মিষ্টির নাম অমৃতকেলী। কেলী অর্থাৎ ক্ষীর। ঘন দুধ, এলাচ, কর্পূর মিশিয়ে তৈরি এ ক্ষীরের স্বাদ অমৃততুল্য… তাই নাম অমৃতকেলী। মিষ্টান্ন নিজুক ও দুধলুচি।হলদিয়ার মিষ্টান্ন “নিজুক” হল বগড়ির দোল খেলার সময় গুড় দিয়ে তৈরি একটি বিশেষ মিষ্টি, যা প্রভুকে শীতল ভোগে দেওয়া হয়।
তমলুক শহরে মহাপ্রভুর মন্দির প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। এখানে মহাপ্রভুকে ৫৬ ভোগ ও দ্বাদশ ব্যঞ্জন দেয়া হয়। যার মধ্যে মোহনভোগ, মাঠা পুলি, রসাবলি, হামসা কেলি, কণিকা, বেসর, মালপোয়া, অবলেহ, বাল্কা, মুরব্বা, মঠরি, ফেনি, পরিষ্ঠ, পুরী, খজলা, চন্দ্রকলা, খুরমা, আরায়া পরিখা, মণ্ডকা, মালাই, বিলসারু, রাবড়ি, শিরা, শিখরণ, গোপালবল্লভ, বটক, শুকনো মিষ্টি ইত্যাদি অন্যতম। মহাপ্রভুর প্রিয় দোলের ঐতিহ্যবাহী খাবার খোঁজ করতে হবে দুই মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের মন্দিরগুলোয়।
মহাপ্রভু দিশাহারা হয়ে চলেছেন বৃন্দাবনের পথে, সঙ্গে চলেছেন নিত্যানন্দ আচার্যরত্ন ও মুকুন্দ। গোপনে বহু পথ চলার পর প্রভু যখন দিশাহারা, তখন নৌকায় চড়িয়ে নিত্যানন্দ নিয়ে এলেন তার বাড়িতে এক মুঠো ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য। চৈতন্যদেব খেতে খুব ভালবাসতেন কিন্তু তার খাওয়া কি রকম ছিল তা জানা যায় বৈষ্ণব সাহিত্যে, মূলত চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনগ্রন্থগুলিতে। শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যখন্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে রয়েছে মহাপ্রভু সেই খাবারদাবারের ফিরিস্তি।
খান বত্রিশেক এঁটে বা বীচি কলা, মাঝে হলুদ ঘিয়ে ভাজা লাল শালী ধানের ভাতের স্তূপ, তার চারিদিকে মুগের ডাল সহ নানান ব্যঞ্জন। রাইমরিচ সহযোগে কুমড়ো পটল বড়ি দিয়ে সুক্ত, লাবড়া, নিমবেগুন ভাজা, কুমড়ো ও মানকচু ভাজা, মিষ্টি ও নারকেল দিয়ে মাখা ছানা, মোচার ঘন্ট, দুধ-চিঁড়ে-কলা, চাটনি, মাষ বড়া, কলার বড়া, টক মিষ্টি চাটনি, পাঁচ-ছ-রকমের পিঠে, নারকেল পুলি, ঘি পায়েস, দগ্ধকুষ্মাণ্ড (দুধে রান্না করা কুমড়ো), দুগ্ধলকলকি (ঘন দুধে চুষি পিঠে), অমৃতগোটিকা। শুক্তো ছিল মহাপ্রভুর পছন্দের খাবার। গুরুভোজনের সময় আমাশয় হলে শুক্তো খেয়ে তার উপসম করতেন।
এছাড়াও থাকতো মাটির হাড়িতে রাখা চাঁপা কলা, দই-সন্দেশ। ভাত ও ব্যঞ্জনের উপর তুলসীমঞ্জরি রাখা হতো এবং পিপাসার জন্য তিন পাত্র সুগন্ধি জল। শোনা যায় ব্যঞ্জন পাত্রর সংখ্যাও ছিল নাকি খান পঞ্চাশেক। প্রাণগৌরাঙ্গ ভোজন করিবেন সে কি কম কথা!
খেতে বড়ই ভালবাসতেন মহাপ্রভু। শোনা যায় নীলাচলে থাকতে তিনি ৫৪ বার দিনে খেতেন এবং এক একবার গ্রাসে তিন জন মানুষের খাবার খেতে পারতেন। অথচ বনে বনে চলার সময় যখন ভিক্ষা করে সামান্য চাল ডাল, বুনো শাক সবজি জুটতো, তাই দিয়েই বড় সন্তুষ্ট হতেন প্রাণগৌরাঙ্গ।
নীলাচলে থাকার সময় গৌড় দেশ থেকে যখন ভক্তরা আসতেন মহাপ্রভুর সঙ্গে দেখা করতে তখন জগন্নাথের স্পেশাল প্রসাদ ‘খাজা’ নিয়ে আসা হতো তাদের মুখ মিষ্টি করাতে। প্রভুর বড় প্রিয় এই খাজা।
নীলাচলে থাকার সময় প্রতি বছর রথের সময় পাণিহাটির শ্রীরাঘব পন্ডিতের বাড়ি থেকে শ্রীচৈতন্যের প্রিয় খাবারগুলি পাঠানো হতো রাঘবের বাড়ি থেকে। তাঁর বাড়ি থেকে যেত বলে এর নাম হয় ‘রাঘবের ঝালি’।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর সঙ্গে রাঘব পণ্ডিতের অন্তরঙ্গতার সম্পর্ক ছিলো। নবদ্বীপে নিমাই পণ্ডিতের টোলে তাঁর বিদ্যার্জন। তাঁরা বংশপরম্পরাক্রমে দেবসেবায় সমর্পিত। তাই শ্রীরাঘব পণ্ডিতের শ্রীপাট বা “রাঘব ভবন” পুণ্যতীর্থস্থান হিসেবে পরিগনিত।
মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণের পর শান্তিপুর আসলে রাঘব পন্ডিত তাঁকে দর্শন করতে ছুটে আসেন। মহাপ্রভু রাঘবকে বলেছিলেন, “তোমার শুদ্ধ প্রেমের প্রভাবে আমি তোমার বশীভূত।”
রাঘব পন্ডিতও ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের প্রেমে প্রেমময়। তাই তার বাড়ি থেকে মহাপ্রভুর জন্য গৌড় দেশ থেকে নীলাচলে নিয়ে যাওয়া হত নানা রকম খাদ্যবস্তুর সম্ভার। এবং এই পরম্পরা আজও বর্তমান।এখন শুধু পাণিহাটি বা গৌড়দেশ নয়, বহু জায়গা থেকে ভক্তগণ রাঘবের ঝালি সমর্পণ করে।
‘রাঘবের ঝালি সমর্পণ’ কারার গুরুদায়িত্বটি অতি বাৎসল্যভরে সারাবছর ধরে করতেন রাঘবের ভগ্নী দময়ন্তীদেবী। সেই আমলে ফ্রিজ ছিল না অথচ কত সুনিপুণভাবে সারাবছর ধরে দ্রব্যাদি মনের মাধুরী দিয়ে ভগবৎ সেবার জন্য গুছিয়ে রাখতেন। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী দময়ন্তীদেবীর প্রস্তুতকৃত দ্রব্যসামগ্রীর বর্ণনা দিয়েছেন। আমরা সংক্ষেপে তা আস্বাদন করব।
রাঘবের ঝালিতে ছিল আম-কাসন্দি, আদা-কাসন্দি, ঝাল-কাসন্দি, নেম্বু-আদা,আম্রকলি আমসি, আমখন্ড, তৈলাম্র ও আমসত্ব, পুরনো পাটপাতা চূর্ণ (আমাশা দূরীকরনের জন্য) শুকনো কুল, কুলের আচার, আদার আচার সঙ্গে আদা কাসুন্দি, শুকনো কুল।
বহু যত্নে দময়ন্তীদেবী সুকুতার তিত সবজী শুখিয়ে গুড়ো করে দিতেন।
সুকুতা বলি অবজ্ঞা না করিহ চিত্তে।
সুকুতায় যে সুখ প্রভুর, তাহা নহে পঞ্চামৃতে।।
(চৈঃ চঃ অঃ ১০/১৭)
ভাবগ্রাহী মহাপ্রভু কেবল স্নেহমাত্রই গ্রহণ করেন। সুকুতাপাতা, কাসন্দি ইত্যাদি সাধারণ খাবার খেয়ে তিনি মহাসুখ পেতেন।
স্নেহের বশে দময়ন্তীদেবী ভেবে নিয়েছিলেন,অধিক আহারে প্রভুর উদরে আম হলে সুকুতায় তা নাশ হবে।এই স্নেহের কথা ভেবে মহাপ্রভু অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন।
ধনে ও মৌরী গুড়া চিনিতে পাক করে নাড়ু তৈরী করে দিতেন। আম পিত্ত নাশকারী শুষ্ক আদার নাড়ু বানিয়ে আলাদা কাপড়ের থলিতে বেঁধে দিতেন। এছাড়াও থাকতো গুড়ের নাড়ু, শালীধানের ভাজা চিঁড়ে, কথক চিঁড়ে, ঘিয়ে ভাজা ফুটকলাইযের নাড়ু, খইয়ের নাড়ু প্রভৃতি নানা প্রকার জিভে জলা আনা খাবার।
রাঘব পণ্ডিত আদেশ করেছেন আর দময়ন্তীদেবী তা তৈরী করেছেন। দুজনেই ছিলেন মহাপ্রভুর পরমভক্ত।
গঙ্গামাটি শুকিয়ে গুঁড়ো করে কাপড়ে ছেঁকে,তাতে গন্ধদ্রব্য মিশিয়ে “পাঁপড়ি” (ছোট ছোট গুলি) করে দিয়েছেন প্রভুর হাত ধোয়ার জন্য।সব খাবার এত সুন্দর করে গুছিয়ে বেঁধে ঝালিতে দিতেন যা শুধু প্রেমভক্তির প্রকাশ পায়।
রাঘবের ঝালির সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীধর পন্ডিতের থোড় মোচার ঝালির কথা না বললেই নয়। প্রভুর বড় প্রিয় ছিল এই খাবার। প্রভুর প্রিয় খাবারের মধ্যে ছিল নারকেল ছোলা দিয়ে মোচার ঘন্ট, কচুর শাক, ডালের বড়া, তালের বড়া, রসবড়া। গরমকালে দই আদা লঙ্কা কুচি দিয়ে ঠান্ডা ভাত মেখে খেতেন।
১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে যখন মহাপ্রভু নীলাচল থেকে গৌড় দেশে এলেন, সেই খবর পেয়ে নবদ্বীপ থেকে ছুটে এলেন শচীমাতা স্নেহের পুত্রকে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াবেন বলে। শান্তিপুরে থাকার সময় রান্নার দায়িত্ব নিজেই নিলেন রন্ধন পটিয়সী মাতা।
শচীমায়ের নিমাই তখন চৈতন্য। নানা ব্যঞ্জনের সঙ্গে বানালেন কুড়ি রকমের শাক। পুত্র যে ভীষণ ভালোবাসে শাক খেতে। মহাপ্রভুর আনন্দ আর ধরেনা মায়ের হাতে রান্না খাবেন বলে, এত রকমের শাক দেখে মহা আমোদিয়া নাথ বেশ রসিকতাও শুরু করে দিলেন। নানা রসিকতার মধ্যে তিনি শিষ্যদের বলেছিলেন কোন শাকের কত গুণ। যেমন মহাপ্রভু বললেন, ‘এই যে শালীঞ্চা হেলেঞ্চা শাক,… এ খেলে দেহ যেমন রক্ষা হয়, তেমনি কৃষ্ণভক্তি হয়, রাধারানীর করুণা মেলে।’
শান্তিপুরনাথ অদ্বৈত আচার্য, নীলাচলের রাজপন্ডিত, সার্বভৌম ভট্টাচার্য ,পানিহাটি রাঘব পন্ডিত যখন মহাপ্রভুর জন্য ভোজন সামগ্রি সাজাতেন, তখন তাতে থাকত চৈতন্যদেবের সবধরণের প্রিয় পদ।
মহাপ্রভু ভোজন করিবেন সে কি কম কথা! আর তাইতো তার সেই ভোজনকে সম্মান জানাতে রচিত হয়েছে ভোগ আরতির গান।
“…শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু কর অবধান।
ভোগ মন্দিরে প্রভু করহ পয়ান॥
বামেতে অদ্বৈত প্রভু দক্ষিণে নিতাই।
মধ্যাসনে বসিলেন চৈতন্য গোসাঞি॥
চৌষট্টি মহান্ত আর দ্বাদশ গোপাল।
ছয় চক্রবর্ত্তী আর অষ্ট কবিরাজ॥
ভোজনের দ্রব্য যত রাখি সারি সারি।
তাহার উপরে দিলা তুলসী মঞ্জরী॥
শাক সুকুতা নানা উপহার।
আনন্দে ভোজন করেন শচীর কুমার॥
দধি দুগ্ধ ঘৃত ছানা আর লুচি পুরী।
আনন্দে ভোজন করেন নদীয়া বিহারী॥
ভোজন করিয়া প্রভু কৈলা আচমন।
সুবর্ণ খড়িকায় কৈলা দন্তের শোধন॥
বসিতে আসন দিল রত্ন সিংহাসনে।
কর্পূর তাম্বুল যোগায় প্রিয় ভক্তগণে॥…”
কত না খাবারের হদিস পাওয়া যায় বৈষ্ণব ইতিহাসে যা পড়ে বাস্তবেই পাঠকের মন বলে ওঠে ‘আহা’ !!
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, শ্রীশ্রীবন্ধুকুঞ্জ বারাসাত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি।
Opurbo
রীতিমতো অবাক হলাম খাবারের list দেখে 😝😂😜
আমরা মাঝে মধ্যে নবদ্বীপে হরিসবা মন্দিরে কিছু কিছু পদ খেয়েছি।
অনেক পদের নাম কোনো দিন শুনিনি।
কিছু কিছু খাবার বাড়িতে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করা যেতে পারে।
খুবই সুন্দর হয়েছে লেখা।