শনিবার | ২৯শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৪:১৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
আত্মশুদ্ধির একটি বিশেষ দিন চৈত্র অমাবস্যা : রিঙ্কি সামন্ত চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয় : ড. দীপাঞ্জন দে রায়গঞ্জে অনুষ্ঠিত হল জৈব কৃষি বিপণন হাট অশোকবৃক্ষ, কালিদাসের কুমারসম্ভব থেকে অমর মিত্রর ধ্রুবপুত্র : অসিত দাস কৌতুকে হাসতে না পারলে কামড় তো লাগবেই : তপন মল্লিক চৌধুরী জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর ও রোহিঙ্গা সংকটে অগ্রগতি : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন এথেন্সের অ্যাগনোডাইস — ইতিহাসের প্রথম মহিলা চিকিৎসক : রিঙ্কি সামন্ত সন্‌জীদা খাতুন — আমার শিক্ষক : ড. মিল্টন বিশ্বাস হিমঘরগুলিতে রেকর্ড পরিমাণ আলু মজুত, সস্তা হতে পারে বাজার দর : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শিশুশিক্ষা : তারাপদ রায় জঙ্গলমহল জৈন ধর্মের এক লুপ্তভুমি : সসীমকুমার বাড়ৈ ওড়িশা-আসাম-ত্রিপুরার অশোকাষ্টমীর সঙ্গে দোলের সম্পর্ক : অসিত দাস পাপমোচনী একাদশী ব্রতমাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত ভগত সিংহের জেল নোটবুকের গল্প : কল্পনা পান্ডে নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘অমৃতসরী জায়কা’ মহিলা সংশোধনাগারগুলিতে অন্তঃসত্ত্বা একের পর এক কয়েদি, এক বছরে ১৯৬ শিশুর জন্ম : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ‘শোলে’র পঞ্চাশ বছর : সন্দীপন বিশ্বাস বিভাজনের রাজনীতি চালিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা ইতিহাস পালটাতে চায় : তপন মল্লিক চৌধুরী অশোক সম্পর্কে দু-চারটে কথা যা আমি জানি : অসিত দাস চৈত্রের শুরুতেই শৈবতীর্থ তারকেশ্বরে শুরু হলো সন্ন্যাস মেলা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম বাঙালি পরিচালকের প্রথম নির্বাক লাভ স্টোরি : রিঙ্কি সামন্ত গোপিনী সমভিব্যাহারে রাধাকৃষ্ণের হোলি ও ধ্যানী অশোকবৃক্ষ : অসিত দাস শেখাওয়াটির হোলী-হাভেলী : নন্দিনী অধিকারী সংস্কৃত সাহিত্যে অশোকবৃক্ষ যখন দোহলী : অসিত দাস প্রাণগৌরাঙ্গের প্রিয় পঞ্চব্যঞ্জন : রিঙ্কি সামন্ত ‘দ্য স্টোরিটেলার’ — শিল্প এবং বাজারের মধ্যে দ্বন্দ্ব : কল্পনা পান্ডে অপুষ্টি আর দারিদ্রতা ঢাকতে সরকার আর্থিক উন্নয়নের পরিসংখ্যান আওড়ায় : তপন মল্লিক চৌধুরী দোহলী মানে অশোকবৃক্ষ, তা থেকেই দোল ও হোলি : অসিত দাস সিনেমা প্রেমীদের হোলির গান : রিঙ্কি সামন্ত দোলের আগের দিনের চাঁচর নিয়ে চাঁচাছোলা কথা : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ দোলপূর্ণিমা ও হোলি ও বসন্ত উৎসবের  আন্তরিক শুভেচ্ছা শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কল্লোলের কাল : তপন মল্লিক চৌধুরী

তপন মল্লিক চৌধুরী / ৩১০ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৪

প্রথম সংখ্যা ১৯২৩-এর এপ্রিল (১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ), শেষ সংখ্যা ১৯২৯-এর ডিসেম্বর (১৩৩৬ বঙ্গাব্দের পৌষ)। সাত বছরে মোট ৮১ টি সংখ্যা। কিন্তু মাত্র এই ক’বছরেই পত্রিকাটি আলোড়ন তুলেছিল। বলা হয় অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত এই সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে রবীন্দ্র উত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পথ চলা শুরু হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার চর্চায় এই পত্রিকাটি একটি বিশেষ জায়গা দখল করে। যে কারণে ‘কল্লোল’ পত্রিকার সময়কালকে কল্লোল যুগ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছিল। একশো বছর পেরিয়ে এসেও তাই ‘কল্লোল’ আমাদের ভাবায়।

‘কল্লোল’-এর কথায় অবশ্যই বলতে হয় ফোর আর্টস নামে ক্লাবের কথা। এই ক্লাবের  মুখ্য প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশ এবং গোকুলচন্দ্র নাগ। গোকুলচন্দ্র তখন রোজ বসতেন তাঁর মামার নিউ মার্কেটের ফুলের স্টলে। সেই দোকানে নিয়মিত আসতেন দীনেশচন্দ্র। দুই বন্ধুর আড্ডা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ফোর আর্টস ক্লাব। ক্লাবে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলার চর্চা হত। প্রতিষ্ঠাতা দু’জন ক্লাবের আড্ডাতে মেয়েদের আসার কথাও ভেবেছিলেন। বস্তুতপক্ষে সেই ভাবনা থেকেই পরবর্তীকালে ‘কল্লোল’ পত্রিকাতে মহিলা লেখকদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য একটি দিক। দীনেশচন্দ্র আর গোকুলচন্দ্র দুজনেই ব্রাহ্মসমাজ সূত্রে পূর্বপরিচিত সুনীতি দেবীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ফোর আর্টস ক্লাবের প্রথম অধিবেশন সুনীতিদেবী স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলেন। কেবল তাই নয়, যতদিন ক্লাব ছিল সুনীতিদেবী ছিলেন তাঁর অন্যতম সংগঠক। প্রথম অধিবেশনে ক্লাবের আর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নিরুপমা দাশগুপ্ত একটি কথিকা পাঠ করেছিলেন।

তখনকার দিনে নারী পুরুষের যৌথ ক্লাবকে অনেকেই ঘরভাড়া দিতে রাজি ছিলেন না। নিরুপমা দেবী ও তাঁর স্বামী সুকুমার দাশগুপ্ত তাদের বাড়ির সামনের ঘরটি সামান্য ভাড়ার বিনিময়ে ক্লাবকে ব্যবহারের জন্য দেন। ক্লাবের নাম ছড়িয়ে যাওয়ায় অনেকে আসা শুরু করলে ছোট ঘরে আসর বসানো যেত না। তখন আসর বসত গ্রামে বা খোলা জায়গায়। ফোর আর্টস ক্লাবের অন্যতম সদস্য ছিলেন উমা দাশগুপ্ত, মায়াদেবী প্রমুখ। এছাড়াও শান্তা দেবী, সীতা দেবীর মতো সে সময়ের পরিচিত সাহিত্যিকেরা ক্লাবে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। এক সময় নিরুপমা দেবীর বাড়ি থেকে যখন ক্লাব সরে আসে, তখন মায়াদেবী তাঁর বাড়িতে ক্লাবের কয়েকটি অধিবেশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফোর আর্টস ক্লাবের উদ্যোগে কয়েকটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘ঝড়ের দোলা’ নামের একটি গল্প সংকলন। সেখানে দীনেশচন্দ্র দাশ, গোকুল নাগ, মণীন্দ্রলাল বসু এবং সুনীতিদেবীর লেখা চারটি গল্প ছিল।

নানা কারণে দু’বছরের মাথায় ফোর আর্টস ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন দীনেশচন্দ্র আর গোকুলচন্দ্র অন্য এক উদ্যোগের কথা ভাবতে থাকেন। ক্লাব থেকে নতুন একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করার স্বপ্ন তাঁদের অনেক দিনের। নতুন মানে যে পত্রিকা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা করবে। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেওয়ার আগেই ‘ফোর আর্টস ক্লাব’ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এবার দুই বন্ধু এক আড্ডায় একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, নাম ঠিক করলেন-‘কল্লোল’। সেদিন গোকুলের ব্যাগে এক টাকা আটআনা আর দীনেশের পকেটে দু’টাকা। সেই সম্বলটুকু নিয়েই রাতারাতি ছাপা হয়ে গেল কল্লোলের প্রথম হ্যান্ডবিল। কিন্তু শুধু হ্যান্ডবিলে তো হবে না, সাহিত্য পত্রিকায় তো চাই লেখা। ‘ফোর আর্টস ক্লাব’-এর সাহিত্য শাখার পুরোনো খাতা থেকে নাম ঠিকানা নিয়ে লেখার আমন্ত্রণ জানানো হল, সারাও মিললো। কিন্তু সেদিনও কেউ জানত না আচমকা ছাপানো এই পত্রিকা বাংলাসাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা করবে।

‘কল্লোল’-এর প্রথম সংখ্যাটি মাসিক গল্প সাহিত্যের পত্রিকা হিসেবেই বিজ্ঞাপিত হয়েছিল। বৈশাখ থেকে ভাদ্র সংখ্যা পর্যন্ত কল্লোল পত্রিকার প্রচ্ছদে মাসিক গল্প সাহিত্যের পত্রিকা কথাটি উল্লেখ ছিল। এমনকি আশ্বিন সংখ্যার জন্য প্রবাসী পত্রিকায় ‘কল্লোল’-এর যে বিজ্ঞাপণ বেরিয়েছিল সেখানেও একই উল্লেখ ছিল। কিন্তু যখন আশ্বিন সংখ্যা প্রকাশিত হল তখন প্রচ্ছদে দেখা গেল মাসিক গল্প পত্রিকা কথাটি নেই,  পরবর্তী সংখ্যাগুলিতে মাসিক গল্প পত্রিকা বলেই উল্লেখ থাকতো। মনে হয় ‘প্রবাসী’তে বিজ্ঞাপণের বয়ানটি আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুরু থেকেই ‘কল্লোল’ প্রচলিত সাহিত্য চর্চা থেকে সরে অন্য ধারায় চলার চেষ্টা চালায়। এই পরিবর্তনটি যে সচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখার ধরণ ধারণের বিরোধীতা তা সাহিত্যের পাঠকমাত্রই জানেন। রবীন্দ্র বিরোধিতা প্রসঙ্গে অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত লেখেন- “ভাবতুম, রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তাঁর পরে আর পথ নেই, সংকেত নেই। তিনিই সবকিছুর চরম পরিপূর্ণতা। কিন্তু ‘কল্লোল’-এ এসে আস্তে আস্তে সে ভাব কেটে যেতে লাগল। বিদ্রোহের বহ্নিতে সবাই দেখতে পেলুম যেন নতুন পথ, নতুন পৃথিবী। আরো মানুষ আছে, আরো ভাষা আছে, আছে আরো ইতিহাস। সৃষ্টিতে সমাপ্তির রেখা টানেননি রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যে শুধু তাঁরই বহুকৃত লেখনির হীন অনুকৃতি হলে চলবে না। পত্তন করতে হবে জীবনের আরেক পরিচ্ছেদ।”

সেই সময় ‘কল্লোল’ থেকে অনুপ্রাণিত হয় ‘প্রগতি’, ‘উত্তরা’, ‘কালিকলম’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি পত্রপত্রিকা। তাছাড়া কল্লোল যুগেই বাংলা কবিতায় গদ্যধারার শুরু। ইতিমধ্যে সমকালীন ইংরেজি ও বিদেশী সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে জীবনসংগ্রাম, রাজনীতি, সমাজনীতি-সহ নানা নতুন নতুন বিষয় উঠে আসে। কার্ল মার্কস ও সিগমন ফ্রয়েডের চিন্তাধারার প্রভাবে জগদীশ গুপ্ত, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, মনোজ বসু, গোপাল হালদার, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, সুবোধ ঘোষ, গজেন্দ্রকুমার মিত্র প্রমুখের চর্চায় এক নতুন রচনাশৈলী লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে কবি জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, অমিয় চক্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সঞ্জয় ভট্টাচর্য-সহ আরও অনেকের কবিতায় নতুন ভাবনা-ভাষা প্রকাশ পায়। মোটকথা ‘কল্লোল’ আত্মপ্রকাশে বাংলা সাহিত্যে যে নব্যরীতির সূচনা হয় তা উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ তথা আধুনিক কাল।আর এই কল্লোল যুগেই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে মানব-মনস্তত্ত্ব।

১৯২৩ থেকে ১৯২৯- মোট সাত বছর বা ‘কল্লোল যুগ’কে সাহিত্য বিশেষঙ্গদের কেউ বলেন, ‘কল্লোল’ পর্বের লেখকদের হাত ধরেই বাংলাসাহিত্য ‘ভিক্টোরিয়ান’ ও ‘এডওয়ার্ডিয়ান’ খোলস ছেড়ে আধুনিকতার পোশাক গায়ে জড়িয়েছিল। অন্য মতে বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি অনেক সাহিত্যিক ‘কল্লোল যুগ’কে নিছক ফিকশন  বলেও আখ্যায়িত করেছেন। এই সব মত, দ্বিমত সত্ত্বেও, একশো বছর পেরিয়ে এসেও বাংলাসাহিত্যে ‘আধুনিকতাবাদ’-এর অঙ্কুরে ‘কল্লোল’-এর অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এই সময়ে বিশ্ব সাহিত্যে আধুনিকতার চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যে আধুনিকতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এজরা পাউন্ড বলেছিলেন, ‘আধুনিকতাবাদী লেখকদের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তারা পাঠককে উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও নাটকের মাধ্যমে  এক অপরিচিত জগতের মধ্যে নিয়ে ফেলে। তাদের লেখা প্রায়শই পাঠককে একটি বিভ্রান্তিকর এবং কঠিন মানসিক ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায় যে অবস্থা বুঝে উঠতে পাঠককে শেষ পর্যন্ত যেতে হয় এবং যেতে যেতে পাঠক প্রতি মুহুর্তে নিজের মধ্যে নিজেই কাহিনির একটি মানসিক ম্যাপ তৈরি করতে করতে যান’। আবু সয়ীদ আইয়ুব তার ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে আধুনিক সাহিত্যের দুটি বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন, ‘কাব্য দেহের প্রতি একাগ্র মনোনিবেশ, যার পরিণাম কাব্য রচনায় ও সমালোচনায় দেহাত্মবাদ, ভাষাকে আধার বা প্রতীক জ্ঞান করে আপনারই দুর্ভেদ্য মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা জ্ঞান করা’ এবং দুই-‘জাগতিক অমঙ্গল বিষয়ে চেতনার অত্যাধিক্য’।

মনে রাখা দরকার একশো বছর পেরিয়ে আমরা যে পত্রিকাটির কথা বলছি সেই সময়টি হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল।‘কল্লোল’-এর জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভাঙচুর ও পালাবদলের কালপর্বে।‘কল্লোল’কে বুঝতে সেই ইতিহাস-রাজনীতি-সমাজ ও অর্থনীতিকে জানা দরকার। একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গোটা দুনিয়া জুড়ে যে আর্থিক মন্দা তৈরি হয়েছিল বাংলা সেই অবস্থার প্রভাবমুক্ত ছিল না। বাংলার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি তখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত তীব্র খাদ্য ও বস্ত্র সংকট ও দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির কারণে। তার উপর সেনাবাহিনী ছাড়া কোথাও কর্মসংস্থান নেই। ফলে ব্যাপক বেকার সমস্যা, হতাশাগ্রস্ত যুবসমাজ। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে আন্দোলন এবং যে জাতীয় আবেগে বাংলা আন্দোলিত হয়েছিল, বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ায় সেই আবেগ স্তিমিত হয়। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সহযোগিতা করলে ব্রিটিশ ভারতকে স্বরাজ দেবে যুদ্ধশেষে সেই আশ্বাসও মিথ্যায় পরিণত হয়, দেশে স্বরাজের পরিবর্তে মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন প্রণীত হয়। এতে গোটা দেশের মতা বাংলার যুবসমাজে নামে নৈরাশ্যের অন্ধকার। এই নৈরাশ্যপীড়িত সমাজের মন ও মননের কালপর্বে জন্ম নিয়েছিল ‘কল্লোল’ আর তার তরুণ লেখকগোষ্ঠী ছিলেন সেই নৈরাশ্য নিমিগ্নিত যুবসমাজের প্রতিনিধি। তাই রোম্যান্টিক ভাবালুতার বদলে ‘কল্লোলে’র লেখাগুলিতে যুবচিত্তের যন্ত্রণাক্লীষ্ট নগ্ন বাস্তব ভাষারূপ লাভ করেছিল।

রবীন্দ্রোত্তর কালের শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ যে ‘কল্লোল’ থেকেই পরিচিতি পেয়েছিলেন সে কথা অনস্বীকার্য| জীবনানন্দ দাশগুপ্ত তখনও দাশ হন নি, ‘নীলিমা’ কবিতাটি ছাপা হয়েছিল ‘কল্লোল’ ১৩৩২-এর ফাল্গুন সংখ্যায়| ‘কল্লোলে’ প্রকাশিত জীবনানন্দের ১২ টি কবিতার মধ্যে শেষ কবিতা ‘পাখিরা’ প্রকাশিত হয় ১৩৩৬-এর বৈশাখে| জীবনানন্দ ছাড়াও কবি যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার প্রমুখের নবীন পাঠক সমাজে পরিচিতির পিছনে ‘কল্লোল’-এর বিশেষ ভূমিকা ছিল| তারাশঙ্কর ‘কল্লোল’-এ লিখলেও অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারেন নি বরং একটু দূরেই থেকেছেন তবে তাঁর কবিতাও প্রকাশিত হয়েছে ‘কল্লোল’-এ। নজরুল তখন কারারুদ্ধ| কারাকক্ষের অন্তরালে বসেই তিনি লাল কালিতে লিখে কবিতা পাঠান ‘কল্লোল’-এ প্রকাশের জন্য| কবিতাটির জন্য পাঁচ টাকা পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় পৌঁছে দিয়েছিলেন নজরুলকে| ‘কল্লোল’ পছন্দের হওয়া সত্বেও শরৎচন্দ্র কিন্তু কখনো ‘কল্লোল[-এ লেখেন নি। আসলে তিনি ছিলেন ‘ভারতবর্ষ’পত্রিকার বাঁধা লেখক। তাছাড়া হয়তো ‘কল্লোল’-এর আর্থিক অসামর্থ্যও এক্ষেত্রে কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

‘কল্লোল’-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২ টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ সহ বেশ কয়েকজনের গানও প্রকাশিত হয়েছিল। তবে ‘কল্লোল’ আলোড়ন তুলেছিল গল্পে। ‘কল্লোল’ মহিলা লেখকদের গুরুত্ব দিয়েছিল, যা স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা দরকার। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন – নীলিমা বসু, সুরমা দেবী, সরোজকুমারী দেবী, শান্তা দেবী, রাধারাণী দত্ত, শৈলবালা ঘোষজায়া, অহল্যা গুপ্ত, সুনীতি দেবী, নৃসিংহদাসী দেবী, সীতা দেবী, নিরুপমা দেবী প্রমুখ।‘কল্লোল’-এর  আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ প্রবন্ধ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে প্রমথ চৌধুরী, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, বারীন ঘোষ, দিলীপকুমার রায় ছাড়াও কাজি আবদুল ওদুদ, বুদ্ধদেব বসু, নীহাররঞ্জন রায়, অমলেন্দু বসু, হুমায়ুন কবির, বিষ্ণু দে, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখেরা লিখেছেন। ‘কল্লোল’-এর বিশেষ উৎসাহ ছিল নাটকে। কল্লোলের পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘মুক্তি’ ও ‘কেয়ার কাঁটা’, হরিসাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘অকাজের বাঁশী’, মন্মথ রায়ের ‘অজগরমণি’, ‘চরকা’, ‘মাতৃ মূর্তি’ প্রভৃতি নাটক। মণীশ ঘটক যুবনাশ্ব ছদ্মনামে ‘কল্লোল’-এ ধারাবাহিক লিখেছিলেন। তাঁর ‘পটলডাঙার পাঁচালী’ প্রথম কলকাতার নীচের তলা মানুষের কথা- একটি ভিক্ষাজীবী দল, যার মধ্যে উদ্বাস্তু থেকে শুরু করে ডাকাতি করতে গিয়ে পা হারিয়ে জীবিকাচ্যুত লোকজন, বারবণিতা, চোর, ছিনতাই, পকেটমার সবাই আছে। এই লেখায় মানবিকতার স্পর্শ থাকলেও রোমান্টিকতা নেই। প্রেমের চেয়ে যৌনতা, ভালোবাসার চেয়ে হিংসা, বিশ্বাসের চেয়ে সন্দেহ এই লেখায় প্রাধান্য পেয়েছে। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘লোয়ার ডেপথস’-এর প্রভাব থাকলেও বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ নতুন।

‘কল্লোল’ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর ‘রজনী হল উতলা’ গল্পটি নিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে, একই অভিযোগ উঠেছিল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘বেদে’ উপন্যাসটি নিয়েও। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ অচিন্ত্যকুমারকে একটি চিঠি লেখেন (‘কল্লোল’ ১৩৩৬-এর বৈশাখ সংখ্যায়) – “তোমার কল্পনার প্রশস্ত ক্ষেত্র ও অজস্র বৈচিত্র্য দেখে আমি মনে মনে তোমার প্রশংসা করেচি। সেই কারণেই এই দুঃখ বোধ করেচি যে কোনো কোনো বিষয়ে তোমার অত্যন্ত পৌনঃপুন্য আছে – বুঝতে পারি সেখানেই তোমার মনের বন্ধন। সে হচ্ছে মিথুনাসক্তি। সে প্রবৃত্তি মানুষের নেই বা তা প্রবল নয় এমন কথা কেউ বলে না। কিন্তু সাহিত্যে সকল বিষয়েই যেমন সংযম আবশ্যক, এ ক্ষেত্রেও।”… কল্লোলের বহু লেখক রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজেদের কথা নিজেদের মতো করে বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁরা কবিকে কখনো অশ্রদ্ধা বা অবজ্ঞা করেননি। ১৩৩১-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ নিয়ে একটি স্বল্প মূল্যের সুলভ সংস্করণ প্রকাশ করতে ‘কল্লোল’ বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিল যাতে সর্বসাধারণ তাঁর রচনা পড়তে পারেন। অন্যদিকে ‘কল্লোল’-এ প্রকাশিত লেখা নিয়ে সজনীকান্ত দাস সরাসরি রবীন্দ্রনাথের কাছে নালিশ জানালে তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ কোনো মন্তব্য করতে চান নি।পরে একসময় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে লেখেন, ‘আমার নিজের বিশ্বাস শনিবারের চিঠির শাসনের দ্বারাই অপরপক্ষে সাহিত্যের বিকৃতি উত্তেজনা পাচ্ছে।’

প্রেমেন্দ্র মিত্র লেখেন, “জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আধুনিক সাহিত্যের বিচার সভা যেদিন বসেছিল যতদূর মনে পড়ছে তার দু’একদিন বাদেই সকালবেলা ওই বাড়িতেই কল্লোলের ডাক পড়েছিল। কল্লোলের কাছে সেটা আশাতীত সৌভাগ্য। মনে পড়ে দোতালার পূর্ব দিকের একটা লম্বা ঘরে আমরা কজন নিচু কটি আসনে একসারি হয়ে, পশ্চিমমুখো হয়ে বসেছিলাম। গরদের ধুতি চাদরে রবীন্দ্রনাথ এসে আমাদের সামনের একটি নিচু আসনে পূর্ব মুখে বসে ছিলেন। সে আসরে শিশিরকুমার ভাদুড়ীও একটু পরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন।… কথায় কথায় তাঁর নিজের লেখার হাত পাকা করবার কথা বলেছিলেন। ছাপার অক্ষরে প্রকাশের আগে শ্লেটে কত কবিতা যে লিখেছেন আর মুছেছেন সে কথা জানিয়ে বলেছিলেন যে “সার্থক কোন সৃষ্টির পেছনে নিরলস দীর্ঘ সাধনা না থেকে পারেনা, হঠাৎ ভুঁইফোড় হঠাৎ অসামান্য স্রষ্টা হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত তাই নেই বললেই হয়। সামনে প্রকাশ পাক বা না পাক– নীরব নেপথ্যে সাধনা সব সাফল্যের পেছনেই থাকে।” সেদিন যাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ এসব কথা বলেছিলেন তারা এটুকু বুঝে কৃতার্থ হয়েছিল যে, তিনি তাদের তখনকার বাজারদর দিয়ে দাম করেননি। নিভৃতে সাহিত্যের কথা শোনাবার উপযুক্ত মনে করে ডেকে স্বজাতি বলে বোঝাবার সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি দিয়েছেন।”

কিন্তু এরপরেই একদিন আচমকা ‘কল্লোল’ বন্ধ হয়। অথচ প্রবোধকুমার সান্যালের বড় গল্প ‘কাজললতা’র ভূমিকায় সম্পাদক দীনেশরঞ্জন লিখেছিলেন, “গল্পটি চৈত্র সংখ্যা পর্যন্ত চলবে”। কিন্তু সেই সংখ্যাতেই আবার দীনেশরঞ্জন লেখেন – “এই কয় বৎসরে আমি এত ঋণজালে জড়িত হইয়া পড়িয়াছি যে, আমার পক্ষে একমাসও এখন কল্লোল চালান সাধ্যাতীত হইয়া পড়িয়াছে। … ইহার পর আমার স্বাস্থ্য ভঙ্গ হওয়ায় আরও বিপন্ন বোধ করিতেছি।” এই লেখা পড়ে কেবল অনুরাগী পাঠকেরাই নয়, ‘কল্লোল-এর লেখকদের মনেও কী গভীর ছাপ ফেলেছিল, তার প্রমাণ রয়েছে বুদ্ধদেব বসুর লেখায়, “…. ‘কল্লোল’-এর স্রোত যে তার পূর্ণতার সময়েই সহসা থেমে যাবে তা আমরা কেউ কল্পনা করিনি। ‘কল্লোল’ আর চলবে না এ খবর যেদিন শুনেছিলাম সেদিন মনে যে আঘাত পেয়েছিলাম তার রেশ এখন পর্যন্ত মন থেকে একেবারে মিলোয়নি। সেদিন মনে-মনে বলেছিলাম, দীনেশ-দা মস্ত ভুল করলেন, আজও সে কথা অভিমানে আর্দ্র হয়ে মাঝে-মাঝে মনে পড়ে। যদি ‘কল্লোল’ আজ পর্যন্ত চলে আসতো এবং এ-ক’বছরে সমাগত নবীন লেখকদেরও নিঃসংশয়ে গ্রহণ করতো তা হলে সেটি হত বাংলাদেশের একটি প্রধান – এবং সাহিত্যের দিক থেকে প্রধানতম – মাসিকপত্র আর দীনেশরঞ্জনের নাম প্রসিদ্ধ সম্পাদক হিসাবে রামানন্দবাবুর পরেই উল্লিখিত হতে পারতো।”

পেজফোরএর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩ প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Comments are closed.

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন