উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে উত্তর-পূর্ব ভারতের সমাজ সংস্কৃতির ইতিহাসে পঞ্চানন বর্মার আবির্ভাব একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কোচবিহার রাজ্যের মাথাভাঙ্গার অন্তর্গত খলিসামারি গ্রামের দিনদরিয়ার ক্ষেত্রধারায় লালিত পঞ্চানন। শৈশব থেকে যা দেখেছেন তা উপলব্ধি করেছেন যুক্তি দিয়ে। তদুপরি পিতা-মাতার দৈনন্দিন জীবনচর্চা শৈশব থেকে পঞ্চাননকে প্রভাবিত করেছিলো যা পরবর্তী জীবনে সামাজিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যাওয়ার পথে তাঁকে উজ্জীবিত করেছে।
দৈনন্দিন জীবনে তিনি ছিলেন সাত্ত্বিক প্রকৃতির, আহারেও শুচিতা পালন করতেন। সম্ভবত পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে এ ধরনের জীবন। রাজবংশী সমাজের দেশীয় খাদ্য ছ্যাঁকা, লাফাশাক, কাঁচা দুধের দই, গুড়, চিঁড়া ছিল তার একান্ত প্রিয়। নিত্যদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই স্নান করা, প্রাতঃভ্রমণ, শরীরচর্চা, ইষ্ট চিন্তা, স্তব করতেন।
সাহসী চরিত্র, উদারতা এবং মহত্ব গুণ তাকে সকলের প্রিয় করে তুলেছিল। ছোট বড় নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে সমান ভাবে মিশতেন। সাহসী চরিত্র উদারতা ও মাহাত্ম্য গুনে তার চরিত্র আরো মনোরম হয়ে উঠেছিল। জাতির কলঙ্কমোচনে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
বঙ্গবাসী কলেজ থেকে এফ.এ পাস করে সংস্কৃত অনার্স নিয়ে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে বি.এ পাশ করেন। পরে এম.এ করেন এবং রিপন কলেজ থেকে ল পাশ করেন। রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম বি.এ এম.এ ল পাস করা ব্যক্তি তিনি। অথচ তার ভাগ্যে জুটলো সাধারণ হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট-এর চাকরি। দেশীয় রাজ্যের তার প্রতি এই বঞ্চনা পঞ্চাননকে পীড়া দিয়েছিল। চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার কলকাতা এসে ল পাশ করলেন। তারপর ১৯০১ সালে রংপুরে গিয়ে সেখানকার জেলা আদালতে ওকালতি শুরু করেন। এখান থেকেই আরম্ভ হয় ব্যক্তি পঞ্চাননের উত্তরণের অধ্যায়।
চোখের সামনে ঘটা নিজের সমাজের প্রতি নানা বৈষম্য উকিল পঞ্চাননকে ব্যথিত করে তোলে। এ রকমই দুটি ঘটনার প্রথমটি তার ব্যক্তিগত জীবনে ঘটা–
সে সময় আদালতে সাওয়াল জবাব করার সময় আইনজীবীরা এক ধরনের টোগা বা টুপি ব্যবহার করতেন। একদিন তাড়াহুড়োতে পঞ্চানন তার নিজের টোগা না পড়ে নামজাদা উকিল মৈত্র মহাশয়ের টোগা মাথায় দিয়ে চলে যান। পরে ফিরে এসেই নিজের মোক্ষম ভুলটা বুঝতে পারেন এবং তৎক্ষণাৎ সেটি ফেরত দিতে যান। কিন্তু মৈত্র মহাশয় সেটি নিতে অসম্মত হন, বলেন — ‘আই হেট টু ইউজ দিস টোগা ইউজ বাই রাজবংশী’। মৈত্র মহাশয়ের কাছে পঞ্চানন সেদিন চরমভাবে অপমানিত হন।
দ্বিতীয় ঘটনা রংপুর নর্মাল স্কুল হোস্টেলের। পড়াশুনার জন্য অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে সেখানে কয়েকজন রাজবংশী ছাত্রও থাকতো। একদিন রান্না হয়েছে কিনা জানতে একজন রাজবংশী ছাত্র রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। আর তাতেই গোলমাল শুরু হয়। অন্যান্য ছাত্র বলে রাজবংশীর ছোঁয়া খাবার তারা আর খাবে না। ফলে সেদিনের রান্না হওয়ার সমস্ত খাবার ফেলে দিতে হয়। মানবতার প্রতি এই চরম লাঞ্ছনা পঞ্চানন বর্মাকে প্রতিনিয়ত আঘাত হানতে থাকে আর সেই থেকেই বদলে যেতে থাকে তার চিন্তাভাবনার পরিসর।
তিনি উপলব্ধি করেন রাজবংশী সম্প্রদায়কে যদি বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে পা মেলাতে হয় তাহলে সমকক্ষ হয়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরি। সেই জন্য সর্বপ্রথমে তাদের জাতিগত ব্রাত্যত্ব মোচন ও স্বভিমানী করে তোলা দরকার। শুরু হয় রাজবংশী সমাজকে ক্ষত্রিয় মর্যাদায় উন্নীত করার লড়াই — পরবর্তীতে যা বৃহত্তর ক্ষত্রিয় আন্দোলনের রূপ নেয়।
১৯২০ সালের ১ মে গঠন হয় ক্ষত্রিয় সমিতি। দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলা থেকে প্রায় ৪০০ প্রতিনিধি সমিতির প্রথম অধিবেশনে যোগ দেন। এই অধিবেশনে রাজবংশী জাতিসত্তা শিক্ষাবিস্তার ও নিজস্ব ব্যাংক তৈরির প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
ক্ষত্রিয় সমিতির দ্বিতীয় অধিবেশনে রাজবংশীদের ক্ষত্রিয়করণ ও উপবীত ধারনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মিথিলা কামরূপ ও নবদ্বীপের পণ্ডিতবর্গ সমস্ত বিচার বিবেচনা করে উপবিত ধারনের ধর্মসম্মন্ত সম্মতি প্রদান করেন।
১৩১৯ বঙ্গাব্দে পুণ্যতোয়া, করোতোয়া নদীর তীরে উপনয়ন গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অগণিত রাজবংশী সম্প্রদায় মানুষ সেখানে মস্তক মুন্ডন ও বেদ মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে যজ্ঞাগ্নিতে সমস্ত গ্লানি ও ব্রাত্যত্বকে আহুতি দিয়ে পুনরায় ক্ষত্রিয় রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। পঞ্চানন তার জন্মসূত্রে পাওয়া সরকার পদবী ত্যাগ করে বর্মা পদবী গ্রহণ করেন। পরিচিত হন ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা নামে।
শুধুমাত্র উপবীত ধারণ করলে ক্ষত্রিয় হওয়া যায় না, মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে অর্থনৈতিক বিকাশ ও শিক্ষার প্রসার করতে হবে। বর্তমানের রাজবংশী সমাজ শিক্ষা যতটা গেছে তার পিছনে মূল অবদান রয়েছে পঞ্চানন বর্মার।
নারী শিক্ষার বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সজাগ ছিলেন এক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের ভাবনার সঙ্গে তার অনেকটা মিল পাওয়া যায়। ১৯৩০ সালের পর রংপুর জেলার নানা অংশে নারী ধর্ষণ ও অপহরণ ব্যাপক বৃদ্ধি পায় ধর্ষিতা অপহৃত স্ত্রী লোকের আর্তনাদে আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ হয়েছিল। সমাজ সংস্কারক পঞ্চানন বর্মা হৃদয় কম্পিত হয় তিনি “ডাংধরী মাও” কবিতার মধ্যে দিয়ে সমাজের জাগরণ ঘটানোর চেষ্টা করেন।
কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা সুনীতি দেবী কোচবিহারের রাজবধূ হয়ে আসার পর নারী শিক্ষা প্রসারে একটি বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন কিন্তু সেটা ছিল মূলত কোচবিহার শহর ও তার আশেপাশে অঞ্চলে। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল পর্যন্ত শিক্ষা প্রসারের কাজ পঞ্চানন বর্মাই করে গেছেন। মেয়েরা নিজেরাই যাতে আত্মরক্ষা করতে পারে সেজন্য প্রত্যেক জেলা ও মহাকুমায় মেয়েদের জন্য লাঠি খেলা, অস্ত্র চালানো ইত্যাদি প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
মনীষী পঞ্চানন বর্মার মূল্যায়ন করতে গেলে বলতে হবে যে, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষটির যোগ্য নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজবংশী ক্ষত্রিয় আন্দোলনের জন্যই জনগোষ্ঠী হিন্দু সমাজের মূল স্রোতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। ক্ষত্রিয় পরিচয় দিতে আজ কতজন গর্ব অনুভব করেন বা আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে এই সমাজের কত শতাংশে জীবনের লক্ষ্যংশ পরিচয় ঘটিয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। মনীষী পঞ্চানন বর্মা না জন্মালে এই জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ হয়তো মুসলমান কিংবা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যেত আর বাকি অংশ এখনো টোটা বা বাল্মিকী সম্প্রদায়ের মতো আত্মপরিচয়ের সংকটে বা পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় হিসেবে গা ভাসিয়ে দিত। ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যালের ভাষায় তার আন্দোলনের জন্যই উত্তরবঙ্গে হিন্দু সমাজের রক্ষা পায়। বাংলার নবজাগরণে উত্তরবঙ্গকে যিনি শামিল করেছেন সেই ঠাকুর পঞ্চানন বর্মাকে তাঁর জন্মদিনে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।
খুব ভালো।কিছু অজানা তথ্য জানা গেল। ধন্যবাদ জানাই।
অজানা তথ্য দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ❤️🌹
অনেক ধন্যবাদ 🌹
সাম্প্রতিক নাম শুনেছিলাম, কিছু জানা ছিল না। জানা হলো।
ধন্যবাদ ❤️🌹
ক্ষত্রিয় আন্দোলনের তাৎপর্য এর পরবর্তি প্রভাব আপনি স্বল্প লেখায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন অনেকাংশে।আপনার দৃস্টিভঙ্গিকে সন্মান জানাই।গারো বোড়ে, মিজোদের মত রাজবংশীরাও হত ভারতীয় ধর্ম সংস্কৃতি পরিত্যাগ কারী একটি পথভ্রান্ত গোস্টীতে।