বৃহস্পতিবার | ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৬:৪৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর রেল প্রকল্পের কাজ ভাবাদিঘিতে ফের জোর করে বন্ধ করা হলো : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর — অনেক বিদ্যাসাগর মাঝে তিনি একক : প্রলয় চক্রবর্তী আমেরিকা-ইসরায়েল সম্পর্কের শেকড় অনুবাদ ফাতিন ইশরাক নিয়ম নীতি আচারে লক্ষ্মী পূজার তোড়জোড় : রিঙ্কি সামন্ত আমার প্রথম বই — ঘুণপোকা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘কে জাগ রে’ জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন একটি বিপ্রলম্ভের কবিতা : প্রসেনজিৎ দাস আন্দোলন ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই : তপন মল্লিক চৌধুরী রেখা দাঁ ও বিজ্ঞান আন্দোলন : দীপাঞ্জন দে বাংলা উপন্যাসে নিম্নবর্গ : মিল্টন বিশ্বাস বদলে যাওয়ার অসুখ : বিষ্ণু সরকার বিবেকের মুখ : পার্থ রায় কল্লোলের কাল : তপন মল্লিক চৌধুরী দশমীর বিকেল, জলঙ্গী নদীতীরে মেলবন্ধনের আনন্দমুখর ছবি : অমৃতাভ দে উৎসবে ফেরাই জীবন…. : অশোক মজুমদার দ্বিশতবর্ষে পদার্পণ করলো বাঁকুড়ার অযোধ্যার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো : কমল ব্যানার্জী একটি গ্রামের বাড়ির পুজো… : বিজয় চৌধুরী আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে… : লুৎফর রহমান রিটন ময়নাপুর দেওয়ান বাড়ীর পুজো : কমল ব্যানার্জি মা দুর্গার মহাস্নান পর্ব : রিঙ্কি সামন্ত কোষ্টিয়া গ্রামের শীট বাড়ির দুর্গাপুজো : কমল ব্যানার্জী অয়দিপাউস : রিমি মুৎসুদ্দি পোড়খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনকথা : হরিশংকর জলদাস সাজসজ্জার পুজো : নন্দিনী অধিকারী আঠেরো শতকে কলকাতার ভেড়া যেত অস্ট্রেলিয়ায় : অসিত দাস জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (অষ্টম পর্ব) : বিজয়া দেব হরিয়ানায় হ্যাট্রিক করলেও উপত্যকার মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ে গান্ধী জয়ন্তী : দীপাঞ্জন দে পটের পাড়ায় মাজরামুড়ায় : রঞ্জন সেন একটি ড্যান্স হাঙ্গামা : শৈলেন সরকার
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই মহাঅষ্টমীর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

আমার প্রথম বই — ঘুণপোকা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় / ২৮ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪

অত্যাশ্চর্য এই যে, ‘ঘুণপোকা’ এখনও বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। প্রকাশের পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও। এ সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে বলেই আমাদের সাদামাটা জীবন পুরোপুরি একঘেয়ে হয়ে যায় না। সুখ, আনন্দ, সম্পদের চেয়েও অনেক বেশি জীবনীয় উপাদান হল বিস্ময়। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন যাপনে এই বিস্ময়ের বড় অভাব। এবং কোনও কোনও বিস্ময় আছে যা বিশল্যকরণীর মতো। আবার হেমলকের মতো বিস্ময়ও যে নেই তা নয়। ‘ঘুণপোকা’ ঘটিত বিস্ময় আরও এই কারণে যে, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আজ যে ডিট্যাচমেন্ট বা দূরত্ব রচিত হয়েছে, বইটির সঙ্গে আমার, তাতে মনে হয় ওটি ফিরে না পড়লে কী লিখেছিলাম তা মনেই পড়বে না।

বইখানি যে লিখেছিল সেই যুবকটির সঙ্গে আমার এখনও মাঝে মাঝেই দেখা হয়ে যায় গড়িয়াহাটায়, কালীঘাটের ফুটপাথে, কলেজ স্ট্রিটে বা সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে বা বাসে। শীর্ণকায়, ছোট করে ছাঁটা চুল, ঘোর অন্যমনস্ক এবং দিশাহীন চোখ। লেখালেখির শুরু থেকেই যে আস্তে আস্তে বুঝতে শিখেছিল যে, লিখে কিছু হয় না। যুবকটির পকেটে পয়সা ছিল না। সেটা এবং প্রতিভার অভাব সে বরাবর টের পেত। তাই তেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষাও কিছু ছিল না তার। নিজেকে নিয়েই ছিল তার মুশকিল। জনসমক্ষে জাহির হওয়া, প্রমাণিত হওয়া বা প্রতিষ্ঠালাভ ভাগ্যবানদের লভ্য, তার নয়।

লিখে যে কিছু হয় না, এটা সে সেই বয়সেই, ষাটের দশকেই বুঝে গিয়েছিল, কিন্তু লেখা ছাড়া তার আর কোনও পন্থাও ছিল না। একটা অতি নিম্ন মানের স্কুলে উচ্চারণের অযোগ্য বেতনে সে মাস্টারি করত। নুন-পান্তা দু’য়েরই টানাটানি। গল্প লিখত। সেই সব গল্প পত্রপত্রিকায় ছাপাও হত। আর স্বপ্ন দেখত। অসম্ভাব্যতার স্বপ্ন। এই সময়ে এক দিন সাগরময় ঘোষ তাকে ডেকে প্রস্তাব দিলেন, এ বারের শারদীয়া দেশে তুমি বা বরেন (গঙ্গোপাধায়) কেউ এক জন উপন্যাস লিখবে। কে লিখবে তা নিজেরা কথা বলে ঠিক করে নাও।

প্রস্তাবটা তেমন সম্মানজনক নয়। তার ওপর বরেন যুবকটির অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সুতরাং সে ঠিক করে নিল বরেন লিখবে, আমি নয়। কিন্তু বরেন প্রস্তাব শুনেই হাঁ হাঁ করে উঠল। বলল, না রে, আমি পারব না। বহু ঝামেলায় আছি। বরেনের সত্যিই অসুবিধে ছিল। ব্যক্তিগত গুরুতর সমস্যায় সে তখন কণ্টকিত। আর সেই যুবকটিরও তখন একটা সংকটকাল চলছে। জীবনের প্রথম উপন্যাস লেখার মতো মানসিক অবস্থাই তার নয়।

তার জীবনের মতোই তার লেখালেখিও ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পনাহীন। কী লিখবে তা আগে ছক কষে, কোমর বেঁধে হিসেব করে লেখার মতো এলেম তার ছিল না। লিখতে বসে ভাবত আর ভাবতে ভাবতে লিখত। সে অনেকটা ছিল কাগজকুড়োনিদের মতো। রাস্তায়, ঘাটে, নর্দমার ধারে আবর্জনা ঘেঁটে যা পায় তাই কুড়িয়ে নিয়ে ঝোলায় পোরে।

এই ভাবেই জীবনের নানা টুকরোটাকরা, ভাঙা আয়না, বাঁকা পেরেক, পুরনো কাগজ, ছেঁড়া জুতোর মতো কুড়িয়ে-বাড়িয়ে তার যা কিছু সঞ্চয়। আর ওই সবই তার লেখায় ভিড় করে আসে। ‘ঘুণপোকা’ লিখতে গিয়েও তা-ই হল। গল্প আর আসে না। শুরুটা হল তো এগোতে চায় না। একটা চ্যাপটার কোনও রকমে গলদঘর্ম হয়ে শেষ করার পর দু’নম্বর কী নিয়ে লিখবে তা আর ভেবে কূল পায় না। সিগারেটের শ্রাদ্ধ হয়। সময় বয়ে যায়। ডেডলাইন এগিয়ে আসে। ভয় খামচে ধরে বুক। একটু আধটু বন্ধুদের পড়ে শোনায় বটে, কিন্তু তাদের ভাবগতিক খুব একটা আশাব্যঞ্জক মনে হয় না। খুব দমে যায় সে।

লেখাটা কেমন হচ্ছে তা নিয়ে একটা আবছায়ার মধ্যে সে ছিল তখন। বুঝতে পারছিল, উপন্যাসটি আনাড়ি চালকের হাতে গাড়ির মতো নানা ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করছে। চলে যাচ্ছে ভুলভাল রাস্তায়। পথ ছেড়ে উঠে যাচ্ছে ফুটপাথে, ধাক্কা মারছে একে-ওকে। আর ওই ভাবেই নানা বিপত্তির শেষে এক দিন যুবকটির শেষ পাতা লেখা হয়ে গেল। বিপত্তি বাধল নামটা নিয়ে। নাম আর কিছুতেই মাথায় আসে না। তখন ঠাকুরের (শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র) ‘সত্যানুসরণ’ বইটা হাতে নিয়ে ঠিক করল, বইটা খুলে যে শব্দটায় প্রথম চোখ পড়বে সেটাই নাম দেবে। ওই ভাবেই ‘ঘুণপোকা’ নাম হল।

কেমন হল তার প্রথম উপন্যাস? শারদীয়া ‘দেশ’ বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই কি ‘ঘুণপোকা’ নিয়ে হইচই পড়ে যাবে? লোকে ছুটে আসবে অটোগ্রাফ নিতে? যুবতীরা পাঠাবে সুগন্ধী প্রেমপত্র? সাহিত্য আকাদেমি প্রাইজ দেবে?

তার প্রথম উপন্যাসটির এমন ঘটনাহীন, প্রতিক্রিয়াহীন প্রকাশ চরম হতাশাবাদীরও কল্পনায় ছিল না। এক বা দু’জন বন্ধু মাসখানেকের মাথায় সামান্য সাধুবাদ দিয়েছিল। এক জন বলেছিল, পড়েছি। তবে, কথা আছে। পরে বলব।

প্রশংসাই যে তার প্রত্যাশিত ছিল, এমন তো নয়। তার বদলে বিতর্ক বা প্রবল নিন্দেমন্দ হোক, তা-ও ভাল। কিন্তু শীতল উপেক্ষা যে অতি কঠিন আঘাত!

ভাগ্য এই যে, যুবকটির কাছে উপেক্ষা অচেনা বস্তু নয়। তখন পর্যন্ত তার বেশির ভাগ লেখালিখিই তেমন আন্দোলন তোলেনি। কাজেই তার ভেঙে পড়ার কোনও কারণ ছিল না। লিখে যে কিছু হয় না, অন্তত তার যে হবে না এই বিশ্বাস একটু দৃঢ়তর হল মাত্র। বছরের শেষে ‘ঘুণপোকা’ বইখানি মাত্র আড়াইশো বিক্রি হয়েছিল। পরের বছরও তাই।

বছর দুই কাটবার পর ‘ঘুণপোকা’ নিয়ে কিছু কিছু কথাবার্তা তার কানে পৌঁছতে লাগল। বিক্রি বাড়ছিল ধীরে ধীরে। বছরে একটি এডিশন। কিন্তু কেন এই ছেড়ে দিয়ে তেড়ে ধরা, তা যুবকটি আজও বুঝে উঠতে পারল না।

বাংলা সাহিত্য হয়তো বা অনেক এগিয়ে গেছে। আর ‘ঘুণপোকা’ এখন প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠে। এত দিন টিকে থাকার কথাই নয় তার। তবু কেমন করে যেন টিক টিক করে সে আজও ছাপার অক্ষরে রয়ে গেছে। যুবকটি আজও তাই যখন শুনতে পায় তার ওই উপন্যাসখানা কেউ পড়েছে, কৃতজ্ঞতায় তার চোখে জল চলে আসে। প্রশংসা শোনার জন্য মোটেই উৎকর্ণ নয় সে। শুধু কেউ পড়েছে শুনলেই খুশি।

বইখানি প্রকাশ পাওয়ার দু’তিন বছর বাদে যুবকটির কানে একটি কথা পৌঁছে দিয়েছিল কেউ কেউ, একটি অল্পবয়সি ছেলে আত্মহত্যা করেছে এবং তার ডায়েরিতে লেখা ছিল যে, সে সতেরো বার ‘ঘুণপোকা’ পড়েছে। খবরটা শুনে যুবকটি যুগপৎ ভীত হয় এবং মুষড়ে পড়ে। সে কি ‘ঘুণপোকা’য় এমন কিছু লিখেছে যা কাউকে আত্মহননে প্ররোচনা দিতে পারে? যদি তা-ই হয় তবে তো তার গ্রন্থখানি প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত! কিন্তু ডায়েরিতে ছেলেটি এমন কথা লেখেনি যে, বইটা পড়েই তার আত্মহত্যার ইচ্ছে হয়েছিল। তবু যুবকটি বেশ কয়েক বছর একটু ধন্দের মধ্যে ছিল, বার বার ভেবেছিল, কোনও লেখার নেতিবাচক অভিঘাত কতটা হতে পারে।

বইখানি আদতে নেতিবাচক নয়। বরং এই পৃথিবীর প্রতি গভীর ভালবাসার কথাই তো বলতে চেয়েছে। বলতে চেয়েছে, যে-মানুষের জীবনে সত্যিকারের প্রেম বা অভিসার নেই, তারও আছে মনের অভিসার, আছে কল্পপ্রেম। একটি রক্তমাংসের মেয়ে কি কারও মানসী হতে পারে? তাকে মনে মনে গড়ে নিতে হয় ‘বিয়াত্রিচে’। ‘ঘুণপোকা’ কেমন উপন্যাস কে জানে, কিন্তু যুবকটি জানে, তার কিছু পাগলামি, কিছু উদ্ভট কল্পনা আর কিছু কিম্ভূত চরিত্রের মিশেল দিয়ে ওই গ্রন্থ।

ওই উদ্ভ্রান্ত যুবকটির সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন আমি তার মধ্যে নিজেকে আর পুরোপুরি খুঁজে পাই না। খানিকটা চেনা, খানিকটা অচেনা। যে ওই বইখানি লিখেছিল সে কি আমি? নাকি আমি নই, ও? এই দ্বন্দ্ব নিয়ে আজও আমার দিন কাটে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন