শুধু নতুন জামাকাপড়, নতুন সিনেমা আর পুজোসংখ্যাই নয়, আগে পুজো মানে ছিল নতুন নাটক। পুজোর অনেক আগে থেকেই তৎপরতা শুরু হত উত্তর কলকাতার থিয়েটার পাড়ায়। এখন তা শুধুই অতীতের স্মৃতি। শুধু বাণিজ্যিক থিয়েটারগুলিই নয়, পুজোয় নতুন নাটক নামাতো দেবদ্বিজে ততটা ভক্তি না থাকা প্রগতিশীল নাট্যদলগুলি। পুজোয় দর্শক ধরতে তৎপর হত তারাও। তাদের শোগুলিতেও উপচে পড়তো দর্শক। কয়েক বছর আগে দেবশঙ্কর হালদারের এক স্মৃতিচারণায় এই তৎপরতার একটা ছবি পাওয়া যাচ্ছে। দেবশঙ্কর লিখছেন – কয়েকদশক আগেও একবার পুজোর সময় ষষ্ঠীর দিন জামশেদপুরে শো করে ট্রেন ধরে কলকাতায় ফিরে সপ্তমীতে শো করেছেন লন্ডনে। তারপর আবার কলকাতায় ফিরে নবমীর দিন শো করেছেন। এমনকি দশমীর দিনও বাঁকুড়ায় শো ছিল তার। বাংলা থিয়েটারের সোনালী দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় এই স্মৃতিচারণা।
পুজোয় এই নাটকীয় তৎপরতা উত্তর কলকাতার থিয়েটার পাড়ায় শুরু হয়ে যেত চতুর্থী-পঞ্চমী থেকে। তারও আগে থেকে চলতো প্রস্তুতির পালা, বিজ্ঞাপনে, হ্যান্ডবিলে আর নানাবিধ ঘোষণা ও উপহারে দর্শক টানতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন শহরের সবকটি থিয়েটার হলের মালিকরা। শুধু শহরের দর্শক নন, পুজোয় শহরে থিয়েটার দেখতে ভিড় জমাতেন মফস্বল ও গ্রামগঞ্জের দর্শক এবং প্রবাসী বাঙালিরাও।
অন্যদিকে দিল্লি, মুম্বই তো বটেই, সাগরপাড়ের লন্ডন, আমেরিকার মত জায়গাতেও প্রবাসী বাঙালিরা পুজোর সময় সে দেশ বা রাজ্যের নানাপ্রান্ত থেকে নাটক করা বা দেখার জন্য জড়ো হতেন বাঙালি অধ্যুষিত কোন বিশেষ এলাকায়। সেখানে দুর্গাপুজোর উদ্যোক্তারা কলকাতার নামী নাট্যদলগুলির শো’র আয়োজন করতেন। বহুরূপী, নান্দীকার, থিয়েটার ওয়ার্কশপ, সুন্দরম সবাই বিদেশে পুজো উপলক্ষ্যে শো করতে যেত। কলকাতার নামী নাট্যদলগুলির নাটক দেখার জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকতেন তারা। সে ঢেউ এখন অনেকটা স্থিমিত।
এই তৎপরতা শুধু বাণিজ্যিক আর গ্রুপ থিয়েটারে আটকে ছিল তা নয়। কলকাতার বহু বনেদী বাড়িতে থিয়েটার ছিল পুজোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। তা নিয়ে বাড়ির ছোট ও বড়দের মধ্যে মান-অভিমান, রেষারেষিও কম ছিল না। কে ভালো পার্ট পেলেন, কার খারাপ অভিনয় গোটা শো’টাকে ঝুলিয়ে দিল তা নিয়ে উতপ্ত হত সারা বাড়ি। শুধু বনেদী বাড়িই বা বলি কেন, শহরের বিভিন্ন পাড়ার বারোয়ারি মন্ডপগুলিতেও থিয়েটার নিয়ে উত্তেজনা বা হাস্যকর ঘটনাও কম ছিল না। কোন নাটক এবার অভিনীত হবে, কারা হবেন তার অভিনেতা, তা নিয়ে ব্যাপক ঝগড়াঝাঁটি হত পুজোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে। সবাই যাকে ‘এবার ফাটিয়ে দেব’ জাতীয় উত্তেজনায় ফুটতেন।
এ সবই বাঙালির জীবনের সঙ্গে থিয়েটার কতটা জড়িয়ে ছিল তার বড় প্রমাণ। পুজো সামনে আনতো এই নাট্যপ্রেমকে। অনেকেই মনে করতেন পার্ট না পেলে জীবন বৃথা। উল্টোটাও ঘটতো। কাজ উপলক্ষ্যে যারা শহরে থাকতেন তারা শহর থেকে ফিরতেন প্রবল থিয়েটার প্রেম নিয়ে। দেশে ফিরে থিয়েটারের আসর বসাতেন তারা। উত্তেজনা, ঝগড়াঝাঁটি সেখানেও কম ছিল না।
দেবসাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত চমৎকার পুজোবার্ষিকীগুলিতে পুজো উপলক্ষ্যে বাঙালির নাট্য উন্মাদনার একটা ছবি পাওয়া যায়। বিশিষ্ট নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য সৃষ্ট অমরেশ নামে একটি নাটকপাগল চরিত্র বাঙালির এই নাট্যপ্রেমকে জীবন্ত করে তুলতো। অবিভক্ত বাংলায় প্রায় সর্বত্রই ছিল এই থিয়েটার প্রেম। হাতিবাগানের থিয়েটারে সেসময় কোনটাতে অভিনীত হত মন্মথ রায়ের কারাগার আবার কোনটাতে অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের কর্নাজুন, আবার কোথাও মহেন্দ্র দত্তের উত্তরা। এসব নাটক দেখার স্মৃতি দর্শকদের মাথায় থাকতো। অভিনেতা, পরিস্থিতি, আয়োজন যাইহোক না কেন শহরের থিয়েটার দেখে অভ্যস্ত পরিচালকরা গ্রামের অভিনেতাদের কাছ থেকেও পেশাদার অভিনেতাদের দক্ষতা আশা করতেন। বহু সময়েই তা পেতেন না বলে তাদের মন খারাপ হত।
শহরের বন্ধ থিয়েটার হলগুলির দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। কোনটা বন্ধ হয়ে গেছে, কোনটা পা বাড়িয়ে রয়েছে প্রমোটারের গ্রাসে যাওয়ার জন্য। একমাত্র অ্যাকাডেমি ও মিনার্ভা ছাড়া শহরের প্রায় কোন মঞ্চেই এখন আর নিয়মিত অভিনয় হয় না। পুজোর জাঁকজমক এই শূন্যতাকে আরও প্রকট করে তোলে। পুজোয় চাই নতুন নাটক বলার লোকই যে এখন বড় কম!