পাঁচ.
১৩১৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘সৌরভ’। প্রায় দুই যুগ নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছিল পত্রিকাটি। বাংলার বিখ্যাত পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’, ‘সাধনা’, ‘প্রবাসী’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘অরণি’, ’বান্ধব’ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে একাসনে বসার দাবি রাখে ‘সৌরভ’। ময়মনসিংহ তখন ঢাকার মতো শহর হয় নি। সেই সুদূর ময়মনসিংহ থেকে এ রকম পত্রিকা প্রকাশ করা এবং তার ধারাবাহিকতা বজার রাখা কেদারনাথের মতো মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। আর একটা কথা, এই পত্রিকায় মূলত ময়মনসিংহ ও পাশ্ববর্তী লেখকদের লেখাই প্রকাশিত হয়। কলকাতা বা ঢাকার লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকদের লেখার জন্য কেদরনাথ লালায়িত হন নি। এ বিষয়ে ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপদেশ সর্বদা স্মরণ রেখেছিলেন কেদারনাথ।
চন্দ্রকুমার দের বক্তব্যে এই বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, ‘কেদারনাথ তাঁহার সমস্ত কর্মশক্তি এককালে ময়মনসিংহের সাহিত্যিকগণের বিশ্ববিদ্যালয়স্বরূপ সৌরভে নিয়োজিত করিয়াছিলেন। তাঁহার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল ময়মনসিংহে একদল নতুন লেখক সৃষ্টি করা। বাঙ্গালার কোন উপবিভাগে বিশেষত ময়মনসিংহের মতো জিলায় একখানা মাসিকপত্র পরিচালনা করা কিরূপ কষ্টসাধ্য তাহা হয়ত কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হইবে না।’
এই পত্রিকার জন্য কেদারনাথ তাঁর আর্থিক ও মানসিক শক্তি ব্যয় করেছেন। শুধু তাই নয়, ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘বঙ্গদর্শন, ‘সবুজপত্র’ প্রভৃতি পত্রিকার মতো তিনি তৈরি করেছিলেন এক লেখকগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীতে ছিলেন চন্দ্রকুমার দে, সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, যতীন্দ্রনাথ মজুমদার, যতীন্দ্রমোহন সিংহ, পরমেশপ্রসন্ন রায়, অক্ষয়কুমার মজুমদার, অনঙ্গমোহন লাহিড়ী, কালীপ্রসন্ন চক্রবর্তী, প্রিয়গোবিন্দ দত্ত, উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিজয়নারায়ণ আচার্য, মনোরঞ্জন চৌধুরী, বনমালী গোস্বামী, রসিকচন্দ্র বসু, অমরচন্দ্র দত্ত, গিরিশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ, কুমুদচন্দ্র সিংহ, অমৃতলাল চক্রবর্তী, পূর্ণচন্দ্র ভট্টচার্য, অমরচন্দ্র দত্ত, গোবিন্দচন্দ্র দাস, সুন্দরী দাশগুপ্তা, হেরম্বচন্দ্র চৌধুরী, দ্বিজেন্দ্রচন্দ্র সিংহ, জিতেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী . মহেশচন্দ্র ভট্টচার্য, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, সুধীরকুমার চৌধুরী, ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহ, পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখেরা। এই গোষ্ঠীকে ‘কেদারমণ্ডলী’ নাম দিয়েছিলেন পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য।
কেদারনাথের লেখক তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে মজার কাহিনি বলেছেন চন্দ্রকুমার দে। প্রথমে তিনি ‘সৌরভে’ প্রকাশের জন্য তিনটি কবিতা পাঠান। সেগুলি প্রকাশিত হয় নি। চন্দ্রকুমার নিরুৎসাহিত হয়ে লেখা পাঠানো বন্ধ করেন। কিছুদিন বাদে তিনি কেদরনাথের একটি চিঠি পান। চিঠিতে লেখা — ‘একেবারে নিভিয়া গেলেন কেন?’ তারপর চন্দ্রকুমার ময়মনসিংহের মেয়েলি সংগীত বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠালেন। সে লেখাও অমনোনীত হল। চন্দ্রকুমার প্রতিজ্ঞা করলেন আর কোন লেখা পাঠাবেন না। তারপরে কেদারনাথ তাঁকে একটি চিঠিতে লিখলেন –‘তুমি আমার সঙ্গে দেখা কর’। দেখা হবার পর কেদারনাথ তাঁকে বাংলা বানান, বাক্যরচনাপদ্ধতি, বিষয়বিন্যাস সম্পর্কে অবহিত করেন।
কেদারনাথের উদ্যোগে ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সৌরভ সাহিত্য সংঘ’। এই সংঘের প্রথম সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত আইনজীবী সারদাচরণ ঘোষ দস্তিদার। যেসব বিশিষ্ট অতিথি উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন দুর্গাদাস রায়, রাজেন্দ্রকুমার শাস্ত্রী, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখ।
সংঘের প্রথম অধিবেশন প্রসঙ্গে ‘সৌরভ’ পত্রিকায় লেখা হয় —
‘ময়মনসিংহে সাহিত্যচর্চার জন্য একটি সুহৃদ সমাজের প্রতিষ্ঠা সৌরভের অন্যতম উদ্দেশ্য। একপ্রাণ একনিষ্ঠ একটি সুহৃদ সমাজের প্রতিষ্ঠা এবং সাহিত্যের উন্নতি একসূত্রে গ্রথিত। কাব্যই হউক আর ইতিহাসই হউক, দর্শনই হউক আর বিজ্ঞানই হউক, ভাবের বিনিময় না হইলে হৃদয়ের শক্তি সঞ্চার হয় না, তাহার অনুসন্ধান হয় না এবং সাহিত্যের অঙ্গ পুষ্ট হইতে পারে না। সাহিত্যের সৌরভে ময়মনসিংহের সাহিত্যসেবকগণ যদি সমবেত হইতে পারেন তাহা হইলে উহার অপেক্ষা আনন্দের বিষয় আর কি আছে ?’
কেদারনাথের নিরলস চেষ্টায় ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন মহকুমায় সাহিত্য সম্মেলন ও সাহিত্য আলোচনাসভার সূত্রপাত হয়। গঠিত হয় —
কিশোরগঞ্জের সাহিত্য সম্মিলনী,
গৌরীপুরের পূর্ণিমা সম্মেলন,
মুক্তাগাছার ত্রয়োদশী সমিতি,
জামালপুরের সাহিত্য সভা,
টাঙ্গাইলের সাহিত্য সংঘ,
নেত্রকোণার পূর্ণিমা সম্মিলনী।
সৌরভ সাহিত্য সংঘের লেখকদের কেদারনাথ ময়মনসিংহের গ্রাম্য শব্দ সংগ্রহ, প্রাচীন কবিদের গীত সংগ্রহে উৎসাহিত করেন। প্রাচীন লুপ্তপ্রায় সাহিত্য উদ্ধারে তাঁর আগ্রহ ছিল গভীর। পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যকে তিনি ঘাটুগান, সারি গান, রাখালের গান, মেয়েলি গীত সংগ্রহ করতে পরামর্শ দেন। মহেশচন্দ্র কবিভূষণকে পরামর্শ দেন রামগতির টপ্পা সংগ্রহ করতে। তাঁরই উৎসাহে চন্দ্রকুমার দে লোকগীতি সংগ্রহ শুরু করেন। তিনিই চন্দ্রকুমারকে দীনেশচন্দ্র সেনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি দীনেশচন্দ্রের অনেক ভ্রম-প্রমাদ সংশোধন করে দেন ; বিশ্ববিদ্যালয়ে ময়মনসিংহ গীতিকা পড়াতে গিয়ে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তথ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হলে কেদারনাথই তাঁকে সাহায্য করেন। [ক্রমশ]