আমার যখন বোধ জাগ্রত হচ্ছে, মানে ছোটবেলায় যখন একটু-আধটু বুঝতে শিখছি, মানে যখন একটু একটু কথা মনে থাকে, তখন আব্বার যে চিত্র আজও আমার মনে গেঁথে আছে, তা হলো ‘মাটিতে মাথা, আকাশে পা।’ এ কী! মানুষটি উল্টো কেন!
পরে জানলাম, বুঝলাম, জি না, মানুষটি উল্টো না, মানুষটি শীর্ষাসন করছিলেন। মাথার দুপাশে কনুই থেকে হাত ভাঁজ করে মাথা নিচে দুপা আকাশে সটান করে রয়েছেন। যোগব্যায়াম করছেন।
আমার জ্ঞান হওয়ার পর যে মাথা মাটিতে দেখেছি, সেই মাথা আজ বাংলা সাহিত্যের অনেক উঁচুতে পৌঁছেছে।
বাংলা সাহিত্যের সার্থক এই কথাশিল্পীর কথাশিল্পী শওকত ওসমান হওয়ার শুরুতে যে নামটি সর্বাগ্রে উচ্চারিত, তিনি হলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় জনাব হবীবুল্লাহ্ বাহার। তাঁর সময়ে সবার প্রিয় বাহার দা।
জনাব হবীবুল্লাহ্ বাহার তখন ‘বুলবুল’ পত্রিকার সম্পাদক।
একুশ বছরের তরুণ শওকত ওসমান ‘বুলবুল’ পত্রিকার সম্পাদককে তাঁর ছোট্ট এক অভিমত পেশ করলেন, ‘পত্রিকায় নতুন কবিদের একটা কবিতা ছাপলে কবির প্রতিভা ঠিক বোঝা যায় না। একসঙ্গে তিনটি কবিতা ছাপলে নতুন কবিকে বোঝা সহজ হয়।’ বলে পকেট থেকে শওকত ওসমান তিনখানা কবিতা বের করে দেখার অনুরোধ জানিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
সদ্য-বিবাহিত বত্রিশ বছরের টগবগে তরুণ সম্পাদক, ক্যালকাটা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের, ক্যাপ্টেন জনাব হবীবুল্লাহ্ বাহারকে নসিহত করছেন একুশ বছরের পুঁচকে শওকত ওসমান!
যে ‘বুলবুল’ পত্রিকায় লিখছেন প্রমথ চৌধূরী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অন্নদাশংকর রায়, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ফররুখ আহমদ, কবি আহসান হাবীব, আবু রুশদ মতিনউদ্দীন, কবি আবুল হোসেন — সেই পত্রিকার সম্পাদককে জ্ঞান দিচ্ছে ছোকরা শওকত ওসমান!
একটু বেয়াদবি মনে হতেই পারে। ফলে ছমাস ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে রইল শওকত ওসমানের কবিতাত্রয়ী। সম্পাদক জনাব হবীবুল্লাহ্ বাহার স্যার একবার পড়েও দেখলেন না।
এদিকে শওকত ওসমানও প্রায় ছমাস ‘বুলবুল’ পত্রিকা অফিসে যাননি।
পরের ঘটনা কথাশিল্পী শওকত ওসমানের লেখা থেকে জানা যায়, — ‘হঠাৎ এক সংখ্যায় দেখলাম সম্পাদক জনাব হবীবুল্লাহ্ বাহার আমার উপদেশ অনুযায়ী তিনখানা কবিতা পাশাপাশি ছেপেছেন।
নিতান্ত দৈবী ব্যাপার। কলকাতার ওয়েলেসলী স্ট্রীট স্কোয়ারের কাছে ট্রামের জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। চলন্ত গাড়ী থেকে এক ভদ্রলোক নেমে পড়লেন। গায়ে লম্বা আচকান, হাতে সংবাদপত্র ও অন্যান্য কাগজ।
তারপর সোজাসুজি অভিযোগ কানে ধাক্কা মারে, “কী ব্যাপার? ঠিকানা দিয়ে যাননি। পত্রিকা পাঠাতে পারিনি।”
এই প্রথম ঠিকানাসহ জড়িয়ে পড়লাম।’
শুরু হলো কথাশিল্পী শওকত ওসমান হওয়ার পালা।
ষাটের দশকে জনাব হবীবুল্লাহ্ বাহার স্যার থাকতেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দক্ষিণ গেটের পাশে, মানে শান্তিনগরের দিকে, আর কথাশিল্পী শওকত ওসমান থাকতেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উত্তর গেটের পাশে, মানে মোমেনবাগের দিকে। এখন যেখানে গ্রিনলাইন বাসস্ট্যান্ড।
আমরা ছোটবেলায় কত গেছি জনাব হবীবুল্লাহ্ বাহার স্যারের বাসায়। তখন খাঁটি দুধের জন্য প্রায় বাসাতেই গরুর লালনপালন হতো। জনাব হবীবুল্লাহ্ বাহার স্যারের শান্তিনগরের বাসায়ও কিছু গরু পালা হতো। কথাশিল্পী শওকত ওসমানের একমাত্র কন্যা আনফিসা ওসমান, ডাকনাম লাইলী, তার বয়স তখন এগারো-বারো হবে। মিসেস আনোয়ারা বাহার, জনাব হবীবুল্লাহ্ বাহার স্যারের স্ত্রী, লাইলীকে খুব আদর করতেন। কবে কথায় কথায় লাইলী মিসেস আনোয়ারা বাহারের কাছে জানতে চায় যে গরুর বাচ্চার লেজ কি টিকটিকির লেজের মতো পড়ে যায়? লাইলীর প্রশ্ন শুনে মিসেস আনোয়ারা বাহার খুব মজা পান ও বলেন, ‘ঠিক আছে, এর পরেরবার আমাদের গরুর বাচ্চা হলে সেই বাচ্চাটা তোমায় দিব, তুমি নিজেই দেখবে যে গরুর বাচ্চার লেজ টিকটিকির মতো পড়ে কি না।’
পরেরবারের গরুর বাচ্চাটা লাইলীকে দেওয়া হয়। গরুর নাম রাখা হয় কালী, কারণ গরুর রং কালো। সেই কালী বড় হয়ে বাচ্চা প্রসবের পর দুগ্ধ দোহনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল কথাশিল্পী শওকত ওসমানের তৃতীয় পুত্র বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। জনাব হবীবুল্লাহ্ বাহার স্যারের স্ত্রী, মিসেস আনোয়ারা বাহার, লাইলীর এই গল্প অনেকের কাছে বলেছিলেন।
মিসেস আনোয়ারা বাহারের অক্লান্ত পরিশ্রমে শান্তিনগরে গড়ে ওঠে আজকের হবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ।
সেই ‘বুলবুল’ পত্রিকার তিনটি কবিতার লেখক কথাশিল্পী শওকত ওসমানের প্রকাশিত বই প্রায় ৮৬টি।
যত দূর জানা যায়, শওকত ওসমানের প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয় ১৯৩৯ সালে, ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার পৌষ সংখ্যায়। গল্পের নাম, ‘সাবেরা ও মোটর গাড়ী।’
তারপর কথাশিল্পী শওকত ওসমান সাহিত্যাঙ্গনে একে একে ডালপালা মেলতে থাকলেন। তিনি ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ—সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণ করেছেন। লিখলেন ‘জননী’র মতো কালজয়ী উপন্যাস, ‘ক্রীতদাসের হাসি’র মতো রূপক সাহিত্য।
‘নেকড়ে অরণ্য’, ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘ওটেন সাহেবের বাংলো’, ‘বনি আদম’, ‘পঞ্চসঙ্গী’ বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য।
এর মাঝে ‘জননী’ ও ‘ক্রীতদাসের হাসি’ ধ্রুপদ সাহিত্যের পদমর্যাদা লাভ করেছে।
তাঁর সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক, আদমজী, মুক্তধারা, ফিলিপস সাহিত্য, বাংলা একাডেমি, একুশে পদক, স্বাধীনতা দিবস ও টেনাশিস্ পুরস্কার।
প্রখ্যাত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত কথাশিল্পী শওকত ওসমানকে বাংলার গোর্কি বলে চিহ্নিত করেন, কারণ, কথাশিল্পী শওকত ওসমান আজীবন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নিপীড়িত জনগণের কথা বলেছেন। আর সর্বদা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। আমরণ মানুষের মনুষ্যত্বের জন্য তাঁর লেখনীর মাধ্যমে লড়াই করেছেন। ছিলেন প্রচণ্ডরূপে আশাবাদী মানুষ। পূর্ব পাকিস্তানে, ষাট সালের গোড়ার দিকে, হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার সময় আবু রুশদ, এ কে এম আহসান, মুজিব চাচা, সিকান্দার আবু জাফর, কথাশিল্পী শওকত ওসমান — সবাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে লড়েছেন। দলবেঁধে রাতের বেলা সব প্রাইভেট গাড়ি করে বন্দুক নিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাড়া পাহারা দিতেন।
কথাশিল্পী শওকত ওসমানকে কিছুতেই ধনী বলা যাবে না। বলা যাবে না উচ্চমধ্যবিত্ত। অথচ তারপরও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান যখন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের বর্তমান বনানীর চেয়ারম্যান বাড়িতে জমি দান করেন, তখন প্রায় সব বুদ্ধিজীবী, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের উপহার গ্রহণ করে ধন্য হলেন। কিন্তু শওকত ওসমান ওই স্বৈরাচারী, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের অনুগ্রহ ঘৃণাভরে প্রতাখ্যান করেন। তিনি কত লোককে আর্থিক সাহায্য করেছেন, তা বলে বোঝানো যাবে না।
আমার ছোটবেলায় দেখেছি, শীর্ণকায় শ্যামলা এক উর্দু কবি আব্বার কাছে এসেছেন, তাঁর স্ত্রীর সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে যেতে হবে, যথাসম্ভব উনি আর্থিক সাহায্য করেছেন। ষাটের দশকে দেখতাম, গ্রাম থেকে গোয়ালা এসেছে তার সন্তানের ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফি, কারও সন্তানের কলেজে ভর্তির ফি, এমনি কত সাহায্য করেছেন নিভৃতে-নীরবে, তার অনেক খোঁজ হয়তো আমরা জানিও না। আবার অনেক সময় দেখেছি বাড়ি তৈরির সময় প্রয়োজনে প্রতিবেশী ওভারশিয়ার জনাব আশ্রাফ আলী ভুঁইয়া, শ্রদ্ধেয় জনাব আবদুল বাকী চাচার কাছ থেকে ধার করছেন।
একবার কালবোশেখীর ঝড়ে আমাদের বাড়ির টিনের চাল উড়ে যায়। আব্বা তখন ইংল্যান্ডে। তখন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম চাচা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাসখানেকের মাঝেই ছাদ পাকা করে দিলেন। এই ষাটের দশকে রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানি জান্তা চারজন ছাত্রকে রাস্টিকেট করেছে। রাষ্টিকেট মানে এই চারজন ছাত্র পূর্ব পাকিস্তানের কোনো কলেজে আর লেখাপড়া করতে পারবে না। শওকত ওসমান ছাত্রদের হয়ে লড়াই করে সেই আদেশ বাতিল করিয়ে তবে ক্ষান্ত হলেন। সহযোদ্ধা ছিলেন ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্রাল জনাব জালাল উদ্দিন স্যার। তাঁরা সমাজে উঁচু-নিচু, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কোনো ভেদাভেদ করতেন না। মানুষকে মানুষই ভাবতেন।
শওকত ওসমান সম্পর্কে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ভাষাসংগ্রামী, কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্রগবেষক জনাব আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘যেকোনো বই উপহার দিতে গিয়ে বইতে, দ্বিপদী-চৌপদীতে ফুটে উঠেছে ঝকমকে বক্তব্য। তীক্ষ্ণ তির্যক বাককুশলতায় দীপ্ত শওকত ওসমানের তুলনা সম্ভবত তিনি একাই।’ কবি নাসির আহমেদকে বই উপহার দিতে গিয়ে কথাশিল্পী শওকত ওসমান লিখলেন, ‘নাসির, এ দেশে মানুষ হওয়ার আগে হিন্দু বা মোসলমান হওয়া লাগে।’
এবারের বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝেও যেন কথাশিল্পী শওকত ওসমানের মননেরই অনুরণন শুনি, ‘হে মানবকুল, তোমরা আর কিছু না হয়ে প্রথমে মানুষ হও, দ্বিতীয়ত মানুষ হও, তৃতীয়ত মানুষ হও, শেষ পর্যন্ত মানুষ হও…মানুষ হলেই মানুষ বাঁচবে।