আজ রাস্তায় হল্টার নেক ব্লাউজ,হাই টপ বুটের সঙ্গে খোলা আঁচল আর চুল উড়িয়ে এক বাসন্তিকা গটগট করে হেঁটে গেলেন।আমি উৎসুক, স্পন্দিত প্রেমিকের মত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলাম। ফিউশন পোশাকে যদি সুন্দরী বাস্তবে এমন স্বচ্ছন্দ হন তো শিল্পী আর কবির কল্পনা কি থেমে থাকতে পারে! তাঁদের তুলির আঁচড়ে,কলমের ডগায় নারী তো বটেই দেবীরাও বিচিত্রবেশধারিনী, নব নব রূপে আবির্ভূতা। যুগে যুগে কালে কালে আমরা তাই বিচিত্র ভাবনায় দেবদেবী কে পেয়েছি। সেই ভাবনার অনুসরণ করে মর্ত্যে তাঁদের আমাদের সুখদুঃখের সঙ্গী করেছি। কখনো তাঁরা আমাদের চৌহদ্দির সীমা ছাড়িয়ে স্বর্গলোকের বাসিন্দা হয়ে রয়ে গেছেন!
বসন্ত পঞ্চমীতে দেবী সরস্বতীকে আমের মুকুল,পলাশ ,অভ্র আর আবীরের অর্ঘ্য দিয়ে আমরা বরণ করে নিলাম। তিনি বসন্তদূতী হলেন। আমরাও সেজে উঠলাম বাসন্তীরঙের পোশাক-আশাকে।
সেই কোন যুগে সরস্বতী নদীর তীরে ঋষিরা বেদ পাঠ করতে করতে নদীকে দেবীত্বে উন্নীত করেছিলেন। নাম দিলেন বাগদেবী। বৈদিক জনগোষ্ঠী ভরতদের বিশেষ উপাস্যা বলে তিনি হলেন ভারতী।
এমন সুন্দরী দেবীটিকে আমাদের সুন্দর জাতীয় পক্ষীটির সঙ্গে খুব মানায়। তাই তিনি রাজহাঁসকে কখনো কখনো ময়ূরবাহনা। এই দেবীকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরা আপন করে নিলেন।
বাংলার শিল্পীরা মেষকেও সরস্বতীর বাহন করেছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সংগ্রহশালায়, আশুতোষ মিউজিয়ামে মেষবাহনা সরস্বতী শোভিত রয়েছেন। মেষবাহনার গল্পটিও ভারি মজার। বিদ্যার দেবীটি চিকিৎসা শাস্ত্রেও দড়। স্বর্গের ডাক্তার অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সঙ্গে থেকে তিনি একবার দেবরাজকে সারিয়ে তুললেন। উপহারস্বরূপ সুরপতি ইন্দ্রের কাছ থেকে বীণাপাণি একটি মেষ উপহার পেয়েছিলেন।
অন্ধ্রপ্রদেশের একটি লেখতে কবি বর্ণনা করছেন, দুধসমুদ্রের অভ্যন্তর থেকে আবির্ভূত হয়ে সর্বশুক্লা দেবী এ ধরায় পা দিলেন। তাই তিনি এমন কুঁদফুলের মত সর্বশুক্লা। পরনে তাঁর শুভ্রবস্ত্র। হাতে ধরা শ্বেত পুন্ডরীক বা পদ্ম। তাঁর সঙ্গগুণে রাজহংসটিও ধবধবে সাদা। দুধ থেকে জল ছেঁকে পান করে পরম জ্ঞানী।
নৃত্যশীলা সরস্বতী মূর্ত হয়েছেন কর্ণাটকের ভাস্কর্যে। হালেবিড়ুর ভাস্কর্যে তিনি ষড়ভুজা। ডানদিকের তিন হাতে পদ্ম, অক্ষমালা, অঙ্কুশ। বামদিকের হাতে পাশ অস্ত্র, বীণা ও পুস্তক। তাঁর দুই দিকে দুই শিল্পী মৃদঙ্গ ও করতাল বাজাচ্ছেন।এই মূর্তিটি কি নটরাজকে মনে পড়ায়? হ্যাঁ সামান্য হলেও দুএকটি মূর্তিতে তিনি জটাজুটধারিণী, ত্রিনয়না। জটায় তাঁর অর্ধচন্দ্র। তাই তিনি শিবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
চতুর্ভুজা ব্রহ্মবাদিনীরূপে তিনি ব্রহ্মার মানসকন্যা। হাতে তাঁর কমন্ডলু, পুস্তক, রুদ্রাক্ষ এবং বীণা।
মহাদেব এবং ব্রহ্মার সঙ্গে জুড়ে আছেন অথচ বিষ্ণু কি বাদ যেতে পারেন?
পুরাণের কবি বললেন,তাঁর উৎপত্তি বিষ্ণুর জিহ্বাগ্র থেকে। তাই তিনি লক্ষ্মীর সপত্নী। তবে লক্ষ্মীর তুলনায় এক্ষেত্রে তাঁর মর্যাদা একটু কম। তাই শুধুমাত্র সরস্বতী-বিষ্ণুমূর্তি অদ্যাবধি পাওয়া যায় নি।
বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মীঠাকরুণ নারায়ণের ঘর সংসার গোছান। ব্রত কথায় তিনি মর্ত্যের দরিদ্র ব্রাহ্মণের বাগানে ফুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। শাস্তিস্বরূপ ব্রাহ্মণের সংসারে তিনি দাসীবৃত্তি করেন। এইসব কারণে তিনি বোধহয় তাঁর বোন মতান্তরে সতীনের থেকে আমাদের একটু বেশি আপন। প্রতি লক্ষ্মীবারে গেরস্তের ঘরে ঘরে পাঁচালির সুরে সুরে তাঁর আগমন। কোজাগরীর রাতে ঘরের সব আলো জ্বালিয়ে আমাদের তিনি জাগিয়ে রাখেন। পৌষ-ভাদ্র-চৈত্রে ধানের খুঁচিকে মা লক্ষ্মী সাজিয়ে, আল্পনা দিয়ে মনে মনে বলি,তুমি আমার ঘরে অচল থাকো।
সরস্বতী যেন সেই তুলনায় একটু দূরাগতা। বছরে একটিমাত্র দিন তাঁর জন্যে ধার্য। নৃত্যগীতপটিয়সী,সর্ববিদ্যাঅধিষ্ঠাত্রী দেবীকে বোধহয় আমরা একটু সম্ভ্রমের চোখেই দেখি। তিনি থাকেন মানুষের জ্ঞানে, মননে। ছাত্রদের পরীক্ষা পাসের ঠাকুর হয়ে।
এই সুযোগে কবি কালিদাস (বিক্রমোর্বশীয় কাব্য), অন্য গল্পকারেরাও দুই সতীনের ঝগড়া বাঁধিয়ে দেন। তাঁদের এই ঈর্ষাবিবাদের সূত্র ধরেই কি আমরা সাধারণ মানুষ সরস্বতীকে একটু আপন করে নিই! যেমন করে বারবার আমরা দেবতাকে প্রিয় করেছি!
যদিও বুদ্ধিমান মানুষ ও দূরদর্শী ভক্তদের চোখে সরস্বতী ও লক্ষ্মীর কোনো মৌলিক বিরোধ নেই। দুজনেই অপরূপা। প্রতিমা শিল্পে সমাদৃতা। সমান ক্ষমতাশালিনী। উপাসকরা দুই দেবীর কাছেই সমান প্রসাদ লাভ করতে পারেন। সংবৎসরপ্রদীপের প্রণেতা বলেছেন, মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে লক্ষ্মী সরস্বতী দুই বোন তথা সতীনকে পুষ্প, ধূপ, দোয়াত, কলম দিয়ে পুজো করবে। শ্রী পঞ্চমী নামেই স্পষ্ট, এ তিথি সরস্বতীর সঙ্গে লক্ষ্মী পুজোর জন্যেও নির্দিষ্ট।
আমরা যে ঘরের মেয়েকে আদর করে একই সঙ্গে রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী বলতে ভালোবাসি!
তথ্যঋণ : প্রতিমা শিল্পে হিন্দু দেবদেবী, কল্যাণ কুমার দাশগুপ্ত।