বারো.
যতদূর মনে পড়ে ১৯২৮ সালে নজরুলের দ্বিতীয়বার ঢাকা আগমনে কুমারী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় নিয়ে একই ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়। ফজিলাতুন্নেসা অসামান্যা সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীণানিন্দিত মঞ্জুভাষিণী’ও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম.এ. এবং একজন উঁচুদরের বাকপটু মেয়ে। তিনি আমার বান্ধবী ছিলেন এবং আমার কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন যে কবি একজন সৌখিন হস্তরেখাবিদ। আমাকে তিনি কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্যে অনুরোধ করেন। যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ফজিলাতুন্নেসার গৃহে আমি উপনীত হই। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কবি ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্করেখা, জীবনরেখা, হৃদয়রেখা, সংলগ্ন ক্ষুদ্র রেখাসমূহ এবং সেইসঙ্গে ক্রস, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ সমন্বিত অন্যান্য মাউন্ট, শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থানগুলো নিরীক্ষণ করলেন; কিন্তু এগুলোর সম্বন্ধ-সূত্রের ফলাফল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একজন জ্যোতিষীর মত সূর্য-চন্দ্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত তারকার অবস্থান টুকে নিলেন এবং রাত্রিতে তিনি বিশদভাবে এটা নিয়ে পরীক্ষা করবেন বলে জানালেন। ঘন্টাখানেক পরে আমরা ফিরে এলাম। রাত্রে খাবার পর প্রতিদিনকার অভ্যাসমত আমরা শুতে গেলাম। তখন রাত প্রায় এগারোটা হবে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর হওয়ার আগে জেগে উঠে দেখলাম নজরুল নেই। বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম নজরুল কোথায় যেতে পারে। সকালে নাস্তার সময় তিনি ফিরে এলেন এবং তাঁর অমনভাবে অদৃশ্য হওয়ার কারণ বললেন :
রাত্রে ঘুমিয়ে আমি স্বপ্নে দেখলাম একজন জ্যোতির্ময়ী নারী তাকে অনুসরণ করার জন্য আমাকে ইঙ্গিত করছে। কিন্তু জেগে উঠে সেই দেবীর পরিবর্তে একটি অস্পষ্ট হলুদ আলোর রশ্মি দেখলাম। আলোটা আমাকে যেন ইঙ্গিতে অনুসরণ করতে বলে, আমার সামনে সামনে এগিয়ে চলছিল। আমি বিস্ময় ও কৌতূহল নিয়ে কিছুটা অভিভূত হয়ে সেই আলোকরেখার অনুসরণ করছিলাম। মিস ফজিলাতুন্নেসার গৃহের কাছে না পৌঁছান পর্যন্ত আলোটা আমার সামনে চলছিল। তাঁর বাড়ীর কাছে পৌঁছতেই আলোটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি দেখলাম একটি ঘরের মধ্যে তখনও একটি মোমের বাতি জ্বলছে। রাস্তার ধারের জানালার কাছে সম্ভবতঃ পথিকের পায়ের শব্দ শুনে গৃহকর্ত্রী এগিয়ে এসে ঘরের প্রবেশ-দরোজা খুলে দিলেন এবং মিস ফজিলাতুন্নেসার শয়ন-ঘরের দিকে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। ফজিলাতুন্নেসা তাঁর ঘরের দরোজা খুলে আমাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন। কুমারী নেসা তাঁর শয্যার উপর গিয়ে বসলেন আর আমি তাঁর সামনে একটি চেয়ারে বসে তাঁর কাছে প্রেম যাঞ্চা করলাম, তিনি দৃঢ়ভাবে আমার প্রণয় নিবেদন অগ্রাহ্য করলেন।
এই হচ্ছে সামগ্রিক ঘটনা— একে মানসচক্ষে নিয়ে আসা কিংবা এর রহস্যোদ্ঘাটন করা অত্যন্ত কঠিন। সূর্য উঠার পর কোথায় ছিলেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : ঐ ঘটনার পর নিরতিশয় ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়ি; তাই ভোর বেলা রমনা লেকের ধারে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিলাম।
এটা অবশ্য একটা যুক্তিসঙ্গত বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার। কেননা নজরুল রমনার লেক ভালবাসতেন এবং লেকের ধারে সাপের আস্তানা আছে জেনেও সেখানে ভ্রমণ করতে যাওয়া তাঁর পক্ষে আদৌ অসম্ভব ছিল না। কিন্তু আরও একটি বিস্ময়ের ব্যাপার তখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঐদিন দুপুরে লক্ষ করলাম ফজিলতের গলার লম্বা মটর-মালার হারটা ছিড়ে দু’ খান হয়ে গিয়েছে। পরে সেটা সোনারুর দোকান থেকে সারিয়ে আনতে হয়েছিল। অত্যন্ত কাছ থেকে জোরাজুরি ছাড়া এমন একটা কাণ্ড কেমন করে ঘটতে পারে আমার পক্ষে তা বুঝে উঠা মুশকিল। নজরুল ইসলাম আমার কাছে ও ফজিলাতুন্নেসার কাছে যেসব দীর্ঘ পত্র লিখেছিলেন তা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় এমন অঘটন কিছু ঘটেছিল যাতে ফজিলতের হৃদয় তিনি জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ঐসব চিঠিপত্রে নজরুলের হৃদয়ের গভীর হাহাকার ব্যক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের সত্যতা সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এক্ষেত্রে নোটনের ব্যাপারে যেমনটি ঘটেছিল ফজিলতের ব্যাপারেও ঠিক তাই-ই ঘটেছিল।
তেরো.
কুমারী ফজিলাতুন্নেসার বিলাত গমন উপলক্ষে নজরুল “বর্ষা-বিদায়” নামক একটি কবিতা লেখেন। তাঁর বিখ্যাত প্রেমের কবিতাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। কিন্তু কবিতাটি এমন নৈর্ব্যক্তিকভাবে লেখা যে অধিকাংশ পাঠকের পক্ষে এর ব্যঙ্গার্থ কিংবা রূপকের রহস্যভেদ করা কঠিন। তাঁরা শুধু দেখবেন প্রকৃতি কিভাবে বর্ষা ঋতু থেকে শীত ঋতুতে রূপ পরিবর্তন করছে। অথবা অন্যভাবে বলা যায় যে তিনি তাঁর অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে চেতনাশ্রিত কল্পনায় এমনভাবে জারিত করে নিয়েছিলেন যা থেকে তিনি মুক্তোর মত এমন কতকগুলো কবিতা রচনা করেন যা তাঁর অনুভূতিকে বিশ্বচারিত্র্য দান করেছে। অসাধারণ ক্ষমতাবান কবি ছাড়া বক্তব্য বিষয়কে এমন অনিন্দ্যসুন্দর রূপকের আড়ালে ব্যক্ত করা অসম্ভব। আমি কবিতাটির নির্বাচিত কয়েকটি পংক্তি এখানে তুলে দিলাম :
ওগো বাদলের পরী।
যাবে কোন দূরে ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী
ওগো ও ক্ষণিকা পূব অভিসার ফুরাল কি আজি তব?
পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন দেশ অভিনব?
তোমার কপোলে পরশ না পেয়ে পাণ্ডুর কেয়া রেণু,
তোমারে স্মরিয়া ভাদরের ভরা নদীতটে কাঁদে বেনু।
**
ওগো ও কাজল মেয়ে –
উদাস আকাশ ছল ছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে।
কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।
ওগো ও জলের দেশের কন্যা! তব ও বিদায় পথে
কাননে কাননে কদম কেশর ঝরিছে প্রভাত হতে ।
**
তুমি চলে যাবে দূরে –
ভাদরের নদী দু’কূল ছাপায়ে কাঁদে ছল ছল সুরে!
যাবে যবে দূর হিমগিরি শিরে, ওগো বাদলের পরী
ব্যথা করে বুক উঠিবে না কভু সেথা কাহাকেও স্মরি।
সেথা নাই জল, কঠিন তুষার নির্মম শুভ্রতা,—
কে জানে কী ভালো বিধূর ব্যথা – না মধুর পবিত্রতা।
সেথা রবে তুমি ধেয়ানমগ্না তাপসিনী অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি “ফটিকজল”।
চোদ্দ.
বাদলের পরীর সঙ্গে আর একটি কবিতার যে অনেকখানি মিল আছে সে কথাটি আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই । এই কবিতাটিও ফজিলাতুন্নেসার বিলাত গমন উপলক্ষে রচিত। কবিতাটি এমনি :
জাগিলে “পারুল” কি গো “সাতভাই চম্পা” ডাকে।
উদিলে চন্দ্রলেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে!
চলিলে সাগর ঘুরে
অলকার মায়ায় পুরে,
ফোটে ফুল নিত্য যেথায়
জীবনের ফুল-শাখে
আঁধারের বাতায়নে চাহে আজ লক্ষ তারা,
জাগিছে বন্দিনীরা টুটে ঐ বন্ধকারা
থেকোনা স্বর্গে ভুলে –
এ পারের মর্ত্য কূলে
ভিড়ায়ো সোনার তরী
আবার এই নদীর বাঁকে।।
এই কবিতাটিতে নজরুল তাঁর মনের ভার গোপন করেন নি, ফজিলাতুন্নেসাকে ফিরে আনার জন্য সরাসরি আবেদন করেছেন। কিন্তু আরও একটি কবিতায় এবং ‘বুলবুল’ ও ‘চোখের চাতক’-এর অনেকগুলি কবিতায় কবি তাঁর অন্তরের গভীর অনুভূতিকে বিভিন্ন অর রূপকের আড়ালে ব্যক্ত করেছেন। ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা বছরের সময় সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়। সমান্তরাল আর একটি স্তবকে লক্ষ করা যায় কবি তাঁর আকাঙ্ক্ষিত প্রেমকে সুন্দরতর আর এক জগতে খুঁজে ফিরছেন যেখানে প্রেমে কোনো নৈরাশ্য নেই, কোনো বেদনা নেই। প্রেমের জন্যে নারীর কাছ থেকে তিনি চেয়েছিলেন পূর্ব আত্মসমর্পণ কিন্তু কোথাও তিনি তা পান নি। ফলে ধীরে ধীরে তিনি খোদা-প্রেমের দিকে ঝুঁকে পড়লেন
পরজনমে দেখা হবে প্রিয়
ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও।।
এ জনমে যাহা বলা হল না,
আমি বলিব না, তুমিও বলো না।
জানাইলে প্রেম করিও ছলনা,
যদি আসি ফিরে, বেদনা দিও।।
হেথায় নিমেষে স্বপন ফুরায়,
রাতের কুসুম প্রাতে ঝরে যায়,
ভালো না বাসিতে হৃদয় শুকায়,
বিষ-জ্বালা ভরা হেথা অমিয়।।
হেথা হিয়া ওঠে বিরহে আকুলি’,
মিলনে হারাই দু’দিনেতে ভুলি’,
হৃদয়ে যথায় প্রেম না শুকায়
সেই অমরায় মোরে স্মরিও॥
স্পষ্টতঃই, প্রেমের এই বিশ্বাসহীনতা ও ক্ষণস্থায়িত্বের অভিজ্ঞতা কবিকে পার্থিব প্রেমের প্রতি নিরাসক্ত করে তুলেছিল। তাই তিনি অমর এক প্রেমের জগতে আত্মার শান্তি খুঁজে ফিরছিলেন; যেখানে প্রেম কখনও বিচ্ছেদের জ্বালায় কলুষিত হয়ে ওঠে না— শাশ্বত মিলনের আনন্দই যেখানে সদা প্রবাহিত। [ক্রমশ]
ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা ইংরেজী প্রবন্ধ Nazrul Islam : The singer and writer of songs লেখার অনুবাদ। লেখাটা নজরুল একাডেমী পত্রিকা ৪র্থ বর্ষ, ১ম (গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত ১৩৮১) সংখ্যায় ছাপানো হয়। অনুবাদ করেছিলেন শাহাবুদ্দিন আহমদ।