রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বলতেই হয় ‘পৌষ পার্বণের আর কত দেরি’। সত্যি একথা আজও ঠিক শিক্ষক নেপাল চন্দ্র রায়কে যেদিন কবিগুরু তাঁর হৃদয়ের এই কথা বলেছিলেন, যার মধ্যে আজও গ্রামাঞ্চলে পৌষের জন্য জেগে থাকে প্রাণের আকুতি। নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় স্নিগ্ধ সবুজ গ্রাম। বাংলার প্রতিটি মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের মিলনের আনন্দবার্তা। এই আচারপ্রথা গ্রামে-গঞ্জে কিছুটা ভাটা পড়লেও, একেবারে মলিন হয়ে যায়নি। বিশেষ করে রাঢ় বাংলায়।
পৌষ পার্বণ বা মকর সংক্রান্তি উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের মিলনের আনন্দবার্তা। কী সেই আনন্দবার্তা? একদিকে শস্যোৎসব, অপরদিকে সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশ হয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এদিন। সারাদেশে এই উৎসব বিভিন্ন নামে প্রচলিত। যেমন পশ্চিমবঙ্গে মকর বা পৌষ পার্বণ উৎসব, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, কর্ণাটকে মকর সংক্রমণ, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, কাশ্মীরে শায়েন ক্রাত এমন নানান নামে একই উৎসব পালন হয়। অর্থাৎ মকর সংক্রান্তিকে ঘিরে উৎসব আক্ষরিক অর্থে একটি সর্ব ভারতীয় উৎসব। আমাদের রাঢ় বাংলার এই উৎসব আজও অটুট।
উল্লেখ করতেই হয় মকর সংক্রান্তির দিন সাগরদ্বীপে পুণ্যস্নান ছাড়াও গ্রাম-বাংলার ছোট-বড়ো নদীগুলোতে ভোরেরবেলায় রমণী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পুণ্যস্নান। সেইসঙ্গে মকরের পুণ্যলগ্নে একে অপরের সঙ্গে সারা জীবনের বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার পর মিষ্টি মকরচাল সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে নিজেদের মধ্যে প্রসাদ হিসাবে খেয়ে মকরের বন্ধন দৃঢ় করেন। এখনও প্রতিটি গ্রামে মকরের ছড়াছড়ি। নাম নয়, একে অপরকে ‘মকর’ বলে সম্বোধন করে থাকেন। এমনকি নতুন বধূ এসেও এদিনটিতে মকর পাঠিয়ে চিরদিনের সাথী করে একে অপরের পরিবারের সম্পর্ক দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
এছাড়া পরিবারের গৃহিনীদের বিশ্বাস বিধাতা এদিন সকলের দুয়ারে আসেন পরীক্ষা নিতে। তাই সতর্ক আগেভাগেই। বাড়ির সদস্যদের খাওয়ার বাসনকোসন যেমন হিসেব করে রাখার প্রথা চালু আছে, তেমনি মকরসংক্রান্তি উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি আলপনা, ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবের চিত্র আজও স্মরণীয়। সেই সঙ্গে নানান পিঠেপুলি ও পায়েস আকর্ষণীয় করে রেখেছে আপামর বাঙালির প্রাণের হৃদয়ে।
প্রসঙ্গত, মকর সংক্রান্তি হল সেইক্ষণ যাকে ঘিরে এই উৎসব পালিত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসব পালিত হচ্ছে। তবে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। হতে পারে এটা হাজার বছরের উৎসব বা তার আগের। পুরাণেও এর উল্লেখ আছে। মকর সংক্রান্তি এই মহাতিথিতেই মহাভারতের পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় ইচ্ছা মৃত্যু গ্ৰহণ করেছিলেন। আবার কারও মতে এই দিনটিতে দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। বিষ্ণু অসুরদের বধ করে তাদের কাটামুণ্ডু মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দিয়েছিলেন। তাই মকর সংক্রান্তির দিনই সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশ হয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে আজও গ্রামাঞ্চলে তা মানা হয়। আবার অন্য মতে সূর্য এদিন নিজের ছেলে মকর রাশির অধিপতি শনির বাড়ি এক মাসের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলেন। তাই এই দিনটিতে বাবা-ছেলের সম্পর্কের একটি বিশেষ দিন হিসেবেও ধরা হয়।
এটা ঠিক সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে সঞ্চার বা গমন করাকেও সংক্রান্তি বলা হয়। সূর্য এদিনই ধনু থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। এর থেকেই মকর সংক্রান্তির উৎপত্তি। তাই আজও গ্রামাঞ্চলে পৌষের জন্য জেগে থাকে প্রাণের আকুতি।
গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে রমণীরা আউনি-বাউনি শস্যোৎসবকে টিকিয়ে রেখেছেন। এই উৎসবের লক্ষ্যনীয় হল ক্ষেতের পাকা ধান প্রথম ঘরে তোলা উপলক্ষে কৃষক পরিবারে পৌষ পার্বণ। এদিন ২-৩ টি ধানের শিষ বিনুনি করে আউনি-বাউনি তৈরি করা হয়। এর সঙ্গে মুলো ও সরষের ফুল, আমপাতা ইত্যাদি গেঁথে ধানের গোলা, ও সংসারের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রে বেঁধে দিতে হয়। বছরের প্রথম ফসলকে অতি পবিত্র ও সৌভাগ্যদায়ক মনে করে একটি পবিত্র ঘটে সারা বছর ধরে সংরক্ষণ করা হয়। বাইরের প্রাঙ্গণে আরাধনা করে সন্ধ্যায় পেঁচার ডাক শুনে লক্ষ্মীকে ঘরে তোলার রেওয়াজ আজও মুছে যায়নি। তাই গ্রামাঞ্চলে কান পাতলেই শোনা যাবে পৌষের জন্য জেগে আছে গৃহলক্ষ্মীরা। যাঁদের হৃদয়ে প্রাণের আকুতি মিনতির স্বর শোনা যাবে। কী সেই স্বর? তা হল —
‘পৌষ এল গুড়ি গুড়ি
পৌষের মাথায় চালের গুঁড়ি
এস গো পৌষ যেও না
জন্ম জন্ম ছেড়ো না’।
গ্রামের এই পরিবেশ অন্তত তিনটি দিন প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সব মিলিয়ে মানতেই হয় — ‘এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবুও রঙ্গে ভরা’। তাই বাংলার পৌষ পার্বণ বা মকর সংক্রান্তিতে নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় স্নিগ্ধ সবুজ গ্রাম।
খুব ভালো লাগলো, আপনার কলমে আমাদের গ্রাম বাংলার মাটির সাথে মিশে থাকা মানুষ গুলির সাদা সরল প্রাণের উৎসবের কথা সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। আপনাকে অনেক অনেক অভিনন্দন🎉🎊🎉🎊
ধন্যবাদ।