২২৮ নং কিস্তি
নতুন বাড়িতে বিধানদাদের সঙ্গে কথা বলে নিচে নেমে এলাম। চারদিক শুনসান। বাড়ির পেছন দিক থেকে কাদের যেন গলার আওয়াজ পাচ্ছি।
বারান্দায় উঠতেই দেখলাম চিকনা, ভানু বেঞ্চে বসে কথা বলছে।
কিরে শুস নি।
এবার শোব।
কাল যাবি তো।
ইচ্ছে ছিল না। বড়োমা যে ভাবে চেপে ধরলো।
সবাই শুয়ে পড়েছে।
হ্যাঁ।
এবার লাইটগুলো নিভিয়ে দে।
আর একটু জলুক। ওরা সেপাশে কাজ করছে।
আবার কিসের কাজ!
এতো বাসন পত্র। গোছাতে হবে না।
সবাই চলে গেছে?
পাঁচু আছে, পচা চলেগেছে।
বাসু চলে গেছে?
হ্যাঁ।
কাল বাসু যাবে?
সবাই গেলে এখানে কে সামলাবে।
মীরচাচা আছে তো।
ভানু, বাসুকে ফোন করে বলে দে।
আমি হাসলাম। একটা বিড়ি দে।
আমার কাছে সিগারেট আছে। ভানুর কাছ থেকে নে।
কেন বিড়ি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস।
ভদ্দরলোক হচ্ছি।
চিকনার পাশে বেঞ্চে বসলাম।
তোর সঙ্গে কথা কইবে বলতিছে।
ভানু মনেহয় বাসুকে ফোন করেছে। কয়েকটা কথে বলে হ্যাঁ হুঁ করে ফোনটা চিকনার দিকে এগিয়ে দিল।
বিড়ি কাই রাখছু।
চিকনা পকেটে থেকে বিড়ির বান্ডিলটা বের করে দিল।
বল….বিড়ি অনি খাবে….শালা ঢ্যামনার গাছ….কি করবি, তার ইচ্ছে হয়েছে, মীরচাচাকে বলে দে….কালকের দিনটা ম্যানেজ করুক পর্শু বৈকাল বৈকাল চলে আসবো….হ্যাঁ মীরচাচা যেন গাড়ি পাঠায়।
আমি একটা বিড়ি ধরালাম।
হ্যাঁ শালা এখন মিটিং করে নামলেন। মৌজ করে বিড়ি খাচ্ছেন এবার শোবেন।
চিকনা ফোনটা পকেটে রেখে একটা বিড়ি ধরাল।
আমি চিকনার দিকে তাকিয়ে হাসছি।
হাঁইসা মরছু কেন।
তোর কথা শুনে।
অনাদির প্রেম উথলে উঠেঠে কেন।
সেটাই ভাবছি।
ভাবা তোর হইইছে।
আমি চিকনার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছি।
গ্রামে ঢুকলে বাঢ্ঢান খাবে।
কে মারবে? তুই।
আমি কেন। কতো লোক আছে। তোর প্ল্যানটা কি বলতো।
চুপ করে চিকনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
চুপ করে গেলি কেন বল।
বারান্দায় লাইট জ্বলছে। তার আলো হাত দশেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করেছে। খামারটা ঘুট ঘুটে অন্ধকার। আমি ওই দিকে তাকালাম।
জানিস চিকনা, আঠারো বছর পর যেদিন প্রথম চকে এসে নামলাম। সেদিন ভানুকে দেখে চিনতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। বুকের ভেতরে যন্ত্রণা অনুভব করেছিলাম।
এরপর পরিদা, উনামাস্টার আমি কিছুই ভুলি নি। ক্যালভার্টে দাঁড়িয়ে তোর কাঁধে হাত দিয়ে আমি কয়েকটা শপথ করেছিলাম। সেদিন তোর ভিঁজে ওঠা চোখ আমাকে এখনো যন্ত্রণা দেয়।
একা থাকলেই তোর ভেঁজা চোখ ভানুর জরাজীর্ণ শরীর আমার চোখে ভেসে ওঠে।
তোরা কোন অন্যায় করিস নি। তাহলে কেন তোদের শাস্তি পেতে হলো।
তুই চোদ্দদিন জেল খেটেছিস। অনাদিকে নব্বইদিন জেলের ঘানি ঘুরিয়েছি।
তুই গুলি খেয়েছিস, অনাদিকেও গুলি খাইয়েছি।
তুই ভিক্ষে করিস নি। ওকে বাটি হাতে ভিক্ষে করাবার ইচ্ছে আছে।
চিকনার মুখের দিকে তাকালাম। আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে।
তোকে কথা দিলাম ওকে মারবো না। মারলে আমার শরীরের জ্বালা জুড়বে না। ওকে আমার চোখের সামনে জীবনমৃত অবস্থায় ঘুরতে ফিরতে দেখবো। সবাই দেখবে।
কাকা-কাকী কোনও অন্যায় করে নি। ওরা গ্রামের সহজ সরল নিষ্পাপ মানুষ।
মনাকাকার কাছে বহুদিন কাকা এসে চোখের জল ফেলেছে। আমি চোখে দেখি নি। কানে শুনেছি। ওই বুড়ো বুড়ীর দীর্ঘশ্বাস কোন দিন বিফলে যাবে না।
কাকী ন’মাস দশদিন ওকে গর্ভে ধারণ করে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিল। কি প্রতিদান দিয়েছে ও।
তাঁরা তো ওর কাছে গাড়ি বাড়ি চায় নি। সুস্থ সাধারণ জীবন চেয়েছিল। সেটুকু ও দিতে পারল না। এতো ক্ষমতা ওর। ওর লোভের লকলকে জিভটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে আমি ওকে বোবা বানিয়ে দেব। আমায় একটু সময় দে।
চিকনা, ভানু দুজনে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমার চোখটা ভীষণ জ্বালা জ্বালা করছে।
কিরে তন্যে এউঠু বুইসে আছু বাসন-কোষনগা কাই রাখবো ক।
দু-জনেই আমাকে ছেড়ে দিল।
পাঁচু এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। তিনজনের মুখের দিকে তাকাল। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পেরেছে।
কিরে! কি হয়েছে?
চিকনা তাকাল পাঁচুর দিকে।
কিছু না।
কিছু না তো এই ভাবে বসে আছিস।
এমনি।
চল সে পাশটা গুছি লিয়ে টুকু শুই। ভানু উঠে দাঁড়াল।
চিকনা তবু বসে রইলো। ভানু, পাঁচুকে নিয়ে চলে গেল।
দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। চিকনার কাছ থেকে আর একটা বিড়ি চেয়ে খেলাম।
বাসুর দোকানের ছেলেটার কি ব্যবস্থা করলি।
মীরচাচা সব বার করেছে।
কতটা ক্ষতি করেছে।
অনেকটা।
সামলাতে পারবি।
পারবো।
ওই মেয়েটা।
নম্বরি মেয়েছেল। বলে দিয়েছি এরপর কিছু হলে গ্রাম ছাড়া করবো। পেছনে লোক লাগিয়ে দিয়েছি।
ভাল করেছিস।
যা তুই এখন শুয়ে পর। কাল সকালে উঠতে হবে।
অর্করা কোথায়।
ও বাড়ির বারান্দায়।
টাকাগুলো ঠিক ঠাক গুছিয়েছিস।
ওটা নিয়ে আর মাথা ঘামাই নি। সুবীর-ইসলামভাই ব্যবস্থা করছে। অনিমেষদার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে।
তুই শুবি না।
ভানু আসুক।
তোর গুরুমা কিছু বললো।
কি বিষয়ে।
আয়েষার ব্যাপারে।
আমি যতটুকু জানি বলেছি। মীরচাচার সঙ্গে মনে হয় কথা বলেছে।
ভেতরে চলে এলাম।
চিকনার বিছানটা টান টান করে পাতা। একটা মশারিও টাঙানো রয়েছে। মাথার শিয়রে কাকার ছবিটা জল জল করছে। একটা মালা লাগান রয়েছে।
কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
দাঁড়ালাম না। শিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম।
লম্বা বারান্দায় টানা বিছানা পাতা।
একদিকে অনিসারা আর একদিকে পক্কেরা। বসির পিকুকেও দেখলাম দলে আছে। দুটো টেবিল ফ্যান দুদিক থেকে ঘুরছে। অঘোরে ঘুমচ্ছে সকলে।
দরজাটা একটু ঠেলা দিতেই খুলে গেল। অবাক হলাম।
নিচে বিছানা পাতা হয়েছে মিলি, টিনা, অদিতি, সুরো, শ্রীপর্ণা শুয়ে খাটে ইসি, মিত্রা, তনু। একদিকের সোফায় কনিষ্ক উপুর হয়ে শুয়ে আর এক দিকের সোফায় নীরু, বটা হেলে রয়েছে।
আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখলাম। হাসিও পাচ্ছে।
আমার শোবার জায়গা কোথায়?
দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে নিচে নেমে এলাম। চিকনার বিছানা শূন্য। তারমানে এখনো কাজ শেষ করে আসে নি। বাইরের দরজাটা খোলাই রয়েছে।
একবার এদিক ওদিক দেখলাম চারদিক শুনসান।
বাড়ির পেছন দিক থেকে হাল্কা কথার আওয়াজ ভেসে আসছে।
দনো মনো করে চিকনার খাটে মশারিটা খুলে টান টান হয়ে শুয়ে পরলাম।
হাজার চিন্তা মাথার মধ্যে কিলবিল করছে।
একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল একঠেলায় ঘুম চৌপাট।
চোখ খুলে দেখলাম সামনে নীরু দাঁড়িয়ে।
হারামী, আমরা ওপরে মোমবাতি নিয়ে বসে আছি, তুমি এখানে মজমা মারছ।
আমি গেছিলাম। তোরা ঘুমচ্ছিলি। জায়গা পাই নি তাই এখানে শুয়ে পরলাম।
দেখলাম চিকনা-ভানুও রয়েছে।
তোদের কাজ শেষ হলো।
ভানু হাসছে।
দাঁত কেলাচ্ছিস কেন।
তান্যে আইসেঠে।
কারা!
ম্যাডামরা।
সবাই উঠে পড়েছে।
হ্যাঁ।
তোরা শুস নি।
তুই এউঠি শুইছিলু আমান্যে বাইরে মাদুর পেতে শুইছিলি।
কিগো নীরু তুলতে পেরেছ।
দেখলাম মিত্রা এগিয়ে এলো। পেছনে তনু, ইসি।
ব্যাপারটা কি বলতো। কানা রাতে সব বেরিয়ে পরেছিস।
বেশি কথা বলিস না। ফুল ব্যাটেলিয়ান সব নামছে। পাজামা পাঞ্জাবী পরাই আছে চেঞ্জ করার আর দরকার নেই চোখে মুখে একটু জল দিয়ে নে।
বুড়ো বয়সে কচি হওয়ার সখ জেগেছে।
অনি কি বলছে ম্যাডাম। কনিষ্কর গলা পেলাম।
এখনো ওঠে নি।
ওপর থেকে ফিস ফিস গুজ গুজ শব্দ ভেসে আসছে। কনিষ্ক সামনে এসে দাঁড়াল।
কাল ঘরে তাড়াতাড়ি ঢুকলে এই দুর্ভোগটা ভুগতে হতো না।
শোবার জায়গা রেখেছিলি।
একবার ডাকতে পারতিস।
কেন ডাকবো।
কথায় কথা বারে। ঝট করে উঠে পর। সকালের দীঘা আড়িটা দেখা হয় নি। ম্যাডামের মুখ গল্প শুনে শুনে হেজে গেছি।
রস উথলে উঠছে।
এখন পরন্ত বেলা। একটু বেশি উথলে উঠছে। বটা।
তোরা পারবি না। আমাকে হাত লাগাতে হবে। বটা এগিয়ে এলো।
কাঁচা ঘুমটা….।
গাড়িতে যেতে যেতে পাকা করে নিস। ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে। একপাক মেরে আসা যাবে। কনিষ্ক কথা বলছে সবাই হাসছে।
কিগো মা, বাবা এখনো ওঠে নি।
মেয়েরা সকলে শিঁড়ি দিয়ে নেমে কাছে এগিয়ে এলো।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসছে।
ওঠো ওঠো দেরি করো না, দিদান সাতটায় বেরবে বলেছে।
তোরা বেরিয়ে যা।
তাহলে অনেক আগেই চলে যেতাম তুমি জানতেই পারতে না।
মিলিরা খাটের কাছে এসে দাঁড়াল।
অনিদা দেখতো ড্রেসটা ঠিক আছে কিনা।
আমাকে জিজ্ঞাসা করছো কেন কনিষ্ককে জিজ্ঞাসা করো।
সব্বনাশ এতো ভূতের মুখে রাম নাম। নীরু বলে উঠলো।
সবাই হেসে উঠলো।
আস্তে আস্তে। ও বাড়ির সব উঠে পরলে এখুনি ঝামেলা হয়ে যাবে। বটা বললো।
বাধ্য হয়ে অনিচ্ছা সত্বেও উঠে বসলাম। চিকনার দিকে তাকালাম।
তুই যাবি নাকি।
না তোরা যা আমি এদিকটা একটু সামলে নিই।
ভূত তলার ওখানে কাদা আছে?
একটু আধটু আছে। তুই বাঁধে বাঁধে চলে যা।
কটা বাজে।
চারটে পাঁচ।
বসিররা দেখলাম সকলে ওপর থেকে নীচে নেমে এসেছে।
সকলেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কম বেশি হাসাহাসি করছে।
তনুর মুখের দিকে তাকালাম।
বাজে কথা একবারে বলবে না। মেয়ে সামনে আছে।
প্ল্যানটা কার শুনি।
তুই চল না পরে বলছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মিত্রা হির হির করে হাত ধরে টেনে বাইরের বারান্দায় নিয়ে এলো।
বাধ্য হয়ে ওদের সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। চিকনা, ভানু দুজনেই হাসছে।
খামারে এসে দাঁড়ালাম। আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদ নেই। তারাগুলো মিট মিট করে জ্বলছে।
সুরো এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরলো।
আজ আমি তোমার হাতটা ধরবো।
কেন বরকে সঙ্গে নে।
ওটা বেঢপ রস-কষ নেই। খালি ভঁস ভঁস। কালকে বললাম সকালে এরকম একটা প্রোগ্রাম আছে যাবে নাকি। বললো, তুমি যাও ঘণ্টা দুয়েক বেশি ঘুমলে শরীর সুস্থ থাকবে।
দেখলাম বাড়ির পেছন দিক দিয়ে নাগেশ বনি অর্ক অরিত্র সন্দীপরা বেরিয়ে এলো।
কিরে মিত্রা ওরা তো এবাড়িতে শুয়ে ছিল।
তোর অসুবিধে আছে।
ডাকাত বলে যদি গ্রামের লোক পেটে আমি ফেলে ফুলে দৌড় লাগাব।
কেউ পিটবে না।
হাঁটা আরম্ভ করলাম।
এখন মাঠ ভড়া ধান। গাঙ্গুলী বাড়ির পুকুর ধার দিয়ে বাঁশ বাগানে ঢুকলাম।
লম্বা করে লাইন দিয়ে চলেছি।
গাঙ্গুলী বাড়ির পুকুর ধার দিয়ে চলে এলাম সেই কঁয়েৎ বেল গাছের তলায়।
ওপরের দিকে তাকালে দু-একটা চোখে পরতেও পারে। মেঠো রাস্তায় এঁকে বেঁকে চলেছি। স্নেহময়ী সন্তানের ভারে ধানগাছগুলো নুয়ে পড়েছে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে মাতৃত্বের জৌলুস।
আর কয়েকদিন পরেই মাঠ থেকে ধান চলে যাবে খামারে। তারপর ঝাড়াই বাছাই করে হামারে তোলা হবে। পরের চাষ ওঠার আগে পর্যন্ত খাওয়ার ধান টুকু রেখে উদ্বৃত্ত ধান বেচে ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ হবে। ঘর-গৃহস্থলির কিছু জিনিষ-পত্র কেনা হবে।
কনিষ্ক ওই যে উঁচু ঢিবিটার ওপর বট গাছটা দেখছো। ওটা ভূততলা।
মিত্রা চেঁচিয়ে উঠলো।
বুবুন তুই অতো তাড়াতাড়ি হাঁটছিস কেন। একটু আস্তে চল না।
অনিদা ঘোঁড়ার মতো টগবগ টগবগ করে চলেছে। অদিতি বললো।
থমকে দাঁড়ালাম। পেছন ফিরে দেখলাম ওরা একটু পিছিয়ে পড়েছে। ফাঁকা মাঠে গোল হয়ে মিত্রাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে।
হয়তো মিত্রা ওদের গল্প বলছে। মিহি শব্দ ভেসে আসছে।
মেয়েরা তাদের দুই মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে।
দেরি করিসনা, অনেকটা পথ যেতে হবে। আমি বললাম।
ম্যাডাম তোমার সেই পটি বনটা দেখিও। নীরু বলে উঠলো।
কেন তুমি করবে। শ্রীপর্ণার গলা পেলাম।
তোমার টর্চটা জেলে রাখবে। না হলে সরাত করে কাতলা মাছ, তারপর বুঝতে পারছো।
আমার টর্চ নেই তোমারটা জালো।
সবাই হেসে উঠলো।
ধ্যুস ধ্যুস। মিলি চেঁচিয়ে উঠলো।
শ্রীপর্ণাদি মুখের লাগামটা একটু বাঁধো। টিনা বললো।
ও যেমন, ওকে বলতে পারছো না।
কাকে বলবে।
ওরা হাঁটতে শুরু করলো, আমিও হাঁটছি।
তখন প্রচুর গাছ ছিল এখন কমে গেছে। মিত্রা বললো।
বাঁধের ওপর এসে দাঁড়ালাম। নদী শুকিয়ে খটখটে। আগের থেকে চাষবাস বেরে গেছে। তাই গ্রীষ্মে আর নদীতে জল থাকে না। সবটাই চাষের কাজে লেগে যায়।
মিত্রা বলে চলেছে। এটা ওই ওটা সেই।
মা সেই খেঁজুরগাছটা কোথায়? অনিসা বলে উঠলো।
আর বলিস না। তোর মায়ের খেঁজুর গাছ, আমাদের হারুজানার কালা। মিলি বলে উঠলো।
ওরা নিজেরাই হাসাহাসি করছে।
শীতকাল হলে ভাল হতো তাই না মিলি মনি।
খেঁজুর রস খাওয়া যেত কি বল।
অনিসা, অনিকারা হাসছে।
টিনা মনি।
বল।
তোমার মনে আছে।
রস খাওয়ার অংশটুকু মনে নেই। তবে পরের অংশটুকু সারা জীবন ভুলবো না।
উঃ যা দৌড়টা দৌড়েছিলাম। অদিতি বললো।
হাসি থেমে নেই।
তোমরা বাবার সঙ্গে কত মজা করেছ। আমি যদি তখন জম্মাতাম খুব ভাল হতো।
তনু অনিসার দিকে তাকিয়ে হেসেই যাচ্ছে।
বাবা শ্যাম আঙ্কেলের ওখানে গিয়ে মহুয়া খাব।
তোর বাপ ও সব খায় না। বৈষ্ণব। নীরু বললো।
বাঁধের ওপর দিয়ে লম্বা লাইন করে আমরা চলেছি।
ওরা ঘন ঘন থমকে দাঁড়াচ্ছে। আমাকেও ওদের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে দাঁড়িয়ে পরতে হচ্ছে।
তোমায় এখানে নাচিয়েছিল। নীরুর গলা পেলাম।
মিত্রা নীরুর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
ও বললো আর তুমি নাচলে?
চারদিকে দম ফাটা হাসির শব্দ। ফাঁকা মাঠে সেই হাসির শব্দ রিনিঝিনি হয়ে ছরিয়ে পরছে।
প্লিজ ম্যাডাম তুমি একটু নেচে দেখাও কেমন করে নেচেছিলে। বটার গলা পেলাম।
ও শালা তখন কি করছিল। নীরু বললো।
একটা বিতিগিচ্ছিরি মুখ করে বললো, কুত্তার পেটে ঘি শয় না।
অনিকা ওখান থেকেই আমার দিকে কট কট করে তাকিয়ে আছে।
আমি যে হাসছি না তা নয়। তবে ওদের মতো নয়।
পাজামা পাঞ্জাবী পরে ওই গাছে উঠে পরলো। বটা বলে উঠলো।
ওই যে আগের বনটা দেখালাম।
হ্যাঁ।
ওখানে তখন অনেকগুলো পেঁপে গাছ ছিল, ওখান থেকে পেঁপে ডাল ভাঙল। তখনতো অতো বুঝি নি, ও এই কীর্তি করবে। প্রথম গ্রামে এসেছি। এর আগে টাকির শহুরে গ্রাম দেখেছি।
মামা, দিদির কেশটা এই মওকায় ঝেরে দিই। পক্কে চাঁচাল।
কেন শুধু আমার একার, তোদের নেই। অনিকা তার ওপর চেঁচাল।
আবার লেগে পরলো ওরা।
সন্দীপরা হাসতে হাসতে এগিয়ে এসেছে।
দ্বীপায়ন এসে জরিয়ে ধরলো।
হ্যাটস অফ অনিদা। মাঝে মাঝে টুকরে টুকরো গল্প শুনেছি। এখানে এসে লাইভ দেখছি।
পূব আকাশে ভোরের আলো ছরিয়ে পরছে।
যেদিকে চোখ যায় যতদূর চোখ যায় ঘন সবুজ।
এই রাস্তাতেই যার খেঁজুর গাছ তার সঙ্গে দেখা। তখন বুবুন কি তাপ্পি দিল। আমি যেই হেঁসে ফেলেছি আমার মুখ টিপে দিয়ে বললো।
ছাগল, বুঝতে পারলে এখুনি গুষ্টি উদ্ধার করে দেবে। তাড়াতাড়ি পা চালা।
মিত্রা কনিষ্কর দিকে তাকাল।
তুমি বলো কনিষ্ক এক পেট রস খেয়ে তাড়াতাড়ি পা চালান যায়।
সেই জন্য দ্বিতীয়বার গুছিয়ে এ্যাটেম নিলে। নীরু বললো।
তুই এ্যাটেম নিবি। বটা বললো।
তোকে কথা বলতে বলেছি।
হাসি থেমে নেই।
বাঁধের ওপর দিয়ে যেতে যেতেই পূব আকাশটা কমলা হয়ে উঠলো।
সবার হাতের মোবাইল কথা বলে উঠলো।
পটাপট যে যার নিজের খেয়ালে মোবাইলের ক্যামেরায় ক্ষণিকের স্মৃতি বন্দি করে নিচ্ছে।
তনুদি একবার আসবে। সায়ন্তন বললো।
কেন।
কয়েকটা ছবি তুলে দাও।
তুই তোল না।
তোমার চোখ আমার চোখের মধ্যে অনেক তফাৎ।
ছাপা হলে বিলটা তনুর এ্যাকাউন্টে যাবে, তোর এ্যাকাউন্টে যাবে না। সন্দীপ বললো।
ঘুঁটি বাজি বার করে দেব। এখুনি অনিদার কানে বাঁশিটা বাজাব।
কেন চুলকুনি হয়েছে। কলকাতায় চল মলম কিনে দেব।
আমি দ্বীপায়নের দিকে তাকালাম।
ছারো তো সায়ন্তনের কথা। দিনরাত সন্দীপদার পেছনে লেগে রয়েছে।
সুমন্তকে দেখেছিস কেমন ভাবুক হয়ে পড়েছে। সন্দীপ বললো।
সুমন্ত একবার ঘুরে তাকাল। নিউজ ছাড়া কিছু বোঝ। তাকিয়ে দেখো কতো ফিচার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দু-একটা তুলতে পারো তো।
সন্দীপ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
ব্যাপারটা এরকম মালটা কিরকম বানিয়েছি বল। ছোট্ট করে একটা থ্যাঙ্কস দে।
হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম পদ্মপুকুর। গ্রীষ্মের দাবদাহে জল অনেকটা মরে গেছে। তবু যে টুকু জল আছে, তাতে বেশ কয়েকটা পদ্ম ফুটে রয়েছে।
মিত্রাদের জালায় ঘন ঘন থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে। অনিকা অনিসা নম্রতা তরবর তরবর করে চলেছে। চোখ চলে গেল অনন্য সুন্দরের দিকে। দুজনকে বড়ো অন্যমনস্ক লাগছে।
ওদের চোখ বলছে প্রকৃতির এতো লালিত্য ওরা এর আগে এতো কাছ থেকে দেখে নি।
আমি এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছি।
ওরা পায়ে পায়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল।
বাবা তুমি যখন ছোট ছিলে তখন এখানে একা একা আসতে?
অনন্যর মুখের দিকে তাকালাম।
হ্যাঁ।
তোমার ভয় করতো না।
তোরা যখন শহরের রাস্তা ঘাটে একা একা বেরতিস তখন তোদের ভয় করতো।
ঠিক বলেছো।
তোরা আগে এই পথে আসিস নি?
চিন্তামই না। দীঘা আড়ি গেছি অনাদিকাকার বাড়ির পাশ দিয়ে।
ওটা চন্দ্রপারা।
ওই রাস্তা থেকে এই রাস্তাটা আরও বেশি রোমান্টিক।
ছেলের কথা শুনে হেসে ফেললাম।
এখন লোক বসতি আগের থেকে বেরে গেছে গাছপালাও কমে গেছে।
কেন!
গ্রামের মানুষ এখনো কাঠের জাল, মাটির বাসন কোষণে রান্নাবান্না করে। জালন পাবে কোথায়? তাই গাছের ডালপালা কেটে নিয়ে যায়।
কেউ বারন করে না।
কে বারন করবে।
ওরা কেমন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁরে। এখনো গ্রামে গঞ্জে এরকম অনেক জায়গা পরে রয়েছে। যার কোন মালিক নেই। গ্রামের পরিভাষায় বলে ইজমালি। সবার সম্পত্তি।
তোমার মুখ থেকে কথাটা আগে শুনেছি ঠিক বিশ্বাস হয় নি।
বিশ্বাস না হওয়ার কিছু নেই। বড়ো আদ্ভূত আমাদের জীবনটা। অনেকটা কুকুর বেড়ালের সংসারের মতো।
সুন্দর হাসলো।
তোমার সেই মানব সম্পদ।
হ্যাঁ।
অনন্য সুন্দরের দিকে তাকাল।
ড্যাড একবার আমাকে বুঝিয়েছিল মাথায় ঢোকে নি।
কি রকম।
ড্যাড আর একবার বলবে।
হাসলাম।
মিত্রারা তখনো ওখানে দাঁড়িয়ে গুলতানি করে চলেছে। নিজেদের মধ্যেই হাসাহাসি করছে।
আমি অনন্য সুন্দর ধীর পায়ে সামনের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।
দীঘির পারে একটা বড়ো শিরীষ গাছের তলায় এসে তিনজনে দাঁড়ালাম। নরম সূর্যের আলো চারদিকে ছরিয়ে পড়েছে। অসংখ্য পাখির কিচির মিচির। যে যার আপন ভাষায় কথা বলে চলেছে।
এই সময়টা প্রকৃতিকে বড়ো মায়াবী লাগে। দূরে দীঘা আড়ির টলটলে দীঘির জল দেখা যাচ্ছে।
এগুলো আমার শোনা কথা। ইতিহাস ঘেঁটে সত্য উদ্ঘাটন করার ইচ্ছে হয় নি।
দুজনেই আমার দিকে তাকাল।
আমরা তিনজনেই দীঘির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
মনাকাকার মুখ থেকেও দু-চারবার শুনেছি।
মনাকাকার শৈশবে গ্রামটা এতটা ছড়ান ছিটান ছিল না।
মাত্র কয়েক ঘর নিয়ে আমাদের গ্রাম। লোক সংখ্যা বড়ো জোর গোটা পঞ্চাশ।
আমাদের জমিদার ছিল দত্তরা। তাদের পরিবার একসময় উড়িষ্যাতে বসবাস করতেন। আমাদের এই অঞ্চলটাও একসময় উড়িষ্যার ভূখন্ডের অন্তর্ভূক্ত ছিল।
শুনেছি দত্তদের পূর্ব পুরুষদের ওকালতি ব্যবসা ছিল। বেশ নামকরা উকিল ছিলেন। তিনি নাকি কোন একসময় উড়িষ্যার রাজার কোন একটা প্রায় হেরে যাওয়া মক্কদমা জিতিয়ে দিয়েছিলেন।
তাই রাজা খুশী হয়ে এই অঞ্চলের কয়েক হাজার একর জমি তাঁকে দান করলেন।
ভদ্রলোক উকিল থেকে জমিদার বনেগেলেন।
স্থায়ী ভাবে বসতি স্থাপন করলেন এখানে।
একটা সঙ্ঘবদ্ধ সমাজ তৈরি করতে গেলে কামার, কুমোর, তেলি, হাঁড়ি, ডোম, নাপিত, ভাট, ধোপা, ব্রাহ্মণের প্রয়োজন। যেমন মনাকাকার দাদু। শুনেছি তিনি কৃষ্ণনগরের আশে পাশে থাকতেন। পূজা-অর্চনা বেশ ভালই করতেন। চৌহদ্দিতে তার নামডাকও বেশ ছিল।
এ তল্লাটে কোন ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল না। জমিদার বাবু মন্দির প্রতিষ্ঠা করার পর কোন এক সূত্র ধরে মনাকাকার দাদুকে সেখান থেকে ধরে আনলেন।
একেবারে জমিদারের গৃহদেবতার পুরোহিত।
তিনি এমনি এমনি আসবেন কেন?
তিনি আসলেন সঙ্গে তার পরিবার আর গৃহদেবতা। তা জমিদার মশাই সেই গৃহদেবতার নামে বেশ কয়েক একর জমি দান করলেন। আর মনাকাকার দাদুর নামে আরও কয়েক একর।
চাষবাস করো খাও।
জাতপাতের ব্যাপারটা তখন বেশ রমরমিয়ে চলছে। বলতে পারিস নীচু জাতের কারুর ছায়া যদি ব্রাহ্মণের গায়ে পরতো তাহলে তিনি স্নান করতেন।
অনন্য সুন্দর দুজনেই হাসছে।
নীচু জাত তায় অশিক্ষিত। ব্রাহ্মণরা জাতিশ্রেষ্ঠ শিক্ষিত। সবাই মান্নিগণ্যি করে।
তিনি এবার তার দু-চারজন ব্রাহ্মণ বন্ধুকে হায়ার করে আনলেন তার নিজের এলাকা থেকে। যেহেতু জমিদার বাড়ির পুরোহিত, জমিদার মশাই তার কথা একটু আধটু শোনেন তাই তিনিও ছোট-খাটো এলাকাতুত জমিদার বনে গেলেন।
অনন্য হাসলো।
একটু ভেবে দেখ এটাই রুঢ় বাস্তব। আমাদের সমাজে এই যে সব জাতি রয়েছে এরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের পরিপূরক।
ঘর গৃহস্থলির জিনিষের জন্য কামার কুমোর এলো। ব্রাহ্মণ তো আর হাঁড়ি খুন্তি বানাবে না। কিংবা মাটির তৈরি কলসী, খাবরি। সেগুলো কামার কিংবা কুমোরকেই বানাতে হবে।
ঠিক তেমনি কামার কুমরের ইচ্ছে হলো বাড়িতে একটু ঠাকুর পূজো করি তখন ব্রাহ্মণ মশাই পূজোটা করে দিলেন। ঠিক সেই ভাবেই চুল দারি কাটতে হবে তার জন্য নাপিত এলো। মরেগেলে দাহ করতে হবে এলো ডোম।
অতএব আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নিড থেকেই জাত পাতের উৎপত্তি।
ভাটটা কি বাবা।
এদের মতো ওরাও একটা সম্প্রদায়।
খালের ধারের ওই পাশের পারাটা ভাটপারা।
হ্যাঁ।
ওরাও কি এখানকার আদি বাসিন্দা।
না। ওদের আদি বাসভূমি যতদূর সম্ভব হুগলী। ওদের পেশা পট আঁকা। পটের ছবি এঁকে বাড়ি বাড়ি পটে আঁকা ছবির গল্প বলে জীবিকা নির্বাহ করতো।
জমিদারবাবু ওদের এই গুণটা দেখে নিজের তালুকে নিয়ে এলেন।
এখানে ওদের কাজ ছিল সংবাদ সংগ্রহ এবং পরিবেশন।
জার্ণালিস্ট। সুন্দর বললো।
আমি হাসলাম।
কিরকম। দারুণ ইন্টারেস্টিং। অনন্য বললো।
তখনতো আর প্রিন্টিং মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া ছিল না। কিন্তু জমিদার মহাশয়ের অনেক সংবাদ পরিবেশন করতে হতো। যেমন জমির খাজনা এই মাসের মধ্যে দিতে হবে। তা জমিদারতো নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলতো না। তার জন্য লোক ছিল। কিংবা জমিদার বাড়ির কোন উৎসব হবে গ্রামবাসী পারা প্রতিবেশীকে জানাতে হবে।
ভারি অদ্ভূত বুঝলি। খুব ছোট সময়ে দেখতাম। ওই পাড়ার যারা সমত্ত পুরুষ তারা কাঁধে একটা ঢোল নিয়ে গ্রামের হাটে হাটে কিংবা পথে পথে ঢোল বাজিয়ে বলতো, শোন শোন সবাই, আজ জমিদার বাবুর কাছারীর সামনের আঙিনায় কবিগাণ হবে। জমিদার বাবু সকলকে যেতে আজ্ঞা করেছেন। ডুম ডুম ডুম করে ঢাক বাজলো।
আমরা ছোটরা হৈ হৈ করে দৌড়ে আসতাম, ঢ্যারা পেটান অলা এসেছে।
ঢোলটা নিয়ে তখন কতো স্বপ্ন। দু-একবার ওদের কাছ থেকে কাঠি নিয়ে ঢোল বাজিয়েছি।
বেশ কয়েকদিন মনের মধ্যে ঢোলের নেশাটা চাগিয়ে বসলো। ঢোলতো পেলাম না। একটা বাঁশের বেঁকারি জোগাড় করে বাড়ি ঘরের কোন দরজা জানলা বাকি রাখলাম না। সারাদিন রাত আমিও ঢ্যারা পেটাতে লাগলাম। আর ওদের নকল করে বলতে শুরু করলাম।
ওরা হাসছে।
ভাট কথার ডিক্সনারিক্যাল মিনিং?
কনো অভিজাত বা উঁচু বংশের স্তুতিমূলক পরিচয় গেয়ে শোনানোই যাদের জীবিকা, এককথায় স্তুতিপাঠক, বন্দনাগানের গায়ক।
পরে জেনেছি ওদের সম্প্রদায়েও উঁচু নীচু ভেদাভেদ আছে।
পটুয়ারা একটা সম্প্রদায়। আমাদের গ্রামে যারা আছে এরা একটা সম্প্রদায়।
আমাদের এখানকার ভাটেরা একটু উঁচু সম্প্রদায়ের যেহেতু এরা জমিদারের সংস্পর্শে ছিল।
এদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রাহ্মণ। পৈতেও হয়েছে।
কি রকম! অনন্য বললো।
হাসলাম। আমার হাসির অর্থ ওরা বুঝতে পেরেছে।
এখন আমরা এ্যাডাল্ট তুমি নির্দিধায় বলতে পার।
পেছন থেকে হাসির রোল উঠলো। চমকে পেছনে তাকালাম। দেখলাম মিত্রারা একটু দূরে সকলে দাঁড়িয়ে। সকলে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো।
এ্যাকচুয়েলি ভাটেদের কোন যুবতীর সঙ্গে ব্রাহ্মণ পরিবারের কোন যুবকের অবৈধ সম্পর্কের যে ফসল তারাই পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ হয়ে পরলো।
এটাই আমি গেইজ করেছিলাম। সুন্দর বললো।
সুন্দর অনন্যর দিকে তাকাল।
তোর ভাসিলা ভেরির কথা মনে পরছে।
অনন্য মাথা দোলাল।
ডাটাগুলো ঠিক ঠাক রেখেছিস।
হ্যাঁ।
বড়ো জটিল আমাদের এই সমাজ শ্রেণীকরণ। আমি বললাম।
আবার একটু বড়ো হয়ে দেখেছি। কারুর বাড়ির কোন বিয়ে বা পৈতের অনুষ্ঠান হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ভাট পাড়ার লোকেদের ডাক পড়েছে।
কেন! অনন্যর চোখে বিষ্ময়।
আমাদের গ্রামের ঘরে যাদের বাড়ির অনুষ্ঠান সেই পরিবারের কেউ কোনদিন নিমন্ত্রণ করতে যায় না। ভাটপাড়ায় খবর পাঠালে কেউ না কেউ আসে। যিনি আসেন তাঁকে একটা সন্দেশের থালা, সন্দেশের থালাটা আবার পেতলের হতে হয়। পেতলের থালাটা কিন্তু নতুন হতে হবে। আর একটা নতুন ধুতি। সেইই গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রত্যেক বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আসে।
সন্দেশের থালা! নতুন কাপর! কেন?
আমাদের এখানে কোন অনুষ্ঠানের কার্ড করা হয় না। ধর গ্রামের একশোটা ঘরে নিমন্ত্রণ করতে হবে। তাঁকে একশোটা সন্দেশ দেওয়া হলো। তিনি প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে একটা করে সন্দেশ দেবেন, আর নিমন্ত্রনের বার্তা পৌঁছে দেবেন। সংবাদ শব্দের উৎপত্তি এই সন্দেশ থেকে। কারন ভাটেরা যে সন্দেশ বয়ে নিয়ে আসছে সেটা একটা সংবাদ।
অর্ক সুমন্ত আমাকে দুপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো।
সুমন্ত মালটা তুই নামাবি না। আমি নামাব। বাকিটা আমি জোগাড় করে নিচ্ছি। অর্ক বললো।
তুমি হাফ নামাও, আমি হাফ নামাই।
আমি কি কলা খাব। অরিত্র চেঁচিয়ে উঠলো।
তুই অন্য কিছু বাগা। অর্ক বললো।
ওরা হাসছে।
এখানকার সামাজিক স্ট্রাকচার আর শহরের সামাজিক স্ট্রাকচারের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
অনন্য সুন্দর আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
চল দেরি হয়ে যাবে।
বাবা তুমি কখনো কবিগান শুনেছো। অনিসা বললো।
মেয়ের মুখের দিকে তাকালাম।
হ্যাঁ।
কোথায়?
আগে আমাদের এখানে বাসন্তী পূজোর সময় একরাত্রি যাত্রার আসর বসতো, আর একরাত্রি কবিগাণের আসর বসতো।
এখন হয় না?
যাত্রাটা এখনো হয়, কবিগান আর হয় না।
কেন?
কেউ আর চর্চা করে না।
অনিদা কবিগানটা যেতে যেতে গিলব। এর সঙ্গে আর একটু এ্যাড করছি। গ্রামের ঘরে একটা সময় এন্টারটেনমেন্ট বলতে বোঝাত খেউর, খ্যামটা, কবিগান। অরিত্র বললো।
আমি অরিত্রর দিকে তাকালাম। হাসলাম।
এর ভাগ সুমন্ত অর্ককে দেবে না। আগেভাগে বুকিং করলাম।
ইসি হেসে উঠলো।
তোকে এরা গিলে খেলে শান্তি পাবে।
না ইসি ম্যাডাম। সে কথা বলবেন না। তখন ম্যাডাম যদি ইসারা না করতো এই রস থেকেও বঞ্চিত হতেন। পুরোটা দুই ভাইপো ভাগা ভাগি করে সটকে পরতো। আমাদের কপালে লবডঙ্কা জুটতো।
অনন্য, সুন্দর হাসছে।
প্রথমের টুকু একটু শেয়ার করিস। গুছিয়ে নামিয়ে দিতে পারবো। অর্ক বললো।
কবে দিবি। সন্দীপ বললো।
অর্ক, অরিত্র, সুমন্ত তিনজনেই সন্দীপের দিকে কট কট করে তাকিয়ে।
সন্দীপদা তুমি একবারে দাদার মতো শুরু করে দিলে। তনু বলে উঠলো।
সবাই হাসাহাসি করছে।
তুমি জানোনা তনু। এদের পেছনে টিক টিক না করলে মাল বেরবে না। বড্ড গেঁতো।
এ্যাডভান্স মাল দেবে সঙ্গে সঙ্গে স্লিপ আর ফটো পেয়ে যাবে। সায়ন্তন বললো।
(আবার আগামীকাল)
Dada,glpo ta ki ar ashbe naaa
Aj onk bchr hoi geloo
Ksto kre update den…