মিনিট তিনেকের মধ্যেই বড়োমাদের গাড়ির কাছে চলে এলাম। এখান থেকে আর মিনিট পাঁচেক গেলেই নদীর সেই খাঁড়িটা পড়বে। তারপর ধীরে ধীরে আবার ওপরে উঠতে হবে।
গাড়িটা এসে দাঁড়াতেই বড়োমার তারস্বর গলার আওয়াজ পেলাম।
কি রে মিত্রা, অনি এসেছে।
গাড়ির ভিড়ে বড়োমা কোন গাড়িতে বসে আছে দেখতে পেলাম না। মিত্রা কি বললো তাও শুনতে পেলাম না। হৈ হৈ চলছেই। সামনের গাড়িটায় কনিষ্করা বসে রয়েছে। ড্রাইভিং সিটে রতন। সকলের খালি গা। এখনো জামা পরে নি।
কনিষ্ক আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। জানলা দিয়ে মুখ বারিয়ে বললাম।
কিরে খালি গায়ে বসে আছিস?
মিসন সাক্সেসফুল?
হ্যাঁ।
নেমে একবার বড়োমাকে মুখটা দেখিয়ে আয়।
কেন!
সকলের বাপ চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছেড়ে দিয়েছে।
তোদের গাড়িতে নীরুকে দেখতে পাচ্ছি না।
বড়োমার কাছে রয়েছে।
প্রেসার-ট্রেসার বেড়ে গেছে নাকি?
না।
আমি যাইঠি তুমি বুইস। বিষান বলে উঠলো।
তুই যাস নি বাবা। এখন এগারো হাজার ভোল্টে রয়েছে। পুরে ছাই হয়ে যাবি।
অর্জুনরা দেখলাম পেছন থেকে মুচকি মুচকি হাসছে।
আমি নেমে দাঁড়ালাম।
কোন গাড়িতে বসে রয়েছে।
একবারে সামনের গাড়িতে।
তোরা কি কেউ গাড়ি থেকে নামিস নি।
ভয়ে কেউ নামে নি।
কেন।
অনি নেই, যদি হাতি তাড়া করে।
চেঞ্জ করে নে।
আগে তুই মুখটা দেখিয়ে আয়।
হাসলাম। হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। শ্যাম-বিষান আমার দু-পাশে। প্রথমে ধাক্কা খেলাম দাদার গাড়ির সামনে। দাদা, ডাক্তারদাদা সামনে। ইসলামভাই ড্রাইভিং সিটে। মাঝে অনিমেষদা, বিধানদা, আফতাবভাই পেছনে রূপায়নদা, অনুপদা, ইকবালভাই।
গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে হেসেফেললাম।
কি গো এইরকমভাবে বসে আছো?
তুই আর কথা বলিস না। আগে তোর বড়োমাকে মুখটা দেখিয়ে আয়। দাদা বলে উঠলো।
অনিমেষদা, বিধানদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আর দাঁড়ালাম না। বড়োমার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম।
আমাকে দেখামাত্রই বড়োমার চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করলো। কাছে যেতেই হাতটা চেপে ধরলো। কোনও কথা নেই। মুখটা কেমন ভেঙে দুমড়ে যাচ্ছে।
এই তো গন্ডগোল শুরু করে দিলে। হেসেফেললাম।
বড়োমা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে।
আরে আমার কিছু হয় নি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
তবু বড়োমার চোখ দিয়ে জল পড়া বন্ধ হলো না।
হাতি দেখলে?
বড়োমা কাপর দিয়ে চোখ মুছলো।
ছোটোমা, বৌদি জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।
এখনো ভিঁজে জামাকাপরে বসে আছো। ঠান্ডা লেগে যাবে।
আমি নিজেই দরজাটা খুললাম।
সামনের সিটে জ্যেঠিমনি, আন্টি বসে। পেছনে দামিনীমাসি, বৌদি, ছোটোমা। দেখেই মনে হচ্ছে কেউ আর জামা-কাপর বদলাবার সুযোগ পায়নি। যে যেমন অবস্থায় ছিল ওই অবস্থাতেই গাড়িতে উঠে বসেছে। ভেঁজা জামাকাপরের জল গায়েই শুকিয়েছে।
তোমরা তো এখানে এসে কাপরটা চেঞ্জ করে নিতে পারতে? ছোটোমার দিকে তাকালাম।
ছোটোমা মুচকি মুচকি হেসে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
সিগগির নেমে এসে আগে ভেঁজা জামা-কাপর চেঞ্জ করে নাও। বড়োমার হাতটা ধরলাম।
বড়োমা একবার সামনের দিকে তাকাল। আমি বড়োমার চোখে চোখ রেখেই পেছন দিকে তাকাতেই দেখলাম মিত্রারাও সকলে ভেঁজা জামা-কাপর পরে গাড়িতে বসে আছে।
তনু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। মিত্রা কি বিড় বিড় করে বলে চলেছে, এখান থেকে ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে খুব যে একটা ভালো কথা বলছে আমার সম্বন্ধে, তা নয়।
কিরে তোরাও….?
বড়োমাকে বল। মিত্রা ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
কেন!
তুই দেশোদ্ধার করবি, আমরা ঝাড় খাব।
বিষান।
বইলো।
ডাবগুলো কোথায় রেখেছিস?
হাল্কা হাসির ঢেউ মিত্রাদের গাড়ি থেকে ভেসে এলো।
কুন একটা গাড়ি-এর মাথায় আছে, দেখতি হবে।
অনিদা আমাদের জন্য। গাড়ির ভেতর থেকে মিলি হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি হাসছি।
মিত্রাদের গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে সুরো-বনি নেমে এলো। ভিঁজে শালোয়ার কামিজ শরীরে সেঁটে রয়েছে। হন্ত-দন্ত হয়ে কাছে এসে বড়োমার দিকে তাকাল। ছোটোমারা সকলে এবার একে একে দরজা খুলে নেমে এসেছে। আমি বড়োমাকে ধরে নামালাম।
ছেলেকে জল-জ্যান্ত অবস্থায় পেয়েছো। সুরো চেঁচিয়ে উঠলো।
বড়োমা কোনও কথা বললো না, কান্না ভেঁজা চোখে মুচকি মুচকি হাসছে।
ছেলে ছাড়া যখন অন্ধ, আঁচল দিয়ে বেঁধে রাখতে পার না। গলায় সেই সমান ঝাঁঝ।
আমার দিকে তাকিয়ে।
তোমার জন্য আজ সকলে মুখ শুনেছে।
আমায় বলেছিল হাতি দেখালি না। তাই দেখিয়ে দিলাম। আমি হাসতে হাসতে বললাম।
সুরো হেসে ফেললো।
শুনলে মিত্রাদি, শুনলে।
তুই শোন। মিত্রা টোনট কাটল।
শোন না। আমি সুরোর দুই কাঁধে হাত রাখলাম। বনি ফিক ফিক করে হাসছে।
তুই দেখছিস….। সুরো বনির দিকে তাকিয়েছে।
মিকিরা কোথায়?
জানি না যাও।
বিষাণ ডাবের কাঁদি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আকা।
ওরা কাপর-চোপর ছেড়ে নিক।
কনিষ্ক আকাদের দেই আসি।
যা।
সুরো কট কট করে আমার দিকে তাকাল।
রাগ করিস কেন, নে জামাকাপরটা ছেড়ে নে। আমি একটু ওপাশ থেকে আসছি। মাসীমনিকে কোন গাড়িতে তুলেছিস?
জানিনা যাও।
আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে। সুরো, বনি বড়ামার দিকে তাকিয়ে, চোখে হাসছে।
কিছু বলতে পারছো না ছেলেকে। সুরো আবার বড়োমার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
ঠিক আছে তোদরকে বলতে হবে না। আমি খুঁজে নিচ্ছি।
কথাটা বলে পা বাড়াতেই দাদার গলা পেলাম।
তুই কোথায় যাচ্ছিস?
পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম দাদা, ডাক্তারদাদারা সবাই গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এসেছে। প্রত্যেকের হাতেই ডাব।
এখুনি আসছি।
তোর জন্য বুড়ো বয়সে আমরা সকলে আর গালাগাল খেতে পারবো না।
আর হাতি বেরবে না।
দাদা হেসে ফেললো। ডাক্তার শুনলে ওর কথা।
এখন ডাবের জল খেয়ে প্রাণ ঠান্ডা করো। ডাক্তারদাদা বললো।
বিধানদা, অনিমেষদা, শুভরদাদু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
কনিষ্কদের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম।
ওরা যে যার দেখলাম চেঞ্জ করে নিয়েছে। নীরুকে দেখতে না পেয়ে কনিষ্ককে বললাম।
কিরে, নীরুকে বড়োমার গাড়িতে দেখতে পেলাম না?
মাসীমনির গাড়িতে।
কেন?
সখ হয়েছে তাই।
কোনও সমস্যা?
না একবারে ঠান্ডা, শীতল পরিবেশ।
মাসীমনি একা?
না অর্ক, অরিত্র, সুমন্তরা আছে। বেশি ঝামেলা করছিল বাচ্চাগুলোকেও ওখানে গুঁজে দিয়েছি।
কেন! বেগতিক কিছু?
মুখ-চোখ ভাল ঠেকছিল না। তাই নীরুকে গুঁজে দিলাম।
ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকলো না।
সব ব্যাপার তোর মাথায় ঢুকবে ভগবান এমন কথা তো লিখে দেয় নি।
আমি কনিষ্কর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
ভেবেছিলাম বড়োমার গাড়িতে উঠেছে। তারপর নীরুই বললো, এই গাড়ির থেকে ওই গাড়ির অবস্থা আরও খারাপ। তাই ওই গাড়িতে যাচ্ছি।
তোরাও কি ভয় পেয়েছিস নাকি?
কেন!
উল্টোপাল্টা বকছিস।
বড়োমা আর মাসীমনির মূর্তি তো দেখিস নি। প্যান্টে পেচ্ছাপ হয়ে যেত।
তখন যা হলো, তাড়াহুড়ো করে কে কোন গাড়িতে উঠলো বোঝাই গেল না। বটা বললো।
নৌকাডুবি।
দেখলি দেখলি কনিষ্ক, এই সময় এই কথাটা বলার কোনও যুক্তি আছে।
আমার দিকে তাকিয়ে, তোরটার সঙ্গে।
হলে বেঁচে যেতাম।
বটা, বিড় বিড় করতে শুরু করলো, আমি হাসতে হাসতে পা বাড়ালাম।
তুই কোথায় যাচ্ছিস? কনিষ্ক পেছন থেকে বললো।
যাই মাসীমনির সঙ্গে দেখা করে আসি।
কেন গালাগাল খাবি….
কিসের জন্য বল।
নীরু বহুত খেপচুয়াস।
না না। আমাকে গালাগাল করবে না।
আমি এগিয়ে গেলাম। এলোমেলো ভাবে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে। মাসীমনির গাড়ির কাছে আসতেই, উৎকণ্ঠিত মুখে আমার দিকে তাকাল। চোখে জল নেই তবু যেন ছল ছল করছে। তিন্নী, তিতলি বসে। সামনের সিটে বিনয়দা বসে। পেছনের সিটে নীরুর মুখটা একঝলক দেখতে পেলাম। বাচ্চাগুলোকে দেখতে পেলাম না। অর্ক, অরিত্ররাও ধারে কাছে কেউ নেই।
কাছে যেতেই তিতলি দরজা খুলে নেমে এলো। তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো।
তোমার হাতি তাড়ান হয়েছে।
বাবাঃ তোরা তো সব্বাই….
হাসতে হাসতে তিতলির নাকটা চেপে ধরে নাড়িয়ে দিলাম।
তিতলি উ করে উঠলো। তিন্নী মুখ ঘুরিয়ে হাসছে।
গাড়িতে উঠে মাসিমনির পাশে বসে গলা জড়িয়ে ধরলাম।
তিতলি সমানে পেছন থেকে তরপে যাচ্ছে।
এবার ঠাম্মা কিছু বলতে পারছে না দেখ মা। এখন মুখে কুলুপ এঁটেছে। এতক্ষণ শুধু তরপে গেল। আসুক একবার পিঠ ফাটাব। যেই অনিকাকা এসেছে ওমনি বেলুন ফুস।
আমি হাসছি।
বিনয়দা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। মাসীমনির মুখের দিকে তাকাল। আস্তে করে বললো।
এবার শান্তি।
কেন এতক্ষণ অশান্তি হচ্ছিল। আমি বললাম।
তিতলি ঝাঁজিয়ে উঠলো। একদিকে বড়দিদা, আর একদিকে ঠাম্মা যেন কাক উড়ছে চিল পরছে। আর বাবু, হাতি তাড়াচ্ছেন। এতগুলো লোককে যে সঙ্গে নিয়ে এসেছো, সে দিকে খেয়াল আছে।
মাসীমনির মুখের দিকে তাকালাম।
বিশ্বাস করো। আমার কিছুই হয় নি। আমাকে এক ফোঁটাও হাত লাগাতে হয় নি। অনেক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওরা বনের প্রাণী বড্ড অবুঝ।
মাসীমনি আমার মুখের থেকে চোখ নামিয়ে নিল।
চলো বড়োমার গাড়িতে গিয়ে বসবে।
আর তো একটুখানি পথ। মাসীমনির ধরা গলা।
নীরু পেছনের সিটে বসে আমাকে সমানে মেপে যাচ্ছে।
কিরে তুই এই গাড়িতে!
সংক্ষেপে বলবো, না বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করার দরকার আছে। নীরুর গম্ভীর গলা।
আকা ডাব কাইটি।
বিষাণ এসে দাঁড়িয়েছে।
আকা ডাব কাটি। নীরু পেছন থেকে ভেংচে উঠলো। বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি। জিজ্ঞাসা করতে হয়।
বিষাণ নীরুর কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসে।
আবার তাকিয়ে থাকে।
পেছন ফিরে তাকালাম।
বিষান দাঁড়িয়ে, পেছনে আর একটা ছেলের কাঁধে এক কাঁদি ডাব।
তুমি সেউঠি সামলাইগে যাও।
বিষাণের দিকে তাকালাম।
আবার কি হলো!
বড়দিদার সঙ্গে লাগিইছে।
কার।
ডাক্তারদাদাই আইছে আরও অনেকগুলান দাদাই। চিনিনি।
সবাই একসঙ্গে লেগে পড়েছে।
হ।
তোর বাপ।
সামলাইতে পারে নি।
চলো। মাসীমনির মুখের দিকে তাকালাম।
মাসীমনি নড়ে চড়ে উঠলো। মুচকি মুচকি হাসছে।
এসো।
আমি গাড়ি থেকে নেমে মাসীমনির হাত ধরলাম।
আমি পারবো।
মাসীমনির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। মাসীমনি আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো। ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে এলো। তিন্নী কাপরটা একটু ঠিক করে দিল।
এতটা পথ হেঁটে যেতে পারবে?
খুব পারবে, তোর থেকে স্ট্রং। নীরু বললো।
মাসীমনি একবার নীরুর দিকে তাকাল। হাসছে না তবু হাসছে।
আমি মাসীমনির কোমড়টা জড়িয়ে ধরলাম। মাসীমনিও আমার কোমড়টা জড়িয়ে ধরেছে।
বিষাণ এখানে দুটো দিয়ে বাকিটা নিয়ে অনির পেছন পেছন চলে যা। নীরু বললো।
তিন্নী নেমে এসে মাসীমনির পাশে দাঁড়াল।
তোমার কি শরীরটা গন্ডগোল করেছিল?
মাসীমনি আমার মুখের দিকে তাকাল। না।
তিন্নী ফিক করে হাসলো।
মাসীমনি একবার তিন্নীর দিকে তাকাল।
তুমি বলো….একবারে ভাজা মাছটা….
তোরা ওকে এখনো চিনলি না।
চেনার দরকার নেই। শালুক চেনে গোপাল ঠাকুর।
তোরা এগিয়ে যা, আমি ওর সঙ্গে আস্তে আস্তে যাচ্ছি।
তিন্নী, আমে দুধে মিশে গেছে। আঁটি এবার গড়াগড়ি খাবে।
নীরুর দিকে তাকালাম। কথাটা বলেই ডাবে চুমুক দিয়েছে।
ডাব থেকে মুখ তুলে বললো। হাতি যখন কাদায় পরে চামচিকিতে নাথি মারে।
কথাটা মনে রাখিস।
আমি মাসীমনিকে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম।
সুবর্ণরেখা এখানে শীর্ণ। তবু শ্রোতস্বিনী সুবর্ণরেখা। নদীগর্ভে পরে থাকা এলোমেলো পাথরের বুকে ধাক্কা খেয়ে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। একটানা তার কল কল শব্দ চারদিকে ম ম করছে। এখান থেকে কিছুই দেখা যায় না। নদীর বুকে পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা নানা আকারের পাথর এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তবু সুবর্ণরেখা একই ছন্দে এগিয়ে চলেছে তার নির্দিষ্ট পথের উদ্দেশ্যে।
দু-পাশে টান টান হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে রয়েছে সোনালী বালির চড়। সূর্য মধ্য গগনে। তার আলোয় চিক চিক করছে সুবর্ণরেখার মেদহীন শরীর। পাড়ের ঠিক কোল ঘেঁসে সবুজ বনানী, ছোট ছোট টিলার মতো আঁকা বাঁকা পাহাড়। শিল্পীর তুলির টানও এতটা সূক্ষ্ম নয়। গরম আছে। তবে সেরকম ভ্যাপসানি নেই। নদীগর্ভে দাঁড়িয়ে ততটা বোঝা যাচ্ছে না। দমকা হাওয়ায় পরনের পরিধেয় ওলট পালট।
তবু একটানা শ্রোতস্বিনীর কল কল শব্দের সঙ্গে বাতাসের হু হু শব্দ মিলে মিশে একাকার।
ভেঁদোদা, ভজু, মৌসুমি মাসি কোন গাড়িতে আছে বুঝতে পারছি না। তখন অমন একটা হজপচ হয়ে গেল….।
গাড়িগুলো এক জায়গায় জড়ো করা। আশে পাশেই সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে আবার সেই পূর্বাবস্থায় ফিরে আসছে। এতক্ষণ সবার মধ্যে যে একটা চাপা টেনসন, উত্তেজনা ছিল সেটা এখন উধাও। এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি ওরা আস্তে আস্তে নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে।
মাসীমনির মুখের দিকে তাকালাম।
তোমার জায়গাটা ভাল লাগছে?
এটা সুবর্ণরেখা?
হ্যাঁ।
সোনা পাওয়া যায় কোথায়?
আমি হাসছি।
তোর বলা গল্পটা ও বলেছে। মাসীমনির চোখে মুখে খুশির হাসি ছড়িয়ে পরলো।
তুমি বিশ্বাস করলে?
অবাস্তব কোনও জিনিষ ও কখনো বিশ্বাস করে না।
তোমাকে দেখাব।
শ্যামরাও কি এই দলে রয়েছে।
ওরা পাহাড়াদার।
মাসীমনি আমার মুখের দিকে তাকাল। চোখেমুখে হাল্কা অবিশ্বাসের ছায়া। তিন্নী পাশে পাশে আসছিল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মাসীমনি বললো।
বৌমা তুমি এগিয়ে যাও।
তিন্নী আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে হন হন করে সামনের দিকে হেঁটে চলে গেল।
আমি মাসীমনির মুখের দিকে তাকালাম। চোখ অন্য কথা বলছে।
পাহাড়াদার কেন!
কেনর প্রশ্নেই তো যত সমস্যা।
তাহলে এখানে যে সংগঠনটা গজিয়ে উঠেছে? যাকে নিয়ে এত সমস্যা।
ওটা আই ওয়াশ।
মাসীমনি দাঁড়িয়ে পরলো। আমিও থমকে দাঁড়ালাম।
বিশ্বাস হচ্ছে না।
না।
মাসীমনির চোখে মুখে ফুটে উঠেছে তীব্র অবিশ্বাসের রেখা।
দেখবে যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একটা শ্রমিক সংগঠন থাকে। যদি নাও থাকে, মালিক ইচ্ছে করে সেটা তৈরি করার চেষ্টা করে। কেন জান? সেটা তার নিজের স্বার্থে। একচুয়েলি সংগঠনটা হচ্ছে শ্রমিকের সংগে মালিকের সংযোগ রক্ষার সেতু। আর সেই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি মালিকের কাছে জাস্ট মিডিলম্যান।
মাসিমনির চোখ কুঁচকে গেল।
তুমি তো এই সংগঠনটা করেছো। আমার কথাটা একটু তলিয়ে দেখবে।
মাসিমনি যেন আমার কথাটা শুনে ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না। কিন্তু মনে মনে যেন বললো, ঠিক আছে তোর কথাটা আমি ভাববো।
আবার এক-পা দু-পা করে হাঁটতে শুরু করলাম।
তারপর। মাসীমনি আমার মুখের দিকে তাকাল।
আর মিডিলম্যানদের ব্যাপার তোমাকে নতুন করে বলতে হবে না। তুমি তো জানো। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, দো ঘড়্যা চ্যাং। তলারও খাব ওপরেরও কোরাব।
মাসিমনির ঠোঁটে সামান্য হাসির ঝিলিক দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
হাসলে যে।
তোর কথা শুনে।
যা সত্যি তাই বললাম। তোমার কষ্ট হচ্ছে না তো?
না তুই বল।
এখানেও ঠিক তাই। ওদেরকে সামনে রেখে, পেছনে দে-দার ব্যবসা চলছে। ভারতের সিক্সটি টু সিক্সটি ফাইভ পার্সেন্ট ন্যাচারাল রিসোর্স রয়েছে এই অঞ্চলে। গ্যাস আর তেল বাদে সব পাবে। একটু ভাল করে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবে শুরুটা সেই মোগল প্রিয়েড থেকে। শেষ হায়দ্রাবাদের নবাবে। তাও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে হায়দ্রাবাদের নবাবের যুদ্ধ হয়েছিল। একবার ভাবো, দেশের একটা নবাবের সঙ্গে সেই স্বাধীন দেশের সেনাদের যুদ্ধ। কেন জানো?
মাসীমনি আমার মুখের দিকে তাকাল।
হায়দ্রাবাদের নবাব মনে করতো ভারতীয় ভূখন্ডের মধ্যে তার রাজ্যটা একবারে আলাদা ভূখন্ড। তিনি কিছুতেই এই স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেন নি। স্বাধীনতা মেনে নিলে তার যে ব্যবসার ক্ষতি হয়ে যাবে।
তবে তারা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। কিসের টানে বলো তো?
মাসীমনি আবার দাঁড়িয়ে পরলো। চোখেমুখে জিজ্ঞাসা।
তখন তোমাদের ছাত্রাবস্থা। জানিনা কতটা খোঁজ খবর রেখেছিলে।
তখন তো এখনকার মতো এতটা কমুনিকেসন ছিল না। তবে কাগজে দেখেছি। তোর মতো এতটা পড়াশুনার এলেম তখন ছিল না। মাসীমনি খুব ধীরে ধীরে বললো।
একটু ভেবে দেখ, তখন তোমরা একটা মতবাদকে আঁকড়ে ধরে তোমাদের বিশ্বাসের জগতটাকে একটু একটু করে তৈরী করতে চেয়েছ। সেই মতবাদের বীজটা কিন্তু তারও আগে থেকে বপন করা হয়েছিল এই সব অঞ্চলে। কিন্তু শেষ হয়ে হইলো না শেষ। নবাবের যারা আমচা-চামচা ছিল, ততদিনে তারা লাইনবাট্টা ভাল বুঝেগেছিল। তারা ব-কলমায় কাজটা শুরু করে দিল। কাঁচা পয়সা বুঝলে। সমস্যা যে তিমিরে সেই তিমিরেই রইলো। শুধুমাত্র রাজার বদলে উজিরের কাছে হাতবদল ঘটলো। মতবাদেরও সূক্ষ্ম অদল বদল ঘটলো। ফলে পার্টি দু-টুকরো।
(আবার আগামীকাল)
Onek valo
Please make big episodes to read. please
আহসান লেখার মতো সময় পাচ্ছি না। দেবো কোথা থেকে।