কলকাতার ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে কি দূরতম কোনও সংযোগ-সম্ভাবনা ছিল? ইতিহাসের সমর্থন কিন্তু আছে। নদীয়া রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজা হন। তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যের বিস্তার ঘটে। তাঁর সময় পরগনার সংখ্যা ছিল ৮৪টি এবং রাজ্যের পরিধি ছিল ৩৮৫০ ক্রোশ। নদীয়া জেলার প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত হন মি. এফ রেডফার্ণ তাঁরই রাজত্বকালে। তাঁর রাজত্বকাল নানা ঘটনায় পূর্ণ ছিল পলাশীর যুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, বর্গী হামলা ইত্যাদি তাঁরই আমলে হয়। সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কৃষ্ণচন্দ্র-কে প্রথমে ‘মহারাজা’ ও পরে ‘মহারাজেন্দ্র বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেই সঙ্গে পতাকা, নাকাড়া, ঝালদার পালকি ইত্যাদি রাজ পুরস্কার প্রদান করেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পূর্ণ রাজ উপাধিটি ছিল এই রকম — ‘অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী শ্রীমন মহারাজরাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র রায়’। কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই নদীয়া সর্বাধিক উন্নতি লাভ করে। তিনি সারা নদীয়া জুড়ে অনেক দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আমলেই কৃষ্ণনগর রাজপ্রাসাদের দরবার কক্ষ বা বিষ্ণুমহল এবং পঙ্খের কারুকাজ সমন্বিত নাট মন্দির নির্মাণ করা হয়। লর্ড ক্লাইভ কৃষ্ণচন্দ্র-কে ‘রাজেন্দ্র বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে তাঁর প্রভূত সখ্য ও হৃদ্যতার কথা শোনা যায়। ড্রেক ও ক্লাইভের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া চিঠিতেও তাঁর নাম পাওয়া গেছে। তিনি নাকি কালীঘাটে পূজা দিতে যাওয়ার ছলে লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে দেখা করতেন কলকাতায়। এইভাবে ইংরেজদের অনেক গোপন তথ্য তিনি সরবরাহ করতেন। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ জয়রাম ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতার কথা তো অনেক জায়গাতেই লেখা হয়েছে। তিনি জয়রাম ঠাকুরের আমিনের কাজের সময় কলকাতার দক্ষিণ দিকের (এর মধ্যে পাঁচটি হাওড়ার দিকে) আটত্রিশটি গ্রামের জরিপের সময় জয়রামের ঘনিষ্ঠ হন।কারণ এর মধ্যে অনেক গ্রাম তাঁর নিজের মালিকানায় ছিল। জয়রামের রাধাকৃষ্ণ মূর্তি তিনিই গড়িয়ে দিয়েছিলেন কষ্টিপাথরে। এই রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের সেবার জন্যে তিনশ এগারো বিঘা নিষ্কর জমি জয়রামকে দান করেন তিনি। সম্ভবত ১৭৩০-১৭৪০ নাগাদ তিনি জয়রাম ঠাকুরের বাড়িতেও গেছেন ধর্মতলা বা ধনসায়রে। পঞ্চানন কুশারী তখনও জীবিত। (তাঁর সঠিক মৃত্যুকাল জানা যায় না)। পঞ্চানন কুশারীর সঙ্গেও জয়রামের মাধ্যমেই তাঁর আলাপ হয়। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন বিদ্বান, লেখক, কবি ও সংগীতবিদ্যায় পারদর্শীদের পৃষ্ঠপোষক। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর, রামপ্রসাদ সেন তাঁর আশ্রিত ছিলেন। ভারতচন্দ্রকে তিনি গুণাকর উপাধি দিয়েছিলেন। মনে হয় পঞ্চানন কুশারীর ঠাকুর উপাধির নেপথ্যেও তাঁর হাত আছে। কারণ পঞ্চানন জাহাজের পণ্যসরবরাহকারী বা স্টিভডোর হলেও তাঁর নেশা ছিল কবিগানের। গায়ক ও সংগীত-বিশারদদের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখতেন। তাই পঞ্চানন-জয়রামকে তিনিই ঠাকুর উপাধি দিয়েছিলেন ভেবে নিলে অতিশয়োক্তি হবে না। প্রসঙ্গত জয়রাম ঠাকুরের মৃত্যু সাল ১৭৫৬ বা ১৭৬২।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসে রামলোচন ঠাকুরের উইলে জনৈক কৃষ্ণচন্দ্র রায় কবিরাজ-এর কাছে প্রাপ্ত জায়গার উল্লেখ আছে। এই কৃষ্ণচন্দ্র রায় কবিরাজের পরিচয় কী? ইনি কি নদীয়ার মহারাজা? তাঁর কাছ থেকে জয়রাম ঠাকুরের পাওয়া নিষ্কর জমির কথাই কি মনে পড়ায় এই উল্লেখ?
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্মরণীয় হয়ে আছেন যোদ্ধার সাজে মৃন্ময়ী মূর্তি বা ‘রাজ-রাজেশ্বরী’ নামে খ্যাত তাঁর জাঁকজমকপূর্ণ পুজো-উৎসবের জন্যেও।
তিনি কলকাতায় গড়গোয়ালা পাঠিয়েছিলেন কোনও এক যুদ্ধের সময়।
১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে কৃষ্ণনগরের রাজা দেহত্যাগ করেন।