বুধবার | ৩রা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:১১
Logo
এই মুহূর্তে ::
সুলেখা সান্ন্যাল-এর ছোটগল্প ‘ঘেন্না’ সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (শেষ পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী শোভারাম বসাকের লবণের ব্যবসা : অসিত দাস রাখাইনে সংঘাত ও সেন্টমার্টিন পরিস্থিতি : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন খেলার মাঠ থেকে চেম্বারে : রিঙ্কি সামন্ত ছড়া কি শিশুসাহিত্য? : লুৎফর রহমান রিটন কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা দিবস ও ডা: বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মজয়ন্তী পালন : দীপাঞ্জন দে সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (তৃতীয় পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (শেষ পর্ব) : গীতা দাস সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (দ্বিতীয় পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (চতুর্থ পর্ব) : গীতা দাস সাবঅলটার্ন দৃষ্টিতে কলকাতার লবণচিহ্ন : অসিত দাস মোদীকে চাপে রাখতে নীতীশ-নায়ডুর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা দাবি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (প্রথম পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বাঁধে ইঁদুরের তৈরি গর্ত দিয়ে ঢোকে বন্যার জল চলছে সংস্কারের কাজ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (তৃতীয় পর্ব) : গীতা দাস কবি সঞ্জীব প্রামাণিক, আবহমান বাংলা কবিতার পথে হেঁটে-যাওয়া এক কবিতাভিক্ষুক : অমৃতাভ দে সৌমেন দেবনাথ-এর ছোটগল্প ‘বিলাসী’ বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (দ্বিতীয় পর্ব) : গীতা দাস সাত্যকি হালদার-এর ‘ছোটগল্প’ কাজলদিঘি ডায়েটে আনতে হবে কয়েক টুকরো নারকেল তাহলেই কেল্লাফতে : রিঙ্কি সামন্ত বাতাসে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে বাঁশগাছের কদর বাড়ছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (প্রথম পর্ব) : গীতা দাস স্পিকার নির্বাচন থেকেই শুরু হল সেয়ানে সেয়ানে টক্কর : তপন মল্লিক চৌধুরী বাসুলী লবণের দেবী (দ্বিতীয় পর্ব) : অসিত দাস শক্তিপদ রাজগুরু-র ছোটগল্প ‘পাখিরা আর নেই’ বিস্মৃত কথাসাহিত্যিক সুলেখা সান্যাল : আনিসুর রহমান ময়মনসিংহের গৌরব কেদারনাথ মজুমদার (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার লেডি ম্যাকবেথ, ওয়াটার আঙ্কেল ও আমি : সসীমকুমার বাড়ৈ জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা শিক্ষার জনক : মনোজিৎকুমার দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কবি সঞ্জীব প্রামাণিক, আবহমান বাংলা কবিতার পথে হেঁটে-যাওয়া এক কবিতাভিক্ষুক : অমৃতাভ দে

অমৃতাভ দে / ৮৯ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪

আবহমান বাংলা কবিতার পথে হেঁটে চল আছো তুমি

হে কবিতাভিক্ষুক আজও তোমাকে খুঁজে বেড়াই আমি

পাতার মর্মরে, বৃষ্টির শব্দে, পাখির কলতানে, নদীর ছন্দে তোমার অক্ষর ফুটে ওঠে

কালকেতু ও ফুল্লরা এসে কথা বলে আমাদের সাথে… ভালো লাগে ব্যাধজীবন

ছায়াঘেরা পথের ধারে ভিক্ষাপাত্র হাতে আজও বসে থাকে অন্ধ দীননাথ

তোমার মতো আমারও মনে হয় ইছামতী কোন নদী নয়- সে অশ্রুতরঙ্গ…

যশোর রোড হয়ে ওঠে ছায়া, গাছেরা হয়ে ওঠে ইতিহাস

তোমার মতো আমিও সারা গায়ে বৃষ্টিরেণু মাখি মনে হয় স্বর্গের আলো,গান আমাকেও ঘিরে বড় হয়।

চলো কবি, পৃথিবীর প্রান্তে একটা ঘর বানিয়ে তুলি- যেখানে অসীম এসে সীমার মধ্যে দাঁড়ায়।

তুমি তো আমার কাছে সেই দরবেশ, যার পায়ের ধুলো আসলে ক্ষমা, পথশ্রম ত্যাগ।

তুমি তো প্রেমিক পুরুষ, জীবনের ভাস্কর

কবিতার পঙক্তিগুলো নিকোনো উঠোনে গাঁদা, জবা, চাঁপা ফুলের মতো ঝরে পড়ে।

যখন বাড়ির উঠোনে চাঁদ খেলা করে, ফুটে ওঠে স্বর্ণকমল, বাড়ি জুড়ে লতা-পাতা আলপনা আঁকা হয় তখন সীতা উঠে আসে কবিতার পাতায়।

বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে বহুদিন

ভুলে যেতে ইচ্ছে করে অসুখের কথা

আমাদের মন খারাপের বিকেলগুলোতে

তোমার কবিতা ঝরিয়ে দেয় বৃষ্টি… বকুলের মতো।

মৃত্যু যে এত শ্যামল তা তো জানা ছিল না আমাদের… তিনি তো দেবী যার সাথে আমরা শুরু করি এক নতুন সংসার।

ভয় ও দৈবের দেশে আজও খুঁজে ফিরি লঙ্গরখানা কিংবা কামার বেদিনি ধোপা কিংবা জেলে…

অথবা খুঁজি জ্যোৎস্নার মতো প্রেম…

আমার প্রাণের কবি,আমার বড্ড প্রিয় সঞ্জীব প্রামাণিকের মৃত্যুর পর এই কবিতা লিখেছিলাম। শুধুমাত্র বাংলা কবিতাকে ভালোবেসে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন এই মানুষটি। শিক্ষক হিসেবে বাংলা সাহিত্যের পাঠ দেওয়ার ফাঁকে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে যিনি তুলে ধরতেন আবহমান বাংলা কবিতা — তিনি কবি সঞ্জীব প্রামাণিক। সেই স্কুল জীবনে শুনিয়েছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী,উৎপলকুমার বসু, মণীন্দ্র গুপ্ত, দেবারতি মিত্র, কালীকৃষ্ণ গুহ, দেবদাস আচার্য,নির্মল হালদার,শ্যামলকান্তি দাশ, মৃদুল দাশগুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, রণজিৎ দাশ, শম্ভু রক্ষিত,পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল প্রমুখের কবিতা।বিভিন্ন দশকের শক্তিমান কবিদের কবিতা মুখস্থ থাকত তাঁর, অনর্গল বলে যেতেন ঘন্টার পর ঘন্টা অসংখ্য কবিতা। সারাবাংলার লিটল ম্যাগাজিন এবং লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল স্বচ্ছ। খোঁজ রাখতেন বিভিন্ন জেলার প্রান্তিক কবিদের। হঠাৎ করেই চলে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়া এক অসীম শূন্যতা।

কী নিয়ে বাঁচব আমি? লোহা-লক্কড়ের দেশে আমি আজ/ কোথায় দাঁড়াব?

প্রাসাদ দুর্গগুলোকে সরিয়ে দিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন গাছেদের মুখ, মাটি দিয়ে বোজানো পুকুরের বদলে যিনি দেখতে চেয়েছিলেন টলটলে জল, সবুজ পানা, মাছেদের হৃৎচঞ্চল, চিমনির ধোঁয়া না দেখে যিনি দেখতে চেয়েছিলেন নীল আকাশ, সূর্যোদয়, শূন্যজুড়ে অবনঠাকুর, ইটের স্তূপ, পিচরাস্তা- এসবের বদলে যিনি দেখতে চেয়েছিলেন ঘুমানো কাশফুল, তিনি চলে গেছেন এক শ্যামল মৃত্যুর দেশে। তাঁর কবিতা আমার কাছে এক আলোকিত ভোর। তিনি আমার জন্য পৃথিবীর প্রান্তে নির্মাণ করেন এক ঘর, গাছে গাছে ঝুলে থাকে আলোর জোনাকি। জীবনের কত না রঙ, রূপ তাঁর কবিতায়। সহজ ভাষায়, সহজ ছন্দে জীবনের কথা লিখে চলেন তিনি। আমার ভিতর লুকিয়ে থাকা বিড়ালকে আমি যেন দেখতে পাই, যার চোখ লোভে চকচক করছে, আমার অতৃপ্ত আত্মা যেন সেই বিড়াল। দাঁত, থাবা, লোভ নিয়ে জেগে ওঠে আমার ভেতরে এক রোমশ বিড়াল। কার কবিতা আমার স্বপ্নে এভাবেই মেঘ নিয়ে আসে। ভেসে ওঠে ডিঙি নৌকো, পদ্মা তীরের গ্রাম ইলশেগুঁড়ি। তাঁর কবিতা পড়লে কখনোই মৃত্যুর কথা মনে হবে না, মনে হবে বেঁচে থাকি আরো অনেক অনেক দিন। যতদিন গোধূলি এসে দরজায় না দাঁড়ায় ততদিন ধুলো থেকে অন্ন খুঁজে যেতে হবে, খুব জোরে বাতাস নিতে হবে আর অপেক্ষা করতে হবে। দিগন্তের কোথাও হয়তো আছে সেই নদী- মৃত্যু দিনের নদী, সেই নদীতো পার হতেই হবে আমাদের। অথচ শিবের মতোই এই শেষ সম্বল ভস্ম মেখে সন্তানস্নেহ নিয়ে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে আমাদের। যিনি আমাদের বাঁচবার ইচ্ছেকে এইভাবেই জাগিয়ে রাখেন তিনি কবি সঞ্জীব প্রামাণিক।

বাংলা কবিতার পাঠ নিয়েছিলাম যাঁর কাছ থেকে,আমার অত্যন্ত কাছের এই মানুষটির চলে যাওয়া আমার কাছে এক অপূরণীয় ক্ষতি। জলঙ্গী নদীর তীরে অনেক দিনের পুরনো একটা বাড়ি, বাড়ির দোতলার উপর একটি চিলেকোঠা, সেই চিলেকোঠায় বসে একের পর এক কবিতা শুনতে থাকা। বাইরে প্রবল ঝড়বৃষ্টি, উত্তাল নদীর জল — আমরা পরিকল্পনা করে ফেললাম একটি পত্রিকার। তখন আমি দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। ‘জীবনকুচি’ পত্রিকা প্রকাশ পেল সঞ্জীব কাকুর অনুপ্রেরণায়। বৃষ্টির ভিতর যিনি মশাল জ্বালাতে চেয়েছিলেন, সেই কবি তো পারেন আমাদের ভেতরে থাকা অগ্নিস্ফুলিঙ্গগুলোকে জ্বালিয়ে দিতে। অনেকটা পথ একসাথে কেটেছে, পত্রিকার জন্য লিখেছেন অনেকগুলি গদ্য-প্রবন্ধ, লিখেছেন অনেক কবিতা। আমার আত্মার আত্মীয় যেন সঞ্জীব প্রামাণিক ও তাঁর কবিতা। মনে পড়ে যাচ্ছে ‘রূপকথা’ কবিতার প্রথম চারটি লাইন —

“আমরা দুজন মরুদেশে দুটি প্রাণ

আমি পোড়া-গাছ তুই নিজে কচি তৃণ

শোকতাপমাখা কিন্নর কিন্নরী

আমরা দু’জন নিজেরাই রূপকথা।”

কবিতার বাগানে কবি সঞ্জীব যেন এক মালী। নিজের রচনা তাঁর কাছে এক টুকরো জমির মতো। জল, রোদ, আলো, বাতাস সব তাঁর। জল তাঁর ক্ষরণ। আলো তাঁর দ্যুতি, বাতাস তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাস। এক টুকরো জমিতে কবি সঞ্জীব লাগান টগর জবা জুঁই মালতীলতা। টগর গাছে ধবধবে ভোর উড়ে এসে বসে। সেই বাগানে বসে তিনি পাহারা দেন। তাঁর মনে হয় একটি ভ্রমর যখন তার কাঁধে এসে বসে সে অন্ধ, সেই ভ্রমরের মতো তাঁরও মুক্তি নেই। কিন্তু কবি সঞ্জীব হয়তো কোনদিনই মুক্তি চাননি। জীবনকে ভালোবাসতেন, জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা কবিতার কথামালাকে নিজের মনের ভিতর রেখে দিতেন সংগোপনে আর যখন তাঁর মনে হতো এই চারপাশ বেঁচে থাকার জন্য বড়ো প্রতিকূল তখন বাংলা কবিতার উজ্জ্বল অক্ষরগুলোকে তিনি ছড়িয়ে দিতেন আমাদের মননে আমাদের চেতনায় আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া আত্মার গভীরে। আর তখনই তাঁর মতো আমাদেরও বলতে ইচ্ছে করে —

“এক জন্মে আমার স্বাদ মেটে না

ইচ্ছে করে বারবার জন্মাই

বারবার তোমার বাগান আলো করে ফুটি”

কবি দেবদাস আচার্যের কথার সূত্র ধরে বলতে ইচ্ছে করছে,”প্রাণের কথা জীবনের কথা বলতে সঞ্জীবের অসুবিধা হয়নি। বরং বলা যায় — জীবনের সত্যের নিরিখেই এসব দেখেছে সঞ্জীব। আর এখানেই সঞ্জীব কবি।অন্য একটি লেখায় আমি লিখেছিলাম —

“কবির ভেতরে ভূত হয়ে ঢুকতে চেয়েছিলেন সঞ্জীব। কবির মাথায় আগুন জ্বালিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। আসলে ভিক্ষুক-কবি মাধুকরী করে ঘুরে ঘুরে নদীতীরে বনের ভেতরে, গঞ্জে, মেঘলা আকাশে খোঁজেন শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা- রূপক-বাক্য-সঞ্জীবকাকু ভূতের মতোই কবির ভিতরে ঢুকে মাতালের মতোই কবিকে নেশায় উড়ান। কবিরা এমনই হন- জীবনে মুক্তি পান না তাঁরা। আমাদের প্রিয় মানুষটি আজও আমাদের ভিতর ভূত হয়ে রয়ে যাবেন, ছুটিয়ে নিয়ে যাবেন কবিতার কাছে, প্রকৃতির কাছে, অজানা কোন শব্দ-সমুদ্রের কাছে। বন্ধ গর্ভগৃহে যে বীজগুলো রেখে গেলেন, নতুন বীজের মতো জলতল থেকে সেগুলিই শস্য নিশান ওড়াবে।”

তাঁর ‘অন্ধযাত্রার পথ’ কাব্যগ্রন্থের ব্লার্বে লেখা আছে — ‘অন্ধকার শব্দের বহুমাত্রিকতা এবং অনালোকিত এক জগতের মায়া ও আলো এসে পড়েছে কাব্যের পাতায় পাতায় বিষয় গৌরব এবং নান্দনিকতায় পূর্ণ কাব্যগ্রন্থটি অন্য এক আলোর সংকেত।’ সত্যিই এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি যেন কাগজকুচির নৌকা হয়ে স্বপ্নের ফসল নিয়ে মঙ্গলদীপের মত ভেসে যায় আমাদের মনের গহনে।তাঁর মতো আমিও দেখি ফুলের শোভা, শুনি শিশুর হাসি, ঘাতককে বলি নামাও ছুরি, দেখি সূর্য ওঠে, জীবনকে রেখে দেই ঊর্ধ্বে আকাশ সীমায় সব যদি মিথ্যে হয় তাহলে ঘড়ির কাঁটা কে দিয়ে থামিয়ে। তাঁর মতো আমারও ইচ্ছে করে নির্ভার হয়ে চলতে বনে শাখা-প্রশাখায় জলের কলকল্লোলে, ফুলে মধু রেখে যেতে ইচ্ছে করে, বাতাসের মতো থাকতে ইচ্ছে করে, শুনতে ইচ্ছে করে আনন্দ গান, তাইতো তাঁর মতো আমি উচ্চারণ করি —

“যদি থামি কোনদিন

যদি থেমে যায় শ্বাস

তবু ফিরে ফিরে পাই

গতি চির বহমান।”

কাব্যগ্রন্থ জুড়ে মৃত্যুর কত না ভাষ্য। অন্ধকার থেকে উড়ে আসে কাক। তার যাত্রা আরো আরো অন্ধকারের দিকে, সে যেন দূত — অন্ধকারের, মৃত্যুর। পৃথিবীর সমস্ত ট্রেন এসে যেখানে থামে সেখানেই অনন্তের শুরু, সেখানে যে সব যাত্রী নামে তারা সব অন্ধকার। মৃত্যুর কী অপরূপ ছবি তার কবিতায় ধরা দেয়। অথচ কবি অপেক্ষা করেন নতুন কবিতার জন্য, সে আসবে অন্ধকার পেরিয়ে,যে-অন্ধকার মিথ্যা এক অহং। আমাদের মিথ্যার উপর বসে সে পাখা ঝাপটায়, যতক্ষণ না সত্য ও চিরায়ত আসবে। আর তাই বোধহয় কেকার ধ্বনির মধ্যে চিরদিন থেকে যেতে চান।লেখেন কৃষ্ণকান্তর বিধবা বৌয়ের কথা। হরিদাস মাধুরী করতে বেরোয়। গৃহিণীরা তাকে গড় ক’রে দু’এক মুঠো তণ্ডুল দেয়। খুব ভোরে যখন রাই জাগো রাই জাগো সুরে এ গান ধরে তখন থেকেই জেগে বসে থাকে কৃষ্ণকান্তের বিধবা। ভাবে মুষ্টিভিক্ষার অছিলায় যদি একবার দরজায় আসে হরিদাস। হরিদাসের বুকের ভেতরেও ব্যথা করে। সে ব্যথার নাম দেন কবি ‘কৃষ্ণকান্তর বিধবা’ আর তার মাধুকরী পথের ছলনা শুধু। রাতে অন্ধকারে কৃষ্ণকান্তের বউয়ের ঘুমের ভেতর খঞ্জনি বেজে ওঠে।

অন্ধকারের মধ্যে সত্যিই তো কত না আলোর সংকেত।পোড়ো বাড়িকে আজও পাহারা দেয় অন্ধকার। দিনের আলো ফোটার আগেই সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু মাঝরাতে বাড়িটি প্রাণ পায়। সিঁড়িতে কত যুগ আগে মরে-হেজে যাওয়া গৃহিণীর পদশব্দ। পুরনো খাটে বাতাস শুয়ে থাকে, ছেঁড়া জামাকাপড় নিয়ে খেলা করে। অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমরা তুলে নিই টুকরো টুকরো আলোর পংক্তিমালা। তাঁর কাছে একটা বাড়ি কিংবা সেই বাড়ির ভিতরে ঘুরে বেড়ানো এক বৃদ্ধা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষ। বাড়িটার জানলা দরজা কোন দিকে কেউ জানে না অথচ সূর্য ওঠে, সূর্য অস্ত যায়, এক সময় রাত নামে। শুধু মা বলে ডাকতে গিয়েই কবি দেখেন ধূলিবসন এক বৃদ্ধা, হাতে লাঠি, লোলচর্ম খড়ি-ওঠা হাত -পা, ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

চন্ডীমঙ্গলের পাঠ নিয়েছি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে কিন্তু কখনো তো কালকেতুকে তারা এইভাবে ভাবেন নি কিংবা আমিও তো এভাবে ভেবে দেখি নি। সঞ্জীব প্রামাণিক তাঁর কবিতায় যেভাবে তুলে আনেন চন্ডীমঙ্গল’-এর নায়ককে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। কবিকঙ্কণের পাতা ছেড়ে কালকেতু কোনও এক ভোরে পথে নেমে বুঝে যায় কোথাও জঙ্গল নেই, যত ইট-কাঠ-পাথর- সিমেন্ট ভরা শহরে, নগরে অন্ধ গলি, বাজার, শপিংমল, পণ্যবীথিকাযই নতুন জঙ্গল আর কত শত শিকারের দেখা মিলে যাবে। নিজের অভ্যাস মতো প্রতিদিন সে খোঁজে স্বর্ণগোধিকার বেশে যদি পাওয়া যায় কোনও দেবী। মনের ছিলায় বেঁধে গোধূলির আগে তাকে ঘরে এনে রেখে দেবে। ফুল্লরা তাকে শোনাবে বারোমাস্যা।এই পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল। আমরা যেন চন্ডীমঙ্গলের সেই কালকেতু আর ফুল্লরাকে আধুনিক বাস্তবতায় দেখতে পেলাম। তারপর কবি লিখছেন-

“কালকেতু তাড়াবেনা, শুধু তাকে দালালের হাতে তুলে দিয়ে আবার ছিলায় বেঁধে

নেবে বলে শহরের কানাগলি, শপিংমল পণ্যবীথিকায়

ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হবে—গোধূলি মাথায় করে

ফিরে এসে পরদিন ভোরে আবার জঙ্গলে যাবে।”

কলাকৈবল্যবাদে বিশ্বাসী কবির কাছে কবিতা আলোর সংকেতের মতো দূরগামী। আর তাই বোধহয় সঞ্জীবের ‘জীবনযাপন’ হয়ে ওঠে আলোর সংকেত। দক্ষিণ দেশে কাজে যাওয়া মানুষটি নিড়িনি চালায় শস্যে — সবখানে দেখতে পায় সোনা,অনুদের মুখ — যারা তিনমাস গেঁড়ি-গুগলি খোঁজে, খোঁজে পানিফল। দক্ষিণদেশে বসে মানুষটি নিজেকে ক্রীতদাস ভাবে, আলের উপরে বসে ধোঁয়া টানে। তিন মাস শেষ হলে ঘরে ফিরবে সে, জ্বলবে উনুন, হবে গরম ভাত — গ্রামের পথে ওরা সবাই দেব,দেবী, দেবশিশুদের মতো বেড়াতে যাবে।

‘ভয় ও দৈবের দেশে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো যেকোনো তরুণ কবির কাছে হয়ে উঠবে পথপ্রদর্শক। এই কাব্যটি সম্পর্কে কবি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন — “কাব্যটি Theametic বা বিষয়নির্ভর নয়। অধিকাংশ মানুষের জীবন এক অর্থে অদৃষ্টজড়িত।সে অশুভ সময়কে ভয় পায় — তার পারিপার্শ্বিকতা, সমাজ, দারিদ্রলাঞ্ছিত জীবন,প্রাত্যহিক কর্ম — সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের ভয় কাজ করে চলে। তাই শবের বদলে চণ্ডালের শ্মশানে শুয়ে থাকা, ভোরের আলো-কে বিধবার সাদা থান ভাবা, মাসিপিসিদের মতো মুখ করে মৃত্যুর বসে থাকা, ইলিশ শিকারের সঙ্গে ইলিশের দৈব, অর্থাৎ জল,নৌকো ও গলুই-এর মিশে যাওয়া, তবলার পাশে বাঁয়া-র গৌণ হয়ে বেঁচে থাকা, নিয়তিতাড়িত ধোপার গাধার অন্ধকারে ময়লা পোশাক নিয়ে গঙ্গার দিকে যাত্রা — এসব কিছুর মধ্যেই দৈব এবং ভয় সম্পৃক্ত।” দৈব ও ভয় কীভাবে সম্পৃক্ত — তাই লিখে ফেলেন কবি। সনেটের আকারে লেখা ‘বেদিনী’ পর্যায়ের চারটি কবিতায় ‘এক ধরনের কুহক আছে।’ “বেদিনী,তার সাপ ধরা, সাপের বিষ — সবই প্রতীক।” বেদিনী তাঁর চোখে এক আশ্চর্য পালক, এক জলাশয় দ্রাক্ষাক্ষেত,বিষভরা মধু। আর কবি ‘পতঙ্গপ্রাণ’

কবি তাই বলেন —

“তোমার স্বপ্নের জলে সাপ দোলে প্রতি স্রোতে স্রোতে —

আমাকে নির্বিষ করে তুমিই প্রকৃত বিষধারী”

‘ফুল্লরা’, ‘মাছ’, ‘ধোপা’, ‘বায়া’ নামের কবিতাগুলি গভীর জীবনবোধের কবিতা। ‘বায়া’ কবিতাটিতে লিখেছেন —

“সমস্ত জীবন ধরে এই বেঁচে থাকা তোমার নিয়তি

তুমি বাজো; তোমার ভূমিকা তবু কবির ছায়ার মতো।”

মৃত্যুর দেশে সবই তো ছায়া। মেঘে ঘুমপাড়ানোর ছলে মাসিপিসিদের মতো মুখ করে মৃত্যু বসে থাকে। অদ্ভুত শীতল সঞ্জীবের কবিতার ভাষা। অন্ধের চেয়েও অন্ধ তার পথ।অন্ধ মানুষটির লাঠিটির গায়ে যেন আঁকা আছে একটি চোখ। লাঠি তো অন্ধের কাছে আলো।লাঠির গায়ে আঁকা সেই চোখ সূর্যোদয়ের মতোই পথে ছড়িয়ে পড়ে। ‘ধোপা’ কবিতাটি প্রসঙ্গে কবি দেবজ্যোতি রায় লিখেছেন — “প্রান্তিক জীবন আবহমানের রূপক হয়ে উঠছে। মাত্র পাঁচ লাইনের পরিমিতিতে ধোপার শ্রমনির্ভর জীবনের বিপন্নতা,দুস্থতা সাবঅলটার্ন ইতিহাসের দলিল হয়ে উঠছে। তবু স্বপ্ন মৃত্যুহীন। যে কাপড়গুলো কাচার জন্য ধোপার অনন্ত অপেক্ষা,সেগুলোর বরাত ধোপা পেল না। অর্থ উপার্জন হল না। কিন্তু না-কাচা পরিচ্ছদগুলি তার অর্থ মনের মধ্যে লালিত হচ্ছে, আকাশে সাদা খণ্ডমেঘ হয়ে উড়ছে। তার মধ্যে গাধার ডাকে ক্ষতচিহ্ন আরও গাঢ় হচ্ছে” —

“অজস্র আত্মাকে তুমি বয়ে নিয়ে কোথায় চলেছ?

চারপাশ অন্ধকার; যোজন যোজন দূরে গঙ্গা বহমান

তুমি ও তোমার গাধা নিয়তি-তাড়িত।

 

ক্রমে অন্ধকার কাটে—- গাধার অবাক ডাকে ভোর নামে

ধোপার আকাশে ওড়ে সাদামেঘ, পরিচ্ছদগুলি।”

কবি দেবদাস আচার্য সঞ্জীব প্রামাণিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভয় ও দৈবের দেশ’-এর বেশ কিছু কবিতা নিয়ে অসামান্য আলোচনা করেছিলেন। এই কাব্যগ্রন্থ সঞ্জীব প্রামাণিক সেই ‘অদ্ভুত’ কবিতাটি আছে,নাম ‘চণ্ডাল’। কবি দেবদাস লিখছেন “সেই দারিদ্র্য! সেই অন্নকষ্ট! কিন্তু কী তার অভিনব প্রকাশ! চণ্ডালের সংসারে অনটন। শ্মশানে চিতা সাজিয়ে বসে আছে চণ্ডাল।শব নেই। তাই অর্থাগম নেই। তাই নিরন্ন। একসময় এই হতাশা থেকে চণ্ডাল নিজেই শব সেজে শূন্য চিতায় শুয়ে পড়ে। এতে কী কী ঘটে? এ দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে স্বয়ং গঙ্গা গতি পাল্টে কয়েকজন দূরে সরে যায়। মড়া-পোড়ানোর চারকোল কাঠেও গজিয়ে ওঠে বাকল, পাতা। বিদ্যুৎ চমকায় অলৌকিক বৃষ্টিপাত হয়। আর চণ্ডালের ছেলে-বউ শ্মশানে ঘুরে ঘুরে দেখতে পায় একটা আঁধার-গাছ অলীক বাতাসে শিহরিত হচ্ছে। অর্থাৎ চণ্ডাল নিজেই নিজেকে দাহ করছে। আত্মহত্যা করছে। এ তো ভয়ঙ্কর সত্য-কবিতা!”

“শবের বদলে আজ শ্মশানে নিজেই এসে শুয়েছে চণ্ডাল—

এসময় চুপিচুপি অমা এসে দাঁড়ান শিয়রে।

ঘরে বউ, অভুক্ত সন্তান তার; পালিত কুকুর হতবাক

অন্নকে মুক্তি পেতে শ্মশানে নিজেই এসে শুয়েছে চণ্ডাল।

 

গঙ্গা তার গতি থেকে ভয়ে ভয়ে কয়েক যোজন সরে যায়

মড়া-পোড়ানোর কাঠে গজিয়ে উঠতে চায় পাতা ও বাকল

 

সে রাতেই ঝড় ওঠে — অলৌকিক বৃষ্টিপাত, বিদ্যুত-চমক

চণ্ডালের ছেলে-বউ শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে দেখে

একটি আঁধার-গাছ শিহরিত হয়ে উঠছে অলীক বাতাসে।”

আমার খুব প্রিয় একটি কবিতা ‘ভোর’। এই কবিতাটির নির্মিতি প্রসঙ্গে আমার পত্রিকা ‘জীবনকুচি’তে তিনি লিখেছিলেন —

“১৯৯২ সাল। কর্মসূত্রে আমি উত্তরবঙ্গে। সুদূর এলাহাবাদ ছেড়ে উত্তরবঙ্গে কর্মসূত্রে আগত এক যুবার সঙ্গে আমার তুমুল সখ্যতা হয়।সে আমাকে তার বাড়ির গল্প বলত।এলাহাবাদের গল্প। তার হাজার দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের কথা। বাড়িতে তার মা, যুবতী বোন আর ৮ বছর বয়সি ভাই। পুরুষবর্জিত বাড়ি। কেননা তার বাবা কর্মসূত্রে কুয়েতে থাকেন। তদুপরি দীর্ঘদিন অসুস্থ। এক ঘোর বর্ষার দিনে এলাহাবাদ থেকে টেলিগ্রাফ আসে — ‘কাম শার্প’। সেদিন ‘তার’ পাওয়ার পর যুবাটি আমার ঘরে এসে কাঁদতে থাকে — অঝোর বৃষ্টির মতো তার সেই অবিরাম কান্না, তার ভয় এবং একা বাড়ি ফিরতে না- চাওয়ার বালসুলভ জেদ আমাকে ভাবিয়ে তোলে। ফলে আমাকে তার সঙ্গী হতে হয়। ট্রেনে যেতে যেতে গোটা ঘটনাটা আমার চেতনায় অ্যালকোহলিক তেজ আনে। কী হতে পারে এই সদ্য-যুবাটির বাবার? তার বোন কিংবা মায়ের কী হতে পারে? তার বাবা তবে মারা গেলেন। ‘মৃত্যু’ শব্দটি মনে পড়তেই — মনে পড়ে সাদা কাপড়-পরা তার মায়ের বৈধব্যের কথা। তখন আমি আর আমি থাকি না। আমি হয়ে উঠি যুবাটি। এবং বৃষ্টি-শেষের সেই রাতের ভোরবেলা, ৪-১০ নাগাদ, তখন আকাশে অকৃপণ চাঁদের আলো — আমরা দুজন বাড়ির দরজায় ভয়-তাড়িত হাজির হই। উপরের বারান্দায় সাদা -কাপড়ের আকার নিয়ে লুটিয়ে পড়েছে চাঁদের আলো। আমার মধ্যে তৈরি হয় illusion এবং ভয়।চোখে ভাসতে থাকে বৈধব্যের পোশাক। চাঁদের আলো হয়ে ওঠে তারের উপর ঝুলে থাকা সাদা কাপড়। তারপর মনে হয় ‘মা’ বলে ডাক দিতেই যেন দরজা খুলে বেরিয়ে আসবেন — খালি হাত, পা, সিঁথির আগুন মোছা, সাদা-কাপড়-পরা এক মহিলা। এরকম ভয় এবং ভাবনা থেকেই কবিতাটি নির্মিতি পায়।”কবিতার শেষটি এরকম —

“সাদা কাপড়ের মতো টুকরো টুকরো ভোর দেবতারা পাঠাচ্ছে লোকালয়ে।”

আমরা তো মনে করি কবি প্রেমিকপুরুষ। যতই বলুন মৃত্যুর কথা — গার্হস্থ্য জীবনের ভাস্কর তিনি। তাঁর কবিতা নিকানো উঠোনের গাঁদা-জবা-চাঁপা ফুলের মতোই, কোজাগরী রাতের মতোই সফেদ বিছানা। বাড়ির উঠোনে চাঁদ খেলা করে, ফুটে ওঠে স্বর্ণকমল, বাড়ি জুড়ে লতাপাতা আলপনা আঁকা। এর মধ্যে সীতা উঠে আসে কবির পাতায় — লেখা হয় অদ্ভুত এক কাব্যগাথা —

“ওকে পিঁড়ি পেতে দাও।মেখে দাও ভাত

মেয়ে তুই গ্রাসে গ্রাসে অঘ্রাণ জাগাস।”

ঘরে থইথই করে সুখ।রাতে গাঢ় ঘুম মোটা ভাত খেয়ে। চন্দ্রের ঘোর লাগে বালতির দুধে। কী অসাধারণ শব্দজাল।আমাকে আবিষ্ট করে। মনে হয় রৌদ্র দেবতার ছদ্মবেশে পৃথিবীতে আবার নেমে আসবেন তিনি। দেখবেন ‘ভোর, মফস্ সল স্টেশনে’। লিখবেন —

“কাপে কাপে ভাপ-ওঠা তরল রৌদ্র ঢেলে দেয় এত ভোরে চা-দোকানি

ছেলেটা কতদূর থেকে আসে?

একরাশ ধোঁয়ার মতো চুল — চোখ দুটো সূর্যের মতো লাল

ও কী আকাশেই থাকে?

কেটলির জল ফুটছে তরল জীবন

উলটে-পালটে সে পাউরুটি সেঁকে —

পাউরুটি আমাদের নরম আত্মা

পুড়ে-যাওয়া ক্ষতে মলমের মতো মাখন লাগায়

৪-৫০-এর ট্রেন সিটি দেয়

খুচরো মিটিয়ে দিয়ে আমরাও ঢুকে পড়ি

                     বিসর্পিল

                   মরালের

                      পেটে।”

এরকম কবিতা পড়ার জন্য বহুদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। ভুলে যেতে ইচ্ছে করে অসুখের কথা। আমাদের মনখারাপের বিকেলগুলোতে তাঁর কবিতা ঝরিয়ে দেয় বৃষ্টি — বকুলের মতো।কোঁচড়ে বকুল ভরে যে মেয়েটি একা একা আসে চৈত্রের দুপুরে, তাকে ছায়া দিতে আকাশের বুকে জমকালো মেঘ হয়ে যান কবি,বকুল গাছের নিচে পেতে দেন নীল ছায়া, আর বকুলফুলের বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েন। কবি একটি প্রদীপ রেখে দেন যাতে সন্তান-সন্ততি আলো পায় রাত্রির শিয়রে, যাতে সন্তান-সন্ততি আলো পায়। রাত্রির দেবীর কাছে চেয়েছেন নির্মল আলোকিত ভোর, ধান-দূর্বার দেশ,কমলাবাসনা আলো,শান্ত সরোবর। পৃথিবীর প্রান্তে একটা ঘর নির্মাণ করেন কবি। সেই ঘর কবিতার শব্দমালা দিয়ে নির্মিত হয়। সেই ঘরে বাবার মৃত্যুর পর টাঙানো থাকে বাবার জীবিত কালের ছবি।ঝড়-বাতাসে বাবার ছবি নড়ে উঠলে মা আনন্দে আটখানা হয়ে যান — ‘যেন বাবা বেঁচে উঠছেন’।

পৃথিবীর প্রান্তে যে ঘর সাজান কবি, সেখানে কত গাছ রাস্তার দু’পাশে পিতামহের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শিব শেষ সম্বল ভস্ম মেখে গৃহী মানুষের মত সন্তান স্নেহ নিয়ে বাঁচতে চান। সেখানে গাছে গাছে ঝুলে থাকে আলোর জোনাকি। সেখানে অন্ত্যজ মেয়েরাই হয়ে ওঠে রাধা —

“আমাদের বিউটি পার্লার নেই

আমরা দু-গালে গোধূলি-আলোর মাখি

মেঘলা আকাশের নীচে দাঁড়াই — তবেই না মেঘ-বরণ —

আমাদের নাকছাবি হারানোর দুঃখ নিয়ে বনপথে রঙ্গল ঝরে পড়ে আমাদের ভাবযমুনায় জোয়ার ওঠে

ওগো ব্রজকিশোর — আমরাই রাধা

বর্ষায় পারঘাটায় একা পেলে তোমাকে ডোবাবো।”

কবি দেবজ্যোতি রায় একটি প্রবন্ধে বলেছেন — ” যশোর রোড কবিতার সামনে আমি থমকে দাঁড়াই। এই সেই রাস্তা যার পথরেখা অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। অনেক সর্বস্বান্ত মানুষের মিছিল হেঁটে গেছে তার বুকের উপর দিয়ে। উদ্বাস্তুদের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়েছে যশোর রোডের বাতাস। তবু সন্তপ্ত হৃদয়ে সে ক্ষণিকের শান্তি দিতে চেয়েছে, আশ্রয় দিতে চেয়েছে ছায়া বিস্তার করে। সঞ্জীব প্রামাণিক লিখেছেন —

যশোর রোড কোন রাস্তার নাম নয়। ছায়ার নাম।

আর ইচ্ছামতীকে কবি বলেছেন কোনও নদী নয়, অশ্রুতরঙ্গ। কারণ ইছামতীর দুই পারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দুই ভূখণ্ড। মাঝখানে বহমান ইছামতী বেদনার নীরব দর্শক। আর ইতিহাসের ট্র্যাজিডি মন্থন করে উৎসারণ ঘটেছে দীননাথের ।তার হাতে ভিক্ষাপাত্র। তিনি অন্ধ।বিক্ষুব্ধ সময়ের প্রতিনিধি।”

বৃষ্টি গাছের নিচে আমিও ক্ষণিক দাঁড়াই গ্রীষ্মের দুপুরে ধুধু মাঠে হাবাগোবা পর্যটক সেজে। কিছু বলতে চাই —

“বাতাস উঠেছে ধীরে, যেন স্বর্গ থেকে

দেববালিকার চুল

অলকানন্দায় স্নান সেরে ঝরিয়েছে

দু’ফোঁটা বকুল।”

‘পৃথিবীর প্রান্তে ঘর’ পড়তে পড়তে এক মায়ায় আচ্ছন্ন হই যেন —

“ঘোর আকালের দিনে আমাদের দেখা হয়েছিল শ্মশানের দেশে —

তখন ছিলাম আমি নাছোড় চণ্ডাল

তখন ছিলাম আমি ক্ষুধা।

 

আজ বহুদিন পর শস্য মাঠে মাঠে

কোথায় রেখেছো হাঁড়িি,কাঠকুটো, তোমার তৈজস

সব বার করে দাও

আজ তবে অন্ন রাঁধি, আজ ঘর বাঁধি।”

কবি সঞ্জীব প্রামাণিক কবিতাকে ভালোবেসেই ফিরে আসবেন হয়তো কখনো। লিখবেন হাজার হাজার কবিতার পংক্তি। গোধূলি এসে দাঁড়িয়েছিল বুঝি তাঁর দরজায়। মৃত্যুদিনের নদী পার হয়ে গেলেন তিনি কীভাবে? তিনি তো মেঘলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে শুনতে চেয়েছেন বৃষ্টির গুনগুন — দেখতে চেয়েছেন ঝাঁক ঝাঁক মৌমাছি।কলমের কালি ফুরোবার আগে পর্যন্ত লিখে যেতে চেয়েছেন ফুরফুরে কবিতা।তাই বোধহয় মৃত্যুর পরে ফিরতে চান — বলেন —

“মৃত্যুর পরে জন্ম নিয়ে দেখে যেতে চাই

                সেইসব মুখ

 কারা কারা আজও আমাকে ভালোবাসে

                 কারা কারা আমার নিন্দুক।”

কবি সঞ্জীব প্রামাণিকের জন্ম ১৯৫২-র পয়লা নভেম্বর কৃষ্ণনগরে। বাবা সত্যেন্দ্রনাথ প্রামাণিক, মা নির্মলা প্রামাণিক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ। উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক ছিলেন। পেয়েছেন কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় চট্টোপাধ্যায় স্মারক সম্মান, ‘কবিতা পাক্ষিক’ প্রদত্ত কবি শামসের আনোয়ার স্মারক সম্মান, ‘নৌকো’ স্মারক সম্মান,দ্বিজেন্দ্রলাল রায় স্মারক সম্মান, ‘কথাকৃতি’ স্মারক সম্মান।

শখ ছিল কবিতা লেখা, কবিতা পড়া।

মৃত্যু : ৩ অক্টোবর ২০১৮

তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :

ভয় ও দৈবের দেশ

প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ২০০২। প্রকাশক: ‘শূন্য দশক’-এর পক্ষে চন্দন চট্টোপাধ্যায়।

প্রচ্ছদপট: সুব্রত চৌধুরী।

দাম ২০টাকা।

উৎসর্গ: প্রসূন আর প্রজ্ঞাপারমিতা-কে।

সে এক শ্যামল মৃত্যু

প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ২০০৯

প্রকাশক:’গাঙচিল’-এর পক্ষে অণিমা বিশ্বাস।

প্রচ্ছদ চিত্র: দেবব্রত ঘোষ

দাম টাকা: ৬০ টাকা

উৎসর্গ: গীতাকে

ব্লার্বে লেখা আছে : বিবাহ, মৃত্যু, প্রেম যেন সমার্থক। এই উপলব্ধি আমাকে তাড়িয়ে ফিরেছে। এমনই আবহে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতি এবং প্রকৃতির টুকরো অনুষঙ্গগুলি। চিত্রকলা, ছবি,নান্দনিকতা,পরাবাস্তবতা মিলেমিশে এ কাব্যে উন্মোচিত হয়েছে অন্য এক আলো — শ্যামল মৃত্যুর আলো মা চিরায়ত এবং দূরগামী।

অন্ধ যাত্রার পথ

প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর২০১২

প্রকাশক:’গাঙচিল’-এর পক্ষে অণিমা বিশ্বাস।

প্রচ্ছদপট:সুব্রত চৌধুরী

দাম:১০০টাকা

উৎসর্গ: কীটনাশক লৌহসিন্দুক মহাকাল

ব্লার্বে লেখা আছে : এ কাব্যে কবিতাগুলি কমবেশি গত তিন বছরে লিখিত এবং অধিকাংশ কবিতা নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। শুধু ‘কৃষি’ কবিতাটি রচনাকাল ১৯৮৯। বাকি কথা, যা বলার, কবিতায় বলা আছে। অন্ধকার শব্দের বহুমাত্রিকতা এবং অনালোকিত এক জগতের মায়া ও আলো যেন এসে পড়েছে কাব্যের পাতায় পাতায়। বিষয়-গৌরব এবং নান্দনিকতায় পূর্ণ কাব্যগ্রন্থটি অন্য এক আলোর সংকেত।

পৃথিবীর প্রান্তে ঘর

প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ২০১৭

প্রকাশক: সিগনেট প্রেস (একটি আনন্দ প্রকাশনা)

প্রচ্ছদ: সুদীপ্তা দত্ত

দাম: ১০০টাকা

উৎসর্গ: শ্রীমান দিব্যদ্যুতিকে

কবিতা সংগ্রহ
সঞ্জীব প্রামাণিক
সংকলন ও সম্পাদনা : গৌতম মণ্ডল
প্রকাশক : আদম
প্রথম প্রকাশ : কলকাতা বইমেলা ২০২২
প্রচ্ছদ : শোভন পাত্র
উৎসর্গ : তরুণ কবিদের

সম্পাদক সঞ্জীব প্রামাণিক বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষভাবে সম্পাদনা করেছেন ‘লিবিডো’, নতুন ‘ভাইরাস’, ‘বাঙ্‌লা ভাষা’ ও ‘আমাদের কবিজন্ম’ নামের পত্রিকা চতুষ্টয়।

‘লিবিডো’ পত্রিকাটি সঞ্জীব সম্পাদনা করেন সুবোধ দাসের সঙ্গে যুগ্মভাবে। তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল।

‘ভাইরাস’ সম্পাদনা করতেন কবি দেবদাস আচার্য। দীর্ঘদিন আগেই ভাইরাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দেবদাস আচার্যের কাছ থেকে সঞ্জীব প্রামাণিক ‘ভাইরাস’ নামটি এবং এই পত্রিকার সুপরিচিত নামলিপিটি ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে নতুন ‘ভাইরাস’ প্রকাশ করেন।

সঞ্জীব প্রামাণিকের প্রত্যক্ষ সম্পাদনায় এবং প্রযত্নে প্রকাশিত তৃতীয় পত্রিকাটির নাম ‘বাঙ্‌লাভাষা’। প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৬-৯৭ সালে। দীর্ঘ চার বছর পর দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে এই পত্রিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম প্রথম পত্রিকাটির চতুর্থ কভারে কয়েকটি ঘোষণা থাকতো, যেগুলি পত্রিকার চরিত্র বুঝতে আমাদের সাহায্য করে:

বাঙ্‌লাভাষা মুখ ও মুখোশের মাঝখানে প্রথম বজ্রপাত।

তরুণের ক্রোধ ও বয়স্কের মনীষা আমাদের সমানভাবে কাঙ্ক্ষিত।

বাজারী, কৃত্রিম, ঠুনকো সাহিত্যচর্চা, পৃষ্ঠকণ্ডুয়ন, ছাপার জন্য লেখা, লেখা বিনিময় প্রভৃতির বিরুদ্ধে বাঙ্ লাভাষার সতর্ক গেরিলাযাত্রা।

আমরা অর্কিড চাই না — তারুণ্যের সম্ভাবনা, স্পর্ধা, হয়ে উঠতে চাওয়াকে আমাদের লালন ও প্রশয় এবং সৌখিন কবিতাকর্মীর জন্য নির্বাসন।

সম্পাদক সঞ্জীবের শেষ এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতাজাত উপহার ‘আমাদের কবিজন্ম’। প্রথম প্রকাশ ২০১৫-র নভেম্বরে।


আপনার মতামত লিখুন :

One response to “কবি সঞ্জীব প্রামাণিক, আবহমান বাংলা কবিতার পথে হেঁটে-যাওয়া এক কবিতাভিক্ষুক : অমৃতাভ দে”

  1. দীপাঞ্জন দে says:

    খুব ভালো লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন