শনিবার | ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:০২
Logo
এই মুহূর্তে ::
সৌরভ হোসেন-এর ছোটগল্প ‘সালাম’ বঙ্গের শক্তি-পূজা : সুখেন্দু হীরা পুজোর পরিবর্তন, পরিবর্তনের পুজো : সন্দীপন বিশ্বাস পিতৃপক্ষের মধ্যে পালিত একাদশী — ইন্দিরা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত অরণ্যের অন্তরালে তাম্বদি সূরলা : নন্দিনী অধিকারী ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হীরালাল সেন : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্যাসাগরের অন্তরালে ঈশ্বরচন্দ্র, পূর্ব পুরুষের ভিটে আজও অবহেলিত : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব সুধীর চক্রবর্তী স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার : দীপাঞ্জন দে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে দুর্গা রূপে আরাধনা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালির নিজস্ব দুর্গা : শৌনক দত্ত সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার : দিলীপ মজুমদার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘প্রাতঃভ্রমণ’ বন্যায় পুনর্জীবন বেহুলার : রিঙ্কি সামন্ত গরানহাটা কি ছিল ভেড়ার হাট : অসিত দাস ডিভিসি-র ছাড়া জলে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ নাজেহাল, দায় কার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা : দীপাঞ্জন দে বোর্হেসের গোলকধাঁধা : অশ্রুকুমার সিকদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের দুর্গোৎসব : রিঙ্কি সামন্ত মর্ত্যে দুর্গাপূজার সেকাল ও একাল : অসিত দাস বই-বাই : নবনীতা দেব সেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘প্রবাসী’ ম্যান মেড নয় ডিভিসি-র পরিকল্পনা আর রূপায়নে গলদ : তপন মল্লিক চৌধুরী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে রাখাইনে সেইফ জোন তৈরি করা আবশ্যক : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ফলের নামটি পাকা কলা : রিঙ্কি সামন্ত বই-বাই : নবনীতা দেব সেন হেমচন্দ্র বাগচীর ১২০তম জন্মবর্ষ : দীপাঞ্জন দে নিম্ন চাপের অতিবৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত আরামবাগ : দেবাশিস শেঠ আরামবাগে ভয়াবহ বন্যা, দুর্যোগের পদধ্বনি, ক্ষোভ জনমানসে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মেয়েদের ক্ষমতায়নের পক্ষেও আওয়াজ তুলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার : দিলীপ মজুমদার

দিলীপ মজুমদার / ৮২ জন পড়েছেন
আপডেট বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বারান্দায় বসে আছেন জগদীশচন্দ্র। বেশ শীত পড়েছে। কিন্তু তাঁর তেমন শীতবোধ হচ্ছে না। আসলে ভাবনার তরঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছেন তিনি। মনের আয়নায় দেখছেন কত ছবি। তাঁর স্ত্রী অবলা সংবেদনশীলা। চেনেন স্বামীকে। রান্নাঘরের কাজ শেষ হয়ে গেছে বহুক্ষণ। রাত দশটা বেজে গেছে কখন। তবু ডাকেন নি স্বামীকে। ধ্যানভঙ্গ করেন নি তাঁর। বহু দিন ধরে তাঁর স্বামী যে স্বপ্ন দেখে আসছিলেন, আজ তা সার্থক হয়েছে। হয়তো সে সব কথাই ভাবছেন তাঁর স্বামী।

ঠিক ধরেছেন অবলা। জগদীশচন্দ্রও ভাবছিলেন তাঁর স্বপ্ন সার্থক হওয়ার কথা। আজ বসু বিজ্ঞান মন্দিরের উদ্বোধনী সভায় তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র তাঁর ভাষণে বলেছেন : “আজ ১৯১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। আজ থেকে একশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দু কলেজ। আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্র। একশো বছর পরে আজ প্রতিষ্ঠিত হল বসু বিজ্ঞান মন্দির। ভারতীয় বিজ্ঞানীর নিজস্ব গবেষণাগার। এত দিন পরাধীন দেশে নিজস্ব গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ ছিল না ভারতীয় বিজ্ঞানীর।

জগদীশের মনে পড়ছে কত পুরানো কথা। কত লাঞ্ছনা, কত অপমান, কত নিগ্রহ। সেগুলি সব জড়িয়ে আছে পরাধীনতার বেদনার সঙ্গে। জগদীশ দগ্ধ হয়েছেন নীরবে। কিন্তু ভয় পান নি, ভেঙে পড়েন নি কখনও, হন নি হতাশ। বন্ধু রবীন্দ্রের বাণী তাঁকে প্রেরণা দিয়েছে। সংকটের কল্পনাতে হোয় না ম্রিয়মাণ। নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না মানো। মুক্ত করো ভয়। আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।

চলার পথে প্রতিবন্ধকতা ছিল পাহাড় প্রমাণ। শত্রু ছিল। কিন্তু বন্ধুও তো ছিল। সংখ্যায় তারা স্বল্প, কিন্তু তাদের প্রেরণা অসীম। বড় বেশি মনে পড়ছে সেই তিন পরম সুহৃদের কথা। মনে পড়ছে রবীন্দ্র, মিসেস ওলি বুল আর মার্গটের কথা। আজকের উদ্বোধনী সভায় এই তিন বন্ধুর কেউ ছিলেন না, এটা কি কম বেদনার কথা!

তিন বন্ধুর একজন হলেন রবীন্দ্রনাথ। গত বছর মে মাসে জাপান হয়ে তিনি গেছেন আমেরিকা। সেখানে মেজর পণ্ড আয়োজন করেছিলেন তাঁর বক্তৃতার। তখন বক্তৃতা করে করে রবীন্দ্রনাথ ক্লান্ত ও বিরক্ত। মেজর পণ্ডের সঙ্গে তাঁর যে চুক্তি হয়েছিল তা ভঙ্গ করে দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল তিনি। রবীন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত কিন্তু বড় দেরিতে হল। মাস দুই আগে সিদ্ধান্ত নিলে তিনি আজকের উদ্বোধনী সভায় থাকতে পারতেন।

আর এক পরম সুহৃদ মিসেস ওলি বুল। বিবেকানন্দ যাঁকে ‘ধীরা মাতা’ বলে ডাকেন। বিবেকানন্দের মতো জগদীশচন্দ্রও এই আমেরিকান নারীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন মাতৃস্নেহ।

মার্গটের মুখে জগদীশ শুনেছিলেন মিসেস বুলের আশ্চর্য জীবন কাহিনি। বিয়ের আগে তাঁর নাম ছিল মিস সারা থর্প। আমেরিকান এই নারীর পিতা জোসেপ জি থর্প ছিলেন এক ধনী ব্যবসায়ী এবং ম্যাডিসনের স্টেট সেনেটর। ইয়াংকি হিলের সুরম্য প্রাসাদে বাস করতেন তাঁরা। সে প্রাসাদে লেগে থাকত মজলিশ। শহরের উচ্চবর্গের অভিজাতরা সমবেত হতেন। একদিন সেই মসজিদে এলেন ওলি বুল। তখনকার কালের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ। ওলি বুলের সঙ্গে পরিচয় হল মিস সারার। ওলি বুলের বয়স তখন ষাটের কাছাকাছি, আর সারার বয়স সতেরো। ওলি বুলকে দেখে মিস সারার চোখে কোন আলো যে লাগল কে জানে! তিনি ওলি বুলের প্রেমে পড়লেন। এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে এক তরুণীর প্রেম! প্রেমের পরে আসে বিয়ের প্রশ্ন। এ বিয়েতে মত ছিল না সারার বাড়ির। স্বাভাবিক। কোন অভিভাবক মেনে নেবে একম অসম ও বিষম বিবাহ! শুধু তো বয়েস নয়, দুজনের জীবন পরিবেশের পার্থক্যও দুস্তর। এক নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশে মানুষ হয়েছে ; আর ওলি বুল নিয়মহারা, বোহেমিয়ান। তবে বাবা সরে দাঁড়ালেও সারার মা মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন। ১৮৭০ সালে ওলি বুলের সঙ্গে বিয়ে হল সারার। তিনি হলেন মিসেস ওলি বুল। কিন্তু বিয়ের বন্ধন স্থায়ী হল না দীর্ঘদিন। জাত বোহেমিয়ান ওলি বুলকে নিয়মের বন্ধনে বাঁধতে পারলেন না সারা। তাই বিবাহ বিচ্ছেদ হল। শিশু কন্যা ওলিয়াকে নিয়ে সারা চলে এলেন ম্যাডিসনে। ততদিনে বাবা মারা গেছেন, ম্যাডিসনের বিশাল প্রাসাদে মা থাকেন একা। বছর দুই মায়ের সঙ্গে থাকার পরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন সারা। আসলে ওলি বুলের বোহেমিয়ান মনোভাব তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। ম্যাডিসন থেকে সারা এলেন নরওয়েতে স্বামীর কাছে। বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও প্রেম তো শুকিয়ে যায় নি। স্বামীর মৃত্যুর পরে সারা চলে আসেন কেমব্রিজে। সেখানে ব্রাটল স্ট্রিটে কেনেন এক বিরাট প্রাসাদ। শহরের জ্ঞানী-গুণীদের মিলনক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় সেই প্রাসাদ। এই প্রাসাদেই বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ। বিবেকানন্দের মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন পুত্রের প্রতিরূপ। বিবেকানন্দের সূত্রে ভালোবাসলেন ভারতকে, বাংলাকে।

আমেরিকান এই নারীর মাতৃস্নেহ জগদীশ পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে জগদীশ ছিলেন ‘খোকা’। জগদীশ তাঁর বিজ্ঞান সাধনার পাথেয় পেয়েছিলেন এই নারীর কাছ থেকে। বই কেনার, যন্ত্রপাতি কেনার, সহকারী রাখার ব্যয়ভার বহন করেছেন মিসেস ওলি বুল। চিঠিতে জগদীশ তাঁকে সম্বোধন করতেন ‘ডার্লিং মাদার’ বলে।

আজকের উদ্বোধনী সভায় ছিলেন না সেই মাতা। বিবেকানন্দ যাঁর মধ্যে ঋষির লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন, সেই ওলি বুল শেষ পর্যন্ত বিকারগ্রস্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন ১৯১০ সালের ১৮ জানুয়ারি তারিখে।

রবীন্দ্র বা মিসেস বুলের অনুপস্থিতি জগদীশকে এতটা কাতর করত না, যদি আর একজন আজ উপস্থিত থাকতেন। সেই আর একজন জগদীশচন্দ্রের মার্গট। মার্গট হলেন মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল। আজ বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দ্বারোদঘাটন করার আগে জগদীশচন্দ্র দ্বারপ্রান্তে স্থাপন করেছিলেন নারী-দধীচি মার্গারেটের অস্থি। বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতীক হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন বজ্রকে। তিনি জানতেন বুদ্ধগয়ায় গিয়ে বুদ্ধবেদীমূলে মার্গারেট আবিষ্কার করেছিলেন বজ্রচিহ্ন, পরে তিনি বলেছিলেন, স্বার্থশূন্য মানুষই বজ্র ; সে-ই নিঃস্বার্থতার সাধনা আমাদের করতে হবে যাতে দেবহস্তের বজ্র হয়ে উঠতে পারি।

জগদীশ জানেন মার্গারেট নিজেই স্বার্থহীনতার প্রতীক। তাঁকে ভোলা যায় না। বিজ্ঞান মন্দিরের দ্বারপ্রান্তে দীপশিখা হাতে যে নারীমূর্তি, তিনিই তো তাঁর প্রিয় মার্গট। দেশ ছেড়ে, পরিবার-পরিজন ছেড়ে এই নারী জ্ঞানের দীপশিখা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলায়। ১৮৯৬ সালে ইংল্যাণ্ডে বৈজ্ঞানিক প্রতিভার স্বীকৃতি পাবার পরে জগদীশচন্দ্রের মনে বসু বিজ্ঞান মন্দির স্থাপনের যে স্বপ্ন জেগেছিল, তাকে সার্থক করার জন্য নিজের জীবন যেন উৎসর্গ করেছিলেন মার্গারেট। অথচ দুজনের মধ্যে নানা বিষয়ে মতের অমিল ছিল, ঠোঁটকাটা জগদীশ অনেকবার মার্গারেটকে কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছেন, আক্রমণ করেছেন তাঁর গুরুকে, তবু মার্গারেট জগদীশ-অবলাকে ছেড়ে যান নি কখনও, সাহাষ্যের হাত সংকুচিত করেন নি। এ যেন : তোমার আমার মিল নাই মিল নাই / তাই বাঁধিলাম রাখী।

মার্গারেটের কথা ভাবতে গিয়ে জগদীশচন্দ্রের মনে পড়ছে অনেক পুরানো কথা।

লর্ড রিপনের চেষ্টায় ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে অস্থায়ী পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছিলেন তিনি আর চাকরি জীবনের প্রথম থেকে শুরু হয়েছিল লড়াই। চাকরির ক্ষেত্রে ভারতীয় ও শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্য দূর করা হল প্রথম লড়াই আর দ্বিতীয় লড়াই হল বৈজ্ঞানিক হিসেবে ভারতীয়দের প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টা করা।

ইংরেজরা মনে করত ভারতীয়রা নিম্ন মেধার মানুষ। তাদের পক্ষে বিজ্ঞানশিক্ষা কঠিন না হলেও বৈজ্ঞানিক হওয়া অসম্ভব। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ টনি সাহেবেরও এই ধারনা ছিল। তাছাড়া তখন এ দেশে বৈজ্ঞানিক হওয়ার সুযোগও বেশি ছিল না। নিজস্ব কোন গবেষণাগার ছিল না, মিলত না যন্ত্রনির্মাতা। কিন্তু প্রতিবন্ধকতার কাছে নত করেন নি মাথা। বলেছিলেন, ‘আমার কাছে এই কথাটাই ঝলসে উঠেছিল — পুরুষ মানুষ অবস্থাকে বিরূপ দেখলে তার সঙ্গে ঝগড়া করে না, সাহসের সঙ্গে তার সম্মুখীন হয়ে তার মোকাবিলা করে, তার উপর আধিপত্য করে। তাছাড়া আমরা সেই জাতির মানুষ যে জাতি সামান্য উপাদানে বৃহৎ বস্তু সম্পাদন করেছে।’

সেই সামান্য উপাদান নিয়ে তিনি ২০ স্কোয়ার ফুট ল্যাবরেটরিতে হর্টিজান ওয়ে্ভের উপর মৌলিক গবেষণা শুরু করলেন। তাঁর সেই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হল এশিয়াটিক সোসাইটির বিজ্ঞানপত্রে। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ ও টাউন হলে বেতারবার্তা প্রেরণের পরীক্ষা দেখালেন জগদীশচন্দ্র। তারপর লণ্ডন থেকে ডি এস সি ডিগ্রি লাভ। বৈজ্ঞানিক লর্ড কেলভিন প্রমুখের উচ্চ প্রশংসা। অব্যাহত বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রা। লিভারপুল ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে বিদ্যুৎ তরঙ্গের উপর ভাষণ। ‘টাইমস’ ও ‘স্পেকটেটর’ পত্রিকার প্রশংসা। তখন ইংল্যাণ্ডের বৈজ্ঞানিক সমাজ বললেন যে ভারতীয় বিজ্ঞান সাধকের জন্য উপযুক্ত গবেষণাগার প্রয়োজন।

এরপরেও কিন্তু জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান সাধনার পথ মসৃণ হয় নি। এদেশের ইংরেজ শাসকদের একাংশ তাঁর বিরুদ্ধতা করে গেছেন।

আর সেই সময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মার্গারেট ও মিসেস বুল। এ কথা ভেবে জগদীশ আপন মনে একটু কৌতুক বোধ করেন। বিবেকানন্দের শিষ্যা তাঁর মতো এক ব্রাহ্মের এত অনুরাগী হলেন কি করে!

হয়তো বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্যাকে বলেছিলেন make in-roads into the Brahmas. জগদীশের মনে পড়ল ১৮৯৮ সালের ডিসেম্বরের কথা। আমেরিকান দূতাবাসে কলকাতার ব্রাহ্মবন্ধুদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেদিনই নিবেদিতার সঙ্গে মুখোমুখী আলাপ জগদীশচন্দ্রের। ব্রাহ্মদের অদ্বৈত তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মার্গারেট।

উত্তরে জগদীশ বললেন, অদ্বৈত তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণ আছে বিজ্ঞানের। চান কি?

— হ্যাঁ, চাই।

— জ্ঞান আর বিজ্ঞানের অনুভব যে অভিন্ন তা কি বিশ্বাস করেন?

— করি। উপনিষদে সে রকম ইঙ্গিত আছে।

১৮৯৯ সালের ২৩ জানুয়ারিতে ব্রাহ্মদের একটা চা-চক্রে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, প্রসন্নকুমার রায়, সরলা ঘোষাল, স্বর্ণকুমারী দেবী। কিন্তু সেখানেও in-road তৈরির কাজ বিশেষ সুবিধে হয় নি।

মার্গারেটকে জগদীশ আঘাতের পর আঘাত দিয়ে গেছেন। মনে পড়ে একবার বলেছিলেন, তোমাদের স্বামীজি যে রামকৃষ্ণকে দেবতা বানিয়ে তুলছেন, তাতে আমার বিরক্তি বাড়ছে।

মার্গারেট বললেন, রামকৃষ্ণ কি দেবতা হবার যোগ্য নন?

— দেবতা! রামকৃষ্ণ! সংকীর্ণ ছাঁচে গড়া এক মানুষ, যিনি মেয়েদের প্রায় আধা-শয়তানি বলে মনে করতেন, আর মহিলা দেখলে মূর্চ্ছা যেতেন, তিনি দেবতা?

শুধু কি তাই, জগদীশ মার্গারেটকে কখনও নিবেদিতা বলে ডাকেন নি। বরং রাখঢাক না করে বলেছিলেন, আপনাকে মিস নোবলের পরিবর্তে সিস্টার নিবেদিতা বলে ডাকতে আমার কষ্ট হয়।

কারণ জানতে চেয়েছিলেন মার্গারেট।

উত্তরে জগদীশ বলেছিলেন, নাম বদলের ফলে মনে হচ্ছে আপনার মানবিক সম্পদে টান পড়েছে। নাম বদল করে আপনি নিজেকে সংকীর্ণ করে ফেলেছেন। সেটা আমাকে কষ্ট দেয়।

এ কথায় কষ্ট পেয়েছিলেন মার্গারেটও। বন্ধু মিস ম্যাকলাউডকে তিনি এক চিঠিতে এই ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছিলেন : ‘একটা দুঃস্বপ্নের মতো তার কথাগুলো আমাকে তাড়া করে ফিরছে। আমি যাকে ভালোবাসি, বিশ্বাস করি, তাদের কেউ কি কখনও আমাকে সংকীর্ণমনা মনে করেছে ? তোমরা কখনও করেছ? তুমি বা সারা?’

আঘাতের পর আঘাত দিয়ে গেছেন জগদীশ। কিন্তু মার্গারেট তাঁকে ছেড়ে যান নি। আচ্ছা, এ ব্যাপারে বিবেকানন্দ তাঁকে কিছু বলেন নি? মার্গারেট তো লুকিয়ে-চুরিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন নি, জগদীশের মতামত জেনেই তাঁর সঙ্গে মিশেছেন।

রহস্যটা কি?

জগদীশের বিজ্ঞান সাধনা সফল করে তুলতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করে গেছেন এই বিদেশিনি। মিসেস বুলকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান সাধনার জন্য অর্থ সাহায্য করতে। তাঁকে মার্গারেট বলেছিলেন, তুমি এ কথা নিশ্চয়ই জানো যে আমি বসুদের কি রকম ভালোবাসি। আমি আশা করব যে তুমি ড. বসুকে অন্তরে গ্রহণ করবে পুত্র বলে।

এর রহস্যটা কি?

ধর্মমতের দিক থেকে পার্থক্য থাকলেও মার্গারেট কি তাহলে জগদীশ ও তাঁর পরিবারকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন? ভালোবাসা কোন পার্থক্যকে স্বীকার করে না।

জগদীশের মনে পড়ছে প্যারিসের আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের কথা। কংগ্রেসের পরে দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। বিদেশ-বিভুঁইতে দিশেহারা তাঁর স্ত্রী অবলা বসু। সে সময়ে মার্গারেট পাশে না থাকলে কি যে হত! কি অক্লান্ত সেবা তাঁর। যেন তিনি তাঁর রক্তের সম্পর্কে আত্মীয়। ম্যাকলাউডকে লেখা চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর মনের কথা : “১২ তারিখে ড. বসুর অপারেশন হল। তারপর আমরা সর্বদা তাঁর রক্ষণাবেক্ষণে আছি। তিনি বিপদ কাটিয়ে উঠেছেন বলে মনে হয়। এই বাড়ির একটি ঘরে তাঁর স্ত্রী থাকেন। আমি ও তাঁর স্ত্রী পালা করে ড. বসুর সঙ্গে কাটাই। আমার মনে হয়, আমরা সবাই আশা করি, অসুখের আগে তিনি যা ছিলেন, তার চেয়ে অনেক ভালো ও শক্তিশালী হয়ে উঠবেন।”

শুধু সেবা নয়, আরও অনেকভাবে মার্গারেট সাহায্য করেছেন তাঁকে।

ইউরোপ আমেরিকায় তাঁর চাকরির জন্য চেষ্টা করেছেন, চেষ্টা করেছেন অর্থ সংগ্রহের, তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, সংবাদপত্রে তাঁর বৈজ্ঞানিক সাফল্যের প্রচার করেছেন, গবেষণাপত্র বা গ্রন্থ রচনায় বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত।

নিজের লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ Plant Response এর কথা খুব মনে পড়ে। মার্গারেট তো এই বইকে ‘আমাদের বই’ বলতেন। সে কথা একেবারে আক্ষরিকভাবে সত্য। পরবর্তী বইএর ক্ষেত্রেও সে কথা সত্য। বহু পেপারের লেখা ও নকশা তৈরির মূল দায়িত্ব ছিল তাঁর।

মার্গারেটের কথা ভাবতে ভাবতে জগদীশের মনের আয়নায় ভেসে উঠল এক নবজাতকের মুখচ্ছবি। তাঁরই সন্তান। কিন্তু তিনি ও তাঁর স্ত্রী লাভ করতে পারেন নি সন্তানসুখ। মধ্যরাতে মৃত অবস্থায় জন্ম হয়েছিল তার। পৃথিবীর মুখও সে দেখতে পায় নি।

মার্গারেট তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন : শিশুকন্যাটিকে দু-এক মুহূর্তের জন্যও আমরা হাতে তুলে নিতে পারলাম না, আমাদের এই মানুষের পৃথিবীতে তার আত্মাকে স্বাগত জানাবার জন্য ব্যাপটিজমের মতো কোন অনুষ্ঠান করা গেল না –তার আগেই সে চলে গেল অনুদ্বিগ্ন, অকলঙ্করূপে। সে যাই হোক, আমার কাছে তুমি চিরদিনের মা। যদি তুমি কোন চলতি আনন্দকে হারিয়ে থাকো, আমি জানি, আমি বিশ্বাস করি, তুমি একই সঙ্গে সেই মহান জীবন্ত শক্তি লাভ করেছ যার ফলে আরও বেশি করে সার্বভৌমিক মাতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সারদাদেবী নিজের একটি সন্তান চেয়েছিলেন, রামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন : ওগো একদিন তুমি এত ছেলে পাবে যে তাদের নিয়ে কি করবে তা ঠিক করতে পারবে না।

হাতে দীপশিখা নিয়ে যে নারী তাঁর ও তাঁর দেশের জীবনে আবির্ভূত হয়েছিলেন, বড় অকালে তাঁকে চলে যেতে হল। মার্গারেটের এই অকাল বিদায়ের জন্য তিনিও কি দায়ী নন! চমকে উঠলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু।

মিসেস বুলের মৃত্যুর পরে তাঁর কন্যা ওলিয়া যে আঘাত দিয়েছিল, তা আর সহ্য করতে পারেন নি মার্গারেট। মিসেস বুল শেষ জীবনে যে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়েছিলেন তার জন্য ওলিয়া দায়ী করেছিলেন মার্গারেটকে।

মৃত্যুর আগে উইল করে গিয়েছিলেন মিসেস বুল। সে উইলে জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানসাধনার জন্য, ভারতে নারী শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ছিল অনেক অর্থ। সে সব জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তাঁর কন্যা ওলিয়া। তিনি একের পর এক অভিযোগের তির ছুঁড়তে থাকেন মার্গারেটের দিকে …

… কেন তাঁর মায়ের অর্থ যাবে ভারতে? কেন ভালোমানুষির মুখোশ পরে মার্গারেট ছুটে এসেছে ভারত থেকে? তাঁর মায়ের টাকা আত্মসাৎ করাই কি মার্গারেটের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়? কবিরাজি ওষুধের নাম করে মার্গারেট কি বিষ খাওয়ায় নি তাঁর মাকে? আর তার গুরু বিবেকানন্দের কুশিক্ষায় তার মা কি ভৌতিক চেতনায় আচ্ছন্ন হয় নি? …

জগদীশের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল জল।

যে মার্গারেট নিজের জন্য কিছু চান নি, নিজের জন্য কিছু করেন নি কখনও, এ আঘাত তিনি সহ্য করতে পারলেন না। ১৯১০ সালের ১৩ অক্টোবর দার্জিলিংএ তাঁদের বসুভবনে মৃত্যু হল তাঁর। জগদীশের স্ত্রী লিখেছিলেন : ‘তাঁর শয্যাপার্শ্বে বসে আছি আমি। তিনি হৈমবতী উমার যে কাহিনি বলতেন, তা চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই তো সেই ঋতু, যখন উমা তাঁর পিতৃগৃহে আসেন। আমার সামনেও আর এক উমা, তুষারশুভ্র তুষারকন্যা। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরে ফিরে এসেছেন আবার তাঁর ভারত ভবনে। তাঁর স্বজন, তাঁর স্বগৃ্হকে জানবার জন্য কি তাঁর এই আবির্ভাব প্রয়োজন ছিল ? না কি আমাদের পিতার গৃহে উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম বলে কোন কথা নেই?’

অবলা বসু এসে দাঁড়ালেন স্বামীর সামনে। জগদীশের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললেন, আমি জানি তুমি মার্গটের কথাই ভাবছ।

পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন