চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিকে বলা হয় ‘পাপমোচিনী একাদশী তিথি’। যে দেবী তাঁর শ্রীচরণে আগত ভক্তিমান ও শ্রদ্ধাবনত সাধকের পার্থিব জীবনের কামনাবাসনা পাপকর্ম থেকে মুক্ত করে অর্থাৎ ভববন্ধন মুক্ত করে মোক্ষদান করেন তিনিই হলেন ‘শ্রীশ্রীপাপমোচিনী একাদশী দেবী।’ মতান্তরে এই দেবী পাপমোচিনিকা নামেও আখ্যাত।
পৌরানিক উপাখ্যানের কথায়, একদা রাজা মান্ধাতা লোমেশ ঋষিকে প্রশ্ন করেন, ‘মানুষ কি তার জীবন চক্রে পাপ মোচন করতে সক্ষম হয়? যদি থাকে, তবে তার উপায় কি’?
রাজা মন্ধাতার প্রশ্নের উত্তরে মুনীন্দ্র লোমশ বললেন : — হে নৃপতি! চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশীর নাম পাপমোচিনী একাদশী। তার ব্রতের প্রভাবে মানুষের বহু পাপ নষ্ট হয়। পাশাপাশি মৃত্যুর পর বৈকুণ্ঠ লাভও ঘটে। আমি আপনাকে সেই ব্রতকথা শোনাচ্ছি, মন দিয়ে শুনুন ।
একবার এক বসন্ত ঋতুতে কুবের তার চৈত্ররথ নামক বন-উদ্যানে আয়োজন করেছিলেন সঙ্গীত ও নৃত্যের। যেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন নানা দেশের রাজা-প্রজা, মুনি-ঋষি প্রমুখ। ওই নিত্যানুষ্ঠানে ভগবত মননের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় অপ্সরা মঞ্জুঘোষ ও চ্যবনের পুত্র মেধাবী মুনি।
অথচ মেধাবী ছিলেন একজন শিবভক্ত ঋষি।
তিনি শিবদ্রোহী কামদেবের কু চক্রান্তের শিকার হন। কামদেবের অনুচরী ছিলেন অপ্সরারা। তাই এক সময় মেধাবী ঋষির তপস্যা ভঙ্গের জন্য মঞ্জুঘোষা নামক এক অপ্সরাকে পাঠান কামদেব।
মেধাবী ঋষি সেই সময় ছিলেন নিজের যুবাবস্থায় ও অত্যন্ত হৃষ্ট-পুষ্ট। তিনি যজ্ঞোপবীত ও দণ্ড ধারণ করেছিলেন। তাঁকে দেখে কামাসক্ত হয়ে পরেন মঞ্জুঘোষা। তিনি চাইতেন মেধাবী যেন তার রূপে মোহিত হন।
তাকে আকর্ষণ করার জন্য, মঞ্জুঘোষা বীণা বাদন করে মধুর স্বরে গান গাইতে শুরু করেন।কামদেব এই সময় মঞ্জুঘোষাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। কামদেব সেই সুন্দর অপ্সরার ভ্রুর ধনুক তৈরি করেন ও কটাক্ষকে তার প্রত্যঞ্চা করেন, তাঁর নেত্রকে মঞ্জুঘোষার সেনাপতি করেন। এ ভাবে কামদেব ঋষি মেধাবীকে জয়ের জন্য প্রস্তুত হন।
ঋষি মেধাবী মঞ্জুঘোষার মধুর গান ও তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। সেই অপ্সরা মেধাবী মুনিকে আলিঙ্গন করে।এদিকে মহর্ষি মেধাবি তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শিব রহস্য ভুলে যান ও কামে বশীভূত হয়ে মঞ্জুঘোষার সঙ্গে রমণ করেন।
কামের বশীভূত থাকায় মুনি দিন-রাতের জ্ঞান লোপ পায়, বহুক্ষণ রমণ করতে থাকেন তাঁরা। পরে মঞ্জুঘোষা তাঁকে বলেন যে, ‘হে ঋষি! অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, আমায় স্বর্গে যাওয়ার আজ্ঞা দিন।’
অপ্সরার কথা শুনে ঋষি বলেন, ‘হে মোহিনী! সন্ধ্যাবেলা এসেছো, সকাল হলে চলে যেও। ‘ঋষির এক কথা শুনে অপ্সরা তাঁর সঙ্গে রমণ করে। এর পর মঞ্জুঘোষা একদা ঋষির কাছ থেকে স্বর্গে যাওয়ার আজ্ঞা চান। মুনি এবারও তাঁকে আরও কিছুক্ষণ থাকার আবেদন জানান। কিন্তু মঞ্জুঘোষা তাঁকে জানান যে, অনেককাল অতিবাহিত হয়েছে। অপ্সরার কথা শুনে ঋষির বোধ ফেরে, তিনি বুঝতে পারেন যে, এ ভাবে ৫৭ বছর অতিক্রম হয়েছে।
এত অধিক পরিমাণ সময় ভোগ-বিলাসিতায় ব্যয় হওয়ায় ঋষি মেধাবী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। নিজের তপ ধ্বংসকারী অপ্সরাকে অভিশাপ দিয়ে বসেন ঋষি। বলেন, ‘আমার তপ নষ্ট করেছিস তুই দুষ্টা! তুই মহাপাপী, দুরাচারিণী। আমি তোকে পিশাচিনী হওয়ার অভিশাপ দিচ্ছি।’
এর পর মঞ্জুঘোষা পিশাচিনী হয়ে যায়। তার পর ঋষিকে রাগ ত্যাগ করার আবেদন জানান তিনি। সেই সঙ্গে এই পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ জানতে চান। মঞ্জুঘোষা তাঁকে বলে, ‘সাধুর সঙ্গ ভালো ফল প্রদান করে, আপনার সঙ্গে আমি বহু বছর কাটিয়েছি। এবার আমার ওপর প্রসন্ন হন, তা না-হলে লোকে বলবে এক পুণ্যাত্মার সঙ্গে থেকে মঞ্জুঘোষাকে পিশাচিনীর রূপ ধারণ করতে হয়েছে।’
মঞ্জুঘোষার কথা শুনে ঋষির রাগ কমে ও আত্মগ্লানি হয়। পাশাপাশি নিজের অপকীর্তির জন্য ভয় পান তিনি। এরপর মঞ্জুঘোষাকে ঋষি মেধাবী বলেন যে, সে তাঁর অনেক ক্ষতি করেছে, তা সত্ত্বেও তাঁকে অভিশাপ থেকে মুক্তি পথ দেখাবেন তিনি। চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের পাপমোচিনী একাদশীর উপবাস করার পরামর্শ দেন মুনি। বলেন এই একাদশী ব্রত পালন করলে পাপ ও পিশাচিনী দেহ থেকে মুক্তি সম্ভব। এর পর তাঁকে ব্রতর নিয়ম জানিয়ে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য ঋষি চ্যবনের কাছে যান।
নিজের পুত্র মেধাবীকে দেখে চ্যবন ঋষি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন যে, এমন কী হয়েছে, যার কারণে তাঁর সমস্ত তপ নষ্ট হয়ে গেছে ও তাঁর সমস্ত তেজ মলিন হয়ে গিয়েছে।
মেধাবী মুনি লজ্জিত হয়ে সব কথা তাঁকে জানান। সঙ্গে পাপ মুক্তির উপায়ও জানতে চান। চ্যবন ঋষি তাঁকেও পাপমোচিনী একাদশীর ব্রত পালন করতে বলেন।
এর পর মঞ্জুঘোষা ও মেধাবী ঋষি এই একাদশী ব্রত পালন করে। ব্রতর পুণ্য প্রভাবে মঞ্জুঘোষা পুনরায় সুন্দর রূপ ফিরে পায় ও স্বর্গলোকে প্রস্থান করে এবং মেধাবী ঋষিরও সমস্ত পাপ ক্ষয় হয়।
লোমেশ মুনি বলেন : হে রাজন! এই পাপমোচিনী একাদশীর প্রভাবে সমস্ত পাপ নষ্ট হয়ে যায়। এই একাদশীর ব্রতকথা শ্রবণ বা পঠন এক হাজার গৌ দানের সমান ফল প্রদান ককে। এই উপবাস করলে ব্রহ্মহত্যা, স্বর্ণ চুরি, মদ্যপান, অগম্যা গমনের মতো ভয়ঙ্কর পাপ নষ্ট হয় এবং ব্যক্তি অবশেষে স্বর্গলোকে প্রস্থান করে।
বৈদিক পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের একাদশী তিথি শুরু হচ্ছে ২৫ মার্চ ভোর ৫টা ৫ মিনিট থেকে এবং সমাপ্ত হবে ২৬ মার্চ ভোর ৩টে ৪ মিনিটে। উদয়া তিথি অনুযায়ী ২৫ মার্চ পাপমোচনী একাদশী পলিত হবে।যাঁরা এই একাদশীতে উপবাস করবেন, তাঁরা পরের দিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ দ্বাদশী তিথিতে পারণ করতে পারেন। এদিন দুপুর ১টা ৪১ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৪টে ৮ মিনিটের মধ্যে ব্রতভঙ্গ করবেন। এই তিথিতে স্নান-দান করে লক্ষ্মী নারায়ণের পুজো করার পর উপবাস ভঙ্গ করুন।
পাপমোচিনী একাদশীর পুজোর নিয়ম :
পাপমোচিনী একাদশীর আগের দিন সমস্ত ঘর গঙ্গাজল দিয়ে শুদ্ধ করুন।
একাদশী তিথিতে ভোরবেলা তাড়াতাড়ি উঠে স্নান করে ব্রতর সংকল্প নিন।
পুজোর স্থানে সাতটি অন্নের ঢিপি তৈরি করুন। এর ওপর তামা বা মাটির ঘট স্থাপন করুন।
এর পর নারায়ণের মূর্তি বা চিত্র স্থাপন করুন।
এবার নারায়ণকে ধূপ, দীপ, চন্দন, ফল-ফুল, তুলসী নিবেদন করুন।
পুজোর পর পাপমোচিনী একাদশীর ব্রতকথা পাঠ করুন।
পাপমোচিনী একাদশীর দিনে অবশ্যই করবেন এই কাজ :
একাদশীর দিনে ব্রহ্ম মুহূর্তে উঠে স্নান করে ব্রতর সংকল্প নিন। পুজোর সময় নারায়ণকে হলুদ মিষ্টির ভোগ নিবেদন করুন। হলুদ রং শ্রীহরির প্রিয়। এই তিথিতে বিষ্ণুর পাশাপাশি লক্ষ্মীর পুজো করা উচিত। এই তিথিতে অশ্বত্থ গাছে জল নিবেদন করা শুভ।
এই দিন অন্ন গ্রহণ করবেন না এবং আপনার যথাসাধ্য ব্রাহ্মণ এবং গরিবদের দান করুন। আট বছরের নিচে শিশু অশীতিপর বৃদ্ধ, অশক্ত-অপটু রোগী ও উন্মাদ প্রমুখদের একাদশী পালনের পক্ষে অনুপযোগী বলে গণ্য করা হয়।।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : স্বামী নিত্যানন্দের শ্রীশ্রী দেবী ও তিথিরূপে একাদশী, হিন্দুস্তান টাইমস অনলাইন।