শনিবার | ৩১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সকাল ৬:০৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
কবির মৃত্যু : দিলীপ মজুমদার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের সপ্তসঙ্গিনী : স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক : সন্দীপন বিশ্বাস সিঁদুরে মেঘের গর্জন : অসিত দাস শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী — তৃপ্তি মিত্র : শৌনক দত্ত আমার প্রথম অভিনয় দেখে সত্যেন বসুই বলেছিলেন— তোর হবে : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রজিৎ আমাকে ক্লান্ত করে কেবলই ক্লান্ত : তপন মল্লিক চৌধুরী মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’ গ্রেস কটেজ বুলেটিন প্রকাশ : দীপাঞ্জন দে অথ ওয়াইন কথা : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসাবিভ্রাট : অসিত দাস বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম : আবু বকর সিদ্দিকি পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অনবদ্য সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি : মনোজিৎকুমার দাস কঠোর শাস্তি হতে চলেছে নেহা সিং রাঠোরের : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন : শান্তা দেবী বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা : ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সিন্ধু সভ্যতার ভূখণ্ড মেলুহা-র সঙ্গে বাণিজ্যে মাগান দেশ : অসিত দাস তদন্তমূলক সাংবাদিকতা — প্রধান বিচারপতির কাছে খোলা চিঠি : দিলীপ মজুমদার হেমন্তকুমার সরকার ও নজরুল-স্মৃতিধন্য মদনমোহন কুটির : ড. দীপাঞ্জন দে রামমোহন — পুবের সূর্য পশ্চিমে অস্তাচলে গেলেও শেষ জীবনে পিছু ছাড়েনি বিতর্ক : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় মাওবাদী দমন না আদিবাসীদের জমি জঙ্গল কর্পোরেট হস্তান্তর : তপন মল্লিক চৌধুরী জৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে শ্রী অপরা একাদশী মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত পর্যটন মানচিত্রে রামমোহনের জন্মভূমিতে উন্নয়ন না হওয়ায় জনমানসে ক্ষোভ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সংগীতে রবীন্দ্রনাথ : সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর গোয়ার সংস্কৃতিতে সুপারি ও কুলাগার কৃষিব্যবস্থা : অসিত দাস পুলওয়ামা থেকে পহেলগাঁও, চিয়ার লিডার এবং ফানুসের শব : দিলীপ মজুমদার ক্যের-সাংরী কথা : নন্দিনী অধিকারী সুপারি তথা গুবাক থেকেই এসেছে গোয়ার নাম : অসিত দাস রোনাল্ড রসের কাছে জব্দ ম্যালেরিয়া : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে, কমবে অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায়
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, মিয়ানমারে সুবর্ণ শব্দের নীরবতা (প্রথম পর্ব) : সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম / ৩৪৮ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ৫ মার্চ, ২০২২

চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলে বলতাম, বুয়েটের রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছি, সামনেই পলাশীর মোড়। ব্রিটিশ কাঠামোর কলোনি ধাঁচের লাল লাল বাড়ি, গাছ-পাতায় ভর্তি ছায়া জমানো পথ। টুকটাক মনোহারির দোকান ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। গেরুয়া রঙের পুরনো দেয়ালের গা ঘেঁষে এমন এক চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছি, যত দূর চোখ যায়, ঝিম ধরা রোদ ছাড়া কিছু নেই। সমান বিরতিতে যে পাখি ধারেকাছে ডাকছে তার নাম জানি না। শুধু ওই ব্যবধানের ফাঁক গলে বারবার ছুটে আসা বাতাসটা মানুষের দীর্ঘশ্বাসের মতো। যেখানে এসেছি সেখানে অবশ্য দীর্ঘশ্বাসই শোনার কথা। এতক্ষণের মুখরা সহযাত্রীও দেখলাম বিরস বদনে একবার গাছের পাতা খুটছে, বার্মিজ ভাষা পড়ার মতো অসম্ভব এক চেষ্টায় ব্যস্ত করে রেখেছে নিজেকে। আরো দুজন এসেছেন আমাদের সাথে। সকাল থেকে তারা ধূমপান করতে পারেননি বলে সময় নিয়েছেন। ফিরলে একসাথে যাব। এখানে কোনো গেটপাস লাগে না এবং যে কেউই আসতে পারে। শুধু উচ্চস্বরে শব্দ করা যাবে না। অবশ্য পরিবেশটা এমন, মানুষ আপনাতেই শান্ত হয়ে যায়।

সুফিই বলব তাকে, স্থানীয় মানুষ অমন করেই চেনে। এখানে শুয়ে আছেন সুফি আবুল মুজাফফর সিরাজুদ্দীন বাহাদুর শাহ গাজি। অন্য পরিচয়, শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর যিনি মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দীন মুহাম্মদ বাবরের ২০তম বংশধর।

এসেছি ইয়াঙ্গুনের উইসারা রোডের জিওকা স্ট্রিটে। বিখ্যাত সেই স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত শ্যোডেগং প্যাগোডার দক্ষিণে মাইল তিনেক দূরত্ব। এই ‘উইসারা’ রোডের নামকরণের পেছনে আরো একটা করুণ ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে নাম ছিল ‘থিয়েটার রোড’। সে সময় ‘উইসারা’ নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করায় তাকে কারান্তরীণ করা হয়। সেই উইসারা ১৬৬ দিন অনশনের পর মারা যান। তাঁকে সম্মান জানাতেই পরবর্তীতে বার্মিজরা এ সড়কের নামকরণ করে। উইসারার মতো মানুষের ছায়া তার অবয়বের চেয়ে প্রশস্ত, দীর্ঘ হয়। শারীরিকভাবে ফুরিয়ে যাবার পরও শত শত যুগ ধরে ভাষান্তর হতে থাকে সেই মানুষের ভাবনা। উইসারা রোডে যে শুয়ে আছেন তিনি আরো একজন তেমনই, যার ছায়া তার অবয়বের চেয়ে ছিল কালোত্তীর্ণ। যিনি পরাজিত হয়েও বিজয়ী, যার জয়-পরাজয়ের পদকারেণু নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অন্তর্গত গূঢ় অনুভূতির অনুভব হূত্কমলে জয়ী হয়ে আছে নিশ্চিত। তাঁর তরবারি ছলকে না উঠলেও আধ্যাত্মিকতার জ্ঞানচর্চা, সাহিত্যানুরাগ শত বছর পরও দ্যুতি ছড়ায়। শাহ জাফর অন্তর্গত রহস্য খুঁজে ফেরা মানুষ। সবাই সাদা চোখে যা দেখত তিনি সেখানেই দেখতেন রঙের ব্যঞ্জনা। সুফিরা তাই করেন, সৃষ্টির ভেতর স্রষ্টাকে খোঁজেন, তবে সেই ‘সৃষ্টি’ শুরু হয় নিজের কলব বা আত্মা থেকে। জাফরও প্রায়ই নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করাতেন তেমন করে। নিজেই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জাফর এই রহস্যের ভেদ কি/ আসছে না আমার বুঝে, যে আছে ভেতরে/ সবাই মরছে তাকে বাইরে খুঁজে খুঁজে।’

আপাতদৃষ্টিতে ইতিহাস বলছে, ক্ষমতার দিক থেকে তিনি পরাজিত, দুর্বল আর হেরে যাওয়ার দলে, আসলেই কি বাহাদুর শাহ জাফর তাই! জাফর আসলে আবুল হাসানের কবিতার মতো হিরণদাহ, বিজন ব্যথা। যিনি সংসারী না হয়ে সন্ন্যাসী হওয়ার মতো তীব্র অভিমান পুষে রাখতেন।

ভারতীয় কেতার গেরুয়া সমাধি ভবনটির সামনে শানবাঁধানো উঠোন। প্রবেশের মুখে হাতের ডান দিকে অভ্যর্থনা কক্ষ। শুক্রবার জুমআর নামাজের আগে-পরে ঘরটির তালা খোলা হয়। বাঁয়ে খোলা ঘরের উপরে ছাউনি, মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা। মাহফিল বা আসর হলে রাতে আগরবাতি জ্বালিয়ে সুফি গান, জিকিরের ধ্বনি ওঠে। এখানে দেওয়ান-ই-আমের লাবণ্য, রাজপুতানার পাহাড়ের চূড়ার রূপকথার সব দুর্গ, অন্দরমহলে জাফরি কাটা আলো-ছায়ার নকঁশা বা কল্কি আঁকা দেয়ালের ভেতর শ্বেতপাথরের ম্লান ঘরের মতো কিছুই নেই। ললিত ভৈরবের মতো কোনো সুরও ভেসে বেড়ায় না বাতাসে। জৌলুস নেই গজল, শের-শায়েরির মজলিসের, তবু কিছু একটা আছে যা সেই সব শ্রুতিকেই স্মরণ করায়।

দরগায় একটা দানবাক্স দেখলাম। তদারকির জন্য মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেয়া হয় না। বাঁ দিকে এগিয়ে দীর্ঘ প্রশস্ত ধবল শীতল মেঝে পড়ে আছে গা ছেড়ে দিয়ে। অন্তত শ দুই মানুষ একসাথে বসতে পারে চাইলে। ৯টি ধাপের সিঁড়ি পেরিয়ে মূল ভবনে উঠতেই একটা মিষ্টি ঘ্রাণ মনে হলো সারা শরীরে জড়িয়ে ধরল। ভবনের বাঁ দিকের ঘরটা থেকে আসছে ঘ্রাণ। একপাশে মিম্বর দেখে বোঝা যায় নামাজ পড়া হয়। নারী-পুরুষের প্রার্থনার ভিন্ন ভিন্ন স্থান রয়েছে। সেখানে একটা বড় স্টিলের থালায় মিষ্টান্ন আর ফুল সাজানোর ধরন দেখে বিস্মিত হয়েছি। একজন মুসলিম বাদশাহর সমাধি, সুফির দরগায় অনেকটা পূজার নৈবেদ্যের মতো আয়োজন। একটা গুনগুন শব্দ আসছে বড় ঘরটার ভেতর থেকে। এগিয়ে গেলাম। দরজার ওপরে লাল প্লাস্টিকের নেম প্লেটে সাদা অক্ষরে লেখা ‘রেড ফোর্ট’। দিল্লির লাল দরগার মতো এখানে কখনো ফরমান জারি হয়নি, হুকুমনামা পেশ হয়নি, এমনকি নতুন রাজ্য দখলের পরিকল্পনা বা বিজয়ের উত্সব কিছুই ঘটেনি কোনো দিন, তবু এর নাম রেড ফোর্ট। দ্বিতীয় আকবর শাহ আর সম্রাজ্ঞী লাল বাঈয়ের দ্বিতীয় পুত্র বাহাদুর শাহ জাফরকে তাঁর শৌর্যবীর্যের কথা বলে স্মরণ করে না কেউ এখানে। আতরের নির্যাস নিয়ে রঙমহলে জেগে ওঠেনি কোনো তরুণী বেগম। এ লাল কেল্লার ইতিহাস শুধুই বিয়োগান্তক। তাই ‘লাল কেল্লা’ লেখাটা কেমন করুণ প্রহসনের মতো দেখাল দরজার ওপর। বাহাদুর শাহ জাফর শেষ সময়ে শুধু নিজের মাটিতে মৃত্যুর অনুমতি চেয়েছিলেন, তাও পাননি বলে যেখানে তার সমাধি হয়েছে সে জায়গাকেই লাল দুর্গ নামে ডাকছে ভক্তরা। বাদশাহ নির্বাসনের সময় দিল্লির দুমুঠো মাটি নিয়ে এসেছিলেন সাথে। কয়েক বছরের নির্বাসনের জীবনে সেই মাটি যত্ন করে তুলে রাখতেন নিজের কাছে। মৃত্যুর পর শরীরের ওপর সেই মাটি ছড়িয়ে দিয়ে বাকিটুকু আবৃত করা হয়েছিল রেঙ্গুনের মাটি দিয়ে। যে শব্দ শুনে এগিয়ে এসেছিলাম তা এই ঘরের ভেতর থেকে আসছে। মিলাদ পড়া হচ্ছে দাঁড়িয়ে। তবে এর কিয়ামের ভাষা ঠিক আমাদের অঞ্চলে প্রচলিত রকমের নয়। মোগল বাদশাহদের দরবারে যেমন মুশায়েরার আসর বসত, অনেকটা সে রকম। নবীর নাম থেকে শুরু করে এই কিয়ামের মধ্যে সুফি জালালুদ্দিন রুমির নামও ডাকা হচ্ছে, শেষ হচ্ছে এসে হযরত সিরাজুদ্দিন বাহাদুর শাহ জাফরের নামে এসে। যারা প্রার্থনা করছেন তাঁরা কেউ মোগল বাদশাহর খোঁজ রাখেন না। তাঁরা এসেছেন একজন সুফি সাধকের জন্য প্রার্থনা করতে। এখানকার মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, জাফর পুণ্যাত্মার। তাই তাঁর দরগায় এসে কিছু চাইলে পাওয়া যাবে। করুণ কান্নার মতো একটা সুর তাদের এই কিয়াম থেকেই উত্সারিত হচ্ছে। নিজের অজান্তে আমিও কখন সেই সুরের সাথে বলতে শুরু করেছি…ইয়া রুমি, মুলক-ই-বাদশা, ইয়া জালাল বাদশাহ সুবহানি…। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচ-ছয়জন পুরুষ মিলাদ পড়ছেন। তাদের মাঝখানে মেঝেতে রাখা থালায় লাড্ডুর মতো হলদে রঙের মিষ্টি, গাদা ফুল। ওড়নার প্রচলন নেই এ অঞ্চলে। মহিলারাও ব্লাউজের সাথে কাপড় পেঁচিয়ে লুঙ্গির মতো করে পরে। ঘরের এক কোনায় দাঁড়ানো বৃদ্ধা মাথায় রুমাল দিয়ে সেই সুরের সাথে সাথে আওড়ে যাচ্ছেন। এখানে শুক্রবার জুমআর সময় সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। সেদিন দুপুরে সবাইকে শিন্নি খাওয়ানো হয় দরগার পক্ষ থেকে। আমরা এসেছি শনিবার বিকেলে, মানুষ কম, তাই নীরবতা বেশি।

ছবি তুলব কি না দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। প্রথমত কবরস্থান, তার ওপর আবার ইয়াঙ্গুনের মতো জায়গা। এ অঞ্চলের মানুষগুলো বেশি সংবেদনশীল। সেই বৃদ্ধার কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ছবি তোলা যাবে? ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে তিনি বাংলা বা ইংরেজি না বুঝলেও হিন্দি বুঝেছেন। তিনি জানালেন, শব্দ না করে ছবি তুলো, কিন্তু প্রার্থনায় বিঘ্ন ঘটিয়ো না। ছবি তোলার পর তিনিই আমাকে সবুজ গিলাফে ঢাকা পাশাপাশি তিনটি কবরের বর্ণনা দিলেন। প্রথমটি জিনাত মহলের, এরপর বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্র মির্জা জওয়ান বখত ও অন্যটি প্রিন্সেস রওনাক জাহানের। এত তাজা বেলি ফুল কোথা থেকে এল কে জানে। রীতিমতো বিয়ের আয়োজনের সমান ফুল। তিনটি কবরের গিলাফ প্রায় ঢেকে আছে ফুলে। গোলাপ জল ছিটানো হয়েছে ঘরে। এ ঘ্রাণই মৌতাত করে রেখেছে পুরো ভবনে। কাঠের দেয়ালে একটি ছবি দেখে কেমন মনে হলো, মোগল দরবারেই দাঁড়িয়ে আছি। বেগুনি মখমলের কাপড়ে সোনার সুতোর হাতে কাজ। সেই সোনালি সুতোয় ফার্সিতে লেখা বাহাদুর শাহ জাফরের সাথে জিনাত মহলের কাবিননামা। পাশে আরো কয়েকটি সাদা-কালো ছবি। একটিতে দেখা যাচ্ছে, বাহাদুর শাহ তাঁর শিষ্যদের আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিচ্ছেন, আরেকটি তাঁকে কোর্টে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, অন্য ছবিতে তাঁর দুই পুত্র ও এক ইংরেজ অফিসার দাঁড়িয়ে। বাহাদুর শাহ মাঝখানে বসে আছেন চেয়ারে। জিনাত মহলের তরুণী বয়সের ছবিটা সম্ভবত তাঁকে নিয়ে আঁকা প্রথম ছবি। জিনাত মহলের আরো একটি ছবি আছে শেষ বয়সের, এটা ফটোগ্রাফ। মুখে অসংখ্য বলিরেখা জানান দিচ্ছে, ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই ছিলেন তিনি। এই ছবিতে জিনাত মহলের হাতে কাচের চুড়ি, ঘোমটার আবরণ সরে কপালের চুলে দীর্ঘ জীবনের ছাপ। পেছনে একটা কুশন দেখা যাচ্ছে। স্থির চোখের ভাষা পড়া যায় না, শীর্ণ হাতের বাহু, একপাশে পানের বাটার সরঞ্জাম। এটাই তাঁর শেষ ছবি।

জিনাত মহল দীর্ঘদিন রোগেশোকে একাকিত্বে ভুগে মারা গিয়েছিলেন ১৮৮৬ সালে। শেষ দিকে একাকিত্ব কাটাতে আফিমে আসক্ত হয়েছেন। জিনাত মহলকে নিয়ে নির্বাসনের সময়ের একটি গল্প আছে। ব্রিটিশরা যখন বাহাদুর শাহ জাফরকে দিল্লিতে কারাগারের মতো এক কুঠুরিতে আটকে রেখেছে তখন বিচারের নামে প্রহসন চলছে। ইংরেজরা তাঁকে সম্রাট বলেই মানত না, তাই ভারত নিয়ে ব্রিটেনে তখন যেসব দিস্তা দিস্তা প্রতিবেদন পাঠানো হতো তার মধ্যে কখনো বড়জোড় একটি প্যারা, কখনো একটি বাক্যে শেষ করা হতো শাহ জাফর প্রসঙ্গ। সে সময়ের কথা খুব ভালো বর্ণনা করেছেন উইলিয়াম ড্যামরিম্পেল। তাঁর ‘দ্য লাস্ট মোগল’ শাহ জাফরকে নিয়ে তৈরি সবচেয়ে নিখুঁত ইতিহাস দলিল।

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পরপর ব্রিটিশ নারী-শিশু হত্যাকাণ্ডে মদদ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় বাদশাহর বিরুদ্ধে। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে হুমায়ূনের কবরে আত্মগোপন করেছিলেন পরিবার নিয়ে। সেখান থেকে ধরে আনা হয় শাহ জাফরকে। শেষ বিচার চলাকালে সবাই জানত হয় তাঁর মৃত্যুদণ্ড অথবা নির্বাসনে পাঠানো হবে। যে কুঠুরিতে আটক ছিলেন সেখানে ইংরেজ নারী-পুরুষরা দিনরাত লাইন ধরে তাঁদের দেখতে আসত। আর প্রতিবার তাদের সালাম জানাতেন মোগল বাদশা স্বয়ং। শাহজাদাদের রীতিমতো প্রতিবারই উঠে দাঁড়িয়ে বলতে হতো, আপনাদের দেখে আমরা আনন্দিত, তশরিফ রাখুন। কয়েকশ বছর ধরে ভারতবর্ষ কাঁপিয়ে বেড়ানো মোগল বাদশা ও শাহজাদাদের এহেন পরিস্থিতি নিজেরা বহুদূর এ অঞ্চলের শত্রুদের কল্পনাতেও স্থান পায়নি। এমনি নজরদারির জীবনযাপন করার সময় জিনাত মহল একদিন রাগেক্ষোভে ফেটে পড়ে বাদশাহর কাছে গিয়ে বললেন, যে জীবন যাপন করছি এর চেয়ে দিল্লির ভিখিরিও ভালোভাবে বেঁচে আছে। যে পাত্রে খেতে দেয়, রাস্তার পাশের ফকিরও তার চেয়ে ভালো পাত্রে খায়। এই কথা শুনে বাদশা তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, জিনাত মহল, ইংরেজদের কাছে গিয়ে মাফ চাইলে তারা এখুনি তোমাকে পেনশন বাড়িয়ে দিবে আর আয়েশি জীবনও পাবে, কিন্তু তাতে কোনো দিন আমার ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তি আসবে না। যদি এই সংকটকালে আয়েশি জীবন চাও, তোমাকে আমি মুক্তি দিতে পারি শুধু। কিন্তু আমার কাছে কিছু চেও না, আমাকে বরং দিল্লি নিয়ে ভাবতে দাও। এমনকি পরিধানের কাপড়ের চেয়ে আমি আমার মানুষের হতাশা নিয়ে ভাবলেও বেশি স্বস্তি বোধ করব। বাদশার কথা শুনে জিনাত মহল ‘গুস্তাকি মাফ কি জিয়ে সুবহানি’ বলে বলেছিলেন, আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আপনার পাশে থাকব। সুন্দরী এই নারী চাইলে শেষ মুহূর্তে অন্য জীবন হয়তো নিতে পারতেন কিন্তু তাঁকে নিয়ে রাজনৈতিক যত বিতর্কই থাকুক, শেষ পর্যন্ত তিনিই বাদশার সাথে ছিলেন (জিনাত মহল ইংরেজদের সাথে আঁতাত করছেন, সিপাহিদের এমন সন্দেহ ছিল)।

জিনাত মহলের ছবিটি দেখলে যৌবনে তাঁর রূপ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। বাদশাহর সাথে তার বয়সের ব্যবধানও কম ছিল না।

এই ঘরের আরেকটি ছবি বাহাদুর শাহর দুই ছেলে মির্জা জওয়ান বখত ও মির্জা শাহ আব্বাসের। টুপি মাথায় বাদশাহর দুই সন্তান পাশাপাশি চেয়ারে বসা। খুব কিশোর মুখ, সাদা-কালো ছবিতেও বোঝা যাচ্ছে সহোদরদের চোখের মণি ধূসর। প্রায় কাছাকাছি বয়সের এই দুই ভাইয়ের একজনের কবর এই সমাধি কমপ্লেক্সে। এই মির্জা জওয়ান বখতের বংশধরেরা এখনো কলকাতা শহরে বেঁচে আছেন এমন একটা খবর নব্বইয়ের দশকে পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর বেশ আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, তারপর আবার সেই যা তাই। হারিয়ে গিয়েছে। তবে মোগল বংশের শেষ বংশধরদের খোঁজ বের করেছিলেন আনন্দ বাজার পত্রিকার অগ্নি রায়। তিনি লিখেছেন, ‘যে কবার পুরুষশক্তির অগ্ন্যুত্পাত ঘটেছে পৃথিবীতে তার মধ্যে অন্যতম বিস্ময়কর দুই ব্যক্তির রক্ত বইছে যাদের উপেক্ষাহত ধমনীতে। মোঙ্গল চেঙ্গিস খান এবং তুর্কী বীরশ্রেষ্ঠ তৈমুর লঙের রক্ত। তবে, বাস্তব হল ৩৩২ বছর ধরে একের পর এক দোর্দণ্ড প্রতাপ সম্রাটের জন্ম দেওয়া ওই পরম্পরার চিহ্নিত শেষতম সলতেটি অধুনা বড় অবহেলায় জ্বলছে হায়দারাবাদের এক মলিন পাড়ায়। নিভু নিভু করেই।’

দুই শাহাজাদার পাশে একটা ক্যালিগ্রাফি বাঁধাই করা। বাহাদুর শাহের হাতের লেখা। এত নিখুঁত আর সমান মাপের অক্ষর যে দেখেই বোঝা যায় লেখাটা তাঁর কাছে এক শিল্পের চর্চাই ছিল। দেয়ালের ছবির সারির সবশেষটি বাহাদুর শাহের মৃত্যুর কদিন আগে তোলা। এটাই তার জীবনের শেষ ছবি। ইজিচেয়ারে সফেদ সাধারণ পাঞ্জাবি গায়ে আধশোয়া হয়ে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। শরীরের সবকিছু হাড়ের সাথে যেমন মিশে আছে তেমনি শেষ মোগল সম্রাটের দৃষ্টিতে মিশে গিয়েছে যাপিত জীবনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা নিঃশেষ হওয়ার বেদনা। তার অন্য ছবির সাথে এ ছবিটি মেলানো কঠিন। (আগামীকাল সমাপ্ত)


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন