তবে একটি কথা এখানে বলা দরকার : প্রেমের এ ‘অশ্রুত গুঞ্জন’ কেবল রবিঠাকুরকে ঘিরেই ঘুরপাক খায়নি, এর সাথে জড়িত ছিলেন একটি ‘তৃতীয় পক্ষও’। এই তৃতীয় পক্ষ আর আর কেউ নন — রবিঠাকুরের তৎকালীন সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্ট স্বয়ং। প্রথম দিকে এলমহার্স্ট ওকাম্পোর ব্যক্তিত্ব আর তাঁর প্রবল দখলদারি মনোভাব নিয়ে বিরক্ত ছিলেন, পরে কিছুটা হলেও আকৃষ্ট হয়ে পড়েন ওকাম্পোর রূপে আর গুণে। অনুরাগের প্রকাশ ছিল ওকাম্পোর দিক থেকেও। কারণ অনুমান করা আমাদের জন্য কষ্টকর নয়। কবি হিসেবে রবিঠাকুরের খ্যাতি যতোই হোক না কেন, আর ওকাম্পোর কাছে তিনি যত কাঙ্ক্ষিতই হোন না কেন, বাস্তবতা হল তিনি সে সময় ছিলেন ষাটোর্ধ প্রৌঢ়। বয়সে একেবারে ওকাম্পোর পিতার কাছাকাছি। অন্যদিকে লেনার্ড তখন বত্রিশ বছরের সুদর্শন যুবক, ওকাম্পোরই কাছাকাছি বয়স। ডরিস মায়ার তাঁর ওকাম্পোকে নিয়ে লেখা জীবনী গ্রন্থে একটি অবরুদ্ধ সত্যের প্রতি নির্দেশ করেছেন আমাদের — ‘সুদর্শন পুরুষের প্রতি ওকাম্পোর মোহ ছিল সারা জীবনের’ (২৩)। ওকাম্পো তাঁর বিবাহবিচ্ছিন্ন স্বামী মোনাকো এস্ত্রাদার প্রতি একসময় তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন অনেকটা তাঁর সুদর্শন চেহারা আর নীল চোখের কারণেই। আর তাঁর গোপন প্রেমিক জুলিয়েন মার্তিনেজেরও খ্যাতি ছিল ‘অঞ্চলের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ’ হিসেবে। কাজেই লেনার্ড এলমহার্স্ট – যিনি ছিলেন একাধারে ‘বুদ্ধিমান, সংস্কৃতিবান সাহিত্যরসিক’ এবং সেই সাথে আবার ‘নীলাক্ষ, খড়গনাসা, মেদবর্জিত দীর্ঘদেহী’- তিনি ওকাম্পোর ভালবাসার রসায়নে কোন ছাপ রাখবেন না তা তো হয় না। এর মধ্যে এলমহার্স্ট আবার তাঁর বাগদত্তা ডরোথি স্ট্রেটকে বিয়ে করার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। কেতকী কুশারী তাঁর ইংরেজি (‘ইন ইয়োর ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’) এবং বাংলা (‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’) বইয়ে বেশকিছু দলিলপত্র হাজির করে দেখিয়েছেন, সে সময় ওকাম্পোর আবেগঘন আর মান অভিমানপূর্ণ বেশ কিছু চিঠি এলমহার্স্টের উপরে নানারকমের ‘চাপ সৃষ্টি করেছিল’। তাঁদের এই ‘বন্ধুত্ব’ নিয়ে তাঁর বাগদত্তা স্ত্রী ডরোথির জীবনভর এক ধরণের অস্বস্তি ছিল। আর কবিগুরুও উভয়ের প্রতি পারস্পরিক মুগ্ধতার ব্যাপারটা কিছুটা হলেও বুঝেছিলেন। এমনকি একটি আলাপচারিতায় এও ইঙ্গিত করেছিলেন যে, এলমহার্স্ট চাইলে ওকাম্পোকে বিয়ে করে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যেতে পারেন (২৩)। আবার ওকাম্পোকে বলেছিলেন, ‘এলমহার্স্টের ডরোথিকে বিয়ে করার কথা থাকলেও তোমাকেই সে ভালবাসে’। এ যেন হিন্দি সিরিয়ালে নিত্য দেখা সেই ত্রিভুজ-প্রেমের চালচিত্র। অবশ্য এলমহার্স্টকে নিয়ে এধরণের জটিলতা রবীন্দ্রনাথের জন্য নতুন নয়। ওকাম্পোর আগে রবীন্দ্রনাথের ষোড়শী বান্ধবী রাণু অধিকারীর সাথে রবিঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং সেই সাথে এলহার্স্টের প্রতি ঈর্ষা ইত্যাদি নিয়েও এক ধরণের বিচিত্র টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল তা বিভিন্ন নথিপত্র থেকে স্পষ্ট হয় (২৪)। এবারেও আমরা দেখব, জটিল এই ত্রিভুজ সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতেই হয়তো, ওকাম্পো পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে যে বইটি লিখবেন, তা উৎসর্গ করবেন তাঁর প্রিয় ‘ইংরেজ বন্ধু’ লেনার্ড এলমহার্স্টকে।
যা হোক, রবীন্দ্রনাথ এলমহার্স্টকে সাথে নিয়ে আর্জেন্টিনা ত্যাগ করেন ১৯২৫ সালের ৩রা জানুয়ারি। সে বছরের এপ্রিলেই এলমহার্স্ট বিয়ে করেন ডরোথিকে। আর রবীন্দ্রনাথ? ওকাম্পোর স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করে তিনি দেশে ফিরলেন। মাস খানেকের মধ্যেই প্রকাশ করেন ঐতিহাসিক ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ। বইটি প্রকাশের পর ওকাম্পোকে পাঠিয়েছিলেন কবিগুরু। ১৯২৫ সালের ২৯শে অক্টোবর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,
‘বাংলা কবিতার একটা বই তোমায় পাঠাচ্ছি, যেটা তোমার হাতে নিজে তুলে দিতে পারলেই খুশি হতুম। বইখানা তোমায় উৎসর্গ করা, যদিও এর ভিতরে কী রয়েছে তা তুমি জানতে পারবে না। এই বইয়ের অনেক কবিতাই লেখা হয়েছিল সান ইসিদ্রোয় থাকার সময়ে’।
এর বহুদিন পরে ১৯৪০ সালের জুন মাসে ওকাম্পো চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন : ‘কবি, যে বইটি তুমি আমাকে উৎসর্গ করেছিলে তার নাম কি?’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪০ সালের ১০ই জুলাইয়ের চিঠিতে এর উত্তরে জানিয়েছিলেন, ‘যে বইটি তোমাকে উৎসর্গ করেছিলাম তার নাম জানতে চেয়েছ। এর নাম পূরবী; মানে পূর্বদিক -স্ত্রী লিঙ্গে।’ (২৫)
অবশ্য কেবল ‘পূরবী’ নয়, এর পরে প্রকাশিত যোগাযোগ উপন্যাস (১৯২৮) এবং ‘মহুয়া’ (১৯২৯)র অনেক কবিতায় (প্রতীক্ষা, বাপী, প্রচ্ছন্ন, অসমাপ্ত, দূত, আহবান, দীনা ইত্যাদি) ওকাম্পোর ছায়া দেখতে পান কেতকী সহ অনেকে। এমনকি মহুয়া কাব্যগ্রন্থের পরেও নানা কবিতায় কেতকী লক্ষ্য করেছেন ওকাম্পোর সরব উপস্থিতি — নির্বাক, ভীরু, তুমি (পরিশেষ, ১৯২৩); অচেনা, আরশি, প্রভেদ, নীহারিকা, অনাগতা, বিদায়, বেসুর (বিচিত্রিতা, ১৯৩০), শেষ সপ্তকের (১৯৩৫) সকল কবিতা, উদাসীন, বিহ্বলতা, ব্যর্থ মিলন, অপরাধিনী, বিচ্ছেদ, বিদ্রোহী, ক্ষণিক, রাতের দান, অন্তরাত্মা (বীথিকা, ১৯৩৫), মায়া, নারী, হঠাৎ মিলন, দূরবর্তিনী, বিমুখতা, অসময়, মানসী, শেষ কথা (সানাই, ১৯৪০) ইত্যাদি। অবশ্য সে কবিতাগুলোর সবগুলোই কেবল ‘ব্যক্তিপ্রেম’ নির্ভর নাকি একান্তই ‘নৈর্ব্যক্তিক’, এ প্রশ্ন তোলাই যায়, যেমনটি তুলেছেন সাহিত্য সমালোচক নিত্যপ্রিয় ঘোষ, তাঁর ‘সন্ধানের সাহস’ প্রবন্ধে; বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী প্রেমের কবিতাগুলো একমাত্র ওকাম্পো-অনুপ্রাণিত, সেই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় — রবীন্দ্রনাথের পৃথিবীকে তাহলে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ করে ফেলা হয়’ (২৬)।
রবীন্দ্র-জীবনে ওকাম্পোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ বয়সে ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠা (২৭)। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ছবি আঁকার শখকে উল্লেখ করেছেন ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’ হিসেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর ভিত্তিটি গড়ে উঠেছিল ওকাম্পোর বাড়িতেই, সেই ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ তৈরির সময়। ওকাম্পো লিখেছেন (২৮)—
‘ওঁর একটি ছোট খাতা টেবিলে পড়ে থাকতো, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন বাংলায়। বাংলা বলেই যখন-তখন খাতাটা খুলে দেখা আমার পক্ষে তেমন দোষের কিছু ছিল না। এই খাতা আমায় বিস্মিত করল, মুগ্ধ করল। লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তার ওপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি। এই আঁকিবুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতো নানা রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল। সমস্ত ভুল, সমস্ত বাতিল করা লাইন, কবিতা থেকে বহিষ্কৃত সব শব্দ এমনি করে পুনর্জীবিত হতো এক ভিন্ন রূপের জগতে, আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন স্নিগ্ধ কৌতুকে হাসত তারা … এই ছোট খাতাটাই হলো শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব।’
ওকাম্পোর বাসায় বসে কবিতা লিখতে গিয়ে কবিগুরু যে সমস্ত বিচিত্র কাটাকুটি করতেন, তা দেখে মাঝে সাঝে ওকাম্পো ঠাট্টা করে বলে বসতেন (২৯) — ‘সাবধান, তোমার কবিতায় যত ভুলভ্রান্তি থাকবে, তুমি তো তত বেশিই ছবি এঁকে মজা পাবে। শেষে দেখবে যে, নিজে ইচ্ছে করেই বাজে কবিতা লিখছো’।
ওকাম্পো আরো লিখেছেন (৩০) —
‘… তাঁর এই আঁকিবুঁকিতে তো আমি মেতে গেলাম। ব্যাপারটায় ওঁকে উশকে দিলাম। সান ইসিদ্রোর ছ’ বছর পর প্যারিসে যখন আবার দেখা হলো কবির সাথে, ঐ খেলা তখন দাঁড়িয়ে গেছে ছবিতে’।
তবে ওকাম্পো যত সহজে বলেছেন ‘প্যারিসে যখন আবার দেখা হলো কবির সাথে, ঐ খেলা তখন দাঁড়িয়ে গেছে ছবিতে’ — ব্যাপারটা আসলে এতো সহজ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মাথায় তাঁর ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর সুপ্ত একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল বটে, আর সেজন্য ১৯৩০ সালে প্যারিসে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর হাতে আঁকা চারশো ছবি; কিন্তু সেখানে গিয়ে বুঝলেন, সেখানে ছবির প্রদর্শনী করা অত সহজ নয়। ভাল গ্যালারি এমনিতেই চট করে পাওয়া যায় না, আর তার মধ্যে আবার প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের জানাশোনাও ছিল কম।
কিন্তু এবারেও উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন সেই ‘সেনিওরা ওকাম্পো’। সৌভাগ্যবশতঃ সেই সময়টা ওকাম্পো প্যারিসেই ছিলেন। তিনি আসলে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর জীবনের ‘নতুন পুরুষ’ পিয়া দ্রিউ রা হোসেলের সাথে। ওকাম্পো প্যারিসে আছেন জেনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টেলিগ্রাম করেছিলেন । হয়তো ভেবেছিলেন এতো মানুষের সাথে সংযোগ রাখা ওকাম্পো কোনভাবে সাহায্য করতে পারবেন।
শেষ পর্বে সমস্ত ফুট নোট দেওয়া রয়েছে।
(ক্রমশ)