সোমবার | ১লা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১১:৩৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (দ্বিতীয় পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (চতুর্থ পর্ব) : গীতা দাস সাবঅলটার্ন দৃষ্টিতে কলকাতার লবণচিহ্ন : অসিত দাস মোদীকে চাপে রাখতে নীতীশ-নায়ডুর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা দাবি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (প্রথম পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বাঁধে ইঁদুরের তৈরি গর্ত দিয়ে ঢোকে বন্যার জল চলছে সংস্কারের কাজ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (তৃতীয় পর্ব) : গীতা দাস কবি সঞ্জীব প্রামাণিক, আবহমান বাংলা কবিতার পথে হেঁটে-যাওয়া এক কবিতাভিক্ষুক : অমৃতাভ দে সৌমেন দেবনাথ-এর ছোটগল্প ‘বিলাসী’ বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (দ্বিতীয় পর্ব) : গীতা দাস সাত্যকি হালদার-এর ‘ছোটগল্প’ কাজলদিঘি ডায়েটে আনতে হবে কয়েক টুকরো নারকেল তাহলেই কেল্লাফতে : রিঙ্কি সামন্ত বাতাসে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে বাঁশগাছের কদর বাড়ছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (প্রথম পর্ব) : গীতা দাস স্পিকার নির্বাচন থেকেই শুরু হল সেয়ানে সেয়ানে টক্কর : তপন মল্লিক চৌধুরী বাসুলী লবণের দেবী (দ্বিতীয় পর্ব) : অসিত দাস শক্তিপদ রাজগুরু-র ছোটগল্প ‘পাখিরা আর নেই’ বিস্মৃত কথাসাহিত্যিক সুলেখা সান্যাল : আনিসুর রহমান ময়মনসিংহের গৌরব কেদারনাথ মজুমদার (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার লেডি ম্যাকবেথ, ওয়াটার আঙ্কেল ও আমি : সসীমকুমার বাড়ৈ জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা শিক্ষার জনক : মনোজিৎকুমার দাস ময়মনসিংহের গৌরব কেদারনাথ মজুমদার (তৃতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার আম্বুবাচী শব্দের অর্থ কি? অম্বুবাচী কেন এবং কারা পালন কর? : মনোজিৎকুমার দাস ময়মনসিংহের গৌরব কেদারনাথ মজুমদার (দ্বিতীয় পর্ব) : দিলীপ মজুমদার নিজের জীবনের নানা কথা — কবিতার জীবন (শেষ পর্ব) : মহাদেব সাহা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন বেমালুম ভুলেগেছি বাংলার রূপকার আর. এন. মুখার্জি সরি স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে : রিঙ্কি সামন্ত গ্রেস কটেজে নজরুলের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী : দীপাঞ্জন দে নিজের জীবনের নানা কথা — কবিতার জীবন (অষ্টম পর্ব) : মহাদেব সাহা কার্লোস তেভেজ — ফুটবলের নিষিদ্ধ চন্দ্রিল উপত্যকা : যীশু নন্দী
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

লেডি ম্যাকবেথ, ওয়াটার আঙ্কেল ও আমি : সসীমকুমার বাড়ৈ

সসীমকুমার বাড়ৈ / ৬০ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪

সেরে উঠেছি। সেরে উঠতেই হত, বেশি দিন জ্বরের খবর চেপে রাখা যেত না। সঙ্গে রাজযোটক খুশখুশে কাশি আর গলা ব্যথার কথা হলে চাউর হলে এতদিনে ঠাঁই হত পুঁতিগন্ধময় হাসপাতালের বেডে বা অজ্ঞাত নদী তীরে আধ পোড়া পরিত্যাক্ত লাশ হিসেবে। তারপর শুরু হত সংখ্যাতত্ত্বের খেলা। সংখ্যা চরিত্রে লেগে যেত রক্তচাপ, মধুমেহ কিংবা আমার হদ্‌রোগের পুরানো ইতিহাস। এ সব ভয় এখন গৌণ, সেরে উঠেও সব চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছি বউকে। সে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর মূর্তিতে যখন তখন উদয় হয়ে ফরমান জারি করে-কি গো, মুদিখানা থেকে ফিরে এসে হাত ধুয়েছ?

— হ্যাঁ ধুলাম তো, দেখলে না বেসিনে হাত ধুচ্ছিলাম।

— কখন ধুলে? সবে গামছা আনতে গিয়ে ফিরে এসে দেখলাম বাবু নেই। অত কম সময়ে কুড়ি সেকেন্ড হয়ে গেল? আরে বাবা, কুড়ি সেকেন্ড বলেছে বলে কুড়ি সেকেন্ডই হাত ধুলে হবে? ও তো বলেছে কমপক্ষে কুড়ি সেকেন্ড ধুতে হবে। তোমাকে ত্রিশ চল্লিশ সেকেন্ড ধুতে কে বারণ করেছে। আর ফিরে এসে দরজার হাতলটা ধরলে, কলের মাথাটা ধরলে সেখানেও তো জীবানু থিকথিক করছে, সেগুলো কে ধোবে? চলো চলো, ওগুলো পরিষ্কার করে হাত পা ভাল করে আবার ধোবে।  আর শোনো কনুই-র উপর পর্যন্ত ধোবে, প্রয়োজনে দুই তিন বার ধোবে। মনে রাখো, বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা আছে কিন্তু।

মোক্ষম অস্ত্র। এই শরক্ষেপ অভিষ্ট ভেদ করেছে। আমি সুড়সুড় আবার বেসিনে গিয়ে হাত ধুতে থাকি। কত সেকেন্ড, কত মিনিট বা  কত ঘন্টা জানি না। ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে বছর থেকে হাজার বছরে, হাত ধুয়েই চলেছি। ধেয়ে আসা তিরগুলোর আভিঘাত আমি জানি কিন্তু যে বা যারা অনুঘটক হিসেবে সাহায্য করেছে শরক্ষেপণে তাদের কেউ চর্মচোখে দেখেনি। আমি তো কোন নস্যি। একজন মানুষ নাকি সত্তর বিলিয়ন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অসুস্থ হয়। শ্বাসনালী ফুসফুসে ক্রমশ  পুঞ্জীভূত করোনা অচল করে দেয় শ্বাস। তাহলে ঠিক আজকের দিনে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ফুসফুস কংক্রিট করে দিতে লাগে মাত্র সাড়ে তিন কিলগ্রাম ভাইরাস, যার এক একটির ওজন দশমিক পঁচাশি এট্টোগ্রাম। আমার বউ শ্যেণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। গভীর সত্তায় প্রবেশ করেছে অবিশ্বাস। সে দেখতে পায় কিনা জানি না, নইলে সে নাকের সামনে দাঁড়িয়ে বলে চলে কেন, হাত পা মাথা সমস্ত শরীর ধুয়ে যাও। তোমার হাত পায়ে কিলবিল করছে নভেল করোনা। এই করে আমার জ্বর এসেছিল। লকডাউনের প্রথম দিনে বাজার করে ফিরতেই দরজা খুলে বউ হুয়িপ জারি করেছিল-না না, ঘরে ঢোকা তো দূরের কথা একদম নড়বে না। পাশে ব্যাগ সরিয়ে রেখে যেখানে আছো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকো। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই খোলা দরজা দিয়ে জল কামানের মতো বুলেট বেগে ছুটে এসেছিল বালতি পর বালতি জল। ছেলে মেয়েরা ম্যাজেনাইন ফ্লোরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হি হি করে হাসছিল আর হোলির আনন্দে জল ঢালছিল। আমি তখন জল কামানের সামনে নিরুপায় ছত্রভঙ্গ বিরোধী পক্ষ। আমার বলার কত কথা ছিল কিন্তু অবকাশ ছিল না। গৃহমন্ত্রীর সামনে সবাই সামুক। মাঝে মাঝে ভাবি, গৃহমন্ত্রীর দাপট কি ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর চেয়ে বেশি, যার দাপটে বৃটিশ সাম্রজ্যের সূর্য কখনও অস্ত যেত না। রাতেই জ্বর এসেছি,  আমি জ্বরের মধ্যে অনন্ত জলে সাঁতার কাটছি, এক বাও মেলে না, দুই বাও…তলহীন জলে কিলবিল করছে ক্যাকটাস ফুলের মতো নভেল করোনা ভাইরাস গুঁড়ো, সংখ্যায় কত আমি তার পরিসংখ্যান মিলাতে পারছিলাম না। এক বাও মেলে না…দুই বাও…

অফিস কক্ষের দরজায় একটি বিজ্ঞপ্তি সাঁটা হয়েছে। এমন বিজ্ঞপ্তি আগে কখনও সাঁটা হয়নি। হতে পারে প্রয়োজন হয়নি। আর যে কথাগুলো সবার উদ্দেশ্যে বলা হয়, কাউকে নির্দিষ্ট করে বলা হয় না, ভাববাচ্যে বলা অফিসের সেই গুরুগম্ভীর কথাগুলো নোটিশ বোর্ডে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে থাকে। চেম্বারের গায়ে সাঁটা বিজ্ঞপ্তিতে শুধু লেখা রয়েছে-মুখোশ ছাড়া প্রবেশ নেই। আমি নিজে ঢুকতে গিয়েও সেই বিজ্ঞপ্তিটি পড়তে পড়তে ঢুকি। দেখে নিই সত্যিকারে মুখোশ পড়েছি কিনা। কারও ঘরে আজকাল আর প্রায় কেউ যায় না, ঘরের মধ্যে আমরা এক একজন কক্ষ উপকক্ষ বানিয়ে নিয়েছি। তার প্রাচীর নেই অথচ অলঙ্ঘনীয় সীমা আছে। এখন ফাইল নিয়ে অধিকাংশ সময়ে যে আসে তার নাম ছিল শঙ্কর। মুখোশ পরা শঙ্করকে আমি চিনি না, এমনকি মুখোশ পরা আমি আমাকেও চিনি না। ঢাকা মুখের আড়ালে মুখ বা মুখোশ আমরা কী করে চিনব। আমরা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি একে অন্যের দিকে। আমরা কি কেউ কোনোদিন কাউকে চিনতাম। তখন সামাজিক দূরত্ব মাপার বালাই ছিল না,  কিন্তু কে ককে চিনতাম? বাড়ি, পাড়া, রাজ্য, দেশের প্রতিটি খোপে খোপে আটকে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে কত কত স্তর। বায়ুর বিভিন্ন স্তর থেকে মুখোমন্ডল পর্যন্ত কত অদৃশ্য মুখোশ ভেদ করে করোনা নাকি পৌঁছায় শ্বাসের কাছে, তা হলে অচেনা শঙ্কর আমরা কি পারব তোমার আমার তীক্ষ্ণ চোখের অবিশ্বাস এই ত্রিস্তরীয় কাপড়ের মুখোশে আটকাতে? তুমি না আমি বয়ে বেড়াচ্ছি উপসর্গের লক্ষণগুলি বা লক্ষণহীন বিপদ সংকেত, যা তুমিও চেন না আমিও চিনি না। আমার পদমর্যাদা অথবা তোমার পদের কথা ভুলে যাও, ইচ্ছা হলে বলো, তুমি আমাকে ঘাতক ভাবো কিনা।  ভাবছ কিনা, যে ফাইলগুলো বয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরবে তার প্রতিটি শব্দের পৃষ্ঠটানে লেপ্টে আছে পৃথিবীর একত্রিত হওয়া সমস্ত সংক্রামক বিষ বা রোগবীজ। শঙ্করকে নিরুত্তর দেখে আমি মাথা তুলি, না কেউ কোথাও নেই। কেউ কি কোথায়ও ছিল আমার শূন্য ঘরে, না একাই আমি তো বসে আছি আজন্ম। যেখানে হাওয়া বাতাস নেই, আমার শ্বাস কেমন বন্ধ হয়ে আসছে, চারপাশে অব্যবহৃত স্তূপাকৃত মুখোশ আর মুখোশ। ত্রিস্তরীয় মুখোশ পরে কারা এত মুখোশ খুলে রেখে গেল আমার ঘরে? মানুষ কি এখন অগুন্তি মুখোশ খুলে একটি মাত্র মুখোশে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ছোটবেলায় আমাদের একটা প্রিয় খেলা ছিল পুকুর বা খালে নাইতে নাইতে জল কাদাকে দই করে ফেলা। আনন্দের মাত্রা বাড়লে কাদা জলের উপরে পাতলা কাদার সর পড়ে যেত। খাওয়া যেত না সেই সর কিন্তু তার মাখন আদর অনুভব করতাম শরীরময়। কাদার সর মেখে যেত আমাদের গায়ে। তারপর পাড়ে উঠে সূর্যের দিকে মুখ করে চিৎ শুয়ে থাকতাম, কেউ কেউ তখনও উলঙ্গ শিশু। গ্রামে লজ্জ্বা আসে একটু দেরি করে।  না সান বাথ নয়, ওটাই ছিল আমাদের খেলার অঙ্গ। পিচ্ছিল সুখের মতো আমাদের শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যেত রোদ হাওয়া। একটু একটু করে শুকাতে থাকত শরীরের নরম প্রলেপ। আগে শুকাত মুখে লেগে থাকা কাদা-সরের মুখোশ আস্তরণ। সারল্যে মুখোশ বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে না। কাদার মুখোশ ফেটে ফেটে চলটার মতো উঠে যেত। সূর্যের মুখোমুখি মুখের সে কী ঝলক। খুলে রাখা অদৃশ্য স্তূপাকৃতি মুখোশের মধ্যে তো স্বস্তি বোধ কাজ কারার কথা, তবে কেন এখন দমবন্ধ হয়ে আসছে? তবে কি শ্বাসনালী, ফুসফুসের গতিপথ রুদ্ধ হয়ে আসছে। দৌড়ে গিয়ে জানালা খুলে হাট করে দিলাম। আঃ কী ফুরফুরে দখিণা হাওয়া। দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ, কত কাল দেখিনি। কারা যেন আকাশের ধোঁয়ার ঘোমটাটা এক ঝটকায় নামিয়ে দিয়েছে। আকাশ বাতাস জল জঙ্গলের এখন বড় সুখের দিন। পড়ন্ত বিকেলে ছেলেরা ঘুড়ি উড়াচ্ছে। অবাক লাগল, বিশ্বকর্মা পূজার এখনও ঢের বাকি। আর পুরানো ঢাকার আকাশে ঘুড়ি ওড়ে পৌষ সংক্রান্তি সাকরাইন উৎসবে। সবে জৈষ্ঠ্য শুরু হয়েছে, পৌষ সংক্রান্তি আসতে আট মাস বাকি। ঢাকার আকাশে কি এখন উড়ছে ঝাঁপ, বেনা, ডাক, কাইটাঘুড়ির মতো ঘুড়ি? কিশোররা কত দিন পরে চার দেওয়ালের মাথায় আকাশের মুখোমুখি হয়েছে। আর যাওয়ারই বা জায়গা কোথায়? সভ্যতা ওদের শৈশব খেয়েছে আর করোনা করেছে বন্দি। ইট পাথরে মাথার আকাশটা যা মুক্ত। ওরা লাটাই খুলে দরাজ হস্ত। এতটা সৌখিন লাটাই আমদের ছিল না, দেশি সুতোয় কাচের গুঁড়ো আর গাবের আঁঠা লাগিয়ে মাঞ্জা দিতাম, চিল ঘুড়ির জন্য সরু পাটের দড়ি ছিল আমাদের সৌখিন বিস্তার। বাসপাতা কাগজে বানাতাম সেই সব ঘুড়ি। খোলা ক্ষেতের মধ্যে প্রতিদ্বন্দিহীন আকাশে উড়াতাম চিল ঘুড়ি, কখনও উড়তে অনুচ্ছুক ঘুড়িটা মিশাইল বেগে নেমে আসত মাটিতে। মাটিতে গোত্তা খাওয়া ঘুড়িটার তোবড়ানো মুখ দেখে বুকের পাঁজরে হাত বোলাতাম। আকাশে এখন অনেক ঘুড়ি, শুধু আমাদের হাতে বানানো চিল ঘুড়ির মতো একটাও নেই। কোনটা পেটকাটি, চাঁদিয়াল, ময়ূরপঙ্খী বা বগ্‌গা বা মুখপোড়া আমি চিনি না, আলাদা করে  চিনতেও চাই না। এমন নির্মল আকাশে ঘুড়ির মেলা দেখতে ভাল লাগছে। ভাল লাগছে তাদের গতিশীল বিচরণ। লকডাউনে কলকাতা শহরটায় একমাত্র ঘুড়িদেরই যা প্রাণ আছে। আমার আচ্ছন্নতা কাটিয়ে হঠাৎ করে কানে ভেসে এল- ও হরি। খেয়াল করে দেখি, আকাশ থেকে খশে গেল একটা অচেনা ঘুড়ি। অচেনা শব্দের মধ্যে এক ধরণে দ্যোতক আছে, চিনি অথচ চিনি না। বা একেবারেই চিনি না। পরে শুধুই ভেসে আসতে লাগল-ভোম মারা, ও হরি, ও হরি আওয়াজ। ও হরি আওয়াজটা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে-বলো হরি, বলো হরি-তে। চিনা মাঞ্জা সুতোয় কেটে দিচ্ছে এক একটা ঘুড়ি। জীবনরেখা। টাল খাওয়া ঘুড়িগুলো আকাশ থেকে নেমে আসছে শত হাজার মাইল উড়তে উড়তে ক্লান্তিতে ঢলে পড়া পরিযায়ী পাখীদের মতো।  আঃ আমি আর চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না, মাটিতে কোনো ঘুড়ি পড়তে দেখছি না, আছড়ে পড়ছে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক। তাদের বাচ্চা বউ। ক্লান্ত শ্রমিকের শ্বাস কেটে যাচ্ছে মৃত্যু চাকায়। রাজপথ, জাতীয় সড়ক থেকে রেল লাইন ঢেকে যাচ্ছে লাশে। লাশের উপর বর্ষিত হচ্ছে অবহেলা, বর্ণবাদী ঘৃণা, বঞ্চনা। সব লাশ বেওয়ারিশ, রাষ্ট্র পর্যন্ত চেনে না তাদের। না, আমি আর পারছি না মৃত্যুর এই উৎসব দেখতে। দখিণা বাতাসে এখন শুধু ছিন্নভিন্ন পরিযায়ী শ্রমিকের পচা গলা লাশের গন্ধ। ওয়াক, ওয়াক উগড়ে আছছে আমার হৃদ্‌পিণ্ড। এক ঝটকায় দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে হড়হড় করে বমি করে দিলাম। বিস্ফোরিত চোখ দু’টো ঠিকরে পড়ল কোথায় যেন। নোংরা জলে উপচে পড়া বেসিনে তখন ভাসছে একটা কাপড়ের মুখোশ।

আজ আর বউকে কিছু বলার সুযোগ দিইনি। ফিরে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলাম। সেটাই নিরাপদ ছিল, অফিসের কথা বউকে বললে, দু’জনেরই হাল খারাপ হত। ঘর থেকে বাইরে বের করে দিয়ে হয়তো জল কামানের গোলা বর্ষণ করত পুনরায়। আমার জ্বর-সর্দি-গলা ব্যথার  ভাবনা শুধু নিজেকেই বলে যেতে হতো নিরুপায়ভাবে। তাকে বলে বুঝানো যেত না। আমাকেও অবাক করে তার নিজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মাত্রাতিক্ত আয়োজন দেখে। আমার আসার পথ ধরে গেটের ছিটকানি, কলিং বেলের সুইচ, দরজার হ্যান্ডেল থেকে জুতো সব কিছুই ধুয়ে ফেলে। পারলে আমার শ্বাস প্রশ্বাসও সে ধুয়ে দিত। ধুয়ে দিত নিক্ষিপ্ত নিঃশ্বাসের বায়ুস্তরের আপাত শূন্য জায়গাটুকুও। শূন্যের রহস্যময় অস্তিত্বের গায়েও সে পাঠাতে চায় জল-সাবানের পিচ্ছিল ক্ষারবিন্দু। তারপর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বাথরুম চলে যায় তার দখলে। হাত ধুয়ে চলে অনন্তকাল ধরে। তার হাতে কিছু লেগে আছে কিনা আমি জানি না, ধুয়ে চলা হাতে কি ঘাতক অনুভূতি আছে? এই ভাবনাটাও হয়তো ভিত্তিহীন। বস্তুগত প্রমাণছাড়া কোনো প্রমাণই বিচারে গ্রাহ্য নয়। তা হলে হৃদয়, স্বাধীনতার শ্বাস খুন হলে  কার কাছে বিচার চাওয়া যায়? চিরকাল সন্দেহের অবকাশে সুবিধা পেয়ে যায় অধিকাংশ আসামী। মহামতি মাই লর্ড, আইনের যে ব্যাখা দেবেন সেটাই কার্যকারী আইন। বউ স্বজ্ঞানে অজ্ঞানে হাত ধুয়ে চলে রাতদিন। জল ছোঁয়ায় আনন্দ হলে বাথরুমে গুণগুণ গান গায় —

আমার পিপাসার আগুনে লেগেছে ঝঞ্ঝা হাওয়া

ওরে ও রুদ্র ভৈরব

বাজাও ডমরু ওই উতল জলতলের বিন্দু নিঃশ্বাসে।

বাথরুমের ঝরনাজলে সে নাচে কিনা আমি জানি না। অদ্ভুত ব্যাপার, এই প্রথমবার মনে হল আমাকে হাত ধুয়ে যেতে হবে, আমার সত্তায় ভাইরাস লেগে আছে। আনন্দ হচ্ছে জলের সঙ্গে সখ্যতায়। কত জলে কতক্ষণ ধুলে যাবে জানি না কিন্তু সাবান মেখে হাত ধুয়ে যেতে চমৎকার লাগছে। বিশ্বাস বোধের সঙ্গে অনুভূতির এতটা মসৃণ সম্পর্ক আগে কখনও বুঝিনি। যুক্তির তুণে রাখা এক একটা তির ছুঁড়ে দিয়ে বলেছি ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার কথা। পাণপণে চেষ্টা করেছি, কোনো বর্মে ঠোক্কর লেগে তিরগুলো যেন ভোতা না হয়ে যায়। অথচ প্রতিপক্ষ অসার কাঠের নৌকায় বিহার করে, বিশ্বাসের দাসত্বে মরেছে প্রতিবার। শাল কাঠের মজবুত্ব বরঞ্চ নিরাপত্তা বোধ বাড়াতে পারত। যেমন এখন ঝাঁপ বন্ধ মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোডায় দরজায় না গিয়ে হাসপাতালে যায় মানুষ। মদ আর ঈশ্বর-আল্লা ছাড়া বাঁচে। ডাক্তার জীবন রাখলে আবার ফিরে যাবে সেই সব দরজায়, শুরু করবে বিশ্বাসের কীর্তন। অনুভব করলাম বিশ্বাসের মাদকাচ্ছন্নটান, হাত ধুতে ধুতে কত আলোকবর্ষ কাটিয়েছি বাথরুমে খেয়াল নেই। শেষে এলো সম্পৃক্ততার ঘুম, শরীরের নীল শিরা উপশীরায় প্রবাহিত হচ্ছে জলের ধারা। মাথার কোষে কোষে কোনো ধূসর সত্তা নেই, সমস্ত ঘিলু কোষ জল স্বচ্ছ। শরীরময় বাড়তে থাকে ঠান্ডা শিহরণ, বুঝে যাই শরীরে আর জল ধারণ ক্ষমতা নেই। বড় অবসন্ন লাগে, ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি জলতল শয্যায়।

কত বছর কত দিন ঘুমের মধ্যে ঘুমাচ্ছি খতিয়ান রাখিনি। চালু জীবনের কোনো তাগাদা না থাকায় এখন ঘুমের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকার সঙ্গত কিছু কারণ আছে কিন্তু অবাক করা কাণ্ড হল, সব কিছুর সঙ্গে অভিযোজন ঘটিয়ে নিয়েছি। এবং ভোগানন্দ বিক্রি করার বাজারি পেপারটাকে তাড়িয়েছি প্রথম সুযোগেই। এক মুখ দেখতে দেখতে মুখের ক্লান্তি দূর করতে একটা কিছু করতেই হতো।  ভেজাল খবরে ক্রমশ সহনশীলমাত্রা অতিক্রম করে যাচ্ছিল লালিত চর্চার। সংক্রামিত হচ্ছিল ভাবনার কৌণিক বিন্দু। টোপে গাঁথা থাকত ভোগ-লালসার মসৃন ত্বক। দৈন্য মুখগুলির সামনে স্পষ্টই মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল চিনের প্রাচীর, যাকে আমি চোখে দেখিনি কিন্তু জানি আমার ভাঙার ক্ষমতা সসীম।  খবরের কাগজ পড়ার তাগিদ নেই, মৃত্যুর সংখ্যা দেখতে চাই না ঘুম থেকে উঠেই। শুধু ঘুমে মধ্যে ঘুমিয়ে থাকার আপাত সুবিধা হল সুখ দুঃখের সংক্রামণ কম হয়। কিন্তু কিভাবে কেবলই অনুভব করছি সব আবহাওয়ার সুযোগ নেওয়া মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা আমার থেকে অনেক বেশি। চাল, ডাল উদ্বায়ী করে দিতে তাদের তাদের অধিবিদ্যা এখানেও চমৎকার কাজে দিচ্ছে। শুধু একটি কাজ পারেনি, তা হল ক্ষুধিত পেটের শূন্যস্থান পূরণের কোনো অলীক যাদু আবিষ্কার করতে। শূন্য পেটের গুড়ুগুড়ু শব্দ থামাতে পারেনি। ক্ষুধা থাকলে ক্ষুধিত মুখের কথাও থাকবে। আসতে পারে টর্ণেডো। আমাদের নিদ্রমগ্নতায় চাল, ডাল উদ্বায়ী করে দেওয়ার খেলাটা তারা খেলে যাচ্ছে আরো পেশাদারিত্বের সঙ্গে। ঘুমের মধ্যে থেকে মাস দিন সাল তারিখ সব বেমালুম ভুলেতে বসেছি। একদিন বউ বলল, তোমাকে রিপ ভ্যান ইউঙ্কেলের মতো লাগছে। চুল দাড়িতে ঢেকে আছে মুখোমন্ডল, বট পাকুড়ের ঝুরির মতো মাথা থেকে চুল নেমছে। গোড়া সাদা মাথা রঙিন। মাথায় এখন আর রঙ মাখার দৈন্য নেই। তোমাকে কেমন চেনা চেনা, কিন্তু অচেনা লাগছে। আর কতকাল ঘুমাবে, উঠে দেখ নিজেকে চিনতে পারো কিনা। যথারীতি আমি ঘুম থেকে ওঠার তাগিদ দেখালাম না। পৃথিবীর অসুখে মানুষের ছন্দহীন চুল দাড়ি গজাবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে? একুশ শতকের সম্পাদকরা সাদা চুল দাড়িতে ঢেকে যাবে, কবিরা ছন্দ ভুলে যাবে, মরিয়া হয়ে গাইতে গিয়ে গলার জমাট বাঁধা কোষগ্রন্থি ছিঁড়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরবে গায়কের এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গতির চালকের আসনে বসে আছে ভয়। আমার মতো তাকে তুমিও চেন না গিন্নি, চিনতে চাওনি।  ফিরে আসা রিপ ভ্যান ইউঙ্কেলকে তার বউ ছেলে মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে বেগ পেতে হয়েছিল। তেমন মেয়ের পোষা বিড়ালটাও এখন আমাকে পাত্তা দিতে চায় না। আমি ওকে পছন্দ করতাম না, তা বিড়ালটা বোঝে। আমেরিকার চিড়িয়াখানায় বাঘ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। তা হলে বাঘের মাসি তো করোনার বাহক হতেই পারে। অন্য সময় সে আমার টের পেলেই দৌড়ে একটু দূরে পালিয়ে যেত, সামনের পা দু’টি মেঝে প্রসারিত করে থুতনি মেঝেতে ঠেকিয়ে আমাকে দেখত। সারা শরীর সাদা, মুখটুকু মিশমিশে কালো, তার মধ্য থেকে বেরিয়ে থাকা সাদা গোঁফে কৌতূহল। তীক্ষ্ণ রহস্যময় চোখে আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলত আর পরিধি মাপত। এখন সে আমার চারদিকে লেজ মোটা করে ঘোরে আর ম্যাও ম্যাও করে ডাকে। আমার সংকট ধরতে পেরেছে। অথচ বউকে কী করে বুঝাই, সম্পর্কের মধ্যে চুল দাড়ি কিছু নয়, নিয়ন্ত্রক হিসেবে ঢুকে পরছে ভাইরাস। পুঁজরক্ত, বিষ। ভাবনায় থাকে এই পুঁজরক্ত সরিয়ে ফেলতে পারলেই আমাদের রোগ ভীতি উধাও হয়ে যেত। সম্পাদক পত্রিকা সাজাত নতুন ভাবনায়, কবি ভাবত পরাবাস্তবতাকেও কী করে ছাড়িয়ে যাওয়া যায়। আমাদের পাশের বাড়িতে, না ঠিক আমাদের পাশের বাড়িতে নয়, সারা শহরের অহংকারী বাড়িগুলোতে ভাড়া থাকত মণিপুর, উড়িষ্যা বা কেরলা থেকে আসা মেয়েরা। মনিপুর থেকে আসা সব সেবিকা মেয়েদের আমি চিত্রাঙ্গদা ভাবি। তোমরা এসেছিলে এই শহরের পুঁজরক্তে হেজে যাওয়া মুখ উন্মুক্ত করে দিতে। অংশ নিয়েছ এক অসম অদৃশ্য যুদ্ধে। যে যুদ্ধে পেন্টাগণ ইতিমধ্যে পরাজিত, বিদ্ধস্ত। অসংখ্য কফিনবাহী শবযানের চালক ট্রাম্পের মধ্যে অসংলগ্নতা দেখা দিয়েছে। সে এখন পৃথিবীর সব চেয়ে ভোতা অস্ত্র ভাণ্ডারের মালিক। তেমন এক ভয়ানক যুদ্ধে  নেমেছিলে তোমরা। পুলিশ, ডাক্তারদের আর শহরের সব নার্স বোনদের সঙ্গে তোমরাও ছিলে প্রথম সারির যোদ্ধা। যুদ্ধটা অদেখা শত্রুর সঙ্গে, মৃত্যুর সঙ্গে। মৃত্যুর অনিবার্যতা মেনেও এতকাল কিছুটা বাড়তি সময় আদায় করে দিতে অধীত বিদ্যার জোরে। তোমরা লড়েছ প্রায় খালি হাতে অদৃশ্যমানতার বিরুদ্ধে। কোনো শব্দভেদী বাণও তাকে ছুঁতে পারত না। সেবার অদম্য জেদ আর ভালবাসা সম্বল করে লড়ে যাচ্ছিলে জয়ী হতে। হাসপাতাল বাস হাটে বাজারে তোমাদের সঙ্গে দেখা হলে বুঝতাম, রবীন্দ্রনাথ তোমাদের হয়ে গাইছেন-আমি রূপে তোমায় ভোলাব না/ ভালবাসায় ভোলাব।‘ হায়, এই হেজে যাওয়া শহর ভালবাসায়ও ভোলে না। সেবার ভালবাসা সে কোন ছাড়, তোমাদের চেহারার উদ্দেশ্যে উড়ে আসে তীব্র ব্যঙ্গবাণ, টিটকিরি-করোনা, করোনা। এ শহরে ভালবাসার অর্জুন নেই, চিত্রাঙ্গদা বোনেরা ফিরে যাও, যাও ফিরে নিষ্ঠুর শেল বুকে। আমি ঘুমের মধ্যে না হয় ভুলে থাকি ভুলের খতিয়ানগুলো। ভুলে থাকি রবিবাবু আপনার বাড়ির সামনে কারা খেউর গেয়েছিল আর এখন কোন প্রজন্ম উত্তরাধিকার বহন করে। জীবনানন্দ আপনিও শহর থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন কবিতার শ্লীল আশ্লীল শব্দের গিরায়। চাকা ঘুরবে না জেনেও বিনয় মজুমদার আপনি গায়ত্রীকে ফিরে আসার অনুনয় করেছেন বারে বারে, আর নিঃশব্দ চাকায় কেটেছে আপনার হৃদয়। শহরের বাইরে, প্রান্ত মাঠের পাশে হয়েছিল আপনার ঠাঁই। আমি আর দেখতে চাই না। এখন চূড়ান্ত দুঃসময়। চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমের আদলে ঘুমিয়ে থাকতে চাই। তবু বলে রাখি, তোমরা যারা সূর্য সাধনা করো, আমাকে ডেকো। আমি আছি তোমাদের দলে।

সভ্যতার কর্কশ শব্দগুলো বন্ধ। লকডাউনের নিঃসঙ্গতার দোসর জুড়েছে নিস্তব্ধতা। নিস্তব্ধ জমাট সময় আমার চোখের পাতার উপর চাপিয়ে দিয়েছে গোটা হিমালয়। মৃত্যু যখন গলায়-বুকে চাপে তখন মৃত্যুর ভার হিমালয়ের চেয়ে কত গুন বেড়ে যায়? ও জর্জ, জর্জ ফ্লয়েড তোমার গালায় চেপে বসেছে ডেরেক মাইকেল চৌভিন-এর মৃত্যু-হাঁটু। করোনার সামাজিক দূরত্ব তত্ত্বও মানছে না রাষ্ট্রের শক্তি। আঃ জর্জ, তুমি শ্বাস নিতে পারছ না। বলো, বলো কত লক্ষ বিলিয়ন টন বর্ণবাদী হাঁটুর চাপ তোমার শ্বাসের উপর? বড় ভয় হচ্ছে, বড় ভয়। এই নয় যে আমি সারা পৃথিবীতে কবরের জন্য অপেক্ষমান অসংখ্য কফিনের একটিতে আমি শুয়ে আছি। বা রিপ ভ্যান ইউঙ্কেলের মতো জীবন থেকে কুড়ি বছর হারানোয় আমেরিকান রেভিউলেশন দেখতে পাইনি। বরঞ্চ ঘুমের মধ্যে থেকেই বেনিয়া শাসকদের রাষ্ট্র বেচার ফন্দি ফিকির দেখি। চাল হাতানো জাদুকররা চালেই থামবে না, মৃত্যুর কাছেও সুদ চাইবে। আমাকে জাগাতে না পেরে বউ অন্য ঘরে ঘুমায়, কিছুটা হয়ত বয়সের জাগতিক নিয়মেই। আমার নিদ্রামগ্নতায় প্রশান্তি আসে। নিদ্রার প্রশান্তি সমানুপাতে বাড়ে হিমালয়ের ভার, আবার দুর্বল হলে বাড়ে বরফের কামড়। সেদিন প্রশান্তিময় ঘুমে যখন আচ্ছন্ন, হঠাৎ  ঘরের মধ্যে যেন চেয়ার ঘষটানো শব্দ পেলাম। আশ্চর্য, এ ঘরে তো চেয়ার নেই। আমি বন্ধ ঘরের বন্ধ বাতাসে শুয়ে আছি। জীবনরেখার উত্থান-পতনরেখায় যা অস্তিত্ব অনস্তিত্ব, তাতে আমার কার্যকারী ভূমিকা নেই। বস্তু প্রবেশের তো প্রবেশ দ্বার দরকার হয়। বন্ধ ঘরে তা হলে চেয়ার এলো কি ভাবে আর এই গভীর রাতে টানছেই বা কারা? চোখের পাতায় বরফ কামড়ের তীব্রতা বাড়ল, আমি ঘুমের মধ্যে জেগে উঠলাম। ঘরের মধ্যে এখন নিঃশব্দের নীরবতা, তবু কাদের উপস্থিতি যেন টের পাচ্ছি। কাচ গলে আসা রাত আলোয় ঘরে দু’জন লোক বসে আছে সরলরেখায়। আমি ঘুমের মধ্যে উঠে বসতেই সবার কৌণিক অবস্থান তৈরি হল। অসমকোণ, আমাদের বসার দূরত্ব অনুসারেই ত্রিভূজ কোণের পরিমান নির্ণিত হয়েছে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে বউকে চিনতে পারলাম। কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তি কে? হঠাৎ করে হাজার তীব্র গন্ধ এসে লাগল নাকে। খুব চেনা লাগল গন্ধটা, স্মৃতিপটে জেগে উঠল মানুষটাও। আরে এ তো ওয়াটার আঙ্কেল! আমার কৈশরে দেখা লোকটা, না ভদ্রলোক। না, ভিজা স্যাত স্যাতে হাজাওয়ালা মানুষটা। আমি তার মৃত্যুর পরে আবায়ব চেহারা এখন শুধু আনুমান করেছি। বিস্ময়ের ব্যাপারও বটে, কিভাবে প্রসঙ্গক্রমে জেগে উঠল বাতিল হয়ে যাওয়া স্মৃতি! পরিসংখ্যানবিদ স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের মস্তিস্ক কোষে দশ থেকে একশো টেরাবাইটস স্মৃতি সঞ্চয় ক্ষমতা আছে। এক টেরাবাইট হল এক হাজার জিবির সমান। আমি প্রায়ই ভাবি, আমার এই মস্তিষ্ক কোষে শুধু আমার একার মজুতকৃত স্মৃতিই নেই, ধরে রাখেছি পূর্বপুরুষদের জীবনের ধারাবাহিকতা এবং তাদের অধীত বিদ্যা। বন মানুষের যুগ থেকে সঞ্চিত সব তথ্যেও পূর্ণ হয়নি সব গোলাকরণ ক্ষমতা। এ জীবনে কতটুকুই বা সঞ্চয় করার ক্ষমতা অর্জন করেছি। বা কে করেছে? সঞ্চয় ভাণ্ডার সময় মতো হাজির করেছে ওয়াটার আঙ্কেলকে। একদিন দেখি দুর্গানগর স্টেশনের জনারণ্যের এককোণে টিউব ওয়েলের সামনে লোকটা দাঁড়িয়ে। তার জামার হাতা, হাঁটু থেকে প্যান্টের গোঢ়ালি চপচপে ভিজা। আমাকে দেখেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আমাকে বলেছিল, দে না ভাই একটু জলকলের হাতলটা টিপে দে, হাত ধোবো। পৌঢ়ের কথা শুনে আমার মায়া হয়েছিল। হাতল চাপছি তো চাপছি, সে হাত ধোয় পা ধোয়। থামে আর না। সে তার জীবনের চেয়েও যেন দীর্ঘ সময় ধরে হাত পা ধুয়ে যেতে চায়। ধুতে ধুতে হাত জলে পচে গলিত বিগলি হয়ে যাক হাত পা, তাতে তার খেয়াল নেই। আর যে কল চেপে চেপে হয়রান তারও ছাড় নেই। শেষে আমি এক প্রকার পালিয়ে বাঁচলাম। পরে দূর থেকে দেখতাম, ঘাড় গোঁজ করে কলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিবর্ণ মানুষটি। নিঃসঙ্গ একা। একটা নতুন মুরগী ধরতে হবে। লোকে তাকে দেখলেই পালিয়ে বাঁচে। বনগাঁও লোকালে ওঠার গণযুদ্ধে সামিল হওয়া যাত্রীরা ভুলেও তাকায় না তার দিকে। তার একটা নাম হয়েছে, ওয়াটার আঙ্কেল। পরে জেনেছি, ওয়াটার আঙ্কেল নলতা গার্লস স্কুলের ইংরাজির মাস্টার মশাই ছিল। সে কোথা থেকে এসেছে, কি নাম বা খায় কী কেউ জানে না। শুধু জানত শুচিবাই ওয়াটার আঙ্কেল নতুন শিকারে আশায় নিঃসঙ্গ কোণে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে স্মরণাতীত কাল থেকে। কয়েকদিন আগে দেকলাম, স্টেশনটা নিজেই নিঃসঙ্গ একা: দুপুরে ঘুঘু চড়ে বেড়াচ্ছে। যাত্রী নেই, হকারদের হাঁকডাক নেই। যান্ত্রিক জীবনধারী গড়িটার কাটাই যা ঘুরছে। গুমোট স্তব্ধ হয়েছিল ঘরের বাতাস, কোনো ঘূর্ণন নেই শ্বাসের। মনে হল, সংলাপ শুরু হওয়া দরকার। সংলাপে গুমোট বাস্পের এক বা একাধিক ছিদ্রমুখ খুলতে পারে, বিস্ফোরণ হওয়া আগে। আমি ওয়াটার আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করলাম, এতদিন পর কোথা থেকে এলেন। আশ্চর্য, নীরবতার নিস্তব্ধতা লঙ্ঘিত হলো না, কিন্তু আমাদের মধ্যে ভাষা-ভাবের আদান প্রদান চলল।

সে বলল-তার সৌন্দর্যে  আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কল্পলোকের মানসীর সঙ্গে প্রেম হয়েছি। কথা হত শয়নে স্বপনে। কথা রাখেনি। বিশ্বাসের চূর্ণ বিচূর্ণ গুঁড়ায় ঢেকে আছে আমার অস্তিত্ব। আমার হাত, মুখ, সারা শরীর। তোমরা যাকে ভাবো অদৃশ্য রোগবীজ, তা হলো অবিশ্বাস। বিশ্বাসভঙ্গ হলে তাকে ধুয়ে ফেলতে হয়। আমার শরীরময় দগদগে ঘাঁয়ে এখনও জমে থাকা প্রতিকূল অনুভূতির সঙ্গে তোমাদের অবস্থার কী অদ্ভুত মিল। আবার ফিরে এলাম, যদি একটু জল পাওয়া যায়। দেবে বাবা?

আমি চমকে উঠলাম, আমি তো আর শৈশবে নেই। দেখতে দেখতে ওয়াটার আঙ্কেলের সমবয়সী হয়ে গেছি। কিন্তু  ওয়াটার আঙ্কেল মূর্তির মতো একই বয়সে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বলতে চাইলাম-জল কোথায় পাই, আমি আছি জলের অতল তলে।

বউ অনুতপ্ত স্বরে বলল-পালালে হবে না, আমাকেও জল দাও। হাতে লেগে থাকা পাপবোধ ধুতেই হবে।

— আমার স্বাধীনতা বাদে তো তুমি কিছু হত্যা করোনি?

— আঃ কী ভয়ঙ্কর সত্য বললে আজ! স্বাধীনতার শ্বাসরুদ্ধ হলে কেউ বেঁচে থাকে? করোনা আমার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে অনুশোচনা। আমাকে জল দাও আরো।

— আমি গোঙাতে থাকি। পৃথিবী জল শূন্য হয়ে আসছে, এত জলের যোগান কোথা থেকে মেলে। জলের জন্য ইউফ্রেতিস নদী তীরে যুদ্ধ চলছে। হায় হাসান! হায় হোসেন! বক্ষলোমহীন পাষণ্ড সীমার তুমি পিপাসার্তের গলায় ছুড়ি চালাও! সিন্ধু-কাবেরির দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাবি, কবে থামবে জলযুদ্ধ। না, শুরু হয়ে গেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ? বিনা জলে আমি কার থেকে কাকে মুক্ত করব:  করোনা ভাইরাস, অবিশ্বাস না পাপবোধ। সংলাপের আর কোনো কথা আমার কানে যাচ্ছে না, ঘুমের মধ্যে আমি শুধু গোঙাতেই থাকি … গোঁ … গোঁ …


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন