শনিবার | ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:১৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়, মিথ এবং ডিকনস্ট্রাকশন : অসিত দাস মহাকুম্ভ ও কয়েকটি প্রশ্ন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভিয়েতনামের গল্প (শেষ পর্ব) : বিজয়া দেব কাশীকান্ত মৈত্রের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন : ড. দীপাঞ্জন দে অমৃতের সন্ধানে মাঘী পূর্ণিমায় শাহীস্নান : রিঙ্কি সামন্ত বাংলার নবজাগরণের কুশীলব (ষষ্ঠ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের যোগ : অসিত দাস ‘হরিপদ একজন বেঁটে খাটো সাদামাটা লোক’-এর গল্প হলেও… সত্যি : রিঙ্কি সামন্ত রোহিঙ্গা সংকট — ফেলে আসা বছর ও আগামীদিনের প্রত্যাশা : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন বাংলার নবজাগরণের কুশীলব (পঞ্চম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার ‘রাঙা শুক্রবার অথবা কহরকন্ঠ কথা’ উপন্যাস বিষয়ে শতদল মিত্র যা বললেন রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় পরিচয় : গোলাম মুরশিদ কেজরিওয়াল হারলো প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অরাজকতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য : তপন মল্লিক চৌধুরী বাংলার নবজাগরণের কুশীলব (চতুর্থ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার সাহেব লেখক দেড়শো বছর আগেই বলেছিলেন পঞ্চানন কুশারীর কবিয়াল হওয়ার সম্ভাবনার কথা : অসিত দাস বাংলার নবজাগরণের কুশীলব (তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার সর্বপাপবিনাশীনি জয়া একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত বাংলার নবজাগরণের কুশীলব (দ্বিতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার বাজেটে সাধারণের জীবনমানের উন্নয়নের একটি কথাও নেই : তপন মল্লিক চৌধুরী শঙ্খ ঘোষ-এর ‘এখন সব অলীক’ নস্টালজিক অনুভূতি দিয়ে ঘেরা মায়াময় এক জগৎ : অমৃতাভ দে বাংলার নবজাগরণের কুশীলব (প্রথম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার কালো গোঁসাইয়ের চিঠি — চিঠিকেন্দ্রীক স্মৃতির পুনর্জীবন : মোঃ তুষার উদ্দিন নব নব রূপে : নন্দিনী অধিকারী সরস্বতীর বীণা কচ্ছপী ও গজকচ্ছপ বাঙালি বুদ্ধিজীবী : অসিত দাস মহাকুম্ভ উপলক্ষে এবার যে জনপ্লাবন দেখা যাচ্ছে, তা এককথায় অভূতপূর্ব : অসিত দাস মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি-র ছোটগল্প ‘আখের রস’ নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সরস্বতী দিদিমণি’ মহাকুম্ভ থেকে মহাদুর্ঘটনা দায় কার : তপন মল্লিক চৌধুরী কুমোরপাড়ার মৃৎশিল্পীরা খুঁজছে মাটির নিরাপত্তা : রিঙ্কি সামন্ত জিবিএস নিয়ে উদ্বেগের কোনও কারণ নেই, মত চিকিৎসকদের : মোহন গঙ্গোপাধ্যায়
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বসন্ত পঞ্চমী ও সরস্বতী পুজোর  আন্তরিক শুভেচ্ছা শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

মহাকুম্ভ ও কয়েকটি প্রশ্ন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী

মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী / ৬৭ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

অভয় সিং। আইআইটি বাবা। এখন সকলের চেনা মুখ, পরিচিতি অভয়ের ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত কি কি ঘটনা, কিরকম খাদ্যাভ্যাস সবকিছুর সঙ্গে। প্রথমে বাবার মুখে শোনা গেল ত্যাগের কথা। তারপর শোনা গেল তাঁকে তাঁর আখড়া থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে কারণ তাঁর জনপ্রিয়তা দেখে নাকি আখড়ার মুখ্য যিনি, তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আইআইটি বাবার মতে আখড়ার সন্ন্যাসীর হিংসা হয়েছে অভয়ের জনপ্রিয়তা দেখে। তারপর অস্বীকার করলেন গুরুকে। বললেন, “ধুর! কে আমার গুরু?” হাসির কথা এবং একই সঙ্গে দুঃখের কথা এটাই যে, যে ছেলেটি মোটা মাইনে, সাংসারিক সুখ দুঃখ হেলায় ত্যাগ করল, কিন্তু তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা পেয়ে তার মাথাটি গেল ঘুরে। তার মানে কুম্ভে স্নান করেও জনপ্রিয়তার আসক্তি যাবার নয়। তবে কেন যাব? প্রায় প্রতিটি ধর্মীয় মেলায় পদপিষ্ট হবার ঘটনা যেখানে হামেশাই ঘটে চলেছে সেখানে যাবার কিসের এত আকুতি? এত মানুষ মারা যাবার পরেও কিসের আকর্ষণে কিসের লোভে মানুষ আবার সেখানে যেতে চান? আসুন এই উত্তরের খোঁজ করা যাক।

১৪৪ বছর পর একবার এই মহাকুম্ভ দেখার সুযোগ এক জন্মে তো দূর, দু-জন্মেও সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। আর যা অসম্ভব তাই পাবার জন্য মানুষের চরম আকুতি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আর্থিক লাভের আশা। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সঙ্গমস্থল উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে যে মানুষের ঢল নেমেছে, তা থেকে সরকারের দু-লক্ষ কোটি টাকার লেনদেনের সম্ভাবনার কথা জানা গেছে। একটা হিসেব বলছে কুম্ভতে আসা প্রতিটি ভক্ত যদি গড়ে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করেন তাহলে ব্যবসা হবে দু-লক্ষ কোটি টাকার। যেক্ষেত্রে ওই পাঁচ হাজার টাকা দশ হাজার হবে, সেক্ষেত্রে ব্যবসা একলাফে দ্বিগুণ। উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের আশা, এই মহাকুম্ভে হাজির হবেন চল্লিশ কোটি মানুষ। শুধুমাত্র খাবার, জল, জুস, বিস্কুট বিক্রি করেই প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে। পূজার উপকরণ, তেল, বাতি, সঙ্গমের জল বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পাত্র এগুলোর বিক্রি কিরকম মাত্রায় হতে পারে সহজেই অনুমেয়। যাঁরা শুধু নিয়ে যাওয়া, থাকা খাওয়ার ভার নিচ্ছেন তাঁদের লাভের অঙ্কটাও নেহাত কম নয়। তাঁরা স্বপ্ন দেখছেন দশ হাজার কোটি টাকার ব্যবসার।

কুম্ভের শিক্ষা হল অবজ্ঞা না করা। সে খাদ্যসামগ্রী হোক বা প্রসাদী ফুলমালা। কুম্ভের সন্ন্যাসী বলেন, “সামনে খাদ্য পেলে অবজ্ঞা করতে নেই। খিদে পেলে সামনে যদি কেউ খাদ্যবস্তু এগিয়ে দেয়, তা অন্ন হোক বা শুখা রোটি, গ্রহণ করবে। কারণ ওটাই অন্নপূর্ণা মা তোমাকে যোগাচ্ছেন।” তাই মহাকুম্ভে ঘুরতে ঘুরতে যে ভান্ডারাতে প্রসাদ লাভ হচ্ছে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে নেই। আর এখানে কোনও জাত দেখতে নেই। যিনি খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন তিনি যে জাতেরই হন না কেন, ওই খাবার আসলে মা পার্বতীর হাতের অন্ন — এমনটাই মানা উচিত। এতে অন্নদাতা, যিনি অন্ন দান করছেন তাঁর যেমন পুণ্যলাভ হয় তেমনি যিনি অন্ন গ্রহণ করছেন তাঁরও একইরকম পুণ্যলাভ হয়। অর্থাৎ দাতা এবং গ্রহীতা দুজনেরই অশেষ পুণ্যলাভ হল। আবার জাতপাতের বিভেদও এখানে রইল না। এটাও কি কম হল?

আবার কেউ বা আসেন এমন বিশ্বাস নিয়ে যাতে তার যা অসুবিধা এই ইহজীবনে রয়েছে তার সবটাই এক শাহীস্নানে বিলীন হয়ে যাবে। কারোর মামলা ঘটিত সমস্যা, কারও বা বিবাহের পর শুধু কন্যা, একটি পুত্রলাভের আশায় কুম্ভস্নান। আবার কেউ তার খুব নিকট জনকে চিরকালের মত হারিয়ে কুম্ভে আসেন শান্তি পেতে এবং এটাও ভাবেন যে তিনি এসেছেন মানে তাঁর নিকটজনও কুম্ভে এসে পুণ্যলাভ করছেন। এতটাই বিশ্বাস নিয়ে সকলে মহাকুম্ভে আসেন। আবার কেউ আসেন কুম্ভে যে করে হোক কারো সেবা করার জন্য। তাতেই তার পুণ্যলাভ হবে এবং যে কাজ আটকে আছে সেটি অনায়াসে হবে। আবার সারাজীবনের ছোট বড় পাপ ধুয়ে সাফসুতরো হবার সেরা স্থান হল এই কুম্ভ। সমস্ত পাপ ধুয়ে ফেলা সম্ভব এই শাহীস্নানে। এটাই বিশ্বাস।

কেন এত বিশ্বাস মানুষের? এ বিশ্বাস তো একদিনে গড়ে ওঠে নি। এ বিশ্বাস চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। গল্পের মাধ্যমে যা আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর খোদিত হয়ে রয়েছে। দেবরাজ ইন্দ্র এবং রম্ভা এক সুন্দর জলাশয়ের ধারে অবস্থান করছেন। এমন সময় ঋষি দুর্বাসা শিষ্যদের নিয়ে যাচ্ছেন বৈকুণ্ঠ থেকে কৈলাসে শিব দর্শনে। ঋষির হাতে একটি পুষ্প, যেটি দিয়েছেন স্বয়ং বিষ্ণু। বিষ্ণু এই পারিজাত দেবার সময় বলেছেন, “এই ফুল আপনাকে দিলাম। যার কাছে এই ফুল থাকবে সে সবার প্রথমে পূজা পাবে। স্বয়ং লক্ষ্মী তাঁর কাছে অচলা হয়ে থাকবেন।” ঋষি দুর্বাসা সামনে ইন্দ্রকে দেখে খুশি হয়ে পুষ্পটি তাঁকে দান করলেন। ইন্দ্র তখন রম্ভাতে আচ্ছন্ন। তিনি ওই ফুল নিজের বাহন ঐরাবতের মাথায় রাখলেন। আর ঐরাবতের কি খেয়াল হল সে ওই ফুল মাথা থেকে ফেলে পা দিয়ে পিষতে লাগল। আর ঋষি ঠিক সময়ে পেছনে ফিরলেন। না ফিরলে কিচ্ছু হত না। এই কুম্ভ মহাকুম্ভ কিচ্ছু হত না। তাই ঋষিকে ঠিক সময়ে ফিরতে হল। আর দুর্বাসার রাগ সাংঘাতিক। তিনি ইন্দ্রকে লক্ষ্মীহীন হবার অভিশাপ দিলেন। ব্যস। লক্ষ্মী সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হলেন।

লক্ষ্মীহীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেম উবে গেল। শুরু হল হায় হায়। তবে একটা প্রশ্ন মনে আসে, দেবতাদের তো না ক্ষুধা জাগে, না কিছু কেনাকাটা করতে লাগে । তবে লক্ষ্মীছাড়া হতে বাধা কোথায়? কোথাও বাধা আছে বা ছিল নিশ্চয়। কারণ এই অভিশাপের সঙ্গে সঙ্গেই ইন্দ্র সহ যত দেবতা আছেন, সকলে শ্রীহীন ও বলহীন হয়ে পড়লেন। সকলে তখন বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। তিনি নিদান দিলেন সমুদ্রমন্থনে অমৃত উঠবে, সেই অমৃত পানে আসবে শ্রী এবং অমরত্ব। মুশকিল হল সমুদ্রমন্থনে দরকার পড়বে অসুরদের। অমৃত যদি অসুররাও পান করে তাহলে দেবতারা আরও বিপদে পড়তে পারেন। তবে আশার কথা অসুরদের কূটবুদ্ধি দেবতাদের থেকে সবসময়ই কম। তারা সরল সাদা। অসুররা রাজি হল অমৃতের অর্ধেক পাবে এই শর্তে। তারা তো জানে না যে কথা দিলেও কথা না রাখাতে দেবতারা কতটা পারদর্শী।

যাই হোক, এবার ক্ষীরসাগর মন্থন শুরু। মন্থনদন্ড হিসেবে আনা হল মন্দার পর্বতকে। বাসুকীনাগ স্বয়ং হলেন দড়ি বা রশি। এই ব্যাপারেও চালাকি করলেন দেবতারা। তাঁরা ধরলেন সাপের লেজের দিক, যেদিকে কোনও ভয় নেই। আর অসুররা ধরল নাগের মুখের দিকে। বিষ্ণু হলেন মন্থনদন্ডের ধারণকর্তা। শুরু হল সমুদ্রমন্থন। প্রথমে সমুদ্র থেকে উঠে এলেন চন্দ্র। চন্দ্রের জন্মের সময় ক্ষীর সমুদ্রে আনন্দের হিল্লোল উঠেছিল। চন্দ্র তাই প্রীত হয়ে ক্ষীরসমুদ্রে প্রবেশ করেছিলেন। সমুদ্রমন্থনে চন্দ্র এবার সমুদ্র থেকে উঠে এলেন। এরপর উঠলেন লক্ষ্মীদেবী। এঁরা গেলেন দেবলোকে। এবার উঠে এলেন সুরার দেবী বারুণীদেবী। এনাকে দেবতারা নিলেন না, নিল অসুররা। এরপর ঐরাবত হাতি, সুরভী গাভী, পুষ্পক রথ, পারিজাত বৃক্ষ, বিভিন্ন ওষধি গাছ, কৌস্তুভ মণি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যেটুকু ভাল তার বেশিরভাগই চলে গেছে দেবলোকে। অবশেষে পীতবসন পরিহিত আয়ুর্বেদাচার্য ধন্বন্তরি অমৃতকুম্ভ নিয়ে উঠে এলেন। আর সব শেষে উঠে এল গরল। মহাদেব সেই গরল পান করে নীলকণ্ঠ হলেন, পৃথিবী রক্ষা পেল।

অমৃতকুম্ভ ওঠার পরেই শুরু হল বঞ্চনার খেলা। ইন্দ্র পুত্র জয়ন্ত অসুরদের হাত থেকে অমৃত রক্ষা করার জন্য কলস নিয়ে পালালেন। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য অসুরদের বললেন জয়ন্তকে ধরে অমৃতকুম্ভ উদ্ধার করে আনতে। শুরু হল পরিক্রমা। বিশ্বব্রম্ভান্ড ঘুরে জয়ন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পৃথিবীর চারটি স্থানে কুম্ভটি নামিয়ে খানিক বিশ্রাম নিয়েছিলেন। প্রয়াগ, হরিদ্বার (গঙ্গা তীরে) উজ্জয়িনী (শিপ্রা তীরে) ও নাসিক (গোদাবরী তীরে)। জয়ন্তর এই কুম্ভ নিয়ে পরিক্রমার সময় সূর্যের উপর দায়িত্ব পড়ে অমৃত যাতে কোথাও না পড়ে সেটা দেখার। চন্দ্রের দায়িত্ব অমৃতকুম্ভে যেন কোনও ঢেউ না ওঠে সেটি দেখার। দেবগুরু বৃহস্পতি কুম্ভ অসুরদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব পেলেন। আর শনিদেব দেখবেন যাতে জয়ন্ত নিজেই না সব অমৃত খেয়ে ফেলেন। এই চারটি স্থানে কলস নামানো ও ওঠানোর সময় কয়েক ফোঁটা অমৃত পড়েছিল বলে এই চারটি স্থানেই বসে কুম্ভমেলা। এখানেও অসুরদের প্রতারণা করা হল। অসুররা জয়ন্তকে ধরে ফেলার পর বিষ্ণু এক পরমা সুন্দরীর রূপে উপস্থিত হতে অসুররা অমৃত ফেলে তাঁর দিকে ছুটল। সেই সুযোগে দেবতারা পান করে ফেললেন সমস্ত অমৃত। তাঁরা হলেন অমর।

ইন্দ্রপুত্র জয়ন্তর অমৃত কলস নিয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে স্বর্গে পৌঁছতে সময় লেগেছিল দেবতাদের হিসাবে বারো দিন। আবার অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবতা দানবের যুদ্ধ চলেছিল বারো দিন ধরে। দেবতাদের একদিন সমান পৃথিবীর এক বছর। বারো দিন মানে বারো বছর। এই জন্য মর্ত্যে বারো বছর অন্তর পূর্ণকুম্ভমেলা আয়োজিত হয়। বারো বছর অন্তর সূর্য, চন্দ্র, বৃহস্পতি ও শনি এক সরলরেখায় অবস্থান করে বলে এই অমৃতযোগ তৈরি হয়। কুম্ভমেলা পাঁচ প্রকার। মাঘী কুম্ভমেলা প্রতিবছর মাঘ মাসে প্রয়াগে অনুষ্ঠিত হয়। কুম্ভমেলা তিন বছর অন্তর প্রয়াগ, হরিদ্বার, নাসিক ও উজ্জয়িনীতে অনুষ্ঠিত হয়। অর্ধকুম্ভমেলা হয় ছ’বছর অন্তর হরিদ্বার ও প্রয়াগে। পূর্ণকুম্ভমেলা ওই চারটি স্থানেই বারো বছর অন্তর হয়। একমাত্র মহাকুম্ভমেলা ১৪৪ বছর অন্তর শুধুমাত্র প্রয়াগেই হয়। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধার্মিক মেলা। প্রয়াগে কুম্ভমেলার শুভ সূচনা করেছিলেন আদি শঙ্করাচার্য ৮৬৪ বছর আগে।

মানব শরীর মধ্যস্থ আত্মাকে ধারণ করে আছে পৃথিবী। পৃথিবী হল গর্ভ। এই গর্ভে রয়েছে অমৃতরূপ ‘কাল’। তাই যে কোন জলাধার অর্থাৎ নদী, সমুদ্র বা পুকুর এগুলি হল কুম্ভের প্রতীক। আর মানবদেহ হল সবচেয়ে বড় মিলনক্ষেত্র। মানব শরীরের মধ্যে রয়েছে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুন্মা। এই তিন নাড়ি হচ্ছে নদীরূপ। ইড়া হল গঙ্গা, পিঙ্গলা যমুনা, সুষুন্মা সরস্বতী। এই নাড়ি গুলি মিলিত হয়েছে আজ্ঞাচক্রে। একেই বলে ত্রিবেণী সঙ্গম। মাতা ত্রিবেণীকে সাক্ষাৎ দর্শন করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের পার্ষদ স্বামী বিজ্ঞানানন্দজী, এক বালিকার রূপে, এই প্রয়াগে।

এবারের মহাকুম্ভের শাহী স্নানের তারিখগুলি হল : —

১৩/০১/২০২৫ — পৌষ পূর্ণিমা — প্রথম শাহী স্নান।

১৪/০১/২০২৫ — মকর সংক্রান্ত — দ্বিতীয় শাহী স্নান।

২৯/০১/২০২৫  — মৌনী অমাবস্যা — তৃতীয় শাহী স্নান।

০৪/০২/২০২৫ — বসন্ত পঞ্চমী — চতুর্থ শাহী স্নান।

১২/০২/২০২৫ — মাঘী পূর্ণিমা — পঞ্চম শাহী স্নান।

২৬/০২/২০২৫ — মহাশিবরাত্রি — ষষ্ঠ বা শেষ শাহী স্নান।

মানুষের মনের মধ্যে চলে সর্বদা দেব ও দানবের যুদ্ধ। দেব আত্মিক বলের আর দানব পশুবলের প্রতীক। সাধনের ভিত্তি বিশ্বাসরূপী কচ্ছপের পৃষ্ঠদেশ। মন-রূপী সর্প হলেন বাসুকী নাগ। মন্থনরূপী সাধনার সময় যার নিঃশ্বাস অসুর প্রবৃত্তিকে হীনবীর্য করে দেয়। হৃদয় – রূপ সমুদ্র মন্থনে উঠে আসে অমৃত। সেই অমৃত আবার পশুরূপ দানব কেড়ে নিতে চায়। শুভ বুদ্ধির কাজ অমৃতকুম্ভ রক্ষা করা। সূর্যের কাজ দেখা যাতে অমৃত অপাত্রে না পড়ে। শনিদেব দেখেন যাতে এটি লোককল্যাণে দান করা হয়। কুম্ভমেলা আসলে আত্ম সমীক্ষার সুযোগ দেয়।

সন্ন্যাসীরা বলে থাকেন যে কুম্ভমেলায় মহাপুরুষগণ ছদ্মবেশে আসেন। হয়ত কোনও ভিখারি বা ঝাড়ুদার রূপে। সুতরাং কুম্ভমেলায় কোনও ভিখারি বা কুৎসিত দর্শন ব্যক্তিকে ঘৃণা বা অবহেলা করবেন না। সকলকে হাতজোড় করে প্রণাম জানালে আশীর্বাদ লাভ অবশ্যম্ভাবী। কুম্ভমেলা জাতপাত উঁচু নীচু কিছু বিচার করে না। কুম্ভমেলা চায় মানুষ। সাচ্চা মানুষ। প্রকৃত মানুষ। যারা শাহী স্নান করে নিজে কলুষমুক্ত হবেন এবং পৃথিবীকে পবিত্র করে তুলবেন। কুম্ভের অমৃত সার্থকতা সেখানেই। কিন্তু শাহী স্নান করে উঠেই পাড়ের গাছ থেকে ঝুপ্ করে পাপের বোঝা আবার ঘাড়ে চেপে বসে — একথা স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ বলে গেছেন। একথা বোঝার সময় কি এখনও আসেনি?


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন