কাঁসা পিতলের তৈজস কেন বাংলায় আর তৈরি হয় না (বাংলায় হয় না এটা অতিকথা – ভদ্রবিত্ত তার জীবনে কাঁসা পিতলকে টান মেরে ছুঁড়ে ফেলেছে কর্পোরেট নির্দেশে), সেটা নিয়ে বছর দুয়েক আগে একটা সাময়িকীতে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিতর্ক চলছিল। প্রবন্ধ এবং চিঠিপত্রে বোঝা গেল সব দোষ বেঁড়ে ব্যাটা ছোটলোক কারিগরের আর তার মাল বিক্রি করা কাঁসা-পিতলের দোকানদারদের। কারিগর-চাষী-হকার ছাড়া বাংলায় ভদ্রদের বাছা বাছা গালি খাওয়ার এমন পাত্র কেই বা আছে? কেউ বলেন বলেন কাঁসা পিতল আর পাড়ায় পাড়ায় পাওয়া যায় না। কেউ বলেন মোরাদাবাদের থেকে বাংলার পণ্যের দাম অনেক বেশি। ভদ্রবাবুদের বলা যাক, মোরাদাবাদ আর বাংলার কাঁসা পিতল উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে — মোরাদাবাদের পাত্রগুলো মূলত ছাঁচে ঢালাই, আর আমাদেরগুলো পেটাই। জ্ঞান, বুদ্ধি, দক্ষতা আর শ্রম মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি হয় বাংলার কাঁসা পিতলের অনন্য পণ্য। পার্থক্য দক্ষতায়, গুণমানে।
বাঙালি শিক্ষিত কর্পোরেট-বন্ধু ভদ্রলোকদের বলা যাক কাঁসা পিতলের পিটাইয়ের কাজ কেমন হয়।একটা পিতলের/কাঁসার গোলককে পিটিয়ে পিটিয়ে নির্দিষ্ট থালা বা বাটির আকারে আনা হয়। এই কাজ যে কত বড় অধীত জ্ঞান আর সামাজিক পরম্পরার দক্ষতায় সাধিত হয়, যন্ত্র নির্ভর প্রায় শ্রমবিহীন উৎপাদন ব্যবস্থাকে ভগবানের পর্যায়ে বসানো ভদ্রদের সে তত্ত্ব বোঝার কম্ম নয়। বাড়িতে ভদ্রবিত্তের পূর্বজরা যে কাঁসা-পিতলের তৈজস রেখেগিয়েছেন (যদি ইতিমধ্যে সেটি বিক্রি/বিদায় না করেন), সেই বাটি থালার অনেকগুলো তৈরি হয় একটা গোলোক পিটিয়ে পিটিয়ে, হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, একটা ধাতুর গোলোককে স্রেফ হাতুড়িতে পিটিয়ে পিটিয়ে থালা বা বাটির আকার দিয়ে। অন্যকে অশিক্ষিত দাগিয়ে দিয়ে, তুই তোকারি করে ব্যাপক ঔপনিবেশিক আত্ম্রপ্রসাদ অনুভাব করা বাঙালি অবলীলায় মোরাদাবাদের ছাঁচে ঢালাই পণ্যের দামের কৃতির ঐতিহ্যের সঙ্গে তুলনা করে খাগড়া বা দেবগ্রাম বা চন্দনপুরের কাঁসা পিতলের কাজ।
ভদ্ররা মাত্র কয়েক বছরের জীবনওয়ালা প্লাস্টিকের খেলনা ফোনের জন্য ৩০ হাজার টাকা খরচ করে, কিন্তু একটা সারাজীবনের পেটাই বাটির জন্য ১৫০/২০০ টাকা বা থালার জন্য ১০০০/১২০০ খরচ করে না, বলে বহুত দাম। ভাইরে ভাই একটা তুচ্ছ মেলামাইন ডিনার সেটের দাম কত?
তাছাড়া আপনি চাইলেও কারিগর কেন কাজ করবে? কেন? তার দাম আপনি দেবেন? আপনাকে কর্পোরেট/রাষ্ট্র বেতন দালালি দ্যায় এই অলিখিত শর্তে যে আপনি সেই অর্থ কর্পোরেটিয় উৎপাদন ব্যবস্থায় ঢেলে আসতে পারেন। বাংলা তথা ভারতজুড়ে কাঁসা পিতলের কাজ টিকে আছে ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রদের জন্য নয় গ্রামীনদের জন্য। ব্যতিক্রমী কয়েকটা বাড়ি বাদ দিলে শহরের ভদ্রবাড়িতে কাঁসা-পিতলের বাসন প্রায় অদৃশ্য। অথচ অভদ্রবাড়িতে একটা না একটা বাসন আপনি পাবেনই। আজও বিয়েতে, শ্রাদ্ধে, অন্নপ্রাশনে কাঁসা পিতল উপহার দিতে হয়। গ্রামীনেরা কাঁসা পিতলকে আজও বিনিয়োগযোগ্য পণ্য হিসেবে গণ্য করে। আপনি ভদ্র; আপনার বাড়িতে রং-বেরঙের প্লাস্টিকের বালতি ভর্তি অথচ বহু গ্রামীনের বাড়িতে আসজও অন্তত একটা পিতলের বালতি পাবেন। দেশিয় কারিগরি বাঁচাবার জন্যে এরকম একটাও আধুনিক রিচুয়াল আপনারা ভদ্রবিত্তরা বানান নি। শুধু কারিগরদের গালি দিয়ে করে কী মোক্ষ লাভ হয় নাই না। এই তাচ্ছিল্য আর কর্পোরেটিয় গালিই কারিগর বা কারিগরদের বিক্রেতাদের প্রাপ্য। বড়বাজারে বা মৌলালিতে বা চিতপুরে কাঁসা/পিতলের দোকানে গিয়ে কোনও দিন দেখেছেন তারা কি ভাবে ব্যবসা করে, বা এই কলকাতারই ঠনঠনিয়ার তারক প্রামাণিক রোডে বা খাগড়া বা দেবগ্রাম বা চন্দনপুরে গিয়ে কোনও দিন দেখেছেন পিটাই কারিগরেরা কীকরে পণ্য উৎপাদন করে? ভদ্ররা কী করে বুঝবেন কারিগরদের আর তার ব্যবসাদারদের বেদনা। গালি দিয়েই খালাস! দায় শেষ।
সব শেষে জেনে নিন চিতপুরের কাঁসারিপাড়ার কৃষ্ণকালী কুন্ডুর দোকানের কী কী কাঁসা পিতলের বাসন পাওয়া যায়। এই বৈচিত্র আমাদের জোর। একে ধরে রাখতে হবে
থালা : বগি থালা, পদ্মকটকি, হ্যাঁচা, লড কটকি, দুপিঠ বগি
বাটি : জামবাটি, নমুনা বাটি, শিউলি বাটি, আয়নাপল
গ্লাস : ধর্মদা, সরপোষ (ঢাকা দেওয়া), বেনারস গ্লাস
ঘড়া : সর্বসুন্দরী, লোহাজং
ডেচকি : বেনারসি
হাঁড়ি : আশিকি, বেনারস হাঁড়ি
কলসি : দাঁইহাট কলসি
ঘটি : মোহরপুর, বাবুঘটি, বেনারসি সিলভার লোটা, ডাবর, মুখ ডিবে, পান ডিবে ফুলদানি ইত্যাদি সৌখিন দ্রব্য
দেশের কারখানা কারিগর হকার চাষীর জীবকা বাঁচানোর অর্থ হল অলিখিত ভদ্রবিত্তের জন্যে বিনা খরচে সামাজিক সুরক্ষার বীমা অর্জন। দেশে থাকুন, দেশিয় অর্থনীতির পাশে থাকুন।
খুব ভালো l