শনিবার | ৩১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ভোর ৫:৪৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
কবির মৃত্যু : দিলীপ মজুমদার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের সপ্তসঙ্গিনী : স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক : সন্দীপন বিশ্বাস সিঁদুরে মেঘের গর্জন : অসিত দাস শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী — তৃপ্তি মিত্র : শৌনক দত্ত আমার প্রথম অভিনয় দেখে সত্যেন বসুই বলেছিলেন— তোর হবে : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রজিৎ আমাকে ক্লান্ত করে কেবলই ক্লান্ত : তপন মল্লিক চৌধুরী মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’ গ্রেস কটেজ বুলেটিন প্রকাশ : দীপাঞ্জন দে অথ ওয়াইন কথা : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসাবিভ্রাট : অসিত দাস বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম : আবু বকর সিদ্দিকি পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অনবদ্য সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি : মনোজিৎকুমার দাস কঠোর শাস্তি হতে চলেছে নেহা সিং রাঠোরের : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন : শান্তা দেবী বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা : ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সিন্ধু সভ্যতার ভূখণ্ড মেলুহা-র সঙ্গে বাণিজ্যে মাগান দেশ : অসিত দাস তদন্তমূলক সাংবাদিকতা — প্রধান বিচারপতির কাছে খোলা চিঠি : দিলীপ মজুমদার হেমন্তকুমার সরকার ও নজরুল-স্মৃতিধন্য মদনমোহন কুটির : ড. দীপাঞ্জন দে রামমোহন — পুবের সূর্য পশ্চিমে অস্তাচলে গেলেও শেষ জীবনে পিছু ছাড়েনি বিতর্ক : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় মাওবাদী দমন না আদিবাসীদের জমি জঙ্গল কর্পোরেট হস্তান্তর : তপন মল্লিক চৌধুরী জৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে শ্রী অপরা একাদশী মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত পর্যটন মানচিত্রে রামমোহনের জন্মভূমিতে উন্নয়ন না হওয়ায় জনমানসে ক্ষোভ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সংগীতে রবীন্দ্রনাথ : সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর গোয়ার সংস্কৃতিতে সুপারি ও কুলাগার কৃষিব্যবস্থা : অসিত দাস পুলওয়ামা থেকে পহেলগাঁও, চিয়ার লিডার এবং ফানুসের শব : দিলীপ মজুমদার ক্যের-সাংরী কথা : নন্দিনী অধিকারী সুপারি তথা গুবাক থেকেই এসেছে গোয়ার নাম : অসিত দাস রোনাল্ড রসের কাছে জব্দ ম্যালেরিয়া : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে, কমবে অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায়
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, মিয়ানমারে সুবর্ণ শব্দের নীরবতা (শেষ পর্ব) : সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম / ৪৬৬ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ৬ মার্চ, ২০২২

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ছবি দেখে কি বলতেন কে জানে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি হয়তো সহ্যই করতে পারতেন না। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের কিছুদিন আগে তিনি একবার দিল্লি গিয়েছিলেন। বোটে চড়ে শহরের কাছাকাছি যাওয়ার পর প্রথম তাঁর চোখে পড়েছিল অদ্ভুত এক দৃশ্য। পরে আত্মজীবনীতে লিখেছেনও তিনি। দৃশ্যটি এ রকম, একটি মাঠে প্রচুর জনতা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কাছেই ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন দিল্লির বাদশা। দিল্লিতে তখন গালিব, জাউক, দাগের মতো প্রবাদপ্রতিম উর্দু কবিদের নিয়ে আসর বসত দরবারে। বিদগ্ধজনেরা বাদশাহ জাফরের গজল ও কবিতা সংগ্রহ করে নাম দিয়েছেন ‘খুল্লিয়াত-ই-জাফর’। পৃথিবীর অনেক ভাষাতেই অনুবাদ হয়েছে এই সংকলন। সেদিন শুধু বাদশার ঘুড়ি ওড়ানোর নবাবিয়ানা নয়, তার কাব্যপ্রেমেও পড়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। জাফর নিজের পরিবর্তিত জীবন নিয়ে অন্যের কাছে আক্ষেপ করেননি, শব্দ দিয়ে গেঁথেছেন সেই যন্ত্রণা। শাহ জাফরের একটি কবিতাকে গজলে রূপ দিয়ে মেহেদি হাসান অনেকবার গেয়েছেন, ‘বাত কারনে মুঝে মুশকিল কাভি অ্যায়সে তো না থি….’ কথা বলা আমার জন্য কঠিন কিছু তো ছিল না কখনো, তোমার আসরটা এখন যেমন এমন তো ছিল না কখনো, কে আজ সবকিছু কেড়ে নিয়ে গেল। জীবনের প্রায় শেষ সময়ে লেখা এই কবিতায় বাদশা নিজেই নিজের আক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছেন। সেই ঘুড়ি ওড়ানো, গজলের মাহফিল বসানো, মুখে মুখে শের আওড়ে যাওয়া বাদশা করুণ পরিণতিতে জীবনের প্রায় শেষ সময়ে এসে পেছনের দিকে ফিরে তাঁকিয়েছেন, অবাক হয়ে দেখেছেন কেউ একজন কেড়ে নিয়ে গেছে তার সমস্ত অর্জন, এমনকি তাঁর নিজস্ব শব্দও।

আসলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮০৩ সালের পর থেকে মোগল বাদশাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা খর্ব করতে করতে প্রায় বামনের পর্যায়ে নিয়ে আসায় যন্ত্রণা ভুলে থাকতে বাহাদুর শাহ আশ্রয় নিয়েছিলেন গজল, শায়রি আর মুশায়রার। সেই মানুষই লেখার জন্য একটি কাগজও পাননি শেষ কয়েক বছরে। দেশ জয়ের পরও ব্রিটিশদের বাড়াবাড়ি সতর্কতা ছিল যাতে কোনো তথ্য ওই অন্ধ কুঠুরি থেকে না প্রকাশ পায়। এক ধরনের কয়লা দেওয়া হতো দাঁত মাজার জন্য। সম্রাট তাই দিয়ে দেয়ালে কিছু কিছু যদিওবা লিখতেন, সাথে সাথে তা আবার সেনারা এসে সাদা রং করে মুছে ফেলত। শেষ দিকে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে নিজের শরীরটাও নাড়াতে পারতেন না বাদশাহ শাহ জাফর। এই সাদা-কালো ছবিটা সেই সময়ে তোলা। কী নির্মল আর নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। হয়তো কিছুই দেখছেন না অথবা একদৃষ্টিতে দেখছেন সবকিছু। এমন সময় লিখেছিলেন, ‘আমি সেই বসন্তের স্মৃতি / যার বিধ্বস্ত অবয়ব শীতের কবলে/ বাগানের অবস্থা কখনো নির্দয় হয় / কবেকার গোলাপ এখন কেবলই কণ্টক শুধু।’

ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। বাহাদুর শাহ জাফরের এই দৃষ্টিতে আছেন সম্রাট শাহজাহানের বড় ছেলে শাহজাদা দারাশুকো। শাহ জাফরের জন্মের দেড়শ বছর আগে তিনি জন্মেছিলেন মোগল বংশে। তিনিও এমনই ছিলেন যাঁর কাছে সিংহাসনের চেয়ে অধিক প্রিয় ছিল কবিতা ও মানুষ নিয়ে ভাবা। অন্তত শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শাহজাদা দারাশুকো’ বইতে তেমনই বর্ণনা পাওয়া যায়। বাবরের স্বভাবকবিত্ব আর আকবরের সাহিত্যপ্রেম নিয়ে মোগল বংশে দুজনই এসেছিলেন, দারাশুকো আর বাহাদুর শাহ জাফর। জাফর হয়তো তাঁর এই পূর্বসূরিকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন অধিক, তাই নিজের প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘মির্জা দারা বখত মিরান শাহ’। দুজনই সিংহাসন রক্ষার চেয়ে বেশি ঝুঁকেছিলেন আধ্যাত্মিকতা আর সাহিত্যচর্চার দিকে। যার পরিণাম ছিল নিজ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রেই দারার প্রাণ হারানো। আর বাহাদুরের মৃত্যু ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম পরিহাস। তবে এমন আরো ঘটনা আছে যা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। শাহ জাফরকে যেমন ভারত থেকে মিয়ানমারে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল তেমনি মিয়ানমারের রাজা ‘থিবা মিন’কে পরিবারসহ নির্বাসনে আনা হয়েছিল ভারতের রত্নাগিরিতে। থিবাও পেনশন পেতেন নির্বাসনের সময়, শাহ জাফরও। যে ইংরেজরা ব্যবসার অনুমতির জন্য তাঁরই পূর্বপুরুষের দরবারে মাথা নুয়ে অনুমতি চেয়েছে সেই তারাই নির্বাসনে পাঠিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছে জাফরকে। মৃত্যুর অনেক আগেই বারবার মৃত্যুর স্বাদ পেয়েছেন তিনি। তাঁর পঞ্চম বংশধর উমাহানী বেগম আনন্দ বাজার পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাত্কারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, সত্যি তাঁর মরদেহ রেঙ্গুনে আছে নাকি ব্রিটেনে নিয়ে মমি করে রাখা হয়েছে? তবে আবেগজনিত কারণ ছাড়া এর পেছনে যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এমন হলে দাফনের পর ৩০ বছর পর্যন্ত এই এলাকা সংরক্ষিত করে রাখত না ইংরেজরা। সে সময় ফাতেহা পাঠের জন্য কাউকে প্রবেশের অনুমতি পর্যন্ত দেয়া হয়নি।

 

আসলে ইংরেজরা ভারতবাসীর আবেগের জায়গাটা ভালোই চিনেছিলেন বলে এই সতর্কতা। নির্বাসনের পর যখন শরীরের চূড়ান্ত অবনতি হয়, বাদশা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর আয়ু ফুরিয়েছে। শেষবারের মতো রেঙ্গুন থেকে পত্র লিখে অনুমতি চেয়েছিলেন, যেন তাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়। দিল্লির মাটিতে ঘুমাতে না পারলে তার মৃত্যুতেও শান্তি নেই। কিন্তু ব্রিটিশ সেনাপতি হডসন বলেছিল, জীবিত কম জোরি বাদশাহর চেয়ে মৃত শাহ জাফরের ক্ষমতা অনেক বেশি হবে। এ অঞ্চলের মানুষ মৃতের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। অতএব তার সমাধি দিল্লিতে থাকলে সেখান থেকেই শুরু হতে পারে নতুন বিদ্রোহ। ১৮৬২ সালের ৭ জুন মৃত্যুর পর অত্যন্ত গোপনে দাফন সম্পন্ন করে ঘাস দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ১৯০৩ সালে ভারত থেকে একদল প্রতিনিধি রেঙ্গুনে এসে প্রথম দাবি করেন, তাঁর সমাধি পুনঃস্থাপনের। জিনাত মহলের মৃত্যুর পর জামশেদ বখত ১৯২১ সাল পর্যন্ত এবং জামানী রওনাক ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সমাধি দেখাশোনা করেন। ১৯২৫ সালে পুরো সমাধি এলাকার দাবি করে বসেন মিসেস ডাওসন নামে এক ব্রিটিশ মহিলা। রেঙ্গুন হাইকোর্টে মামলা ওঠে। ১৯৩৫ সালে এ জায়গা মুসলিম সম্প্রদায়কে অর্পণের জন্য স্থানীয় বিশিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিরা জমায়েত হন। তাঁদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কোর্ট মামলা খারিজ করে একটি নতুন লিজ এগ্রিমেন্টে ওয়াকফ কমিটিকে জায়গাটি প্রদান করে। অদ্ভুত বিষয় হলো, মৃত্যুর প্রায় ১৩০ বছর পর আবিষ্কৃত হয় শাহ জাফরের আসল সমাধি। ১৯৯০ সালে পানির লাইন খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া যায় বাদশার কবর।

জিনাত মহলের সমাধির সামনে প্রার্থনারত সেই নারীকে এবার জিজ্ঞেস করলাম, মূল ভবনে সম্রাটের কবর নেই? তিনি খানিকটা বার্মিজ ভাষা আর কিছুটা হিন্দি মিশিয়ে যা বললেন তার অর্থ, সমাধিতে এসে অস্থির হয়ো না। আছে, সেটা অনেকটা ভূতলে। আমি সত্যি অস্থির ছিলাম তাঁর কবরটি দেখতে। ভবনের সেই প্রশস্ত ফাঁকা জায়গা থেকে ডান দিকে এগিয়ে ঝুঁকলে দেখা যায় তাঁর সমাধি অনেকটা ভূতলে। সরাসরি যাওয়ার পথ নেই। চত্বর দিয়ে বেরিয়ে আবার নিচে নামতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম, ভারত ও পাকিস্তানের যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তি এখানে এসেছেন তাঁদের ছবি। এর মধ্যে এপিজে আবুল কালাম, রাজীব গান্ধী ও বেনজির ভুট্টোর ছবি আছে, বার্মিজ ভাষায় প্রকাশিত পেপার কাটিং যার অধিকাংশ পড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের কোনো কোনো নেতা এলেও তাঁদের কোনো ছবি নেই। ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে নিচের দিকে ভূতলে এখনো অনেকটা অন্ধকার, অনেকটা ঘনীভূত ছায়া জমে আছে। এগিয়ে গিয়ে আরো কিছুটা ডানের মোজাইকের দেয়ালের সাথে তাঁর কবরটা। তিন দিকের টাইলসের সাদা দেয়াল। মাঝখানে ঝাড়বাতি ঝুলছে। মূল কবর মাটির নিচে রেখে উপরে বাক্সমতো করা। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, কবরটা ঠিক সোজা নয়, খানিকটা কোনাকুনি করে কাটা। অন্তত ওপরে রাখা তিনটি কবরের সাথে তুলনা করলে একে আড়াআড়িমতো লাগে। মোজাইকের দেয়ালে বাদশার হাতে আঁকা ছবির স্ক্রিনপ্রিন্ট বসানো। দুপাশে কালো কালো হরফে উত্কীর্ণ সুরা ও তার নিজের লেখা এপিটাফ। সেই আক্ষেপ— ‘কত মন্দ ভাগ্য তোমার জাফর, নিজের দেশে কবরের জন্য দুগজ জমিও মিলল না অবশেষে।’ এই বোধহয় ছিল তাঁর শেষ লেখা। তবে এর প্রতি-উত্তরও আছে। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সফরে এসে লিখেছিলেন, হিন্দুস্তানে তুমি দুগজ মাটি পাওনি সত্য, তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই উঠেছিল আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম গৌরবের সাথে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

বর্তমান এই সমাধিটি তৈরি হয়েছে ১৯৯০ সালে কবর পাওয়ার পর ১৯৯১ সালে ভারতের সহায়তায়। প্রশস্ত, ভারি স্টিলের নঁকশাকাটা বন্ধনী দিয়ে ঘিরে রাখা সমাধি। মখমলের সবুজ গিলাফ তাজা গোলাপের পাপড়িতে ঢেকে আছে। উপর থেকে নেমে এসেছে দীর্ঘ ঝাড়বাতি। সেই বাতির আলোর চেয়ে করুণ অনুভূতির প্রলেপই বেশি। ভূতলে হওয়ায় এখানে ওপরকার মিলাদের শব্দ অস্পষ্ট হয়ে ভাসছে। ডান দিকের দেয়ালের পাশ দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়। জাফরের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অচেনা শহরের সন্ধ্যা নামল চোখের সামনে। কে যেন বলল, ‘জীবন আজ অতিক্রান্ত, সন্ধ্যা নেমেছে জীবনে, আমাকে ঘুমাতে হবে, সমাধির দিকে প্রসারিত আমার পা।’ কত দিন আগে ভেবেছিলেন জাফর এভাবে….তাও তো প্রায় দেড়শ বছর আগের গল্প। বাইরে অন্ধকার যত জমছে ভেতরে বাড়ছে ঝাড়বাতির দ্যুতি। আমরা বেরিয়ে এলাম নিঃশব্দে। সন্ধের মুখে অন্য একটা দল তখন নতুন করে কিয়াম করছে…ইয়া জালাল, ইয়া জাফর সালাম আলাইকা…সন্ধ্যা নামছে ইয়াঙ্গুনে।

মৌনতা নিয়ে ফিরে আসার পথে সহযাত্রী আচমকা চমকে দিয়ে বলল, আপা, দুটো লাইন শুনবেন?…দীর্ঘ জীবন চেয়ে পেয়েছি চার দিন সময়, দুদিন কেটে গেল আকাঙ্ক্ষায় আর দু দিন অপেক্ষায়। জাফর বলেছিলেন।

খান-ড্য-জি লেক পেরিয়ে হোটেলে ফেরার পথে সেদিন অন্ধকারের পথে আমরা আর কেউ কোনো শব্দ করিনি।

সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ঈদ সংখ্যা, বৃহস্পতিবার ১৬ জুলাই ২০১৫, ১ শ্রাবণ ১৪২২, ২৮ রমজান ১৪৩৬


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন