্বারা সমাজ কাঠামো এবং রাষ্ট্র বিবর্তিত হয়। কিন্তু, এই ব্যক্তি তার নিজের বা অন্যের কল্পনার ব্যক্তি না, বরং বাস্তবের ব্যক্তি; অর্থাৎ তারা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তাদের স্বাধীন ইচ্ছার বাইরেও বাস্তব জগতের নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতা, পূর্বধারণা এবং শর্তের অধীনে সক্রিয়।”
“জ্ঞান, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা প্রথমত মানুষের বাস্তবিক কাজ কাম এবং বাস্তব জগতের সাথে মানুষের সম্পর্কের দ্বারা সৃষ্টি হয়। কোন কিছু গ্রহণ করা, চিন্তা করা, মনোজগতের সাথে মানুষের নিজের সম্পর্ক — বাস্তব দুনিয়ায় মানুষের কার্যকলাপের একটা গতিশীল-পরিবর্তনশীল অবস্থা হিসেবে হাজির হয় মাত্র। একই বিষয় মানুষের রাজনীতি, আইন, নীতি-নৈতিকতা, ধর্ম, অধিবিদ্যার (বাস্তব জগত আর আধ্যাত্মিক জগতের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়া কাজ করে যে দর্শন, সেটা হচ্ছে অধিবিদ্যা) বেলায় মানুষের আচরণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মানুষ তাদের জ্ঞান, চিন্তা-চেতনা প্রভৃতির স্রষ্টা। এই মানুষ হচ্ছে বাস্তব জগতের সক্রিয় মানুষ, যারা উৎপাদন ব্যবস্থা এবং এর সাথে তাদের সম্পর্কের অধীনে বসবাস করে। এজন্য মানব সংজ্ঞা বাস্তবের মানুষের জীবন প্রক্রিয়ার সচেতন অস্তিত্বের চেয়ে বেশি কিছু না। প্রত্যেক মতাদর্শে মানুষ এবং তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে যদি ক্যামেরার মত উলটো দেখি আমরা, তাহলে ক্যামেরার রেটিনায় বস্তুর উলটো প্রতিবিম্ব যেমন তৈরি হয়, ঠিক তেমনি মানুষের মতাদর্শ তার ইতিহাস এবং জীবন প্রক্রিয়া থেকে তৈরি হয়।”
এটা মাথায় রাখা দরকার যে, স্পিনোজা এবং পরবর্তী তে ফ্রয়েড এর মত, মার্ক্সও বিশ্বাস করতো যে মানুষ সজ্ঞানে যেটাকে “মিথ্যা” সংজ্ঞা বলে মনে করে, সেটা তার মতাদর্শ এবং যৌক্তিকতা; মানুষের কাজের মুখ্য উদ্দেশ্য তার কাছে অজানা। ফ্রয়েড এর মতে, (সংজ্ঞা)র শেকড় হচ্ছে মানুষের যৌনতা; মার্ক্স এর মতে, মানুষের সামাজিক অবকাঠামো তার সংজ্ঞার শেকড়, যা তার সংজ্ঞার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয় এবং তাকে প্রকৃত সত্য ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অচেতন করে রাখে।
এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, জ্ঞান বা আদর্শকে তত্ত্ব অবাস্তব বা ক্ষমতাহীন মনে করে না। মার্ক্স সংজ্ঞার কথা বলেছেন, আদর্শের কথা না। মানব সংজ্ঞার অন্ধত্বই তাকে তার সত্যিকার প্রয়োজন এবং আদর্শ সম্পর্কে অচেতন করে রাখে। যদি মিথ্যা সংজ্ঞা কে প্রকৃত সংজ্ঞায় রূপ দেয়া যায়, অর্থাৎ, আমরা যদি জীবনকে যৌক্তিকতা এবং কল্পনায় বিভক্ত করার মাধ্যমে বিকৃত না করে বাস্তবতা সম্পর্কে সংজ্ঞাপ্রাপ্ত হই, আমরাও মানুষের সত্যিকারের চাহিদা সম্পর্কে জানতে পারবো।
মার্ক্স-এর জন্য খোদ বিজ্ঞান এবং মানুষের মাঝে বিদ্যমান সমস্ত ক্ষমতা উৎপাদন ব্যবস্থা আর প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির মধ্যকার সম্পর্কের অংশ। মানব বিবর্তনে জ্ঞান-এর প্রভাবের প্রশ্নেও মার্ক্স কোন ভাবেই উদাসীন ছিলেন না। তার কাজের জনপ্রিয় ব্যাখ্যা থেকে মনে করা হয় যে মার্ক্স এর যুক্তি জ্ঞান এর বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু মার্ক্স এর যুক্তি সেই জ্ঞান এর বিরুদ্ধে ছিল, যেই জ্ঞান মানুষ এবং তার সমাজের বাস্তবতা বিবর্জিত। হেগেলের ভাষায় যা “একটা বাস্তব সম্ভাবনা”। তিনি কখনো ভুলে যান নাই যে কেবল পারিপার্শ্বিক অবস্থাই মানুষ তৈরি করে না, মানুষও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা তৈরি করে। নিচের উদ্দীপকটা পড়লে স্পষ্ট হবে যে, এনলাইটেনমেন্ট এর দার্শনিক আর বর্তমান কালের সমাজ বিজ্ঞানীদের মত মার্ক্স ও মানুষ কে ইতিহাসে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় অবস্থান দিয়েছে — একথা বলা কতটা অবান্তর —
“পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং শিক্ষার পরিবর্তন নিয়ে যে বস্তুবাদী ধারণা আছে (মার্ক্সের ধারণার বিপরীতে), তা ভুলে যায় যে পারিপার্শ্বিক অবস্থা মানুষের দ্বারা পরিবর্তিত হয় এবং একজন শিক্ষকেরও নিজেকে শিক্ষিত হতে হয়। এই ধারণা এজন্য সমাজকে দুটা ভাগে ভাগ করে, যার এক অংশ অপর অংশের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।”
“পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে মানুষের কাজের বা নিজের পরিবর্তনের যে কাকতালীয় মিল, এটা কেবল মাত্র একটা বিপ্লবী অভ্যাস হিসেবে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড়া করানো যায়।”
“বিপ্লবী অভ্যাস”-এর ধারণা আমাদের কে মার্ক্স এর দর্শনের সবচেয়ে বিতর্কিত ধারণা, তথা, ক্ষমতার ধারণায় নিয়ে যায়। প্রথমত, এটা কত অদ্ভুত একটা বিষয় যে, বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে যে সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব — এটা কে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র ঘেন্নার চোখে দেখে! বল প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিপ্লবের ধারণা মার্ক্সবাদী ধারণা না, এটা বুর্জোয়া সমাজের বিগত ৩০০ বছর চলে ধারণ করা একটা ধারণা। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র ইংরেজ, ফরাসি এবং আমেরিকান বিপ্লবের কন্যা মাত্র; ১৯১৭-এর ফেব্রুয়ারির রুশ বিপ্লব এবং ১৯১৮-এর জার্মান বিপ্লবের প্রশংসা পশ্চিমা বিশ্ব করেছে, যদিও সেখানে বল প্রয়োগ ঘটেছিল। এটা স্পষ্ট যে, বল প্রয়োগ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে যে ঘেন্না, এটা মূলতঃ কে বল প্রয়োগ করছে এবং কার বিরুদ্ধে করছে — সেটা নিয়ে ঘেন্না। প্রত্যেকটা যুদ্ধই বল প্রয়োগের ওপর ভিত্তি করে হয়; এমন কি গণতান্ত্রিক সরকারও বল প্রয়োগের ওপর ভিত্তি করে টিকে থাকে, যেই বল প্রয়োগ পরিস্থিতির প্রয়োজনে সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে করে থাকে। বল প্রয়োগের বিরোধিতা কেবল শান্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যথার্থ; যেই দৃষ্টিভঙ্গি হয় বল প্রয়োগ মাত্রই খারাপ বলে মনে করে, অথবা কেবল আত্মরক্ষার ঘটনা বাদে সব ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ খারাপ বলে মনে করে। তারা মনে করে, বল প্রয়োগের ফলে কখনো পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে না।
এটা দেখানো যথেষ্ট না যে মার্ক্স এর বিপ্লবের ধারণা (যেটা সে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় ঘটার সম্ভাবনা বাদ দিয়েছে) মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা ধারণা ছিল; এটায় গুরুত্ব দিতে হবে যে, মার্ক্স এর তত্ত্ব মধ্যবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গির একটা গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন, যার শেকড় ইতিহাসে পাওয়া যায়।
মার্ক্স দেখেছিলেন যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোন প্রকার পরিবর্তন ছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা কিছুই তৈরি করতে পারে না। অতএব, যেই উন্নয়ন ইতোমধ্যে সমাজে কিছুটা ঘটেছে, সেটা কে বল প্রয়োগ একটা শেষ ধাক্কা দিতে পারে মাত্র। কিন্তু এটা কখনো একদম নতুন কিছু তৈরি করতে পারে না। তার মতে, “প্রত্যেক পুরনো সমাজের গর্ভে যখন নতুন সমাজ বড় হতে থাকে, এই নতুন সমাজের জন্য দাই হচ্ছে বলপ্রয়োগ।” এভাবেই মার্ক্স মধ্যবিত্তের ধ্যান ধারণা কে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি বল প্রয়োগের সৃজনী শক্তি (বল প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে মৌলিক কোন কিছু সৃষ্টি করা) তে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন না যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা নতুন সমাজ কাঠামো তৈরি করতে পারবে। এই কারণে, মার্ক্স এর মতে, বল প্রয়োগ-এর একটা ক্ষণস্থায়ী গুরুত্ব আছে, এটি কখনোই সমাজের পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় চিরস্থায়ী কোন উপাদান না।
Source : https://www.marxists.org/archive/fromm/works/1961/man/ch03.htm