ক্লাশ সেভেনে পড়ার সময়, ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরে ‘গুণী রবীন্দ্রনাথ’ নামে আমার একটা গদ্য ছাপা হয়েছিলো। তখন সত্তরের দশক। ইত্তেফাক তখন বাংলাদেশে প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে থাকা দৈনিক। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে তখন রাখা হতো ইত্তেফাক। আমি তখন নবাবপুর স্কুলের ছাত্র। ওয়ারি হেয়ার স্ট্রিটের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে বনগ্রাম রোড বিসিসি রোড কাপ্তান বাজার পার হয়ে স্কুলে যাই। বনগ্রামে থাকতো আমার এক সমবয়েসী সহপাঠী বন্ধু। ইত্তেফাকে লেখাটা ছাপা হবার পরের দিন সকালে স্কুলে যাবার পথে বনগ্রামেই দেখা হলো তার সঙ্গে। পাশাপাশি হেঁটে আমরা স্কুলের দিকে যাচ্ছি। এমন সময় সে বললো, কাইলকা ইত্তেফাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররে লইয়া তর নামে একটা লেখা ছাপা হইছে।
আমি বললাম— হ।
— ঈমানে ক তো দোস্ত, লেখাটা কে লেইখ্যা দিছে?
একই স্কুলে একই ক্লাশে পড়া ছাগলটাকে টেকল করতে বিগলিত একটা হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললাম
— তুই ঠিকই ধরছোস!
আমার জবাব শুনে ভুবনজয়ী বীরেরএকটা হাসি উপহার দিলো সে
— হাহ হাহ হাহ। আমি জানতাম ঐটা তর লেখা না। তুই এতো কিছু জানবি কইত্থিকা? সত্যি কইরা ক তো দোস্ত, কে লেইখ্যা দিছে লেখাটা?
আমি বললাম
— আমার বাপে।
জবাব শুনে কী যে খুশি হলো ছেলেটা! ওর আনন্দ দেখে আমারও মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠলো।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন কোনো বিরাট গবেষণা ছিলো না সেই লেখাটা। সেটা ছিলো আমার মতো একজন নবীন কিশোরের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের মেধার বিস্তৃতি আবিস্কার। কেনো তিনি বিশ্ব কবি। কেনো এবং কবে তিনি নোবেল প্রাইজটা পেলেন। কেনো তিনি এতো বড় মাপের মানুষ। কেনো আমরা পাঠ্য বইতে তাঁর লেখা পড়ি।
নিছক কৌতূহল থেকেই তাঁকে নিয়ে আমার মতো একজন কিশোর সেই দুর্বল কিন্তু সঠিক তথ্যভিত্তিক রচনাটা লিখেছিলো। কিন্তু আমার সাধারণ একটা রচনাকে অন্যের লিখে দেয়া বলে সন্দেহ করে ছেলেটা সেদিন আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে এবং বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে — আমি আমার সমবয়েসী বন্ধুদের থেকে খানিকটা এগিয়েই আছি। বিষয়টা এক ধরণের কনফিডেন্স তৈরি করে দিয়েছিলো আমার মধ্যে। আমার সমবয়েসী বন্ধুবলয়ে থেকেও অন্য ভুবনের বাসিন্দা হতে উদবুদ্ধও করেছিলো ঘটনাটা।
পাঠ্য বইয়ের অবশ্যপাঠ্য একজন কবির কবিতা শুধু নয়, সেই কবির প্রতি আলাদা একটা কৌতূহলও আমাকে ধাবিত করেছিলো তাঁর প্রতি। যে কারণে সহপাঠীরা যখন তাঁর কবিতাটি পড়েছে শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাশ করার তাগিদ থেকে, আমি তখন আগ্রহী হয়েছি তাঁকে আরেকটু বিষদে জানতে। জেনেছি আর বিস্মিত হয়েছি।
রবীন্দ্রনাথ তাই সেই কৈশোর থেকেই ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’।
আমি বড় হয়েছি রবীন্দ্রনাথকে পড়তে পড়তে। রবীন্দ্রনাথকে শুনতে শুনতে। আমার সহপাঠীটা যখন পাঠ্য বইয়ের বাইরে রবীন্দ্রনাথের আর কোনো কবিতা পড়েনি, জাতীয় সঙ্গীত ছাড়া রবীন্দ্রনাথের কোনো গান শোনেনি, ‘আমার সোনার বাংলা’ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ যে আরো অজস্র গানের রচয়িতা ও সুরকার সেটাও জানে না, তখন আমি কচি-কাঁচার মেলার অনুষ্ঠানমঞ্চে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের দলের লিড দিচ্ছি রবীন্দ্রনাথের ছোটদের গান গাইতে গাইতে — ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে/ নইলে মোদের রাজার সনে মিলবো কি স্বত্বে/ আমরা সবাই রাজা’…।
রবীন্দ্রনাথ কিশোর আমাকে হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে গেছেন স্বপ্নময় এমন একটা জগতে যে জগতটা অনিন্দ্যসুন্দর। একদিন, কচি-কাঁচার মেলার অনুষ্ঠানে বিপুল দর্শক শ্রোতার উপস্থিতিতে আমার চেয়েও কম বয়েসী একটা বালক, যার নাম ছিলো সম্ভবত জয়? , আবৃত্তি করলো— রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ নামের একটি কবিতা
— ‘মনে করো যেনো বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/ তুমি যাচ্ছো পালকিতে মা চড়ে/ দরজা দু’টো একটুকু ফাঁক করে/ আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে/ টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে’……
সেই কবিতার কাহিনিতে অতঃপর সন্ধ্যা এলো নেমে।
…’সন্ধ্যে হলো সূর্য নামে পাটে/ এলেম যেনো জোড়াদিঘির মাঠে/ ধু ধু করে যেদিক পানে চাই/কোনোখানে জনমানব নাই’…
কাহিনিতে এরপর হারে রেরে রেরে বলে একদল ডাকাত মায়ের পালকিতে হামলা করতে এলো। ভয়ে মা চোখ বন্ধ করে ঠাকুর দেবতার নাম জপ করতে থাকলো। তখন মাকে রক্ষা করতে তাঁর বীরপুত্রটি তলোয়ার উঁচিয়ে এগিয়ে গেলো। ভয়ংকর এক লড়াই হলো। ডাকাতগুলোকে মেরে কেটে (‘শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা/ কতো লোক যে পালিয়ে গেলো ভয়ে/ কতো লোকের মাথা পড়লো কাটা’)
অতঃপর ঘোর বিপদ থেকে মাকে উদ্ধার করলো তাঁর বীরপুরুষ পুত্রটি। মা তখন বলছে—
‘…ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিলো/ কী দুর্দশাই হতো তা না হলে’…
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি সেদিন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো বালক রিটনকে। কবিতার সেই বালকটির জায়গায় খুব অনায়াসে আমি নিজেকে দেখতে পেতাম। আর পালকির ভেতরে দেখতে পেতাম আমার মাকে। (ষাটোর্ধ বয়েসে এসে এখনও দেখি।)
তারপর ধিরে ধিরে বড় হতে হতে এক সময় আবিস্কার করলাম এই মা আমার মা নয় শুধু। পালকির মধ্যে থাকা এই মা তো জননী জন্মভূমিও!
পালকির সেই মাতাকে ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা করতে তার পুত্রকে তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় যেমন, তেমনি শত্রুর হাত থেকে দেশ মাতাকেও রক্ষা করতে হয় তার ‘বীরপুরুষ পুত্র’কেই! দেশ মা-ও তখন পরম আদরে হয়তো বলে ওঠে — ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিলো/ কী দুর্দশাই হতো তা না হলে’!
এইখানে, এই পর্যায়ে এসে রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় হয়ে ওঠেন আমার কাছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ি আমি। নমস্য হয়ে ওঠেন তিনি সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ রিটনের চোখে।
সেই সময়ে, খুব ছেলেবেলায় পাঠ্যবইতে পড়া তার কবিতাগুলোর কোনো কোনোটির পুনর্পাঠের সময়, যেমন ‘আমাদের ছোট নদী’, ফের নতুন করে আবিস্কার করি রবীন্দ্রনাথকে। আরে! — ‘আমাদের ছোট নদী’ তো ছোটদের পাঠোপযোগী একটি কবিতা নয় শুধু! এই কবিতাটির মধ্যে তো মানব জীবনের, একজন মানুষের নানান ধাপের নানান রূপের চিত্রটিই আঁকা হয়েছে নদীর প্রতীকী চিত্রকল্পে!
যেমন — ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে (জীবন চলার পথটি সহজ সরল নয়, নানান বাঁক আছে তার)। বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে'(এই হাঁটুজল হচ্ছে একজন মানুষের শৈশব)।
…’আষাঢ়ে বাদল নামে নদী ভর ভর/ মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর’ (হাঁটু পরিমান জল থাকা নদীটি এখন পূর্ণ যৌবনা, অর্থাৎ মানুষটি যৌবনদীপ্ত ঝকমকে তারুণ্যশোভিত)।
…’এক ধারে কাশবন ফুলে ফুলে শাদা’ (এই কাশবন হচ্ছে পূর্ণবয়স্ক বয়োবৃদ্ধ মানুষের শেতশুভ্র কেশ-শ্মশ্রু)।
আহা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমার রবীন্দ্রনাথ!
বাঙালির নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে সমবেত কণ্ঠে শরণ নিতে হয় রবীন্দ্রনাথেরই— এসো হে বৈশাখ এসো এসো।
সবগাছ ছাড়িয়ে তালগাছে যে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আকাশে উঁকি মারে সেটা সকলেই দেখেছে। কিন্তু প্রথম সেটা কে বলেছে? বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। — ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে’…
সকলের দেখা দৃশ্যটাই রবীন্দ্রনাথ প্রথম লিখলেন, আর সেটা পড়ে আমরা সবাই নোটিশ করলাম— আরে তাই তো!
আহা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমার রবীন্দ্রনাথ!
দুই.
দিন গড়ায়।
আমি বড় হই।
রবীন্দ্রনাথ ক্রমে ক্রমে আরো আমার হয়ে ওঠেন।
আমার যাপিত জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে ওঠেন।
হয়ে ওঠেন প্রধান অনুষঙ্গও।
২০০১ সালের জুনে আমি টোকিও দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি পদে চাকরি নিয়ে গেলাম। নভেম্বরের নির্বাচনে নানা তরিকায় আওয়ামী লীগকে হটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো বিএনপি জামাত জোট। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ইউ টার্ণ নিতে থাকলো বিপজ্জনক ভাবে, স্বাধীনতার বিপরীত স্রোতে। অফিসিয়ালি ক্ষমতায় বসেই পরের দিন উচ্চপদস্থ ১৭ জনকে চাকরিচ্যূত করা হলো যাদের ১৬ জনই বাংলাদেশে চাকরিরত এবং মাত্র একজনই বিদেশে কর্মরত, আর সেটা ছিলাম আমি। বিদেশে কেউ চাকরিরত থাকলে প্রথমে তাকে কল ব্যাক করতে হয়। তারপর খেতে হয় চাকরি। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমার ক্ষেত্রে সেটা মানা হলো না। আমার চাকরিটা খেয়েই ক্ষ্যান্ত হলো না বিএনপি জামাত জোট সরকার। আমার ফিরে আসার পথটাও দিলো রুদ্ধ করে। বেতন ভাতা বন্ধ করে দিলো। দেশে ফেরার টিকিটও দেয় না। বেতন-ভাতাহীন আমি আটকে পড়ি ভয়াবহ খরুচে শহর টোকিওতে।
বিপন্ন আমি তখন ক্যাসেট প্লেয়ারে রবীন্দ্রনাথের একটা গান শুনি বারবার। ক্যাসেটটা আমাকে উপহার দিয়েছিলো বন্ধু শরাফুল ইসলাম। প্রতিদিন অবিরাম শুনতে থাকা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কণ্ঠে গীত সেই গানের প্রথম কলিটা ছিলো— ‘নারে নারে হবে না তোর স্বর্গ সাধন’…।
আমার স্বর্গটা অর্থাৎ আমার দেশটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে, আমার দেশটা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সেটা আমি আস্তে ধীরে টের পেতে শুরু করেছিলাম তখনই।
‘না রে, না রে, হবে না তোর স্বর্গসাধন— / সেখানে যে মধুর বেশে ফাঁদ পেতে রয় সুখের বাঁধন/ ভেবেছিলি দিনের শেষে তপ্ত পথের প্রান্তে এসে/ সোনার মেঘে মিলিয়ে যাবে সারা দিনের সকল কাঁদন/ না রে, না রে, হবে না তোর, হবে না তা— / সন্ধ্যা তারার হাসির নিচে হবে না তোর শয়ন পাতা…./ পথিক বঁধু পাগল ক’রে পথে বাহির করবে তোরে— / হৃদয় যে তোর ফেটে গিয়ে ফুটবে তবে তাঁর আরাধন’…
এই গানের একটা অংশে বিশেষ করে বন্যা যখন গেয়ে ওঠেন— ‘না রে, না রে, হবে না তোর, হবে না তা— / সন্ধ্যা তারার হাসির নিচে হবে না তোর শয়ন পাতা’….
আমার চোখে তখন জলের প্লাবন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর— সন্ধ্যা তারার হাসির নিচে হবে না তোর শয়ন পাতা— এই বাক্যে এসে আমাকে স্পষ্টতই ইঙ্গিত করে যান— সহসা আর ফেরা হবে না তোমার বাংলাদেশের কোলে। বাংলাদেশের সন্ধ্যা তারার হাসির নিচে আর তুমি শয়ন করতে পারবে না…
আমার রবীন্দ্রনাথ এভাবেই আমাকে সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন এই গানে সেই ২০০১ সালে।
নিষ্ঠুর নিয়তি এরপর টোকিও থেকে নিউইয়র্ক এবং নিউইয়র্ক থেকে কানাডার অটোয়ায় এনে থামালো আমাকে। ইতোমধ্যে আমার লাল ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টটি বাতিল হয়ে গেছে। অতঃপর আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিশেবে প্রাপ্য নতুন একটি সবুজ পাসপোর্টের জন্যে আবেদন করলাম অটোয়া বাংলাদেশ দূতাবাসে। কিন্তু আমাকে তখন দেয়া হয়নি আমার প্রাপ্য বাংলাদেশের পাসপোর্টটি। তখন, পাসপোর্টবিহীন নাগরিক হিশেবে সাত সাতটি বছর আমাকে কানাডায় আটকে রেখেছিলো বিএনপি জামাত জোট সরকার।
আমি ফিরে যেতে চাই বাংলাদেশে।
কিন্তু আমাকে যেতে দেয়া হয় না।
তখন রবীন্দ্রনাথের অন্য আরেকটা গান— ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে/ আমি বাইবো না মোর খেয়ার তরী এই ঘাটে গো’ আমাকে আকুল করে তুলেছে ব্যাকুল করে তুলেছে কতো শতবার!
সিডি প্লেয়ারে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা যখন রবীন্দ্রনাথের বাণী ও সুরে গেয়ে ওঠেন— ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’….আহারে….দেশে ফিরতে না পারার ভয়াবহ বেদনায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া আমি লিভিং রুমের ফ্লোরের কার্পেটে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকি! ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’ বাক্যবন্ধে অশ্রুভেজা ঝাপসা চোখে আমি দেখতে পাই বাংলা একাডেমির বইমেলাকে, শিল্পকলা একাডেমি চত্বরকে, টিএসসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে, বাংলা মোটর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে, প্রিয় প্রিয় মানুষ, প্রিয় প্রিয় মুখ, পুরান ঢাকার অলিগলিকে ছাপিয়ে আমার ঝাপসা চোখে ভেসে ওঠে গ্রামের মেঠো পথ, ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলানো বাতাস, হলুদ কার্পেটে মোড়া সর্ষে ক্ষেত, কোশা নৌকায় নদী পার হওয়ার অপরূপ ছন্দ দোলা, ভাজা শিং মাছের টুকরো আর মাষ কলাইয়ের ডাল দিয়ে মাখানো ভাত….আহারে…কান্না তো আর থামে না!
নিয়তি এ আমাকে কোথায় নিয়ে এলো!
কানাডার আকাশ ঝকঝকে চকচকে, নীল।
শাদা শাদা মেঘ সেখানে খেলা করে।
সেই মেঘগুলোর কতো না রূপ কতো না আকৃতি!
সেই আকাশে আমি রবীন্দ্রনাথকে খুঁজি। কিন্তু পাই না!
অদৃশ্য অস্পষ্ট কেউ একজন ফিসফিস করে বলে আমাকে— রবীন্দ্রনাথ তো থাকে বাংলার আকাশে।
এই আকাশে তাকে তুমি পাবে না।
কানাডার শরৎ অর্থাৎ ফল সিজনের এক বিকেলে অটোয়া রিভারের তীর ঘেঁষা পার্কের ম্যাপল গাছের ছায়ার বেঞ্চিতে বসে বিষণ্ণ আমি গুণগুণ করছি রবীন্দ্রনাথকেই— ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে’।
সহসা মুগ্ধ বিস্ময়ে আমি আবিস্কার করি— আরে অইতো কানাডার আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘশিশুরা একত্রিত হয়ে কী রকম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মূর্ত করে তুলেছে!
বাহ্, কানাডার আকাশেও রবীন্দ্রনাথ আছে!
কানাডার আকাশেও রবীন্দ্রনাথ থাকে!
সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের মতো রবীন্দ্রনাথও আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে।
আমি যেখানেই যাই, যতো দূরেই যাই, বাংলা আর রবি ঠাকুর থাকে আমার বক্ষ জুড়ে।
বাংলা আর রবি ঠাকুর থাকে আমার করোটিতে। ছায়া হয়ে। মায়া হয়ে।
তিন.
আমি ছড়ার মানুষ। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার প্রণতি বা নৈবেদ্যটাও হওয়া উচিৎ ছড়ার মাধ্যমেই। নিকট অতীতে লেখা নিজের একটা ছড়াকে নতুন উদ্যমে প্রায় দ্বিগুণ আকৃতিতে পেশ করা হলো এবারের পঁচিশে বৈশাখকে উপলক্ষ্য করে—
আমার ঠাকুর রবি ঠাকুর
লুৎফর রহমান রিটন
**
আমার ঠাকুর কবি ঠাকুর
ঠাকুর বাড়ির রবি ঠাকুর।
যেখানে যাই যতোই দূরে
রবি আমার হৃদয় জুড়ে।
জীবন পথের বাঁকে বাঁকে
রবি আমার সঙ্গে থাকে।
**
উৎসবে আনন্দলোকে
আমার বিষাদ আমার শোকে
রবি থাকে ছায়ার মতো
মায়ের স্নেহ মায়ার মতো—
রবি আমার শিয়রটাকে
আলোয় আলোয় আগলে রাখে।
**
রবি আমার প্রেম-বিরহে
আমার হয়েই কথা কহে।
আমার সকল অনুরাগে
রবীন্দ্রনাথ ঘুমোয়, জাগে।
অনুভূতির অণুতে সে
নিত্য মেশে নিত্য মেশে।
**
তুঙ্গে যখন বৃহষ্পতি—
রবি ছাড়া নেই যে গতি।
হৃদয় নাচে হৃদয় নাচে
রবি ঠাকুর সঙ্গে আছে!
আর কেউ নেই রবি ছাড়া
‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’…
**
রবি আমার দীর্ঘশ্বাসে
হাওয়ায় ভাসে হাওয়ায় ভাসে।
রবি আমায় ঋতু চেনায়
কাপুরুষ ও ভীতু চেনায়।
আমার সকল সংকটে সে
দাঁড়ায় আমার বক্ষ ঘেঁষে।
**
গভীর গোপন হাহাকারে
চাই যে তারে পাই যে তারে।
আমার সকল বিপন্নতায়
রবিই শেষে একলা দাঁড়ায়
নিঃসঙ্গতায় টলোমলো
রবিই বলে— ‘একলা চলো’!
**
অপমানের বিষণ্ণতায়
‘সংকটেরও বিহবলতায়’
দুর্বলতার কাটে না ঘোর।
…’পায়ের চিহ্ন পড়বে না মোর’?
স্বপ্ন ডোবে অস্তাচলে
যাই ভেসে যাই অশ্রুজলে
গাঢ় সবুজ উতল হাওয়ায়
‘ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যায়’…
**
ঢেউয়ের দোলায় রবির বাণী
যায় রেখে কোন বার্তা খানি?
‘চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে’
ঘাসফুলে কার পত্র হাসে?
চরণে যার জলের প্রপাত
জলের ধারায় রবীন্দ্রনাথ।
**
আমার সকল প্রার্থনাতে
রবীন্দ্রনাথ তার দু’হাতে—
মাখিয়ে দেয় ফুলের রেণু
জাগিয়ে রাখে বাজিয়ে বেণু
জোস্না রাতের মায়ার খেলায়
নীল আকাশের মেঘের ভেলায়
জ্বালায় প্রদীপ সন্ধ্যা সাঁঝে
‘অভয় বাজে হৃদয় মাঝে’…
**
চতুর্দিকে ঘোর অশনি।
তার ‘আগুনের পরশমনি’
ফের আমাকে ফিরিয়ে আনে
‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে’…
কে এসেছে? সে এসেছে!
‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’…
**
‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’
আমার মন্দে আমার ভালোয়
পরবাসের ব্যকুলতায়
কান্না ভেজা সুরে কথায়
সংশয়ে সন্তাপে শোকে
ধ্রুপদী এক মন্ত্র-শ্লোকে
কী অপরূপ বাড়িয়ে দু’হাত—
দাঁড়িয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ!
**
একে একে নিভছে বাতি
ঠাকুর সাথি। ঠাকুর সাথি।
নিকশ কালো রাত্রি ঘনায়
রবিই আসে উদ্দীপনায়।
অন্ধকারকে হটিয়ে দিয়ে
নতুন দিনের বার্তা নিয়ে
পূব আকাশে রবিই ওঠে
আবার আলোর কুসুম ফোটে।
**
আবার আমি দাঁড়াই ঘুরে
রবির গানে রবির সুরে।
রবিই আমায় পথটা দেখায়
গানের বাণী-কাব্যে-লেখায়
এই যে আমার জীবন যাপন
পরীক্ষিত সবচে আপন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবি—
আমার ঠাকুর আমার কবি।
অটোয়া, কানাডা, ০৭ মে ২০২৪
[ক্যাপশন/ হিউস্টনে রে মিলার পার্কের বৃক্ষশোভিত সবুজ অঙ্গনে অন্যরকম দ্যুতি ছড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। পেছনে দু’হাত রেখে চিরচেনা পোশাক ও ভঙ্গিতে পূর্ণশরীরের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসাধারণ প্রাণবন্ত ব্রোঞ্জনির্মিত ভাস্কর্যটি এখানে নির্মাণ ও স্থাপন করেছে টেগোর সোসাইটি অব হিউস্টন, ২০১৩ সালে। হিউস্টনের রবি ঠাকুরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো ২০১৮ সালে।]