হিপোলিট-প্রসপার-অলিভিয়ার ‘লিসা’ লিসাগ্যারি (Hippolyte-Prosper-Olivier “Lissa” Lissagaray) (১৮৩৮-১৯০১)
ফরাসি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক নেতা লিসাগ্যারি লিখেছিলেন প্যারি কমিউনের ইতিহাস (‘History of the Paris Commune 1871’)। এই বিপ্লবে তিনি নিজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইংল্যাণ্ডে ও সুইজারল্যাণ্ডে নির্বসিত বিপ্লবীদের সাক্ষ্য সংগ্রহ করছিলেন, যাচাই করেছিলেন তার সত্যতা। এই ইতিহাস লেখার ব্যাপারে কার্ল মার্কস তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। মার্কসের কন্যা এলেনর সেই বইএর ইংরেজি অনুবাদ করেন।
১৮৭১ থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত নির্বাসিত হয়ে তিনি লণ্ডনে ছিলেন এবং ছিলেন মার্কস পরিবারে। জেনি মার্কস, লরা ও তাঁর স্বামী পল লাফার্গ লিসাগ্যারিকে পছন্দ করতেন না। এলেনর কিন্তু তাঁর চেয়ে ১৭ বছরের বড় লিসাগ্যারির প্রেমে পড়েন। এ ব্যাপারে কার্ল মার্কসের মত না থাকলেও মেয়ের মুখ চেয়ে তিনি মেনে নেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পরে এলেনরই মত বদলে ফেলেন। লিসার সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
ম্যাক্সিলিয়েন জোসেফ মল (Maximilian Joseph Mall) (১৮১৩-১৮৪৯)
কোলোনের এক দরিদ্র শ্রমজীবী পরিবারে তাঁর জন্ম। ঘড়ি তৈরির কাজ শিখেছিলেন। কাজের সন্ধানে ইউরোপের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এক ‘জার্মান ওয়ার্কাস অ্যাসোসিয়েশনে’র সদস্যের সঙ্গে আলাপ হল। শ্রমজীবী সংগঠনে যোগ দিলেন। ১৮৩৪ সালে ‘ইয়ং জার্মানি’ নামক গুপ্ত সংগঠনেও নাম লেখালেন। শ্রমিক নেতা কার্ল শ্যাপারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। সুইজারল্যাণ্ড থেকে বহিষ্কৃত হয়ে প্যারিসে এলেন। সেখানে ‘লিগ অব দ্য জাস্টে’র সদস্য হলেন।
১৮৩৯ সালে ‘সোসাইটি অব দ্য সিজনস’ পরিচালিত বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শাসক শ্রেণি সে বিদ্রোহ দমন করতে ধর-পাকড়ের ভয়ে চলে এলেন ব্রিটেনে। লণ্ডনে তৈরি করলেন ‘জার্মান ওয়ার্কাস এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন’। কার্ল মার্কস ‘কমিউনিস্ট লিগ’ তৈরি করার পর তিনি তাতে যোগ দিলেন এবং পরে তার সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হন।
১৮৪৮ সালে চলে আসেন জার্মানিতে। সেখানে তিনি মার্কসবাদী ভাবধারা প্রচারে লিপ্ত হন। শাসকশ্রেণি তাঁকে গ্রেপ্তার করতে উদ্যত হলে তিনি লণ্ডনে চলে যান। ১৮৪৯ সালের মে মাসে বাডেনের বিদ্রোহে অংশ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
ফ্রানৎস সেবাস্টিয়ান সেইলার (Franz Sebastian Seiler) (১৮১০-১৮৯০)
তিনি উইলহেল্ম ওয়েটলিংএর সহযোগী, ‘রাইনিশে সাইতুং’এর সাংবাদিক এবং ‘ব্রাসেলস কমিউনিস্ট করসপনডেন্স কমিটি’র সদস্য। পরে তিনি যোগ দেন ‘কমিউনিস্ট লিগে’। ১৮৪৮-৪৯এর জার্মান বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য তিনি লণ্ডনে চলে যান। সেখানে ‘দেতুৎস সাইতুং’ এর সম্পাদক হন। পরে তিনি ‘দ্য নিউ অরলিনস জার্নাল’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। নিগ্রোদের ভোটাধিকারের জন্যও তিনি লড়াই করেছিলেন।
কার্ল ফ্রেডারিখ কোপেন (Karl Friedrich Köppen) (১৮০৮-১৮৬৩)
বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনো করেন। হেগেলের মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৮৩৭ সালে কার্ল মার্কসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং এই সাক্ষাৎ পরে পরিণত হয় বন্ধুত্বে। ১৮৪০ সালে তিনি আর্নল্ড রুজের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। বিজ্ঞান ও রাজনীতি বিষয়ে নানা সমালোচনামূলক নিবন্ধ লেখেন। কার্ল মার্কসের চিন্তাধারায় তিনি প্রভাবিত হন বলে তিনি তাঁর ‘ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট অ্যাণ্ড হিস অপোনেন্টস’ বইটি কার্ল মার্কসকে উৎসর্গ করেন।
অ্যাডলফ ফ্রেডারিখ রুটেনবার্গ (Adolf Friedrich Rutenberg) (১৮০৮-১৮৬৯)
দর্শন, ধর্মশাস্ত্র ও ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনো করেন রুটেনবার্গ। দীর্ঘদিন নিযুক্ত ছিলেন শিক্ষকতায়। রাজনৈতিক কারণে শিক্ষকতা থেকে বহিষ্কৃত হবার পরে যুক্ত হন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সঙ্গে। বার্লিনে তিনি ‘ডক্টরস ক্লাবে’র সঙ্গে যুক্ত হন। এই ক্লাবে আসতেন কার্ল মার্কস, কার্ল ফ্রেডারিখ কোপেন, ব্রুনো ও এডগার বাউয়ার। এখানেই মার্কসের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তাঁর।
১৮৪১ সালে তিনি ‘রাইনিশে সাইতুং’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। ১৮৪২ সালে কার্ল মার্কসের প্রস্তাবে তিনি পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক হন। জার্মানি ও প্রাশিয়ার বিষয়ে সম্পাদকীয় নিবন্ধ দেখার বিশেষ ভার ছিল তাঁর উপরে। কিন্তু তাঁর কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী তাঁকে বহিষ্কার করে মার্কসকে সম্পাদক করেন। পরবর্তীকালে রুটেনবার্গ প্রতিষ্ঠা করেন ‘ন্যাশনাল সাইতুং’। ‘মার্চ বিপ্লবে’ তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
লুই ইউজিন ভার্লিন (Louis Eugene Varlin) (১৮৩৯-১৮৭১)
এক কৃষক পরিবারে ভার্লিনের জন্ম। বই বাঁধাইের কাজের জন্য তিনি তিনি প্যারিসে যান। সেখানে তিনি ‘বুক বাইণ্ডার ট্রেড ইউনিয়ন’ গঠন করেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৮৬৪ সালে বুক বাইণ্ডাররা ধর্মঘট করেন। বুক বাইণ্ডার ইউনিয়নের প্রতিনিধিরূপে তিনি ১৮৬৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিকে, ১৮৬৬ তে জেনিভা কংগ্রেসে এবং ১৮৬৯ সালে বাসেল কংগ্রেসে যোগ দেন।
আন্তর্জাতিকে প্রুধোঁবাদীদের সঙ্গে মার্কসবাদীদের মতান্তর হলে ভার্লিন প্রুধোঁবাদীদের পক্ষে ছিলেন। ১৮৬৯ সালে তিনি ‘প্যারিসিয়ান ফেডারেশন অব ওয়ার্কাস অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন। ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ান যুদ্ধের ফলে ৩য় নেপোলিয়নের পতন হলে ভার্লিন প্যারিসের ‘রিপাবলিকান সেন্ট্রাল কমিটি’র সদস্য হন। ১৯৭০ সালের ২২ জানুয়ারির বিদ্রোহে, ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চের বিদ্রোহে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৮৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি প্যারি কমিউনের কাউন্সিলে নির্বাচিত হন।
কার্ল হাইনরিখ পিফাণ্ডার (Carl Heinrich Pfänder) (১৮১৯-১৮৭৬)
কার্ল হাইনরিখ পিফাণ্ডার (১৮১৯-১৮৭৬) পিফাণ্ডার মিউনিখ অ্যাকাডেমিতে কিছুকাল অঙ্কনবিদ্যা শিক্ষা করেন এবং তারপরে চলে আসেন লণ্ডনে। সেখানে বিয়ের পরে থাকতেন সোহোতে, মার্কসের বাড়ির কাছেই। ‘জার্মান ওয়ার্কাস এডুকেশন্যাল অ্যাসোসিয়েশনে’র সভায় যাতাযাত ছিল। ‘লিগ অব দ্য জাস্ট’-এর সদস্য হন ১৮৪৭ সালে। মার্কস ও এঙ্গেলসও এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। এই সংগঠন পরে পরিণত হয় ‘কমিউনিস্ট লিগে’। হাইনরিখ বাউয়ার, জোহান ইকারিয়াসের সঙ্গে পিফাণ্ডার ‘লণ্ডন কমিউনিস্ট লিগে’র নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
এর পর থেকে তিনি মার্কস ও এঙ্গেলসের সঙ্গে একযোগে কাজ করেন। তৈরি করেন ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সাপোর্ট কমিটি’, ‘কমিউনিস্ট লিগে’ কাজ করেন ফ্রেনোলজিস্ট হিসেবে, ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিংমেন’স অ্যাসোসিয়েশনে’র সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হন। (ক্রমশ)