শুধু আধ্যাত্মিক বিকাশ নয়, জগন্নাথদেব তাঁর অপার মহিমা নিয়ে অধিষ্ঠান করেছেন ভক্তদের জীবনে ও মননে। তাকে উদ্দেশ্য করে নিবেদিত প্রসাদ, যাকে বলা হয় মহাপ্রসাদ নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণে জগন্নাথ দেবের মহাপ্রসাদের মাহাত্মের কথা বলা হয়েছে। এই মহাপ্রসাদের রন্ধনশৈলী, তার পরিমাণ ও নিবেদন পদ্ধতি অনন্য। জগন্নাথদেব সারা ভারতবর্ষের মানুষকে আকর্ষণ করছেন তার বিখ্যাত মহাপ্রসাদের মাধ্যমে। ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে সেই বিখ্যাত মহাপ্রসাদের কাহিনী নিয়ে আজকের লেখা।
ভক্তদের বিশ্বাস কোন অদৃশ্য হাত যেন এই প্রতিদিনের বিপুল পরিমাণ ভোগ প্রস্তুতি নিয়ন্ত্রণ করছেন যারা নিত্যদিন এই ভোগ প্রস্তুতির পর্বের সঙ্গে জড়িত থাকেন। সুয়ারা ও সেবায়েতরা ছাড়া, বাকি সকলেরই প্রায় কিছুই জানেন না বা ভাসা ভাসা জ্ঞান আছে এই ভোগ তৈরি সম্পর্কে, এনিয়ে গবেষণাও চলছে নিরন্তর। সারা ভারতবর্ষের জুড়ে শ্রীবিষ্ণুর যে কটি ধাম বা পীঠ রয়েছে, পুরী তার মধ্যে ‘ভোগ’-পীঠ। হিন্দুরা বিশ্বাস করে আসছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিপালক ভগবান শ্রীবিষ্ণু রামেশ্বরমে স্নান করেন, দ্বারিকায় বেশ বদল করেন পুরীতে আহার করেন এবং বদ্রিনাথে শয়ন করেন। তাই লক্ষ্মীদেবীর বাসস্থান শ্রীক্ষেত্র এর সঙ্গে সংলগ্ন।
পদ্মপুরান অনুযায়ী পুরীর মন্দিরের রন্ধনশালায় মা লক্ষ্মী স্বয়ং নিজ হাতে যজ্ঞাগ্নিতে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর জন্য ভোগ রান্না করেন এবং শ্রীবিষ্ণু নিজ হাতে এই প্রসাদ গ্রহণ করেন বলে এই মহাপ্রসাদ অত্যন্ত পবিত্র। ভক্তদের বিশ্বাস এই প্রসাদের সামান্য অংশগ্রহণ করলে মোক্ষলাভ হয়, অনেক অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। পুরীর প্রভুজগন্নাথদেবকে বলা হয় দারুব্রহ্ম এবং তার প্রসাদকে বলা হয় অর্ণব্রহ্ম বা মহাপ্রসাদ।
প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে নটার মধ্যে জগন্নাথ দেবের স্নান হয়। স্নান শেষে সূর্য পূজার সঙ্গে রান্নাঘরে যজ্ঞ শুরু করা হয়। এই যজ্ঞের আগুন থেকে প্রতিটি উনুন জ্বালানো হয়। মন্দিরে মহাপ্রসাদ তৈরি করবার জন্য শুধু বিশুদ্ধতা নয় এক বিশেষ ধরনের জলও ব্যবহার করা হয়। রান্নাঘরের কাছে দুটি কূপ ‘গঙ্গা-যমুনা’র জল দিয়ে মহাপ্রসাদ তৈরি করা হয়।
এখানে ভগবানকে ভাত কখনো শুধু দেয়া হয় না এর সঙ্গে ঘি দুধ জল গুড় বা ডালের সঙ্গে পরিবেশিত হয়। রান্না করা হয় জল ও বাটামসলা দিয়ে। জগন্নাথদেবকে ভোগ নিবেদনের সময় উপরে ঘি ছড়িয়ে যাওয়া হয়।
মূলত দেশীয় সবজি যেমন কুমড়ো, বেগুন, ওল, কাঁচকলা, রাঙাআলু, পটল, শাক, ছোলা, পালং, আমের মুকুল, তালের মুকুল, মুলো, পটল, ঝিঙে, কন্দমূল, সারু, কঙ্কন ইত্যাদি ব্যবহার করে তরিতরকারি বানানো হয়। ফলের মধ্যে কাঁঠাল কমলালেবু কলা নারকেল আমলকি, সীতাফল, ছিক্কু, পেয়ারা, তাল ইত্যাদি।
মসলায় হলুদ জিরে সর্ষে বড় এলাচ মরিচ পেস্তা বাদাম কিসমিস এবং টকের জন্য তেঁতুলের ব্যবহার হয়। শুকনো মসলাকে প্রাচীন পদ্ধতিতে পাথরে গুঁড়ো করে নেওয়া হয়, এরপর এটি জলে বা ঘিয়ে মিশিয়ে পেস্ট বানানো হয়।
মিষ্টিতে আটা সুজি চালেরগুড়ি গুড় ক্ষীর ব্যবহার করা হয়। বিদেশী শাকসবজি যেমন আলু টমেটো পাতিলেবু কপি ঢেঁড়স লাউ, লাললঙ্কা ব্যবহার হয় না।
ভীমপাক, নালপাক, সৌরিপাক ও গৌরীপাক এই চারটি রন্ধনশৈলীতে জগন্নাথ দেবের ভোগ রান্না করা হয়। মন্দির কর্তৃপক্ষ যে ভোগ অর্পণ করেন তাকে বলা হয় রাজভোগ বা কোঠাভোগ। অন্য সমস্ত ভোগকে যজমানভোগ বলা হয়। রাজভোগ দিনে দুবার হয় প্রদান করা হয় মন্দিরের গর্ভগৃহে। সাধারণত ৬০ ধরনের রাজভোগ প্রতিদিন নিবেদন করা হয় চার দফায়। সকালে প্রাতরাশে থাকে মিষ্টি, দেশজ ফল, নারকেল, দই, মালাই, রাবড়ি। সকাল দুপুর রাত্রে তিনবার অন্য ভোগ হয়। এই অন্নভোগে হয়ে থাকে মূলত খিচুড়ি, ঘিভাত, সুজি, রাবড়ি, ফ্যানভাত, দুধ ভাত, দই ক্ষীর, ছানা পিঠে, কলা আনারস ইত্যাদি দেশজ ফল।
যজমানভোগ হয় গর্ভগৃহের বাইরে।এতে থাকে মূলত ৬-৭ রকমের ভাত, ৩০ রকমের শাক-শাকসবজি, নারকেল দেওয়া ডাল, ক্ষীর ও রাবড়ি। বিভিন্ন ধরনের সেবক এই ভোগ প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িত থাকেন। মহাপ্রসাদ রন্ধনের রীতি নীতি খুবই কঠোরভাবে পালন করেন প্রত্যেকে। এই ভোগ রান্নার সময় হাতে সামান্য সুতটুকু রাখা যায় না কপালে থাকে দক্ষিণাকালীর টিপ, কোনরকম নেশা করা যায় না, অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলা যায় না, অসুস্থ এবং বয়স্করা এতে অংশ নিতে পারেন না।
এক একটি উনুনের বিভিন্ন মাপের নটি মাটির পাত্র একটির উপর একটি পাত্র বা নবচক্র বসানো হয়। রান্নার সময় কোন খাদ্য বস্তুটি হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করানো হয় না, অথচ প্রতিটি পাত্রে আলাদা আলাদা খাদ্যবস্তু থাকে। মা লক্ষ্মী স্বয়ং এই রান্নার তদারকি করেন বলেই হয়তো বিস্ময়কর ভাবে সবার উপরে থাকা পাত্রটির রান্না দিয়ে আগে সমাপ্ত হয়, তারপর একের পর একটা তলায় থাকা পাত্রগুলির রান্না সুসিদ্ধ হয়ে সমাপ্ত হয়।
মহাপ্রসাদ কে অম্রুতা মানোহী। বিশ্বাস করা হয় এই প্রসাদের অংশ হলো নির্মাল্য, নির্মাল্য মনে হয় অমৃতের সমান যা গ্রহণ করলে মানুষ অমরত্ব লাভ করে। এটি কৈবল্য নামেও পরিচিত। আসলে এটি মহাপ্রসাদের মাহাত্ম্যকেই নির্দেশ করে, কোথাও বিখ্যাত বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জগন্নাথ দেবকে ভোগ অর্পণ করলে তাকে বলা হয় অম্রুতা মানোহী। মনে হয় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের বিভিন্ন ধরনের মানোহীর চল রয়েছে। যেমন সর্প মানোহী, চক্র মানোহী, অম্রুতা মানোহী। এটি নির্ভর করে কোন স্থান বা কোনখান থেকে অর্পণ করা হয়েছে তার উপরে। যেমন নাটমন্ডপ বা রথে অর্পণ করা হয় নৈবেদ্যকে বলা হয় সর্প মানোহী, ভগবানের চোখের সামনে অর্পিত ভোগকে বলা হয় অম্রুতা মানোহী। অম্রুতা মানোহী যেহেতু মূল প্রসাদ, তাই তার আয়োজনও এলাহী। প্রতিদিন প্রায় ১২০ টিরও বেশি ধরনের ভোগ দেওয়া হয়। সেই কারণে বহু বছর ধরে উড়িষ্যার রাজ্য জমিদাররা পালা করে এর উপযুক্ত ব্যবস্থা করে গেছেন। মহাপ্রসাদ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত সুখিলি ভোগ এবং সানুখুড়ি ভোগ।
প্রথাগতভাবে যে কোন মানুষ এই ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করতে পারেন এবং বন্টন করা হয় তাই এর নাম ‘অবাধ’। বলা হয় মহাপ্রসাদ হাতে পাওয়ার পর যে অবস্থাতেই সেটি তাকে ফ্রেশ কিম্বা শুকনো তা গ্রহণ করতে হয়। ভোগ নিবেদনের সময় মন্ত্ররাজ বা পাতাল নৃসিংহ মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। সমর্পণের সময় অষ্টাদশ অক্ষর গোপাল মন্ত্রও উচ্চারণ করা হয়।
ভৈরবী চক্রের (বিশেষ প্রকার ভোগ) কিছু অংশ নিবেদন করা হয় বিমলা দেবীকে অষ্টাদশাত্মিকা বৈষ্ণবদের। এই পুরো আচারকে মহাপ্রসাদ প্রক্রিয়ার সদাঙ্গ সংস্কার বলা হয় এই সদঙ্গ সংস্কারের পর অর্ণ অর্ণব্রহ্মে পরিণত হয়, প্রসাদ পরিণত হয় মহাপ্রসাদে।
জগন্নাথ দেবের পাকশালায় কমপক্ষে একসঙ্গে ১ লক্ষ লোকের রান্না হতে পারে। আক্ষরিক অর্থে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম কিচেন। পুরিতে আগত ভক্তবৃন্দরা ‘খাজা’ (ময়দা চিনি ঘি দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের শুকনো মহাপ্রসাদ) নিয়ে যায় সকলের জন্য কারণে এটি বেশ কদিন সতেজ থাকে। শুকনো চালের মহাপ্রসাদ নির্মাল্য পর্যটকরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য নিয়ে যান।
রথযাত্রার প্রথম দিন থেকে দেবতাদের তাদের রত্ন খচিত সিংহাসনে ফিরে আসার দিন পর্যন্ত মহাপ্রসাদ বন্ধ থাকে। পুরীতে জগন্নাথের দর্শনের ফল মহাপ্রসাদ ছাড়া পাওয়া যায় না। তাই পুরীতে জগন্নাথ দেবের দর্শনের পর মন্দির সংলগ্ন আনন্দবাজার থেকে অতি অবশ্যই মহাপ্রসাদ সংগ্রহ করবেন।