মাত্র দু-ঘন্টার বাজার। রোজকার এই বাজার কেবল কাঁচা আনাজের। জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র চাষি এবং ব্যবসায়ীদের জন্য নির্দিষ্ট এই বাজার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে চলে আসছে আরামবাগের সোদপুর গ্রামে। উৎপাদিত পণ্য চাষিরা সরাসরি তুলে দেন ব্যবসায়ীদের হাতে। ন্যায্য দাম যেমন পান, তেমনি উৎপাদিত আনাজ বিক্রির জন্য অন্য কোথাও কোনও দূরস্থানে দৌড়তে হয় না তাঁদের। ভোরের এই মেলবন্ধন চারটেয় শুরু, শেষ সকাল ছ-টায়। এর মধ্যে চাষিদের কাছ থেকে শাক সবজি নিয়ে ব্যবসায়ীরা দূর দূর জায়গায় চলে যান বিক্রি করতে।উল্লেখ করা যেতে পারে, রাউতারা, ধাপধাড়া, হাটি, সোদপুর, মসিনান, নিমডাঙ্গী, জঙ্গলপাড়া, হরিখোলার চাষিরা ভোরবেলা থেকে টাটকা সবজি তুলে নিয়ে সোদপুর-মসিনান ফুটবল মাঠে হাজির হন। কাঁচালঙ্কা থেকে শুরু করে টম্যাটো, বেগুন, আলু, মূলো, পটল, উচ্ছে, ঝিঙে, পালং পুঁই, নটে শাক, কপি সবই সাজান চাষিরা। মাত্র দু-ঘণ্টার মধ্যে তা বিক্রি হয়ে যায়।
ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দাম দিয়ে তা কিনে নেন। এভাবেই চলে আসছে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর। এদের কাছে এখনও কৃষক মান্ডি ব্রাত্য বলা যেতে পারে। এখানকার টাটকা ও সুস্বাদু সবজি ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে। তাই বাঁকুড়ার কোতুলপুর থেকে যেমন ব্যবসায়ীরা আসেন, তেমনি হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর, মেদিনীপুরের ঘাটাল থেকেও বহু ব্যবসায়ী আসেন। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী ছোটখাট শহরতলি তো আছেই। তপন জানা, গোপাল মাইতি, মিলন ধাড়া, প্রভাস ধারাদের মতো বিশিষ্ট সবজি চাষিরা প্রতিদিন আসেন। এখন সবজি চাষিই এঁদের ধান-জ্ঞান। এঁরা সকলেই জানান, আলু যদিও – এখানকার মুখ্য অর্থকরী ফসল, তবুও সবজি চাষেই লাভ বেশি দেখতে পাই। লোকসান হয়নি আজ পর্যন্ত। তবে যে হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের দাম বাড়ছে, তাতেই চিন্তা বাড়িয়েছে । সেইসঙ্গে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় সবজি চাষে বহু চাষি মুখ ঘুরিয়েছেন।বিশিষ্ট চাষি শম্ভু অধিকারী জানান, এখানকার সবজি চাষের মধ্যে কাঁচা লঙ্কায় সবচেয়ে বেশি লাভ।
কাঁচালঙ্কা থেকে শুরু করে টম্যাটো, বেগুন, আলু, মুলো, পটল, উচ্ছে, ঝিঙে, পালং, পুঁই, নটে শাক, কপি সবই সাজান চাষিরা। মাত্র দু-ঘণ্টার মধ্যে তা বিক্রি হয়ে যায়। তারপরেই লাভজনক চাষ হল টম্যাটো। এক বিঘা টম্যাটো চাষ করতে খরচ পড়ে প্রায় ১২ হাজার টাকা। খরচ দিয়ে বাদ দিয়ে লাভ ২৫ হাজার টাকা। এরপরেই পটল চাষে লাভ বেশি। একই কথা জানালেন ধাপধাড়া গ্রামের উল্লেখযোগ্য চাষি সোমনাথ বেরা। তিনি বলেন, এখানকার মানুষ দশ বছর আগে আলু চাষ ছাড়া কিছুই বুঝত না। কিন্তু এখন সবজি চাষের ঝোঁক প্রতিটি চাষির মধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ একটাই, ঝুঁকি কম, লাভ বেশি। তাছাড়া সারা বছর সবজি চাষ করা যায়।
প্রসঙ্গত, এই এলাকায় প্রত্যেক চাষিই এক কাঠা থেকে এক বিঘা পর্যন্ত সবজি চাষ করেন। সব রকমের সবজিই — এখানে হয়ে থাকে। সুস্বাদু ও উন্নতমানের সবজি পার্শ্ববর্তী এলাকায় সাড়া ফেলেছে। এখানকার সবজি মানেই সেরা। চাষিরাও অতি যত্ন সহকারে চাষ করে থাকেন। ঝিঙে, পটল, মূলো, ঢেঁড়শ চাষেও প্রতি বিঘায় খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাভ পেয়ে থাকেন চাষিরা। তাই উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এখানকার সবজি চাষ। জনৈক চাষি অভিযোগ করেছেন, সরকারিভাবে আজ পর্যন্ত সবজি চাষে কোনও সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এমনকী কোনও ব্যাংক ঋণও মেলেনি। তাই গরিব চাষিদের পক্ষে ব্যয়সাপেক্ষ এই সবজি চাষ করা ক্রমশই দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হয়ে গেলে কোনও বিমার ব্যবস্থাও সরাকরি ভাবে নেই। দুর্যোগে সবজি নষ্ট হলে চাষিদের দেনার দায়ে পড়তে হয়।
তাছাড়া যে হারে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধের দাম বাড়ছে তাতে সরকারি সাহায্য পেলে অনেক চাষিই উপকৃত হতেন। আর একটা সমস্যা হল সেচ। পুরশুড়া এলাকা ‘ব্ল্যাক জোন’ ঘোষণা করায় ভূগর্ভস্থ জল তোলা যাচ্ছে না বা চাষে নতুনভাবে অগভীর নলকূপ বসানো যাচ্ছে না। গ্রামের নদী-নালা-পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে জলের সমস্যায় এখানকার সবজি চাষ বাধা পাচ্ছে। জলের অভাবে অনেক সবজি চাষও বন্ধ করতে হয়েছে। তাছাড়া বৃষ্টির জলেও অনেক সবজির চাষ নির্ভর করে। কিন্তু কয়েক বছর বৃষ্টিপাতও কম হচ্ছে, যার ফলে সবজি চাষে অনেকটাই বাধা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে চাষিরা উপযুক্ত সেচ দিতে না পারায় ফলন সেইভাবে হচ্ছেনা। এ নিয়েও চিন্তিত কৃষিদপ্তর।