মঙ্গলবার | ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১১:০১
Logo
এই মুহূর্তে ::
কাশ্মীরী মন্দির — অবহেলায় না অনীহায়? অবন্তীস্বামী ও মার্তন্ড মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মমতার স্পষ্ট বার্তা — আগে বাংলার মানুষ আলু খাবে, তারপর বাইরে পাঠানো হবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (দ্বিতীয় পর্ব) : রহমান হাবিব লঙ্কা চাষ বাড়ছে, লাভবান চাষিরা, রপ্তানি বাড়াতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পাশাপাশি, তবে প্রাণ নেই, চিহ্ন বইছে ভেলুগোন্ডা, রবিবার জল সরার পরে : অশোক মজুমদার নলিনী বেরার কবিতা — স্বভূমি, স্বদেশ, স্বজন : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (প্রথম পর্ব) : রহমান হাবিব রংবাহারি ক্যাপসিকাম : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যের কৃষকমান্ডিতে কৃষকদের ধান বিক্রিতে দালাল মুক্ত করার নির্দেশ সরকারের : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘উচ্ছেদ’ আমাদের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নানা মত : তপন মল্লিক চৌধুরী বেঙ্গল গোট গ্রামীণ অর্থনীতিতে এনে দিতে পারে স্বচ্ছলতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পিটার নাজারেথ-এর ছোটগল্প ‘মালদার’ অনুবাদ মাসুদ খান আমরা নারী-আমরাও পারি : প্রসেনজিৎ দাস ঝুম্পা লাহিড়ীর ছোট গল্প “একটি সাময়িক ব্যাপার”-এ অস্তিত্ববাদ : সহদেব রায় ঝুম্পা লাহিড়ী-র ছোটগল্প ‘একটি সাময়িক বিষয়’ অনুবাদ মনোজিৎকুমার দাস ঠাকুর আমার মতাে চিরকালের গৃহীর চিরগুরু : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ভাবাদিঘির জট এখনও কাটেনি, বিষ্ণুপুর থেকে জয়রামবাটি রেল চলাচল শীঘ্রই : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (শেষ পর্ব) : অভিজিৎ রায় উৎপন্না একাদশী মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত মারাঠাভুমে লাডকি বহিন থেকে জয়, ঝাড়খণ্ডে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী প্রচারে হার : তপন মল্লিক চৌধুরী কিন্নর-কৈলাসের পথে : বিদিশা বসু হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (চতুর্থ পর্ব) : অভিজিৎ রায় ভনিতাহীন চলন, সাইফুর রহমানের গল্প : অমর মিত্র সাইফুর রহমান-এর বড়োগল্প ‘করোনা ও কফিন’ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (তৃতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় নানা পরিচয়ে গৌরী আইয়ুব : গোলাম মুরশিদ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

কাজলদীঘি, ২২৪ নং কিস্তি

জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় / ২৩২০ জন পড়েছেন
আপডেট বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর, ২০২০
kajaldighi

২২৪ নং কিস্তি

অনিমেষদা কাঠপুল পর্যন্ত নৌকতে যাই। ওখান থেকে হাঁটবো। চিকনা বললো।

কেন ওপারে গিয়ে হাঁটার রাস্তা নেই।

নদীর ধার বরাবর আছে।

তাহলে?

এখনো ঠিকমতো জল টানে নি। কাদা আছে। কোথাও কোথাও জুতো হাতে নিতে হবে।

তা হোক। কাদা মাখবো বলেই তো হাঁটার মনস্থির করলাম।

আমি কোনও কথা বলছি না। মুচকি মুচকি হাসছি।

কিরে তোর কি মতামত। অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকাল।

তোমাদের যেমন ভাললাগে।

তুমি ওপারে গিয়ে নৌকটা বাঁধ আমরা হাঁটবো। অনিমেষদা চিকনাকে বললো।

গলুইয়ে দাঁড়িয়ে চিকনা বাঁশের ঠেলা মারলো। তর তর করে নৌক মাঝ নদীতে চলে এলো।

বাঃ দৃশ্যটা খুব সুন্দর লাগছে। তাই না অনিমেষবাবু। শুভর দাদু বললেন।

তাহলে কাঠপুল পর্যন্ত চলুন।

গেলে মন্দ হয় না। কিছুটা দৃশ্যসুখ উপভোগ করা যাবে।

তাহলে তাই চলো চিকনা।

চিকনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

ওর দিকে তাকিয়ে লাভ নেই চিকনা। এখন আমরা যা বলবো তাই হবে। অনিমেষদা বলছে আর ফিক ফিক করে হাসছে।

রূপায়ন, তুমি অনুপ সকালে নৌক চড়েছ নাকি।

একবার।

অনিমেষদা হাসছে।

লগির ঠেলায় নৌক তর তর করে এগিয়ে চলেছে। জলে একটা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। শুভর দাদু, সুরোর শ্বশুর চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছেন। অফতাবভাই অবাক চোখে চারদিক চেয়েচেয়ে দেখছে।

আফতাবভাই আগে কখনো চড়েছেন। অনিমেষদা বললো।

না ফার্স্টটাইম।

কাল ওদের নিয়ে কোথায় মাছ ধরেছিলি। অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকাল।

ওই জায়গাটা জলে ডুবে গেছে।

ওই যে বাঁশ ঝাড়ের ঝোপটা দেখছেন কাল ওখানে জলটা একটু কম ছিল অনি ওখান থেকে সিঙ্গি মাগুরগুলো ধরেছিল। আর এখন নৌকটা যেখান দিয়ে যাচ্ছে এখানে বসিররা মাছ ধরছিল অনিকা আর নম্রতার ওর্না দিয়ে।

আফতাবভাই চিকনার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।

অনিমেষদা এই সেই আঁখ বাড়ি। চিকনা চেঁচাল।

সবাই একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।

অনি এখান থেকে আঁখ নিয়ে গেছিল!

হ্যাঁ।

আর এই যে বাঁশ ঝাড় দেখছেন।

হ্যাঁ।

কাল এখানে এতটা জল ছিল না। অনি যখন আঁখ চুড়ি করতে গেছিল, পক্কেরা নিজেরা এখান থেকে মাছ ধরেছিল।

দেখছেন অনিমেষবাবু কতগুলো উপরি পাওনা জুটছে। শুভরদাদু বলে উঠলেন।

মাছ খাওয়া হলো জায়গাটাও দেখা হল।

চিকনা ভরা বর্ষায় কতটা জল ওঠে। অচিন্তবাবু বললেন।

বাঁধ ছুঁই ছুঁই।

অতোটা!

তখন ফণি জ্যেঠুর আঁখ বাড়ি ডুবে যায়। ঘরের উঠোনে জল চলে যায়।

জল নামতে কতদিন লাগে।

আমাদের এই পাশটা একটু উঁচু। পশ্চিম পাশটা নীচু। সে পাশে বাঁধ ভাঙলে একমাস। নাহলে মাস দুয়েক।

তারমানে!

খালের মাটি তো কাটে না। পঞ্চায়েতরা একটু মাটি কেটে পয়সা নিয়ে নেয়। হাফ যারা মাটি কাটে তাদের দিয়ে বাকিটা নিজেরা পকেটে ভরে। চাষ বাঁচাবার জন্য বাঁধ কেটে জল বার করে দিতে হয়।

অনিমেষদার চোখ বড়ো বড়ো।

আমার সঙ্গে অনাদির এই নিয়ে গন্ডগোল। ওকে বলেছিলাম তোকে অনি পঞ্চায়েত থেকে এমএলএ বানিয়েছে কিসের তরে। নদীর মাটি কেটে চুরি করার জন্য।

ওকে তো আর এমএলএ ভাবতাম না। আমাদের বন্ধু। প্রথম প্রথম হাসতো। পরে দেখলাম পেছন থেকে ছুরি চালাচ্ছে। তখন অনি এখানে ছিল না। ওকে সব বললাম। ও বললো, এককাট্টা হয়ে ওর বিরুদ্ধে লড়। ও কিছু করতে গেলেই আগে হিসেব নে।

সহ্য করতে পারলো না। আমরা যারা ওর বন্ধু সবাই শত্রু হয়েগেলাম।

এবার বলুন অনির দোষ কোথায়। ও তো আমাদের খারাপের জন্য কিছু করে নি।

রূপায়নদা, অনুপদা চিকনার মুখের দিকে তাকিয়ে।

অনি ফিরে আসার পর আমাদের বুকে একটু বল এসেছে। এখন একটু কাজ হচ্ছে। গ্রামের ছেলেদের বলেছি। কন্ট্রাক্টর বাবুরা ঠিক মতো কাজ না করলেই বাঢ্ঢাবি।

সেটা আবার কি? অনিমেষদা বললো।

গ্রামের কথা বলে ফেলছি। পিটান, মার।

অনিমেষদা হাসছে।

ভাল ওষুধ। তাতে কাজ হচ্ছে। শুভরদাদু বললো।

গড় গড় করে কাজ হচ্ছে।

সামনেই কাঠপুল দেখা যাচ্ছে।

অনি তুই সামনে চলে যা। ঘাটে নেমে নৌক চেপে ধরবি। চিকনা বললো।

আমি এপাশে চলে এলাম।

নৌক ঘাটে ভেড়ার আগেই লাফিয়ে নেমে নৌকটা চেপে ধরলাম।

সামান্য ধাক্কায় নৌক একটু টাল খেল।

অনিমেষদারা হাসছে।

নৌক থামাবার বেশ কায়দা আছে তাই না অনিমেষবাবু। শুভরদাদু বললেন।

এই বয়সে আর লগি ঠেলতে পারবেন না। দেখে সুখ লাভ করুণ।

অনিমেষদা বলতে বলতে নৌক থেকে নীচে নেমে এলো।

ভাগ্যিস আপনি ফোন করেছিলেন। না হলে একটা ভাল ট্যুর মিস হয়ে যেত।

অনিমেষদা একবার আমার মুখের দিকে তাকাল একবার শুভর দাদুর দিকে। হাসছে।

নৌককে নদীর ঘাটে রেখে আমরা নদী গর্ভ থেকে ওপরে উঠে এলাম।

বাঃ জায়গাটা বেশ সুন্দর। শুভরদাদু স্বগতোক্তির সুরে বলে উঠলেন।

অনিমেষদা। চিকনা পেছন থেকে চেঁচাল।

কাল আপনারা আসার সময় ঝড়ের মুখে পরেছিলেন।

হ্যাঁ।

অনি তখন এইখানে অনিসাদের নিয়ে আম কুড়চ্ছিল। ওটা বেড়া ঘরের আম বাগান।

চিকনা আঙুল তুললো।

শুভর দাদু চারদিক চেয়ে দেখছে।

যাই বলুন অনিমেষবাবু, অনির টেস্ট আছে। শুভর দাদু বললেন।

আফতাবভাইরা সকলে নির্বাক দর্শক।

একবার এদিকে আসুন। চিকনা শুভরদাদুর দিকে তাকাল।

ওরা সকলে এগিয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

অচিন্তবাবু কিছুটা এগিয়ে পেছন ফিরে তাকালেন।

তুমি এসো।

আপনারা যান। আমি দাঁড়াচ্ছি।

চিকনা ওদের নিয়ে একবারে নদীর পারে গিয়ে দাঁড়াল। কাল আমি যেখানে অনিসাদের নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হাত তুলে তুলে চারদিক দেখাচ্ছে। এক এক করে গ্রামের সীমানা রেখা বোঝাচ্ছে। ওরাও একবার বাঁদিকে ঘুরে একবার ডানদিকে ঘুরে দেখছে। অফতাবভাই, মল্লিকদারা চিকনাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে দিচ্ছে। চিকনাও ওদের সঙ্গে ফর ফর করে চলেছে। আর সকলে হাসছে।

ওরা ফিরে এলো। আবার হাঁটা শুরু।

আমাবাগান, বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে রাস্তা। সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। এরই মধ্যে কমলা রং ধরেছে। ছেঁড়া ছেঁড়া কথার ফাঁকে নিস্তব্ধ রাস্তায় আমরা হাঁটছি। পাখির কুজন চারদিকে ম ম করছে। মাঝে মাঝে অনিমেষদা, আফতাবভাই ওপর দিকে তাকিয়ে দেখছে।

এত পাখির শব্দ, এ তো আমাদের চিড়িয়াখানায় শোনা যায়। অনিমেষদা বললো।

এটা কিন্তু চিড়িয়াখানা নয় অনিমেষবাবু। পিওর ভিলেজ। শুভরদাদু বললেন।

চিকনা মাছ ধরার জায়গাটা দেখাতে ভুলবেনা যেন। আফতাবভাই বললো।

দেরি হয়ে যাবে। বড়োমা রাগারাগি করবে।

আমরা বুঝে নেব, তোমাকে ভাবতে হবে না। শুভরদাদু বললেন।

চিকনা হাসছে।

অনিমেষদা, অচিন্তবাবু শুভরদাদুর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

কি অচিন্তবাবু ঠিক বললাম কিনা বলুন। হারাবার তো আর কিছু নেই।

অচিন্তবাবু শব্দ করে হেসে উঠলেন।

যেটুকু পাই লুটেপুটে খাই।

শুভরদাদু চিকনার দিকে তাকাল।

চিকনা।

বলুন।

গাছে তো বেশ আম ঝুলছে। পূজোর ফল হিসেবে দু-একটা নিয়েগেলে মন্দ হয় না, কি বলো ?

অনিমেষদা হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল।

তুমি বলো অনিমেষ। কি আফতাবভই আমি ভুল বললাম।

আফতাবভাই হো হো করে হেসে উঠলো।

অনি একলা এনজয় করবে কেন, বুড়ো বয়সে আমরাও একটু আধটু রস আস্বাদন করি। হাতের কাছে যখন উপকরণ রয়েইছে।

শুভরদাদু চিকনার দিকে তাকাল।

চিকনা তুমি তো গাছে উঠতে পার।

চিকনা হাসছে।

দেখো চুরির দায়ে যেন বুড়ো বয়সে জেলে যেতে না হয়।

অনুপদা, রূপায়নদা, মল্লিকদা মুখ ঘুরিয়ে হেসেই চলেছে।

অনিকে বললে ও এখন গাছে উঠবে না। তুমি একবার চেষ্টা করো।

আপনি মশাই বড্ড রসিক মানুষ। অচিন্তবাবু বললেন।

আচ্ছা অচিন্তবাবু আপনি মন থেকে বলুন, ওইরকম গাছ থেকে সুন্দর সুন্দর আম ঝুলে রয়েছে। আপনার একটাও নিতে ইচ্ছে করছে না।

ইচ্ছে থাকলে উপায় কি বলুন।

বয়সটা যদি চিকনার মতো হতো, আপনি একবার ট্রাই করে দেখতেন না।

বলা মুস্কিল।

সকলে হাসছে।

চিকনাকে বেশি কসরত করতে হলো না। একটু খানি গাছে উঠে সবে মাত্র পাক ধরা গোটা পেঁচেক আম টপাটপ ছিঁড়ে নিয়ে চলে এলো।

বুঝলাম সবাই বেশ এনজয় করছে।

চিকনা বাবা। শুভরদাদু আবার চিকনার দিকে তাকাল।

যেতে যেতে আর চাররকম ফল নিশ্চই জোগাড় করে ফেলতে পারবো কি বলো।

এবার অনুপদা, রূপায়নদা জোড়ে হেসে উঠলো।

আপনি তো আচ্ছাই শুরু করলেন মেসোমশাই। অনুপদা বললো।

না অনুপ একটা ফল উৎসর্গ করতে নেই। পাঁচরকম ফল দিতে হয়।

হারুজানার কালায় পেয়ে যাব।

কি মনে করে চিকনা বললো আপনারা একটু এগিয়ে যান, আমি আসছি।

কোথায় যাবে!

বেরা ঘর থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে আসি।

কেন।

আপনি পাঁচরকম ফল বললেন। এতটা পথ নিয়ে যেতে হবে।

দেখছেন অনিমেষবাবু আপনি এতটা ভাবেন না।

শুভরদাদু অনিমেষদার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন আর হাসছেন।

তাড়াতাড়ি আসবে, দেরি করবে না। আজ অনিকে দিয়ে কোন কাজ হবে না।

যাব আর আসবো।

নিমেষে চিকনা বাঁশ বাগানের মধ্যে অদৃশ্য হয়েগেল।

আমরা আবার সামনের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলাম। শুভরদাদু বেশ জমিয়ে গল্প করছেন।

অনিমেষবাবু আপনার জন্ম শহরে না গ্রামে।

গ্রামে।

তাহলে আপনার কিছু অভিজ্ঞতা আছে।

অনিমেষদা শুভরদাদুর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

সেই জন্য আপনি অনির দুষ্টুমিকে প্রশ্রয় দেন। দেখলেন ধরা পরেগেলেন।

অচিন্তবাবু হাসতে হাসতে বললেন। আমি শহরে জন্মগ্রহণ করলেও তখন কিন্তু শহরটা গ্রাম ছিল।

কোথায় ?

নয়নপুর।

দূর ওটা তো গ্রামই ছিল। হালে শহরে পরিণত হলো।

সে কথা বলতে গেলে কলকাতা কিন্তু একটা গ্রাম। অনিমেষদা বললেন।

আপনি জব চার্নকের সময় ফিরে যেতে চাইছেন। তখন গোটা শহরটাই গ্রাম। সূতানুটি, গোবিন্দপুর, কলকাতা। এই তিনটে গ্রাম নিয়েই শহরের পত্তন।

আমার শেকড়টা বাংলাদেশ। দেশভাগের সময় বাবার হাত ধরে চলে এলাম।

কোথায়?

সাতক্ষীরা।

তখন বছর ছয়েক বয়স। বাংলাদেশের কথা সেইভাবে মনে পরে না। বাবা যেটুকু সঙ্গে আনতে পেরেছিল, কলকাতার আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্যে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু আগে বানালেন। বাকিটুকু দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। আমি চাকরি পাওয়ার পর বাড়িটুকু করেছিলাম।

কথা বলতে বলতে একবারে রাস্তার ধারে চলে এলাম।

কিরে অনি চিকনা কালা না কি বললো, সেটা কোন দিকে। অনিমেষদা বললো।

চলুন নিয়ে যাচ্ছি।

লজ্জার কিছু নেই অনি। ছোট বয়সে আমিও গেছো কম ছিলাম না। তোমরা নৌক চেপেছো আমি পানসিতে চাপতাম। নৌকর থেকে সেগুলো ছোট। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। আমাদের বাড়ি যেখানে ছিল। তার পাশেও একটা নদী ছিল। নাম ভুলে গেছি। তবে সেটা মেঘনার একটা স্রোত।

এই নদীটাও কেলেঘাইতে গিয়ে মিশেছে।

এই ছোট ছোট নদীগুলো দেখবে কিছুটা প্রকৃতি কিছুটা মানুষের হাতে তৈরি। বাঁচতে গেলে জল আগে। তাই ঘরের কাছে জল পেতে গেলে প্রথমে পুকুর তারপর নদী তৈরি করতে হবে। আর এই নদীর ধারেই গড়ে উঠেছে জনবসতি। যানবাহন বলতে নৌক।

রাস্তা পার হয়ে আমরা চলে এলাম হারুজনার কালা।

আমাদের আসার আগেই চিকনা চলে এসেছে। হাতে একটা ঝুড়ি আর কাটারি, কাঁধে গামছা। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ও হাসছে।

কাছে আসতে শুভরদাদুই বললো।

কি চিকনা তুমি কোন দিক দিয়ে এলে।

ভেতর দিয়ে।

ঝুড়ি কেন, ব্যাগ আনবে বললে।

আপনি বললেন পাঁচরকম ফল নিতে হবে একটা করে নিলে হবে কি করে। অতো লোক একটু বেশি করে নিতে হবে। আপনারা আমগুলো ঝুড়িতে রেখে একটু এদিক ওদিক ঘরুন, আমি এখান থেকেই আর চাররকম ফল জোগাড় করে দিচ্ছি।

এখানে পাওয়া যাবে।

হ্যাঁ হ্যাঁ। ওই যে দেখছেন কুল গাছ। গামছাটা পরে উঠে পরলেই একটা কাঁদি নামিয়ে আনতে পারবো। নারকেল গাছে উঠে এক কাঁদি ডাব নামিয়ে নেব। তাহলে তিনটে হয়ে গেল। ওই যে কলা বাগান দেখছেন। একটা পাকা কাঁদি নিশ্চই পাব। তাছাড়া লিচু, সপেদা, আতা, শসা তো আছেই।

কেউ কিছু বলবে না।

সব ইজমালি।

ইজমালি মানে!

কারুর নয়। সবার।

আর কেউ নিতে আসে না।

এখানে ভূত থাকে। তাই ভয়ে কেউ আসে না। পাখি খায়। আমি অনি একসময় প্রতিদিন আসতাম।

ভূত দেখতে।

না। মনের সুখে ফল খেতে। কেউ তো কিছু বলবে না।

রূপায়নদা, অনুপদা হাসছে।

অনিমেষদা, চিকনা অনির সলিড চ্যালা এবার বুঝতে পারছেন। অনুপদা বললো।

ওর চোখ মুখ দেখছো।

তাহলে বলছি কি আপনাকে।

তাহলে লেগে পর। অনিমেষদা চিকনার দিকে তাকাল।

চিকনার চোখে মুখে বোকা বোকা হাসি।

বয়ে নিয়ে যাবে কে ?

আমি। সেই জন্য ফনি জ্যেঠুর কাছ থেকে গামছাটা চেয়ে নিয়ে এলাম।

তুমি বয়ে নিয়ে যাবে ?

কতো আর হবে মন খানেক। এর থেকেও কতো ভারি বস্তা আমি অনি বয়েছি। মীরচাচার ধান কুটা কলে দুজনে ধান ভাঙতে যেতাম।

অনিমেষদা মাথা দোলাচ্ছে।

চল অনি।

আমি ওদের পুকুর ধারে নিয়ে গেলাম।

আফতাবভাই চেপে ধরলো। কাল কোথায় মাছ ধরেছিলি ? দেখালাম। এদিক সেদিক ঘুরলাম। আফতাবভাই শুভরদাদু হারুজানার কালার ইতিহাস জানতে চাইল। বললাম।

অনুপদা বললো, মিত্রা একবার এইখানকার গল্প বলেছিল। ঠিক বিশ্বাস করিনি। এখন চাক্ষুষ দেখে মনে হচ্ছে তোর গল্পে কোথাও জল মিশে নেই। ওই সব খাওয়ার সত্যি আদর্শ জায়গা।

তুমি আইন করে এই রসাস্বাদন থেকে বঞ্ছিত করতে পারবে না অনুপ। শুভরদাদু বললেন।

অসম্ভব।

কতো সুন্দর গল্প বলো। কেউ যাতে না আসে তার জন্য সুন্দর একটা রিউমার ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভূত আছে। এমনি জায়গাটা দেখ কতো নিরিবিলি। তায় রাত্রি হলে তো কথাই নেই।

কথা বলতে বলতে আমরা ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে পুকুরের চারধারটা একপাক ঘুরে নিলাম। অনিমেষদাদের কয়েকবার জুতো হাতে করতে হয়েছে। পায়ে সামান্য কাদার ছোঁয়া।

চিকনার কাছে আসতে অনিমেষদার চোখ বড়ো বড়ো।

করেছো কি চিকনা। শুভরদাদু বললেন।

ঠাকুর তো একা খাবে না। সকলে ভাগি ভাগি করলে দেখবেন কম পরে যাবে।

তুমি তো পাঁচের বেশি নিয়েছো।

হাতের কাছে পেলাম। আপনিও একা নন। আফতাবভাই আছেন।

আমাকে বাদ দিলে কেন। অনিমেষদা বললো।

আপনারা এসব মানেন না।

কেন বলছো।

সেই জন্য অনাদি অনির দানকরা বাসন্তী মার জমি বেচে দিয়েছিল, অনেক কষ্টে উদ্ধার করেছি। পীরবাবার জমি বেচতে গিয়ে ধরা পরে গেল। মীরচাচারা খেপে গেল। তখন এখেনে রায়েট বেধে যেত।

চিকনা আমার দিকে তাকাল।

ঝুড়িটা মাথায় তুলে দে।

কথা বলতে বলতেই চিকনা মাথায় গামছাটা জড়িয়ে নিল।

আমি এগিয়ে গেলাম।

মাথায় বোঝা থাকবে, আপনাদের সঙ্গে যেতে পারব না। এগিয়ে যাব।

চিকনা শুভরদাদুর দিকে তাকিয়ে বললো।

আমি ওর মাথায় ঝুড়িটা তুলে দিলাম।

চিকনা মাথায় বোঝা চাপতেই হন হন করে হাঁটতে শুরু করলো।

শুভরদাদু স্থির দৃষ্টিতে চিকনার চলার পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

বুঝলেন অনিমেষবাবু, অনেক ভাগ্য করলে এইরকম বন্ধু কপালে জোটে।

একবারে ঠিক কথা বলেছেন। অচিন্তবাবু বললেন।

অনিমেষদা কিছুক্ষণ শুভরদাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

আজকের দিনে এই ধরণের ডেডিকেসন সত্যি বিরল।

অনিমেষদা তবু কোন কথা বললো না।

আমি ভুল বললাম অনিমেষবাবু।

না। আমি শুধু এতক্ষণ ওর বলে যাওয়া কথাগুলো ভাবছিলাম।

কি নিষ্পাপ বলুন তো মনটা। আমি একটু আনন্দ করার জন্য বলেছিলাম, ও কতোটা সিরিয়াসভাবে নিল ব্যাপারটা।

ধর্মের বাঁধনটা যে ওর মধ্যে নেই, সেটাও কথায় কথায় অবলীলায় বলে দিল।

অনিমেষদা খুব ধীর স্থির ভাবে বললো।

শুধু তাই কি। ওর ভেতরে যে আপনাদের প্রতি একটা চাপা অভিমান আছে সেটাও ও কথায় কথায় বলে ফেললো। হয়তো ও ওইভাবে বলতে চায় নি। কিন্তু বলা হয়েগেল।

অনি না থাকলে এই শিক্ষাটাও হয়তো আমাদের কপালে জুটতো না।

হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় এসে পরলাম।

ক্যালভার্টের কাছে আসতেই দূরে আমাদের স্কুল বাড়ির টালির চাল দেখতে পেলাম। সামনে অশ্বত্থগাছ। সেখানে ভিড় করে আছে সকলে। বড়োমা বলেছিল ফাদার আসবে। দেখতে পেলাম না। তাহলে কি সোজা পীরবাবার থানে চলে যাবে ? হবে হয়তো। একটু এগিয়ে গেছিলাম।

অনি।

অনিমেষদার ডাকে থমকে দাঁড়ালাম।

শ্মশানটা কোনদিকে।

আঙুল তুলে দেখালাম।

বৃষ্টির স্পর্শে সবুজ ধান খেতের রং বদলে গেছে। হাওয়ার ছোঁয়ায় সির সির করে আওয়াজ তুলে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ।

সবাই চোখ দিয়ে সবুজের সুরা পান করছে।

আমরা কি ওই জায়গায় যাব। অনিমেষদা আঙুল তুললো।

হ্যাঁ।

কোন পথে যাব।

মাঠের ভেতর দিয়ে আইল পথে গেলে, কাদা পাবে। না হলে একটু এগিয়ে ডানদিকে ঘুরলে মোরাম রাস্তা বরাবর আমরা ওখানে পৌঁছে যাব।

চিকনাকে দেখতে পাচ্ছি না।

ও শবরপাড়ার ভেতর দিয়ে চলে গেছে।

আমরা মাঠের পথে যাই চলুন। দু-পাশে সবুজ ধানখেত মাঝখান দিয়ে একচিলতে রাস্তা। খারাপ অভিজ্ঞতা হবে না। শুভরদাদু বললেন।

তাই চলুন।

আমরা আবার মাঠের পথে নেমে এলাম।

লম্বা লাইন করে এঁকে বেঁকে সকলে চলেছি।

একবারে শেষে অনুপদা।

ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আমি বোবা হয়ে আছি।

শুভরদাদু একবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মাঠের মধ্যে ওই খড়ের চালা ঘর গুলো কি অনি।

শ্যালো টিউবওয়েল। তাছাড়া ধান পাকার সময় মাঠ থেকে ধান চুরি হয়। তাই রাত জেগে পাহাড়ার ব্যাবস্থা।

এখানে চুরি-চামারি আছে নাকি ?

আগে ছিল না। এখন মানুষ পয়সা চিনতে শিখেছে। তাই চুরিটা বেরে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে পীরবাবার থানে পৌঁছে গেলাম। দূর থেকেই দেখলাম ডাক্তারদাদা, বিধানদা, দাদা পুকুর পাড়টায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কাছে আসতেই ডাক্তারদাদা চেঁচিয়ে উঠলো।

মিঃ সিনিয়ার মুখার্জী অনিবাবুর ফ্লেভারটা কেমন উপভোগ করলেন।

শুভরদাদু হেসে উঠলেন।

উপভোগ করিনি, এনজয় করলাম।

হাঁটতে অসুবিধে হলো না।

না। এখনো প্রতিদিন সকালে এর থেকে বেশি হাঁটি।

সুজিতবাবু অসুবিধে হল না।

না সামন্তদা। বেশ ভাললাগল। বুঝতেই পারলাম না এতটা হাঁটলাম।

একবারে ফ্রেস এয়ার নো পলুসান।

ডাক্তারদাদা আমার দিকে তাকাল।

আফতাবভাই।

নো কমেন্টস।

ডাক্তারদা আফতাবভাই-এর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো।

আগে ভেতরে যা তোর বড়োমা যা ভারতনাট্যম শুরু করেছে বাধ্য হয়ে পালিয়ে এলাম।

আমি হাসলাম।

অনেকদিন পর পীরবাবার থানে এলাম।

অনেক মানুষের ভিড়। পরিচিত লোক ছাড়াও অপরিচিতর সংখ্যা খুব একটা কম নয়।

এরা হয়তো গ্রামের লোক। কিংবা মীরচাচার সাগরেদ।

কলকাতায় ফেরার পর একবার এসেছিলাম। উনা মাস্টার যেদিন মারা গেলেন।

তারপর আর আসা হয় নি। কতো ঝড়ঝঞ্ঝা গেল। মীরচাচা জায়গাটা বেশ ভাল করে গুছিয়েছে। পুকুরটা মনে হয় সংস্কার করেছে। চারিদিকে ফুলের গাছ লাগিয়েছে। বেড়া দিয়ে জায়গাটা ঘিরেছে। একটু চওড়া করে ঘাসের ওপর মোরাম ফেলে একটা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।

গাছটার দিকে চোখ চলে গেল।

না ওই জায়গাটা যেমন ছিল ঠিক তেমনি আছে।

অপরিষ্কার অপাংক্তেয় জায়গাটা কেমন যেন ঝকঝক করছে।

বাবা পীরবাবার দর্শন পেয়েছিলেন। আমি চেষ্টা করেও কোনদিন তাঁকে দেখি নি। হুড়মুড় করে কতো স্মৃতি মগজে ভিড় করে আসছে। চোখ বন্ধ করলে সব যেন দেখতে পাই। মনে হয় এইতো সেদিনের ঘটনা।

কে যেন পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।

আমি সামনে। তুই পেছনে।

সম্বিত ফিরতে দেখলাম বিনদ সামনে থেকে, আর অর্জুন পেছন থেকে জাপ্টে ধরে আছে।

আলতাফ, আপ্পে, অভিমন্যু, ঝিনুক, ভিখু সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে।

আজ ওরা ভাগাভাগি করুক। আমরা পরে ভাগ নেব। আলতাফ বলছে আর হাসছে।

কিরে অর্জুন। সামনে আয়।

বিনদ-অর্জুন দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম।

কতদিন পরে তোমায় দেখছি।

বেশি দিন না মাস খানেক।

তোমার কাছে দিন মাস বছরের কোন হিসেব নেই। বিনদ বললো।

আমি দেড় বছর পর তোমায় দেখলাম। অর্জুন বললো।

গবেট। কেন অনিকাকে নিয়ে যখন মেরিনাদির কাছে গেলাম।

ও হ্যাঁ হ্যাঁ ভুলে গেছিলাম।

বিনদ, অর্জুনের দিকে তাকাল।

খেয়াল নেই।

বিনদের সঙ্গে বরং বছর দুয়েক পর দেখা হলো।

লাস্ট জুহু বিচে।

হ্যাঁ।

তুই ব্যাটা আগের থেকে বেশ চকচকে হেয়েগেছিস। বিনদের দিকে তাকিয়ে হাসছি।

মাল আসছে।

ও ভাল কথা, তুমি ভিখাকে ছারলে কেন। অর্জুন হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে।

এখন পীরবাবার থানে এসেছি।

ঠিক আছে আগে নামাজ পরে নিই।

চল।

দুজনে আমার দুটো হাত শক্ত করে ধরেছে। কনুইটা কোমড়ে ঠেকতেই কেমন শক্ত শক্ত লাগলো।

অর্জুনের দিকে তাকালাম।

এখানেও সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়।

সবার কাছে আছে।

বিনদ হাসছে।

অর্জুনভাই কেশ খায়া। ঝিনুক হাসছে।

ছোড়না ইয়ার।

কয়েক পা বাড়াতেই মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা। পেছনে অনিকা, নম্রতা। সামনে তাকিয়ে দেখলাম শুভরা এগিয়ে আসছে।

নম্রতা হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে।

তোরা এতো সেজেছিস কেন।

কোথায় সাজলাম মীরদাদাই-এর পার্মিসন নিয়ে কয়েকটা গোলাপ তুলেছি।

মীরদাদাই পার্মিসন দিয়েছে।

অনিকা চোখে হাসছে।

বিনদ এগুলোকে দেখেছিস।

তোমার বলার আগে আলাপ হয়েছে।

অর্জুন তিনটের কেশ কিছু শুনেছিস।

সবাই হেসে উঠলো।

বহুত বঁড়িয়া চাল দিয়া। বিনদ বলে উঠলো।

তোদের মতো জোড় করে আদায় করে নেবে।

বিনদ আঙ্কেল বহুত খারাবি হো গা। নম্রতা চেঁচিয়ে উঠলো।

পিকুকো আভিতক নেহি দেখা।

দাঁড়া দাঁড়া সময় হোক দেখবি।

তুমি আজকে আবার চুরি করেছো। অনিসা আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি! একবারে না। শুভরদাদু আর অনিমেষদাদাই।

সবাই আমার কথা শুনে হাসছে।

বড়োমার কাছে আসতে দেখলাম শুভরদাদুর সঙ্গে খুব জোড় তরজা চলছে।

আমকে দেখেই বড়োমা তেন্ডাই-মেন্ডাই করে উঠলো। নিজের রোগটা সবার মধ্যে ইঞ্জেকসন করছিস।

শুভরদাদু, বিধানদা, ডাক্তারদাদা হাসছে।

দেরি করো না। ফিরতে ফিরতে রাত হবে।

দাঁড়া ফাদার আসুক।

ফাদার আসে নি ?

পৌঁছে গেছে, নিয়ে আসছে।

আমার চোখটা চারদিকে বন বন করে ঘুরছে। একপাশে বেশ বড়ো একটা চাদর পাতা হয়েছে। চেয়ার থাকতেও মাসীমনিকে দেখলাম চাদরে বাবু হয়ে বসেছে, সোনাআন্টি, জ্যেঠিমনি মাসীমনির পাশে পা ছড়িয়ে বসে আছে।

চিকনাকে দেখলাম পুকুরের ওপার থেকে আর একটা বড়ো ঝুড়ি কাঁধে করে নিয়ে আসছে।

ফুল দেখা যাচ্ছে। ভেতরে হয়তো আরও অনেক কিছু আছে।

ছোটোমা, বৌদি, দিদিকে ধারে কাছে দেখতে পেলাম না।

হয়তো এপাশে ওপাশে কোথাও আছে।

চিকনা কাছে এসে বড়োমার দিকে তাকাল।

গাছের তলায় রাখবো, না পুকুরে একবার চুবিয়ে আনব।

ধুয়ে আন।

চিকনা ঝুড়ি নিয়ে পুকুরঘাটে চলে গেল।

ছোটোমাদের দেখছি না। বড়োমার দিকে তাকালাম।

নাজমাকে নিয়ে তোর স্কুলে গেছে।

হাসলাম।

এদের দেখতে চেয়েছিলে দেখেছো।

বিনদ, অর্জুন হাসছে।

তুই তো দেখাস নি। ওরাই দেখা দিল।

নেহি দাদিমা অনিদাকো পাস আপকা বহুত স্টোরি শুনা।

আর স্টোরি ফরি শুনতে হবে না। হাত-পা ধুয়েছিস।

অর্জুন আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে। বুঝতে পারে নি।

হাসলাম। ওদের বোঝালাম বড়োমা কি বললো।

ওরা হেসেই যায়।

হঠাৎ হৈ হট্টগোল হতে পুকুরের ওপাশে তাকালাম। দেখলাম ফাদার। সঙ্গে মিত্রা, তনু, ছোটোমা, দিদি, দামিনীমাসি মেয়েরা সকলে একসঙ্গে ঢুকছে। ফাদার দূর থেকে দেখেই হাত তুললো।

পেছনে উসমানকেও দেখতে পেলাম।

ওরা সকলে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।

ফাদার হাতজোড় করে বড়োমাকে বললো, কেমন আছো দিদি।

তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

অনি কোন গন্ডগোল করে নি।

করলেই হলো। মাথা ভেঙে দেব।

ফাদার হাসছে।

বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো, ছোটো।

ছোটোমা একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। ওখান থেকেই চেঁচাল।

একটু দাঁড়াও যাচ্ছি।

আমি ওখানে দাঁড়িয়েই জুতোটা খুলে ফেললাম, বড়োমাকে বললাম তুমি আমার সঙ্গে এসো।

বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল।

আমি বড়োমার হাতটা ধরে পুকুরঘাটে এলাম।

কালকে বৃষ্টিটা হওয়াতে বেশ খানিকটা জল বেরে গেছে। ধীরে ধীরে ঘাটে নেমে এলাম। হাতে মুখে জল দিলাম। ওপরের দিকে তাকাতে দেখলাম সকলে ভিড় করে আছে।

আমাদের ঠিক পেছনে অর্জুন বিনদরা দাঁড়িয়ে। আমরা উঠে আসতে ওরা সকলে ঘাটে নেমে একে একে হাতেমুখে জল দিল।

বড়োমার হাতটা ধরে ওপরে উঠে এলাম।

মনেপরে প্রথম যখন এখানে এসেছিলে।

বড়োমা আমার চোখে চোখ রাখলো।

অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

তবু গাছটা দেখ ঠিক ঠাক রয়েছে। মোমবাতি নিয়ে এসেছ ?

এনেছি।

চলো জালিয়ে দিই।

আমি পূজো করবো।

করোনা কে মানা করেছে।

বড়োমা কিছু বললো না।

আমাকে একটা মোমবাতি দাও জালিয়ে দিই।

মিত্রা। বড়োমা চেঁচিয়ে উঠলো।

মিত্রা ছোটোমাদের কাছে দাঁড়িয়েছিল এগিয়ে এলো।

তনু কোথায় ?

মুখ হাত ধুতে গেছে।

তুই ধুয়েছিস।

মিত্রা মাথা দোলাল। ধুয়েছে।

ওকে একটা মোমবাতি আর দেশলাই এনে দে। বড়োমা বললো।

আমি গাছের তলাটায় এগিয়ে গেলাম। ওপরের দিকে তাকালাম। ঝাঁকড়া গাছটা জটাজুটধারী। নীচ থেকে ওপরের আংশের পাতা দেখা যাচ্ছে না। বাবার কথাটা আজ কেন জানি বার বার মনে পরে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ভাববার চেষ্টা করলাম, কিছুতেই বাবার মুখটা ভেসে উঠছে না।

এখন গোধূলি। সূর্যকে আর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তার আলোর রেশ চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার অবিরাম শব্দ ভেসে আসছে।

মিত্রা, তনু দুজনে আমার পাশে এসে দাঁড়াল।

আমার চোখে চোখ রাখলো।

তনু তুমি তো আমার সঙ্গে কোন দিন এখানে আসো নি।

তনু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কোন কথা বললো না।

মিত্রা তবু দু-একবার এসেছে। এই গাছকে সাক্ষী রেখে ওকে গ্রহণ করেছিলাম। কেন জানিনা আমার জীবনে এই গাছ একটা মাইলস্টোনের মতো। আমি জীবনে কারও কাছে যদি কিছু চেয়ে থাকি তাহলে এই অশ্বত্থ গাছের কাছে।

পৃথিবীর যে প্রান্তেই থেকেছি চোখ বন্ধ করে এই গাছের কাছে আমি আমার প্রার্থনা জানিয়েছি।

তোমাদের দুজনকেও আমি এই গাছের কাছে প্রার্থনা করে পেয়েছি।

তবে না চাইতেও তোমাদের দুজনের কাছে অনেক বেশি পেয়েছি।

জানো তনু, আমি সেই অর্থে ঈশ্বর বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমার বাবা এই গাছের তলাতেই পীরবাবাকে দেখেছিলেন। আমি মনাকাকার মুখে সেই গল্প প্রথম শুনেছি।

মনাকাকাই আমাকে একদিন হাতে ধরে এই গাছের তলায় নিয়ে এসেছিলেন। প্রণাম করতে বলেছিলেন। তারপর এই অশ্বত্থ গাছের মাহাত্ম কথা শুনিয়েছিলেন।

সেই শৈশবেই আমি এই গাছকে আমার জীবনদেবতা হিসাবে মেনে নিয়েছি। বাবা-মার মুখটা এখনো চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট দেখতে পাই না। এখনো কেমন যেন ঝাপসা, অস্পষ্ট।

এই গাছ আমার বাবা-মার পরিপূরক।

তাই আমার জীবনে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা এলেও চিকনাকে একটাই কথা বলেছি, তোর জীবন দিয়ে হলেও শ্মশান আর পীরসাহেবের থানকে তুই ঠিক ঠাক রাখবি।

এর জন্য চিকনাকে অনেক অপমান লাঞ্ছনা-গঞ্জনা শুনতে হয়েছে। তবু চিকনা হাল ছাড়ে নি। চিকনার সঙ্গে একবার তুমি নিজেও এখানে এসেছো।

ওর সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্কের থেকেও অনেক বড়ো সম্পর্ক।

বলতে পারো তোমরা যেমন চিকনাও তাই।

এই গাছের মাহাত্ম্য বলো নিগূঢ় রহস্য বলো আজও আমি উপলব্ধি করি, কিন্তু সেই মাহাত্ম্য বা রহস্যের উন্মোচন আজও করতে পারি নি।

ওরা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে।

এসো আমরা তিনজনে একসঙ্গে মোমবাতি জালাই। কিছু চাওয়ার থাকলে চাইতে পার।

আমি গাছের তলায় হাঁটু ভাঁজ করে বসলাম।

ওরা আমার পাশে একই ভাবে বসলো।

(আবার আগামীকাল)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন