নীলাকাশের ইশারা আমাদের প্রতিদিনই বলছে, “আনন্দধামের মাঝখানে তোমাদের প্রত্যেকের নিমন্ত্রণ।” এ কথা বলে বসন্তের হাওয়া। এ কথা বলেন বিরহের মরমিয়া কবি। যারা এই ডাকে সাড়া দেয়, এই ডাকে ভাসতে চায়, তাদের সকালের প্রভাত কিরণ এসে ধাক্কা মারে। দুপুরের ঝিম ধরা নিস্তব্ধতা এসে বলে, “কি গো! এখনও পোঁটলা পুঁটলি বাঁধো নাই?” সন্ধ্যার মেঘে অস্তসূর্যচ্ছটা দূত পাঠায়। বলে, “নিমন্ত্রণ আছে যে!”
এই যে কবির বাণীতে প্রকৃতির এত আমন্ত্রণ, এই যে নক্ষত্রের অক্ষর আহ্বান জানায়, তাকে কি সুশোভনের মত একজন মানুষ অগ্রাহ্য করে থাকতে পারে? তার ওপর যদি তার কবিতা লেখার বাতিক থাকে, তা হলে তো হয়েই গেল। দুদিন ছুটি পেলেই সে পালাই পালাই করবে। ঘরে মন টেঁকে না। কিন্তু মুশকিল হল দামিনী। নব পরিণীতা। স্নান সেরে সিঁথিতে অনভ্যস্ত হাতে সিঁদুর লাগিয়ে, নতুন নতুন শাড়ি পাট ভেঙে পরে সুশোভনের মায়ের পায়ে পায়ে বিড়াল ছানার মতো গোটা বাড়ি ঘুরে ঘুরে সন্ধে দেখায়। ট্যারাব্যাঁকা লুচি বেলে। কে বলবে এ মেয়ে কোনোদিন শাড়ি পরেনি।
মুশকিল শাড়ি পরা নিয়ে নয়, লুচি খারাপ বেলা নিয়েও নয়। মুশকিল হচ্ছে দামিনী কলকাতার বাইরে যেতে চায় না। ঘুরতে সে ভালবাসে খুবই, কিন্তু সেটা কলকাতা বা তার আশেপাশের অঞ্চলে, যেখান থেকে সে রাতে ফিরে নিজের বিছানা নিজের বালিশে ঘুমোতে পারে। এটা সুশোভন বিয়ের আগে থেকেই জানে। প্রেম তো প্রায় তিন বছর ধরে চলেছে ওদের। একে অপরের দোষ গুণ সব জেনেই পিঁড়িতে বসা। দামিনী তখনই বলেছিল যে ও বাড়ির বালিশ বিছানা ছেড়ে কোথাও ঘুমাতে পারে না। ওর খুব অসুবিধা হয়। সেজন্য বাবার রেলের চাকরি সত্বেও যতটা ঘোরা উচিত ছিল ততটা ওর ঘোরা হয়নি। ওর বাবা মা অবশ্য ওকে ঠাকুমা দাদুর কাছে রেখে মাঝেমাঝেই ঘুরতে চলে যেতেন। সেটাতেও ওর রাগ হতো খুব। এসবই জানা সুশোভনের।
বিয়ের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। সুশোভনের মন কেবলই কোথায় যাই কোথায় যাই করছে, কিন্তু দামিনীর ওসবের বালাই নেই। মন খারাপ লাগলে খানিকক্ষণ সাউথ সিটি মলে কিছুটা ঘুরে এলে তার মুড ঠিক হয়ে যায়। গড়িয়াহাটে চক্কর কেটে হাবিজাবি জিনিস কিনে দামিনী ভাল থাকে। এ হেন মেয়েকে নীলাকাশ, নির্জন পর্বত সান্নিধ্যের সুখ কিছুতেই বোঝাতে পারে না সুশোভন। তবু মধুচন্দ্রিমা বলে তো একটা ব্যাপার থাকে। সেটা না হলে বন্ধুরা তো জ্বালিয়ে মারে। কোথাও গেলি না! বিয়ের পর এতদিন কেটে গেল, তোরা কি!!
দুজনের বন্ধু মানে বেশ কিছু কমন ফ্রেন্ড। তারা সবাই জানে দামিনীর প্রবলেম। সবাই মিলে হ্যাটা দেয়। সকলের হ্যাটা খেয়ে দামিনী মত দেয় টিকিট কাটার। তবে খুব দূরে সে যাবে না। মত পেয়ে যেতেই টিকিট কেটে ফেলে সুশোভন। এন জে পি তে নেমে কালিম্পং, তারপর লাভা লোলেগাঁও রিশপ ঘুরে ব্যাক টু প্যাভেলিয়ন। খুব বেশিদিন নয়, মেরে কেটে ছ’দিন। তাতেই দামিনী সমানে বলছে কতোদিন না ঘুমিয়ে তাকে থাকতে হবে।
দামিনীর কথা ভেবেই সুশোভন হোটেল বুক না করে হোমস্টের ঘর বুক করে রাখে, যাতে একটু হলেও বাড়ির মতো ফিল করে দামিনী। বেড়াতে গিয়ে যদি দামিনীর ভাল না লাগে তাহলে সুশোভনও ঘুরে কোন আনন্দ পাবে না। লাভা দু-জনেরই অদেখা। সুতরাং দুজনেরই ভাল লাগবে নতুন জায়গা। তারপর ভীষণ রকম নির্জন। যেটা নববিবাহিতদের পক্ষে আদর্শ। কিন্তু দামিনীর সব উল্টো। ওর সবসময় গমগমে জায়গা পছন্দ। যেখানে অনেক লোকের ভিড়, সেরকম জায়গা সুশোভনের একেবারেই পছন্দ নয়।
লাভা যেতে বলেছিল ওদের কমন ফ্রেন্ড লুসিয়া। লুসিয়া কিছুদিন আগেই ঘুরে এসেছে লাভা-লোলেগাঁও। ওরা অবশ্য সরকারি বনবাংলোতে ছিল, অনেকজন মিলে গেছিল, খুব আনন্দ করেছে। কিন্তু বনবাংলোতে বড় বড় গাছের মধ্যে আরও নির্জনতা। দামিনী থাকতে পারবে না। তার থেকে, কটেজগুলোর আগেই পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট বাড়ি আছে। ওখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা কয়েকটা ঘর হোমস্টে করে ভালই ব্যবসা করছে। বাড়ির মত ফিলিং হয় থাকলে। দামিনীর ভাল লাগবে। সবদিক ভেবেই গুরু দাওয়ার ‘মণি হোমস্টে’ বুক করে দিয়েছে সুশোভন।
ট্রেনে উঠেই দামিনীর ঘোষণা — গোটা রাত জেগে থাকতে হবে। কারণ ট্রেনে দামিনীর ঘুম হয় না। সারারাত গল্প করে শেষ রাতে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে কখন। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে একটু চা কেকের সদ্ব্যবহার করে একটা গাড়ি নিয়ে কালিম্পঙ। দোতলা একটা স্যুইট ওদের জন্যে রাখা ছিল। ঘর থেকে সামনে পাহাড়ের সারি। বিরাট কাচের জানলা। যেন মেঘ ঘরে ঢোকার অনুমতি চাইছে। সুশোভন প্রকৃতির কোলে বুঁদ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দামিনীর এত ঝুপসি মেঘ না পসন্দ। তবু দোতলা স্যুইট ওর বেশ পছন্দ হয়েছে। কেবল একতলা থেকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ঘরে যাচ্ছে, আবার নেমে আসছে। সুশোভনের ঠিক উল্টো স্বভাব।
কালিম্পঙে সব ঘুরে, কেনাকাটা সেরে লাভার দিকে যেদিন যাত্রা শুরু সেদিন আকাশের মুখ ভার। মেঘ একেবারে সামনে এসে যাত্রাপথ অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে বারবার। চারপাশের গাছ কেমন থম মেরে আছে। সুশোভনের যদিও খুবই ভাল লাগছে, কিন্তু দামিনীর ভাল লাগছে না। “কি ভূতুড়ে জায়গায় নিয়ে যাচ্ছো বলো দেখি! এরকম আবহাওয়া কন্টিনিউ করলে কিন্তু আমি থাকবো না, নেমে শিলিগুড়িতে থাকবো বলে দিলাম।” দামিনীর ধমককে সুশোভন একটুও পাত্তা না দিয়ে ওকে আরও ক্ষেপিয়ে দেবার জন্য গাইতে লাগল
“দামিনী দমকে ডর মোহে লাগে…..”। দামিনী আরও রেগে ওর পিঠে গুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয়, তারপর মুখ ভার করে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করে। হঠাৎ করেই মেঘ সরে গিয়ে এক টুকরো রোদ উঁকি দেয়। ততক্ষণে ওরা এসে দাঁড়িয়েছে একটা সুন্দর ফুলে ছাওয়া বারান্দার সামনে। যাতে লেখা ‘মণি হোমস্টে’।
সুন্দর ছোট্ট দোতলা বাড়ি, লাল টালির চাল নানান ফুলের গাছে সাজানো, চারদিকে পাহাড় ঘেরা, যেন এক রূপকথার গল্পের বইয়ের ছবি। সত্যি না, সব অলীক। কিন্তু গাড়ির ড্রাইভার ভাড়া চাইতেই বাস্তবে ফিরতে হয় সুশোভনকে। সত্যিই তো, এখন ভাড়া মিটিয়ে ওকে ছেড়ে দিতে হবে। গাড়ির আওয়াজে ছবির মত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এক দম্পতি। বয়স্ক কিন্তু পাহাড়ি বলে, বয়েস কতো ঠিক বোঝা যায় না। এসেই ক্ষিপ্র গতিতে ওদের সব সামান তুলে নিয়ে “অন্দর আইয়ে” বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে গেল।
খানিকক্ষণ ওরা দুজনে গাড়ির টাকা মিটিয়ে কোমরে হাত দিয়ে চারপাশটা মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকল। দামিনী হঠাৎ করে বলে উঠল, “এই জানো! আমার না কেমন যেন সবকিছু চেনা মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে অনেকদিন পর নিজের জায়গায় ফিরে এলাম।” সুশোভন লাফিয়ে উঠে বলল, “যাক বাবা, ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে, তাহলে আর নিজের বিছানা নিয়ে কোন প্রবলেম নেই। তুমিও ঘুমোবে আর আমিও শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। কালিম্পঙে দুটো রাত ভাল করে নিজেও ঘুমোলে না, আমাকেও জাগিয়ে রাখলে। এমন জানলে কে তোমাকে নিয়ে বাইরে বেরোত?”
লম্বা চর্চিত রঙিন নখ দিয়ে চিমটি কাটার উদ্দেশ্যে দামিনীর হাত সুশোভনকে ছোঁওয়ার আগেই আবার দুজনে হাজির। এবার পরিষ্কার ভাঙা বাংলায় বললেন,”আসুন স্যার, আসুন ম্যাডাম, আপনাদের ঘর রেডি।” ওরা হোমস্টের ভেতরে প্রবেশ করল। ঝকঝকে ঘর বারান্দা, ভেতরে একটা ছোট্ট বাগান, তাতে নানান ধরনের সব্জি, ফল ফুলের গাছ। একটু দূরে মনাস্ট্রির কিছু অংশ চোখে পড়ছে। আর একদিকে ঘন বন। ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা। ওরা দুজনে ঘরে ঢুকে পরিপাটি করে ঘর সাজানো দেখে খুব খুশি। বাথরুমও সুন্দর। সুশোভন সব দেখে খুশি হয়ে দামিনীকে কিছু বলতে গিয়ে দেখল দামিনী নেই। ওমা! এইতো ছিল, কোথায় গেল!
ঘরের বাইরে বেরিয়ে সুশোভন এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে হোমস্টের মালকিন হাসতে হাসতে চায়ের ট্রে নিয়ে আসছে। ওকে দেখে বললেন, “কাকে খুঁজছেন? বিটিয়ারাণী তো বাগানে দোল খাচ্ছে।”যাহ্ বাবা! এই ক মিনিটে দামিনী এঁদের বিটিয়ারাণী হয়ে গেল! আবার দোলনা পেল কোথায়? চা নিয়ে চুমুক দিতে মন খুশি হয়ে গেল। সঙ্গে পকোড়া। বাগানের শেষ প্রান্তে মোটা গাছের ডালে দোলনায় শ্রীমতী দুলছেন আর নিজের মনে হাসছেন। পাগলি একটা। হোমস্টের মালকিন ওকে ওখানেই চা দিতে গেলেন। এটাই হোটেল আর হোমস্টের তফাৎ। অনেকটাই বাড়ির আবহাওয়া।
বাড়িটার দোতলায় দুটো ঘর, তার একটিতে ওদের থাকার ব্যবস্থা। অন্যটি খালি, সাজানো গোছানো সুন্দর। বোধহয় অতিথি না থাকলে দাওয়া দম্পতি থাকেন। চা খাওয়ার পর দামিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে বেরলো সুশোভন। পাকা রাস্তার ধার দিয়ে সরু সরু কাঁচা রাস্তা পাকদন্ডির মতো নেমেছে উঠেছে। সেই রাস্তার পাশে ছোট ছোট বাড়ি, গাছ, ছোট্ট ছোট্ট দোকানঘর। ওরা একটু দূরে মনাস্ট্রিতে গেল। মনাস্ট্রির খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড় খাদ জঙ্গল সব যেন হাতের মুঠোয় ধরা দিচ্ছে অবাধে।
অনেকক্ষণ ধরে মনাস্ট্রি দর্শন সেরে ফেরার সময় আচমকা এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সুশোভনের একেবারে সামনে এসে পথ আটকালেন। স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন “লওট যাও তুরন্ত। মত্ রহো।” বলেই কোথায় হারিয়ে গেলেন যেন। ওরা তাড়াতাড়ি ওঁকে আবার দেখতে পাবার আশায় এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করে দেখতে পেল না। এদিকে ছোটাছুটির ফলে খিদে পেয়েছে জব্বর। সন্ন্যাসীর কথা ভুলে ওরা মণি হোমস্টের দিকে পা বাড়াল।
দুপুরে ওদের জন্যে দেশী মুরগির ঝাল ঝাল ঝোল, ঝুরো আলু-ভাজা, কপির তরকারি, চাটনি আবার শেষ পাতে বাড়ির তৈরি আইসক্রিম। আইসক্রিম নাকি মিসেস দাওয়া স্পেশালি বিটিয়ারাণীর জন্যে বানিয়েছেন। দামিনী তো সাংঘাতিক খুশি। সুশোভনেরও খুব ভাল লাগছে এঁদের ব্যবহার। ডাইনিং টেবিলে একটা বাচ্চা মেয়ের ফটো রাখা। এই বছর পাঁচেকের হবে। এদের বাচ্চা যেমন হয়, ফর্সা, ট্যাঁপাটোপা লাল গাল, নাকটা সামান্য চাপা। সুশোভন জিজ্ঞাসা করল, “ফটোটা কার?” অদ্ভুত ভাবে ওঁরা উত্তর দেবার আগেই দামিনী খেতে খেতে বলে উঠল, “আরে, ওটা আমার ফটো। চিনতে পারছো না?” সুশোভন হেসে প্রতিবাদ করতে যাবে যে, কি আজেবাজে বকছো! তার আগেই দাওয়া দম্পতি এক যোগে মাথা নেড়ে বললেন, “সচ্ বাত। বিটিয়ারাণীর ফটো ওটা।” এবার সুশোভন সামান্য বিরক্ত হয়ে বলে, “হ্যাঁ, সে আপনাদের বেটির ফটো ওটা, দামিনীর হবে কেন?” সুশোভন দেখল দামিনী আইসক্রিমটা নিয়ে ঠিক একটা বাচ্চা মেয়ে যেভাবে খায় ঠিক সেভাবে খাচ্ছে, পা দোলাচ্ছে, মাথা নাড়ছে।
সুশোভনের খাওয়া হয়ে গেছিল তাই ও উঠে এল আগেই। মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে বাড়ি থেকে আনা একটা উপন্যাসের পাতা ওল্টাতে লাগল। বিকেলে আবার বেরোতে হবে। পায়ে হেঁটে একটা ঝর্ণা দেখতে যেতে হবে। সন্ধের আগে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু দামিনীর দেখা নেই। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ও বাইরে এসে দেখল দামিনী আবার দোলনায় ফিরে গেছে আর ওকে দোল দিচ্ছে মিসেস দাওয়া। এ তো ভারি মুস্কিল! দামিনী কি বাচ্চা হয়ে গেল নাকি! হানিমুনে এসে কেউ এমন সুন্দর একটা দুপুর বৃথা যেতে দেয়! বিরক্ত সুশোভন এসে শুয়ে পড়ে।
বিকেলে ওরা ঝর্ণা দেখতে যায় ঠিকই কিন্তু মিঃ দাওয়া ওদের সাথে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। আর পুরো রাস্তা দামিনীকে আগলে আগলে নিয়ে গেলেন, যেন সুশোভন একটা বাড়তি মানুষ। নাহ্। প্রথম দিকে যতোটা ভাল লাগছিল সুশোভনের, এখন দামিনীকে নিয়ে ওদের এই বাড়াবাড়ি মাত্রাতিরিক্ত মনে হচ্ছে। আর দামিনীও অদ্ভুত মেয়ে একটা। মনে হচ্ছে যেন সে সুশোভনকে চেনে না। দু একবার ওর হাত ধরতে গেলেও দামিনী ছাড়িয়ে নিয়ে মিঃ দাওয়ার পাশে পাশে হাঁটছে।
সন্ধেয় ফিরে একবারের জন্যও দামিনী ঘরে এল না। সবসময় রান্নাঘরে। যে মেয়ে রাঁধতেই পারে না, সে একটা অজানা মানুষের রান্নাঘরে কি করছে সেটা ভেবে পেল না সুশোভন। রাতে অনেক রকম রেঁধে খাওয়ালেন ওনারা। দামিনী খেল ওর সঙ্গে, কিন্তু তারপর যেটা বলল সেটা শুনে সুশোভনের মনে হলো দামিনীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। খেতে খেতে দামিনী বলল, “আমি মায়ের সঙ্গে শোবো। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।” এইবার সুশোভন রাগে ফেটে পড়ল। “কি পাগলামি করছো তুমি? মা মানে? মা তো তোমার কলকাতায়। তুমি ঘরে আসছো না। এঁকে মা বলছো, মাথা ঠিক আছে তোমার?”
“মাথা ওর ঠিকই আছে বেটা। এই যে দেখছো ফটো, ওটা আমার মেয়ে মণির। পাঁচ বছর বয়সে ও গুম্ফা থেকে হারিয়ে যায়, আর ফিরে আসে নি। আমরা এত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি। আজ সকালে যখন বিটিয়ারাণী নামল গাড়ি থেকে, তখনই চিনেছি। আর দ্যাখো না, কিছুক্ষণের মধ্যে ও নিজেই কেমন সব চিনে নিয়েছে। ওকে ছেড়ে দিয়ে তুমি কলকাতা ফিরে যাও। আমাদের বেটি এতদিন পর নিজের ঘরে ফিরেছে।”
সুশোভন ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দামিনীর হাত ধরে টেনে আনার চেষ্টা করে। ওদিক থেকে দাওয়া দম্পতি একসাথে দুজন দামিনীকে জড়িয়ে নেয়। এ কেমন হোমস্টেতে এসেছে সুশোভন! এরা কি পাগল? নাকি আরও ভয়ানক কিছু! আধিভৌতিক কিছু ঘটছে দামিনীকে ঘিরে? ওই জন্যে কি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ফিরে যেতে বললেন? মনের মধ্যে প্রশ্নের পাহাড় ঠেলতে ঠেলতে সুশোভন প্রাণপনে দামিনীর হাত ধরে টানতে থাকে। টানতেই থাকে।
মুখে জলের ঝাপটা পেয়ে চোখ মেলে উঠে বসে ওরা। সুশোভন আর দামিনী। লাভার বাজারে একটা দোকানের সামনে ওরা বসে আছে। চারপাশে স্থানীয় লোকের ভিড়।
“কোথায় উঠেছিলেন? কোথায় যাবেন?”
সুশোভনের মুখ দিয়ে বের হয় “মণি হোমস্টে”
“মণি হোমস্টে!!! সে তো কবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! গুরু দাওয়া আর সোনা দাওয়ার একমাত্র মেয়ে মণি গুম্ফা থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর ওর বাপ মা পাগলের মত হয়ে যায়। তার কয়েক বছর পর ওরা বাড়ি শুদ্ধ পুড়ে মরে।”
সুশোভনের কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয় এবার। দামিনীর চোখে জল, কিন্তু ওর অবস্থা এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।
“কি করবে? থাকবে এখানে? অন্য কোন হোমস্টে বা হোটেলে?” সুশোভন জিজ্ঞেস করে।
“না। আর এক মুহূর্ত নয়। শিলিগুড়ি নেমে চলো। আমার এই নির্জন জায়গা ভাল লাগছে না একদম।” দামিনী বলে।
লোলেগাঁও, রিশপের মায়া ত্যাগ করে সুশোভন বলে, “একটু গাড়ি ডেকে দেবেন? শিলিগুড়ি নেমে যাবো।”
গাড়ি নামছে সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে। সুশোভনের চোখ সেই দৃশ্য মেখে নিচ্ছে। দামিনী সুশোভনের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমে অসাড়।