নবরাত্রিতে দেবী দুর্গার নয়টি রূপের পূজা করা হয়। এই নয়টি রূপের নাম দিয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা।’দুর্গা’ বলতে আমরা বুঝি – রক্ষাকর্ত্রী মাতা। যিনি দৈত্য – বিঘ্ন – রোগ-পাপ-ভয় ও শত্রু বিনাশকারী, তিনিই দুর্গা।ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র রাবণ বধ করে সীতা উদ্ধারের জন্য দেবী দুর্গার অকালবোধন করে শরৎকালে নবরাত্রির ব্রত করেছিলেন। দেবী বলেছিলেন, “আশ্বিন মাসের শুক্লা প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত পূজাকাল বিশেষ প্রশস্ত।” তাই এই নয় দিন নবরাত্রি নামে খ্যাত।
নবদুর্গার প্রথম চারটি নাম শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা ও কুষ্মাণ্ডা। এঁরা হিমালয়বাসিনী। অর্থাৎ তাঁদের লীলাক্ষেত্র হিমালয়। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম নাম যথাক্রমে স্কন্দমাতা, কালরাত্রি, মহাগৌরী ও সিদ্ধিদাত্রী। এঁরা কৈলাসবাসিনী। অর্থাৎ তাঁদের লীলাক্ষেত্র হল কৈলাস। এই আটজনই হিমালয়দুহিতা পার্বতীর পূর্ণাঙ্গরূপ। এঁদের পূজা হয় যথাক্রমে দেবীপক্ষের প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে। এই আটটি রূপই মাধুর্যময়ী, গৃহশ্রী। আর নবদুর্গার ষষ্ঠরূপ কাত্যায়নী হলেন রণরঙ্গিণী মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা। তাঁর লীলাক্ষেত্র বিন্ধ্যাচল। তিনি দানবদলনী ভয়ংকরী। তাঁর পূজা করা হয় নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে।
১) শৈলপুত্রী : কূর্মপুরাণে আছে অসুরের অত্যাচারে দেবতারা পরাজিত হলে ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা বিশেষ করে হিমালয়দেব কঠোর তপস্যা শুরু করেন। সেই তপস্যায় দেবী শৈলপুত্রীরূপে অর্থাৎ হিমালয় দুহিতারূপে আবির্ভূতা হন। শিব ও শৈলপুত্রীর মিলনে দেবসেনাপতি কার্তিক জন্মগ্রহণ করেন ও পরে ভয়ংকর তারকাসুরকে বধ করে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন। তাঁর বাহন বৃষ। তিনি দ্বিভুজা, ত্রিশূল ও পদ্মধারিণী।এই দেবীর পূজা করলে মনের সড ইচ্ছা পূর্ণ হয়।
২) ব্রহ্মচারিণী : কেনোপনিষদ অনুসারে অসুররা দেবতাদের কাছে পরাজিত হলে দেবতারা অহংকারী হয়ে ওঠেন। ব্রহ্মা তাঁদের এই দাবীর অসারতা বোঝানোর জন্য একটি আশ্চর্য বস্তুরূপে দেবতাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন। দেবতারা তাঁর স্বরূপ বুঝতে না পেরে বলে উঠলেন ‘কিমিদিং যক্ষমিতি’ — অর্থাৎ এই পূজ্য বস্তুটি কি? এরপর একে অগ্নি, বায়ু ও শেষে ইন্দ্রদেব এই তৃণখন্ডরূপী যক্ষকে যথাক্রমে পোড়াতে ও উড়িয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হন। আর অহংকারী ইন্দ্রদেব এটিকে চোখেই দেখতে পান না। ইন্দ্র দেবতাদের নিকট ফিরে না গিয়ে এই যক্ষ (পূজ্য বস্তু) কে নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। তারপর দেখলেন আকাশে সালংকারা হৈমবতী উমার আবির্ভাব হয়েছে। ইন্দ্র তাঁর কাছে যক্ষের পরিচয় জানতে চাইলে উমা বললেন — “এই যক্ষ হলেন ‘ব্রহ্ম’। তোমরা যে এতক্ষণ নিজেদের জয়ী বলে উল্লাস করছিলে তা আসলে ব্রহ্মের জয়। তাঁর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে তোমরা অসুরদের জয় করেছ।” উমার বচন থেকে ইন্দ্র, বায়ু ও অগ্নি ব্রহ্মকে জেনেছিলেন। তাই উমার এই রূপের নাম হল ব্রহ্মচারিণী। দেবী বৃষের উপর পদ্মাসীনা, তিনি চতুর্ভুজা মৃগচর্মধারিণী। দুই হস্তে জপমালা, কমন্ডুলু। অন্য দুই হস্তে বরাভয়।
৩) চন্দ্রঘন্টা : পুরাণ অনুসারে দেবগণ মহিষাসুর বধের জন্য দেবী ভগবতীর কাছে প্রার্থনা জানালে তিনি দেবতাদের অঙ্গজ্যোতি নিয়ে মহালক্ষ্মীরূপ ধারণ করেছিলেন। অসুরদের বধের জন্য দেবগণ দেবীর হাতে নানাবিধ অস্ত্র প্রদান করেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র দেন ঘন্টা, যাতে গজরাজ ঐরাবতের মত মহাশক্তি ছিল। তাই সেই ঘন্টার ধ্বনি ছিল প্রচন্ড। ঘন্টাধ্বনি থেকে নাদব্রহ্ম বা শব্দব্রহ্ম সৃষ্টি হয়। দেবীর রূপ চন্দ্রের মত সুন্দর ও নির্মল এবং চন্দ্র অপেক্ষাও অধিক লাবণ্যময়ী বলে এই মহালক্ষ্মীরূপের নাম হল চন্দ্রঘন্টা। দশভুজা এই দেবী ব্যাঘ্রচর্ম ও গজচর্ম পরিহিতা এবং মাথায় অর্ধচন্দ্র। তাঁর রূপ ভীষণা। তিনি দশহাত বিশিষ্টা। বিরাট মুখমন্ডল ও মুহুর্মুহুঃ জিহ্বা সঞ্চালন করেন। চন্দ্রঘন্টা দেবীকে পুজো করলে আমাদের মনের আসুরিক প্রবৃত্তি নষ্ট হয়। যোগীগণ শব্দব্রহ্ম ধ্বনি উচ্চারণের দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন।
৪) কুষ্মাণ্ডা : ‘কুষ্মাণ্ড’ শব্দের অর্থ হল – কু +উষ্ম+অন্ড। অর্থাৎ কু হল কুৎসিত, উষ্ম হল সন্তাপত্রয় এবং অন্ত হল উদর। এখানে সন্তাপত্রয় বলতে আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক — এই ত্রিবিধ তাপের কথা বোঝানো হয়েছে। দেবী ভগবতী সংসারের এই তিনপ্রকার খারাপ তাপ বা দুঃখ ভক্ষণ করার জন্য আবির্ভূতা হয়েছিলেন। তাই তাঁর নাম কুষ্মাণ্ডা। মতানুসারে দেবী রক্তবীজ অসুরকে বধের সময় তার ভ্রাতা কুষ্মাণ্ডকে নিধন করেন বলে দেবীর নাম কুষ্মাণ্ডা। অষ্টভুজা এই দেবী সিংহবাহিনী। তাঁর আটহাতে রয়েছে ধনু, শর, কমন্ডুলু, সুধাভান্ড, চক্র, গদা, জপমালা ও অভয়মুদ্রা। দেবী পর্বতবাসিনী, সিংহবাহিনী ও বৃহৎ দন্তধারিণী। তাঁর পূজা করলে সকল অভীষ্ট লাভ হয়।
৫) স্কন্দমাতা : পুরাণ অনুসারে তারকাসুরের অত্যাচারে দেবতারা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হলে ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা উমাদেবীর শরণাপন্ন হন। তাঁদের প্রার্থনায় মা উমা গিরিরাজ হিমালয় ও মা মেনকার কন্যারূপে জাত হন। কন্যা যৌবনবতী হলে তাঁর সঙ্গে দেবাদিদেব শিবের বিবাহ হবার কথা। মা উমা জানতেন তাঁদের পুত্রই একমাত্র তারকাসুরকে বিনাশ করতে পারবে। তাই তিনি পুত্রলাভের জন্য ধ্যানমগ্ন শিবের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য মদনদেবকে পাঠান। কিন্তু শিবের রুদ্র দৃষ্টিতে কামদেব ভস্ম হয়ে যান। তখন দেবী নিজে শিবকে পাবার জন্য গভীর ধ্যানমগ্ন হন। অন্যদিকে শিবও শক্তি লাভের আশায় গভীর ভাবে ধ্যানস্থ হয়ে আছেন। এই অবস্থায় দুজনে গভীর ধ্যান মিলিত হলে কার্তিকেয়র জন্ম হয়। সেই কার্তিকের অপর নাম স্কন্দ। ইনিই দেবসেনাপতি। তাই তাঁর মাতা স্কন্দমাতা রূপে পরিচিতা। ইনি গৌরবর্ণা, নানা অলংকারে ভূষিতা, দিব্যবস্ত্র পরিহিতা ও প্রসন্নবদনা। মাতৃভাব সমন্বিতা এই দেবী দ্বিভুজা। এক হস্তে শিশুসন্তান ও অন্য হস্তে ভক্তদের অভয় দান করছেন।
৬) কাত্যায়নী : ইনি কাত্যায়ন মুনির আশ্রমে দেবগণের কার্যসিদ্ধির জন্য মুনিকন্যারূপে আবির্ভূতা হন। ব্রহ্মার আরাধনায় মধু কৈটভ নিধনের জন্য এবং ত্রিপুরারি শিবের পুজোয় ত্রিপুরাসুর নিধনের জন্য দেবী মহামায়া প্রকট হন ও কার্যসিদ্ধি করেন। ভাগবতপুরাণ অনুসারে দ্বাপরে গোপীরা শ্রীকৃষ্ণ লাভের জন্য দেবী দুর্গাকে কাত্যায়নীরূপে পুজো করেছিলেন। কন্যারূপা এই দেবী অতিস্নিগ্ধা, হরিদ্বর্ণা, মণিময়কুন্তল শোভিতা এবং ভাবপূর্ণনেত্রবিশিষ্টা। অষ্টভুজা এই দেবীর বাহন বাঘ। তাঁর মস্তকে চন্দ্র এবং আটহাতে শঙ্খ, চক্র, অসি, বাণ, ধনু, যষ্ঠী, শূল ও তর্জনী বিরাজমান।
৭) কালরাত্রি : দেবী ভগবতী এই রূপে সব অশুভ শক্তি এমনকি মহাপ্রলয়কালেরও বিনাশ করেন। রাত্রিকালে যেমন জীব নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেয় তেমনই নিখিল জীবজগৎ রাত্রিরূপে মায়ের কোলে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেয়। অনন্তশয্যায় শায়িত বিষ্ণু তখন যোগনিদ্রায় থাকেন। এই যোগনিদ্রাই হল কালরাত্রি। কালরাত্রিদেবী কালিকাস্বরূপা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, ত্রিনয়না, চতুর্ভুজা, মাথায় ঘন কৃষ্ণ বর্ণের আলুলায়িত কেশরাশি। মহামায়া এখানে শক্তি, শূল ও অসি ধারিণী। ইনি ভীষণা, খেট ও কুঠারধারিণী, সর্বসুলক্ষণযুক্তা। বিশাল দেহ বিশিষ্টা। এই দেবীর চেহারায় সারল্য ও কাঠিন্যের অপূর্ব সমাবেশ। তিনিই শুভঙ্করী অর্থাৎ সর্বদা শুভ ফল প্রদান করেন।
৮) মহাগৌরী : এই রূপে দেবী অত্যন্ত সুন্দরী ( মহা + গৌরী)। কথিত আছে কালরাত্রি দেবীকে দেবাদিদেব মহাদেব পরিহাসছলে ‘কালী’ বা ‘কালোমেয়ে’ বলে অপ্সরাগণের সম্মুখে আহ্বান করেন। এতে মা অত্যন্ত দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি তখন শিবের সংসার ছেড়ে কঠোর তপস্যায় রত হন এবং সিদ্ধিলাভ করে নিজের গাত্রবর্ণ শিবকে দিয়ে শিবের গৌরবর্ণ ধারণ করেন। তাতে তাঁর গায়ের রং অতীব উজ্জ্বল হয়ে বিদ্যুৎপ্রভার মত চারিদিকে আলো বিচ্ছুরণ করতে থাকে। বৃষবাহিনী এই দেবী রত্ননির্মিত নূপুরশোভিত চরণবিশিষ্টা, রত্নবস্ত্র ও হার শোভিতা। তিনি ত্রিনয়না, শূলাদি, সহস্র অস্ত্রভূষিতা ও রত্নমুকুটধারিণী, চতুর্ভুজা ও সর্বগুণসমন্বিতা। তাঁর দুই ডান হাতে ত্রিশূল ও অভয়মুদ্রা এবং দুই বামহাতে ডমরু ও বরমুদ্রা।
৯) সিদ্ধিদাত্রী : এই রূপে দেবীর আরাধনায় মোক্ষ দ্বার উন্মুক্ত হয়। মনুষ্য, দেব, দানব সকলের সব বন্ধনমুক্তি ঘটে এই মাতৃ আরাধনায়। মহাভারতে আছে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে করজোড়ে সিদ্ধিদাত্রী দেবীর কাছে প্রার্থনা করেন। এই দেবীর গাত্রবর্ণ প্রাতঃসূর্যের মত লোহিতবর্ণ। তিনি দিগম্বরী, পদ্মাসীনা ও চতুর্ভুজা। তাঁর চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম বিরাজমান। নবমীতে দেবীর পূজায় ভক্তের অণিমাদি অষ্টসিদ্ধি লাভ হয়। দেবী ভক্তদের অভয় প্রদান করেন।
যথাবিহিত নবরাত্রি ব্রত পালন করে এই নবদুর্গার পূজা করা হয়। প্রতিমার অভাবে ঘটস্থাপন করে, কল্পারম্ভ ও সংকল্প করে দেবীর বোধন হয়। অধিবাস ও আমন্ত্রণ সেরে মহাস্নান করিয়ে পূজা শুরু হয়। পূজার সময় চন্ডীপাঠ অবশ্য কর্তব্য। পূজা সমাপনে দেবীকে তিনবার পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করা হয়। সবশেষে ঘট নিরঞ্জন ও বিসর্জন।
তথ্য ঋণ : স্বামী একরূপানন্দজী মহারাজ ও আন্তর্জাল।