বাঙালির দেবতারা কোনদিনই মন্দিরের সসম্ভ্রম দূরত্বে আবদ্ধ ছিলেন না। জীবনের প্রতিটি ক্ষণে তাঁদের অবাধ লীলাখেলা। তাই, হিন্দুদের প্রধান দেবতা হওয়া সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ কোথাও যেন ভক্তদের কাছে পিতা, ভাই, প্রেমিক, সখা, সন্তান কিংবা ঘরের আদরের জামাইটি হয়ে উঠেছেন। ভক্তগণ কৃষ্ণর সঙ্গে রাধার বিয়ে দিয়ে মাধবকে পুজো করেন জামাইরূপে। এমনই দুই রাজার জামাই হলেন পূর্ব বর্ধমানের কালনার লালজী বিগ্রহ আর নদীয়ার আড়ংঘাটার যুগল কিশোর বিগ্রহ। এই বিবাহতে জড়িয়ে আছে বর্ধমান রাজবংশ এবং নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র রাজবংশের নাম। এই লালজি কে শুধু বর্ধমানের রাজবাড়ির জামাই বলা হয় না তিনি সমগ্র কালনাবাসীর অতি আদরের জামাই। কারন?…বিচিত্র সেই লোককাহিনী আজকের লেখায়।
কালনার লালজী :
মন্দির শহর কালনা, বনেদিয়ানা ঐতিহ্যের এক মিলন স্থল কালনার এই লালজী মন্দির। এই মন্দিরের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে বর্ধমানের মহারাজাদের স্পন্দন। বর্ধমানে মহারাজারা জাতিতে ছিলেন হিন্দু পাঞ্জাবি। সপ্তদশ শতকে দ্বিতীয়ার্ধে এক পাঞ্জাবী বণিক ভাগ্যের নাগরদোলায় চেপে বর্ধমানের রাজা হয়ে বসলেন। এই বংশের কীর্তিচাঁদ রায়ের আমলে বর্ধমান সাম্রাজ্যে প্রভূত বিস্তার ঘটে। বর্ধমানে পাশাপাশি তার কাটোয়ার দাঁইহাট এবং কালনাতে নির্মাণ করলেন প্রসাদ,গঙ্গাবাস ভবন, সমাজবাড়ি, মন্দির। বর্গীহাঙ্গামা পর থেকে দাঁইহাটের তুলনায় কালনা ক্রমশ জমজমাট হতে থাকে।
কীর্তি চাঁদের বাবা ছিলেন জগৎরাম রায়। মায়ের নাম ব্রজকিশোরী দেবী। জনহিতৈষী কাজের জন্য প্রজাদের কাছ থেকে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন ব্রজ কিশোরী দেবী। জলকষ্ট নিবারণ করার জন্য তিনি বর্ধমানের রানীসায়র খনন করিয়েছিলেন। বৃন্দাবনের যমুনা নদীতে ইমলিঘাট বানিয়েছিলেন। মথুরাতে ও ঘাট তৈরি করেন। দাঁইহাটে তৈরি করেছেন ভাগীরথী নদীতে স্নান করার ঘাট। এটি বুড়োরানীর ঘাট নামে বিখ্যাত। শোনা যায় এই ঘাটের পাশের রাজবাড়িতে রানী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ফিরে আসি কালনায়। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে কালনায় ব্রজ কিশোরী দেবী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দক্ষিণমুখী লালজী মন্দির। পঁচিশরত্ন এবং পঁচিশচূড়া বিশিষ্ট এই মন্দির।চূড়াগুলির সজ্জা হচ্ছে ১২+৮+৪+১। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চরত্নের যে ছ’টি মন্দির আছে তার মধ্যে কালনাতেই রয়েছে তিনটি — কৃষ্ণ জিউ মন্দির, গোপাল জিউ মন্দির আর লালজী মন্দির। প্রায় ১৫ ফুট প্রাচীর দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণ ঘেরা। ৬৫ ফুট মন্দিরের সম্মুখে রয়েছে সুপ্রশস্থ নাট মন্দির। মন্দিরের সামনে, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে রয়েছে ত্রিখিলান অলিন্দ।
মন্দিরে বিভিন্ন ধরনের টেরাকোটার ফলক রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, মৃত্যুলতা হংসলতা প্যানেল আর কৃষ্ণ লীলার নানান আলেখ্য ও সামাজিক দৃশ্যাবলী। লালজি দারুবিগ্রহ প্রায় আড়াই ফুট উচ্চতায় বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণ, গায়ের রং নীলাভ পাশি রয়েছে রাধা মূর্তি এছাড়া বঙ্গবিহারী অন্যান্য প্রাচীন বিগ্রহ সহ প্রচুর শালগ্রাম শিলা লালজি কিভাবে ব্রজেশ্বরী দেবী লাভ করেছিলেন তা নিয়ে নানান কিংবদন্তি শোনা যায়। তার মধ্যে বর্ধমান রাজ বংশানুচরিতে লিখিত আছে এক কাহিনী।
রানী ছিলেন রাধার পরম ভক্ত তাই তার কাছে একটি রাধা বিগ্রহ সবসময় থাকতো। সময়টা ছিল পৌষ মাসের মাঝামাঝি, কাছেই গঙ্গাসাগর মেলা। জগন্নাথ ধাম যাবার সময় এক নাগা সন্ন্যাসী বিশ্রামের জন্য কালনার গঙ্গারতীরে তাঁর নিত্য আরাধ্য কৃষ্ণবিগ্রহ নিয়ে উপস্থিত হন। কালনাবাসী সেই শ্রী কৃষ্ণবিগ্রহের রূপ লাবণ্যে বিমোহিত হয়ে গেলো। দলে দলে তারা বিগ্রহ দেখতে আসেন সন্ন্যাসীর কাছে। কথায় কথায় সেই সংবাদটি পৌঁছল রানীর কানে।
রানীও সেই বিগ্রহ দেখার লোভে সাধুবাবার ছাউনির কাছে এলেন। ছাউনির বাইরে থেকে শুনতে পেলেন এক বাচ্চা ছেলের কণ্ঠস্বর। সে বায়না করছে নানান ধরনের খাবারের কিন্তু সাধু বাবা তাকে বলছেন তার কাছে পোড়া রুটি ছাড়া আর কিছুই নেই।
রানী চিন্তা করতে লাগলেন, গঙ্গাসাগর দুর্গম যাত্রা, তবে সাধুবাবার সঙ্গে বালক কেন? নানা প্রশ্ন মনে নিয়ে রানী গঙ্গা স্নান করে সাধু বাবার ছাউনিতে উপস্থিত হলেন।
ব্রজকিশোরী দেবী সন্ন্যাসীকে প্রশ্ন করলেন, ‘বাবা গঙ্গা স্নানে যাবার সময় যে বালকটির গলা শুনেছিলাম সে বালকটি কোথায়?’ সাধুবাবা বললেন তার সঙ্গে কোন বালক নেই। কেবল তার সঙ্গে তাঁর উপাস্য দেবতা শ্যামচাঁদ রয়েছেন। ব্রজকিশোরী দেবী তখন অপূর্ব সুন্দর বিগ্রহ দর্শন করলেন। দর্শন করে তিনি দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারলেন।
তখন সন্ন্যাসীকে বারংবার অনুরোধ করলেন বিগ্রহটি দেবার জন্য। তিনি বললেন, ‘আমায় দিন আমি বড় মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবো কালনাতে। আপনি সেখানেই বিগ্রহের সেবা করবেন’।
সন্ন্যাসী সেই এক কথা, এই ঠাকুর তিনি কাউকে দিতে পারবেন না। রানী পরিকল্পনা করতে লাগলেন কিভাবে এই বিগ্রহ লাভ করা যায়। সন্ন্যাসীকে তিনি বললেন, ‘আমার রাধার সঙ্গে আপনার কৃষ্ণের বিয়ে দিতে চাই’, সন্ন্যাসী অনিচ্ছা সত্ত্বেও একরকম রাজি হলেন। মহা ধুমধাম করে রানীর রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ে হলো।
এইভাবে কয়েকটা দিন কেটে গেল। শেষে সন্ন্যাসী জানালেন, এবার তিনি পুরীধামে রওনা দেবেন। অতএব কৃষ্ণটি ফেরত চাইলেন। রানী বললেন,’ সে কি আপনি জানেন না আমাদের রাজবংশের নিয়ম আছে। আমাদের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে যার বিয়ে হয় তাকে ঘরজামাই থাকতে হয়, আপনার কৃষ্ণবিগ্রহ এখন আমাদের লাল লালজী মানে জামাতা। জামাই এবার শ্বশুরবাড়িতেই থাকবেন।’
সন্ন্যাসী বুঝতে পারলেন রানীর চালাকি ও বিবাহের উদ্দেশ্য। তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। রানী বললেন, আপনি যখন খুশি আপনার পুত্রকে দেখতে আসবেন আপনার থাকা খাওয়া সব ব্যবস্থা সরকার করবে। কিন্তু তিনি তো সন্ন্যাসী, মোহ বিস্তার করতে চাইলেন না।
লালজীর কাছে গিয়ে অভিমান সুরে বললেন,’থাকো তুমি রাজসুখে। আগে তো পোড়া রুটি খেতে, এখন রাজভোগ খাও। সন্ন্যাসী চোখের জলে বিদায় নিলেন কালনা থেকে। পরবর্তীকালে রাজকীয় ৫২ ভাগের আয়োজন থাকলেও সন্ন্যাসী প্রদত্ত সেই পোড়া রুটির ভোগ আজও দেওয়া হয়।
(দীনবন্ধু মিত্রের সুরধ্বনি কাব্য প্রকাশিত হয় ১৭৯৩ শকাব্দে। এই কাব্যে লালজীর উপখ্যানটির বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।) লালজির নাম অনুসারে এই মন্দিরের নাম রাখা হয় লালজী মন্দির। এখানে রাস ও ঝুলনের সময় রঙিন পঞ্চগুড়ি দিয়ে কৃষ্ণের লীলাকাহিনী বর্ণিত হয় যাকে বলা হয় ‘সাঁজি’। ২০২০ আগস্ট মাসে ভারতীয় ডাক বিভাগ কালনার এই প্রাচীন লালজী মন্দিরের ডাক টিকিট প্রকাশ করে।
লালজীর জামাই শ্যামচাঁদ :
সময়ের কালগর্ভে জামাইও একদিন শ্বশুর হয়। এবার বলবো, লালজীর জামাই শ্যামচাঁদ জীউ-এর কথা।
শ্যামচাঁদ জীউর বাড়ির নাম মাঈজীর বাড়ি।
শোনা যায় এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কালনাবাসীর ঠাকুর পদবিধারী মৈথিল ব্রাহ্মণরা। এই বংশেরই একজন ভক্তিমতি মহিলাকে সকলে ‘মাঈজী’ বলে সম্বোধন করত।সেই সময় তাঁদের তাদের অষ্টধাতুর যুগল বিগ্রহ ছিল। একটি পঞ্চরত্ন মন্দিরে সেবা পেত সেটি। বর্তমানে সেই বিগ্রহ অপহৃত হলেও মন্দিরটি আজও অক্ষত আছে।
মাঈজী অকালে নিজের পুত্রকে হারিয়ে শোকে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। তিনি নিত্য গঙ্গা স্নানে যেতেন ও পুত্রের জন্য বিলাপ করতেন। বর্ধমান রাজের পত্নী মহারানী সেই একই ঘাটে পাল্কি চড়ে গঙ্গাস্নানে আসতেন। পুত্রহারা জননীর কান্না শুনে তিনি মাঈজীকে রাজবাড়ীতে এনে সান্ত্বনা দেন। এরপর মহারানী মাঈজীকে বৃন্দাবন থেকে শ্রী শ্রী শ্যাঁমচাদের একক বিগ্রহ আনতে অনুরোধ করলেন। মাঈজী পায়ে হেঁটে শ্যামচাঁদকে নিয়ে আসেন কালনায়। এরপর রাধারানীর সঙ্গে শ্যামচাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। সেই কারণেই শ্যামচাঁদকে বলা হয় লালজীর জামাই বলা হয়।