২২৩ নং কিস্তি
তখন আমি দ্বাদশ শ্রেণীতে পরি। ছুটির সময় বাড়ি আসতাম না। হস্টেলে থাকতাম।
আমাদের কলেজের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কুত্তার ব্যবসা ছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে কুকুর কালেকসন করতো তাদের ব্রিদিং করে কুকুরের বাচ্চা বিক্রী করতো। সেই সময় এক একটা কুকুরের বাচ্চার দাম নিত তিনশো চারশো টাকা করে।
ওর পাল্লায় পরে কুকুরের প্রতি নেশা হলো। ভাবলাম ভবিষ্যতে কিছু যদি না হয় তাহলে কুকুরের ব্যবসা করবো। খেয়ে পরে জীবনটা চলে যাবে।
ভদ্রলোকের ভাল নাম কোন দিন জানতাম না। সকলে ঘেঁটুদা বলতো।
আমিও সেই নামে ডাকতাম। মিত্রা ঘেঁটুদাকে দেখেছে। মিলিরাও দেখেছে।
প্রফেসার্স রুমের সামনে যে ভদ্রলোক টুল পেতে বসে থাকতো। মিলি বললো।
হ্যাঁ।
বহুত খিচ খিচ করতো।
হাসলাম।
ছোট থেকে সমবয়সী সকলের কাছে ঘেঁটুদা।
আমার হস্টেলের রুমেও তার যাওয়া আসা ছিল।
অনেক দিন আমি মাংসের দোকান থেকে ছাগলের নাড়ি-ভুঁড়ির ছাঁট দিয়ে কিমা করে ঘেঁটুদাকে এনে দিয়েছি। কুত্তাকে খাওয়াবার জন্য। কুকুরের সে কি সেবা যত্ন।
আমি যদি অতটা পেতাম তাহলে হয়তো মানুষ হতাম না। বকে যেতাম।
বড়োমা আমার দিকে কট কট করে তাকাল।
বড়োমার হাতটা চেপে ধরলাম।
রাগ করছো কেন গল্প। রসিয়ে বসিয়ে গল্প না বললে ভাল লাগবে না।
ভাল করে বল।
প্রায়ই আমাকে ঘেঁটুদা বলতো, এরা আমার লক্ষ্মী বুঝলি অনি, এদের যদি ঠিকমতো দেখভাল না করি এরা আমাকে দেখবে কেন।
অতো-সতো বোঝার ক্ষমতা তখন হয় নি। কুকুরের বাচ্চা ঘাঁটতে বেশ ভাললাগতো। নাদুস নুদুস কুকুর বাচ্চাগুলো কিঁউ কিঁউ করে ডাকতো। ভীষণ চটকাতাম। কতো সব নাম। মনে রাখতেও পারতাম না। আমার কাছে সব কেমন যেন সাদা আর কালো।
একবার আমাকে বললো, অনি গরমের ছুটিতে মানালি যাব তুই যাবি।
আমার পয়সা নেই।
তোকে পয়সার কথা বলেছি। যাবি কিনা বল।
যাব।
ব্যাশ কথা ফুরিয়ে গেল।
আমার দৈনন্দিন জীবন চলছে।
কুত্তা ঘাঁটার নেশা যায় নি।
গরমের ছুটি পরলো। ঘেঁটুদা বললো, তোর মনে আছে।
কি?
মানালি যাব বলেছিলাম।
সে তো বহুদিন আগে বলেছিলে।
পর্শুদিন যাব। রেডি হয়ে নিস।
ঠিক আছে। তখন মনে হয় জিজ্ঞাসা করেছিলাম ঘেঁটুদা আমরা কি বেরাতে যাব।
না পাহাড়ী কুকুর আনতে যাব।
কুকুর আনতে মানালি!
পাহাড়ী কুকুরের সঙ্গে সমতলের কুকুরের ব্রিদিং করলে বেশ জাঁদরেল কুকুরের বাচ্চা তৈরি হয়। ক্রশ বিটের বাচ্চাগুলোর বেশ ভাল দাম পাওয়া যায়।
অতো বুঝি না বললাম বেশ ভালো।
যাওয়ার দিন যথা সময়ে আমি ঘেঁটুদার কোয়ার্টারে পৌঁছে গেলাম।
কিরে রেডি?
হ্যাঁ।
জামাকাপর।
কাল পর্শু ফিরে আসবো জামা কাপর কি হবে।
ছাগল। সাতদিন লাগবে।
এই পরেই কাটিয়ে দেব।
দেখলাম ঘেঁটুদা কিছু বললো না।
ওকে তো তখন বলতে পারি না। আমার এই একটাই ভাল জামা কাপর। তাছাড়া গ্রীষ্মকাল বেদম গরম। ভাবলাম একটা জামাকাপরেই হয়ে যাবে।
যথা সময়ে হাওড়া স্টেশন।
রিজার্ভেসনের বালাই নেই।
ধস্তা ধস্তি গোঁতাগুঁতি করে ট্রেনে উঠলাম। জেনারেল কম্পার্টমেন্ট। মানুষগুলো সব মালের বস্তার মতো থরে থরে সাজান।
জীবনে প্রথম বেশ ভাল অভিজ্ঞতা হলো বুঝলে।
মানালি পৌঁছলাম। প্রথম পাহাড়ের মতো পাহাড় দেখলাম। জীবনে প্রথম বাইরে গেলাম। ট্রেনের জানলা দিয়ে মাঠ ঘাট দেখেই সময় কেটে গেল।
ঘেঁটুদা নেমে স্টেশনের বাইরে টেলিফোন বুথ থেকে কাকে ফোন করলো। আমরা স্টেশন থেকে একটু দূরে একটা হোটেলে উঠলাম। রাস্তা ঘাটে প্রচুর ঘোড়া।
মিত্রা ফিক করে হেসে উঠলো।
বড়োমা পেছন ফিরে তাকাল। সেই দেখে ছোটোমা-বৌদি হাসলো।
বিকেলের দিকে কয়েকজন এলো। ঘেঁটুদার সঙ্গে কথা হলো। বুঝলাম পরের দিন ঘোড়ায় করে পাহাড়ী পথে যেতে হবে। মাইল পাঁচেক রাস্তা। সেখান থেকে কুকুর কালেকসন করতে হবে।
রাতে বেশ ঠান্ডা পরলো। গ্রামের ছেলে শীত-টীত কম লাগতো।
ঘেঁটুদা বললো, একটা কাজ করবি।
বলো।
রাস্তার অপর্জিটের মদের দোকান থেকে একটা মদের বোতল আনতে পারবি।
কেন।
না খেলে গা গরম হবে না।
আমার শীত করছে না।
একটু রাতের দিকে দেখবি শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পরবে।
আমি খাব না।
তোকে খেতে হবে না।
একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিল। জীবনে প্রথম মদের বোতল ছুঁলাম। মদ কিনলাম, মদ দেখলাম।
কালচে কালচে রক্তের মতো। পরে জেনে ছিলাম ওটা রামের বোতল।
তখন অতো বুঝতাম না। ঘেঁটুদাকে বলেছিলাম ঠাকুরের নামে মদ।
তোকে বুঝতে হবে না। চ্যাপ্টার ক্লোজ।
ঘেঁটুদা মদ খেল, আমি দেখলাম। কোনও গ্লাস লাগলো না। ছিপি খুলে জলের মতো ঢক ঢক।
আমাকে বললো তুই খাবি।
আমি বললাম না।
হোটেলের দেওয়া কম্বল চাপিয়ে শুয়ে পরলাম।
শোয়া মাত্রই ঘেঁটুদার নাকের গর্জন শুরু হলো। বর্ষার মেঘের মতো গর্জন।
আমি শুয়ে শুয়ে জীবনে প্রথম পাহাড়ী পথে ঘোড়ায় চড়ার স্বপ্ন দেখছি। কিছুতেই ঘুম এলো না। রাতের দিকে বেশ জাঁকিয়ে শীত পরলো, বেশ কষ্ট পেলাম। কোনও শীতের জামাকাপর নেই। হোটেল থেকে দুটো কম্বল দিয়েছিল।
সকাল হওয়ার আগেই ঘেঁটুদাকে ডেকে তুললাম।
তরাক করে ঘেঁটুদা লাফিয়ে বিছানায় বসলো।
কিরে!
যাবে না। রেডি হও।
ঘেঁটুদা দেখলাম মুখ ভ্যাটকাল।
ধ্যুস, সত্যি তুই একটা গাধা। কাঁচা ঘুমটা ভাঙালি।
যাবে যে বললে?
সকাল হোক।
সকাল হতে আর বাকি কোথায়!
তোর শীত করছে না।
করছে তো।
এই সময় বাইরে গেলে রক্ত বরফ হয়ে যাবে। রোদ উঠুক যাব। এক কাজ কর।
বলো।
টেবিলের ওপর থেকে বোতলটা নিয়ে আয়। জলের গ্লাসদুটো আর জলের মগটা নিয়ে আয়।
মুখ না ধুয়ে মদ খাবে!
ভাত খেয়েছি কি মুখ ধুতে হবে।
টেবিলের ওপর থেকে মদের বোতল জলের গ্লাস জলের জাগ নিয়ে এলাম।
তোর শীত করছে।
করছে।
কালতো খেলি না। আজ একটু খা। দেখবি গা গরম হয়ে যাবে। আর শীত করবে না।
মনে মনে যে একবারে ইচ্ছে ছিল না তা নয়। বললাম দাও।
ঘেঁটুদা দুটো গ্লাসে মদ ঢেলে একটু জল মিশিয়ে দিল।
খাটের ওপর কম্বল গায়ে দিয়ে বাবু হয়ে বসে প্রথম মদ খেলাম। একঢোক খেতেই গলাটা জ্বালা জ্বালা করে উঠলো।
একটা তিতকুটেস্বাদ কেমন যেন স্পিরিট স্পিরট গন্ধ।
ঘেঁটুদা দেখলাম বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে।
কুত্তার নানারকম গল্প বলছে, পনেরো দিনের বাচ্চা থেকে দেড়বছরের ইতিহাস।
একগ্লাস শেষ হতেই ঘেঁটুদা বোতলটা নিঃশেষ করে আবার দুটো গ্লাসে ঢাললো।
সেটাও খেলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পর দেখলাম আমার সামনে দুটো ঘেঁটুদা কম্বলমুড়ি দিয়ে খাটে বসে।
কেমন হলো ব্যাপারটা?
মাথাটা দু-তিনবার ঝাঁকিয়ে নিলাম।
না দুটো ঘেঁটুদা। মাথাটাও কেমন চক্কর মারছে।
বুঝলি অনি।
বলো।
জানো আন্টি আজ সব কথা মনে নেই। তবে ঘেঁটুদার কিছু কিছু কথা এখনো কানে বাজে।
আন্টি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁগো বিশ্বাস করো।
ঘেঁটুদা বললো।
তোর কোনদিন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।
না।
মানুষ গলায় দড়ি দেয়। ট্রেনে গলা দেয়। বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পরে। কখনো দেখেছিস।
না।
এগুলোকে বলে আত্মহত্যা।
হুঁ।
মানুষ আত্মহত্যা করে কেন বলতো।
কেন।
যখন বেঁচে থাকার প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা এসে যায়, তখন মানুষ এসব করে।
হুঁ।
তোর এরকম কখনো হয়েছে ?
মাঝে মাঝে কেমন যেন লাগে। বাড়ি থেকে যখন টাকা পাঠাতে দেরি হয়। স্যার যখন বার বার ডেকে বলে অনি তোমার দু-মাসের টাকা বাকি পরে গেছে। স্যার সবার সামন বলে, খুব লজ্জা করে।
তখন তোর মনে হয়না বেঁচে থেকে লাভ কি?
মাঝে মাঝে মনে হয়।
ঠিক এই ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বলে। নিজের চেষ্টায় নিজের জীবনটা শেষ করে দাও।
ঠিক কথা বলেছো। মাঝে মাঝে সত্যি এরকম মনে হয়।
ধর আজ আমরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে ওই পাহাড়ী রাস্তায় যাব।
দারুণ মজা হবে কি বলো।
ব্যাটা যা বলছি একটু মন দিয়ে শোন, তারপর ডিসিসন দে, যাব কিনা।
বলো শুনি।
এই যে আমরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাব। ঘোড়াটা একটা প্রাণী।
হ্যাঁ।
ওরও ইচ্ছে অনিচ্ছা ভাললাগা আছে।
হ্যাঁ আছে।
ওরও বৌ-বাচ্চা আছে।
আছে।
প্রত্যেক দিন তোর আমার মতো কাউকে না কাউকে পিঠে চাপিয়ে পাহাড়ে উঠছে।
হ্যাঁ উঠছে।
কাঁহাতক প্রতিদিন এসব করতে ভাল লাগে বল। ওর মালিক তো ওকে সপ্তাহে একদিন ছুটি দেয় না।
ঠিক কথা।
পাহাড়ের রাস্তা তুই দেখিস নি। চড়াই উতরাই। মাঝে ফিন ফিনে সরু রাস্তা।
তুই ওপরের দিকে উঠছিস দু-পাশে গভীর খাদ। নীচের দিকে তাকালে তোর বুক পুরো শুকিয়ে চামড়া হয়ে যাবে। ওই সরু রাস্তায় ঘোড়াটা হেঁটে চলেছে।
দারুণ হবে।
ছাগল। যা বলছি শোন।
বলো।
তুই আমি ঘোঁড়ার পিঠে চড়ে যাচ্ছি।
হুঁ।
ওই রকম সরু রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি।
হুঁ।
দুপাশে গভীর খাদ।
ভয় লাগলে চোখ বন্ধ করে নেব।
ব্যাটা গর্ধভ। তোকে কথা বলতে বলেছি, যা বলছি ভাল করে মন দিয়ে শোন।
বলো।
ওইরকম সরু রাস্তা দুপাশে গভীর খাদ। ঘোড়াটা মাঝ রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। নরেও না চরেও না। আর কিছুতেই সামনের দিকে যেতে চাইছে না। তুই ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে পারছিস না। নামলেই খাদে পরে যাবি। একবারে বেঘরে প্রাণটা যাবে।
এরকম হয় নাকি!
হয়।
কেন হয়?
কেন হয় বলতো?
কেন!
ওরও তো ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু আছে।
থাকতেই হবে।
আমরা আমাদের খেয়াল খুশি মতো ওদের ব্যবহার করি। চাবুকের বাড়ি মারি। বিতৃষ্ণা।
হুঁ।
ওরা মুখ বুঁজে সব মেনে নিচ্ছে। কেন তা হবে? ওদেরও ভাললাগা মন্দলাগা আছে।
হুঁ।
ওই সরু রাস্তা, দুপাশে গভীর খাদ ঘোড়াটা ওইভাবে দাঁড়িয়ে পরলো কেন বলতো?
কেন।
ওর আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। আত্মহত্যা করার এরকম সুন্দর জায়গা পৃথিবীতে আছে?
তুই ওর মনের কথা কিছুই বুঝতে পারছিস না। তুই তোর মতো ঘোড়াটাকে লাথা লাথি করলি।
তোর তো যাওয়ার তাড়া আছে?
হুঁ।
আমি অবাক হয়ে ঘেঁটুদার কথা শুনছি। মাথাটার ঝিম ঝিমানি ভাবটা যেন বেরে গেল।
খালি একটা লাফ। তুই একদিকে ঘোড়া একদিকে। শরীরটা দলামচা হয়ে মাংসের কিমা হয়ে যাবে। কেউ কোনদিন খুঁজে পাবে না। পাহাড়ী লেপার্ডগুলো তারিয়ে তারিয়ে আমাদের শরীরের কিমা হয়ে যাওয়া মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার সারবে।
ঘোড়া আত্মহত্যা করবে!
পেছন থেকে মিত্রারা কোঁত কোঁত করছে।
বুঝতে পারছি ওরা হাসি চেপে রাখার প্রবল চেষ্টা করছে। কনিষ্করা তখন হাসতে শুরু করেছে। খিক খিকে হাসি।
ছোটোমা, বৌদিরাও মুখ চেপে হাসছে। শব্দ হচ্ছে না।
করতেই পারে। তোর আমার যদি ইচ্ছে হয়, ওদের হবে না কেন ?
আমি ঘেঁটুদার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে। দুটো ঘেঁটুদা আমার চোখের সামনে।
করবেই বলছি না। যদি করে?
তুমি কথাটা ঠিক বলেছো ঘেঁটুদা, বিশ্বাস নেই। ব্যাটা ওদের জীবনের দাম নেই, আমার তোমার আছে।
গল্প আর শেষ হল না। মিত্রা আমার পিঠে মুখ রেখে দমফাটা হাসি হেসে উঠলো।
তালে তাল মিলিয়েছে ইসি, তনু। জ্যেঠিমনিও হাসছে।
সবাই হাসছে।
মাসিমনি, আন্টি, বড়োমা আমার মুখের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে।
হাসি থামার পর অনিমেষদা বললো, গল্পটা শেষ কর।
আমিও ওদের হাসিতে যোগ দিয়েছি।
শেষ আর কি, ভয়ের চোটে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম। ঘোড়ায় চড়া আর হলো না।
তখনো হাসি থেমে নেই।
বিকেলে ঘুম ভাঙতে দেখি কুঁই কুঁই ক্যাঁও ক্যাঁও আওয়াজ। ঘরে আরও দুটো লোকের সঙ্গে ঘেঁটুদা কথা বলছে। গোটা ছয়েক বাচ্চা কুত্তা ঘরের মধ্যে ঘোরা ঘুরি করছে।
কলকাতা ফিরে এলাম।
এটা তোর ঘোঁড়ার আত্মহত্যা। বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
দেখলাম মেয়ে ঘরের গেটে এসে দাঁড়াল।
ছোটোমা, অনিসাকে দেখে হে হে হে হে করে হেসে উঠলো।
সকলে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
তোমরা এতো জোরে হাসছো কেন!
মিলিরা হেসে এ ওর ঘারে আছাড় খাচ্ছে।
অনিমেষদারাও হাসছে।
মিত্রা হাসতে হাসতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই একা।
হ্যাঁ, নিচে সপেদা পারছিলাম তোমাদের হাসির আওয়াজে উঠে এলাম।
আবার একচোট হাসি।
ওরা কোথায় ?
চিকনাদা জামরুল পারছে, ওরা গেছে।
তুই গাছে উঠেছিলি?
আবার এক চোট হাসি।
না। নীপা পিসি আঁকসি বানিয়ে দিল।
আর কে আছে।
মিকি, মাম্পি, পিপটু, বাবান।
সাগরেদ ভাল জুটিয়েছিস। যেমনি বাপ তেমনি মেয়ে।
মিত্রা আস্তে করে বললো। মেয়ের দিকে তাকাল।
ঠিক আছে তুই এখন যা পরে বলবো।
মিত্রার কথাটা অনিসা ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো ন। দাঁড়িয়ে রইলো।
বললাম তো পরে বলবো।
অনিসা চলে গেল।
হাসি থেমে নেই। ঠমকে ঠমকে হাসি চলছে।
আন্টি আমার মুখের দিকে তাকাল।
তুই এই গল্পটা বললি কেন ?
বুঝতে পারলে না।
না।
ডাক্তারদাকে জিজ্ঞাসা করো।
ও কিছু জানে নাকি ?
জানে।
কিগো অনিমেষ তুমি কিছু বুঝলে? আন্টি তাকাল অনিমেষদার দিকে।
ওর গল্পের কোনও মাথা মুন্ডু আছে নাকি।
তোমরা যে বলো, ও ভেবেচিন্তে কথা বলে। একটার সঙ্গে আর একটার লিঙ্ক থেকে যায়।
ওর প্রথম মদ খাওয়ার গল্প কাউকে এভাবে বলে নি। তাই বললো।
আন্টি এবার আমাকে চেপে ধরলো। তুই বল।
কি বলবো।
হঠাৎ এই মুহূর্তে তুই গল্পটা বললি কেন।
মনে এলো, তাই বললাম।
সকাল বেলা তুই একটা গল্প বললি শুভ কিছুটা কাঁদল। আর সবাই গম্ভীর হয়েগেল। দুপুরে নীরুকে নম্রতা কি বললো, নীরু একঝুড়ি কথা শোনালো। সবাই দেখলাম হাঁ করে গিললো।
ওটাও গল্প এটাও গল্প।
ইনারমিনিংটা বল।
তুমি ভাব। নিশ্চই অর্থটা খুঁজে পাবে।
খুঁজে পাচ্ছি না।
তোমাকে ভাবতে বলেছি।
আমি ভাবতে পারি না।
মিলি জলের বোতলটা দাও তো।
মিলি জলের বোতলটা এগিয়ে দিল। আমি বোতলের ছিপিটা খুলে গলায় জল ঢালতেই মিলি আবার হেসে উঠলো। বুঝলাম ওর মনে পড়ে গেছে, ঘোড়ার আত্মহত্যা।
আমি হেসে উঠলাম বিষম খেলাম। বড়োমা মুখ চোখ শুকিয়ে পিঠে মাথায় হাত বোলাল, ফুঁ দিল।
মিলির ওপর খিঁচিয়ে উঠলো।
বড়োমার কান্ড কারখানায় আবার একচোট হাসি।
আমি বোতলের ছিপি আটকে মিলির হাতে দিলাম।
মিলি আবার হে হে করে হেসে উঠলো।
সত্যি অনিদা তোমার ঘেঁটুদার কথাটা যতবার মনে পড়ে যাচ্ছে ততবার হাসি পেয়ে যাচ্ছে।
আমাদেরও পাচ্ছে। ইসি বললো।
তুমি বলো ইসিদি, ঘোড়ার আত্মহত্যা, তুমি যাকে বলবে সে হাসবে।
তুমি ঠিক বলেছো মিলি। আমি বললাম।
হাসতে হাসতে সবাই চুপ হয়েগেল।
আমিও যখন একা থাকি, ঘেঁটুদার কথাটা মনে পড়ে গেলে নিজে নিজেই হাসি।
আমি তখন কি গবেট গোবিন্দ ছিলাম।
মদ খাওয়ার নেশায় ঘেঁটুদা যা বুঝিয়েছে তাই বুঝেছি।
হাসির কাটা ছেঁড়ায় একদিন হঠাৎ এর অন্তর্নিহিত অর্থটা উপলব্ধি করলাম।
ঘেঁটুদাকে কাঁচা ঘুম থেকে তুলেছি। কিছুতেই তখন ঘেঁটুদা যেতে চায় না। ওতো আমার মতো ভাববাদী নয় বস্তুবাদী। ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। ঘোড়ার পিঠে চড়বে সঠিক জায়গায় যাবে। ব্যাগে করে কুত্তার বাচ্চা নেবে চলে আসবে। ওর কাছে পাহাড়, ঘোড়ায় চরা ব্যাপারটা কিছুই নয়। ওর চোখে আমার মতো স্বপ্নের কাজল পরা ছিল না। তাই ও ওর মতো আমাকে একটু মদ খাইয়ে গল্পটা বুঝিয়েছিল, আমি বুঝেছিলাম।
পরে যখন এর অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করলাম তখন নিজেই অবাক হলাম, ঘেঁটুদা একটা সামন্য গল্পের মধ্যে দিয়ে কি বিরাট একটা জীবন বোধের কথা বলে ফেললো।
ঘেঁটুদা নিজেই হয়তো জানে না।
সত্যি তো ঘোড়া কোনদিন আত্মহত্যা করে? করে না। ইতিহাসের পাতায় কিংবা গ্রিনিজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে এর সত্যতা সত্য যাচাই করতে পারবে না। কোথাও লেখা নেই।
একটু ভেবে দেখ এই ঘরে যারা বসে আছি তারা প্রত্যেকে এক একজন ঘোড়া। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কারুর না কারুর ভার আমাদের বহন করতে হচ্ছে। বিরক্ত হচ্ছি, লাঠালাঠি করছি। কিন্তু কেউ কখনো আত্মহত্যার কথা চিন্তা করি না। ভেবে নিই এটা আমাদের কাজ।
এবার কেউ আর হাসাহাসি করছে না। গুরুগম্ভীর পরিবেশ।
মানুষ তো আত্মহত্যা করে। মিলি বললো।
ওরা ঘোড়া নয়, গাধা কিংবা খচ্চরের পর্যায় পরে।
পরিবেশটা পুরো থমথমে।
একচিলতে হাসি কারুর ঠোঁটের ডগায় এই মুহূর্তে নেই।
আমি আন্টির দিকে তাকালাম।
আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে। চোখের পাতা নড়াচড়া করছে না। স্থির দৃষ্টি, মনে হল যেন সামান্য জল টল টল করছে।
আমি কি তোমাকে বোঝাতে পারলাম আন্টি।
আন্টি আমার হাতটা চেপে ধরে কাঁধে মাথা রাখল।
বুঝলে আন্টি তোমার জীবনে যেমন অবসর নেই, আমার জীবনেও নেই। অনিমেষদা, আফতাবভাই, বড়োমা, ছোটোমা, বৌদি সবার ক্ষেত্রে বিষয়টা এক। অবসর নিয়ে তুমি বেঁচে থাকতে পারবে না।
আমি আমার দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে তোমাদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম। তোমরা নাও মানতে পার। তবে খুব সামান্য হলেও তোমাদের বুদ্ধির গোড়ায় একটু নাড়া দিতে পেরেছি বলে মনে হয়।
অনিমেষদা স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। মাসীমনি নির্বাক চলচ্চিত্রের জীবন্ত চরিত্র।
জীবনবোধ। এই ছোট্ট শব্দটা নিয়ে তুমি যদি ঠিকমতো কাটাছেঁড়া করতে পার, জিতে গেলে। তোমাকে আর আত্মহত্যা করতে হবে না।
না হলে তোমার বেঁচে থাকাটাও আত্মহত্যার সামিল।
তুমি ঘোড়া, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আদি অনন্তকাল ধরে তোমার চলার শেষ নেই।
নিস্তব্ধ ঘর।
তোর ঘেঁটুদা বেঁচে আছে ? আন্টির গলাটা কেমন ধরা ধরা।
হ্যাঁ। পদুদের বাড়ি থেকে দু-একটা বাড়ি পরে থাকে। সেই যে সেই সময় কলেজের কোয়ার্টার ছেরে ঘর ভাড়া নিয়েছিল এখনও সেখানেই রয়েছে। কুকুরের ব্যবসা আর করে না। ছেল-বৌ-এর লাথি ঝেঁটা খেয়ে দিব্যি রয়েছে। পদুর হাতে মাঝে-সাঝে কিছু টাকা পাঠাই।
পদু-ঝুনেকে পেয়েছিলাম ঘেঁটুদার হাত ধরেই।
আন্টি কাঁধ থেকে মাথা তুললো।
আমি আন্টির দিকে তাকালাম।
মন খারাপ হয়েগেল।
না।
তাহলে তোমার চোখটা কেমন ছল ছল করছে।
আন্টি মাথা নীচু করে রইল।
বুঝলে আন্টি স্যাটায়ার, উইট এই ওয়ার্ড কিংবা শব্দ দু-টোর সৃষ্টি ঠিক এই ধরনের পরিবেশ থেকেই।
আমাদের মধ্যেই বিভিন্ন শব্দ লুকিয়ে রয়েছে। সময় বিশেষে সেগুলো প্রকাশ হয়ে পরে।
অর্জুন, বিনদ, আলতাফ এদের মধ্যে আমি এই সব শব্দ-বর্ণের তাৎপর্য খুঁজি, পেয়েও যাই। তাই ওরা আমার চোখে খারাপ নয়।
আর দশজনের মত সাধারণ মানুষ। অর্জুন কিংবা বিনদ যখন পৃথিবীর আলো দেখেছিল। তখন কেউ কি বলেছিল, ওরা খুনে-গুন্ডা-বদমাস ?
একটু ভেবে দেখ, কেউ বলে নি।
তোমার আমার ঘরের আর দশটা ছেলে মেয়ের মতো মানুষ।
পাক চক্রে ভগবান ভূত। ওরাও এক একটা ভূত তৈরি হয়েছে। আমি ওদের গুণিন।
কখনো চাল পোড়া, কখনো তেল পোড়া, কখনো সরষে পোড়া দিই।
ভূতরা আমার কথা মতো নাচা নাচি করে। নাহলে যদি জলপোড়া দিয়ে মাছি বানিয়ে দিয়ে বোতলে বন্দি করে দিই।
আন্টি হাসলো। এ হাসির মধ্যে কোন প্রাণ নেই।
আর সবাই সম্মোহনের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
হঠাৎ আফতাবভাই নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এলো।
চোখ মুখটা কেমন যেন থম থমে, মনে হলো একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
সকলে আফতাবভাই-এর দিকে তাকিয়ে আছে।
মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেল।
কাছে এসে আমাকে দাঁড় করিয়ে জাপ্টে ধরে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো।
বিধানদা, ডাক্তারদা নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসেছে। বড়োমা, আন্টি কেমন যেন থতমত খেয়েগেছে।
ঘরের সকলেরই এক অবস্থা।
আমিও কেমন যেন কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পরলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেছে।
আফতাবভাই মেয়েটা মারা যাওয়ার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে একবার কেঁদেছিল। তারপর থেকে ওকে কখনো কাঁদতে দেখি নি। নিজের খুব খারাপ লাগছে।
মাসিমনি উঠে দাঁড়িয়ে আফতাবভাই-এর পিঠে হাত রেখেছে।
দিদির চোখ ছল ছল করে উঠেছে।
আমি কি তোমাকে কোন অপমান সূচক কথা বললাম।
আফতাবভাই কোন কথা বলছে না। পরিষ্কার শব্দ করে কাঁদছে।
আমি যদি আমার অজান্তে কোন অন্যায় করে থাকি, তুমি আমাকে শাস্তি দাও।
তুই আমাকে শাস্তি দে।
আমি কেন দেব, তুমি কোন অন্যায় করো নি।
আমি অন্যায় করেছি।
ঠিক আছে, আগে কান্না থামাও। দিদি আমাকে কি ভাবছে। আমি তোমার দুর্বল জায়গায় আঘাত দিয়ে কথা বলেছি।
ও কেন সারাজীবন মুখ বুঁজে সহ্য করলো। কেন আমাকে বাধা দিল না।
কনিষ্করা হতভম্ব হয়েগেছে। আফতাবভাই-এর মতো লোক শিশুর মতো কাঁদতে পারে, ওরা ভাবতেই পারছে না। ওদের চোখে বিষ্ময়ের পাহাড়।
মিলিদি একটু ধরো তো। নীপা দরজার ওপর।
ওর হাতে চায়ের ট্রে পট কাপ ডিস।
আফতাবভাই আমাকে ছেড়ে দিয়ে ওর্ণায় চোখ মুছছে। এই দৃশ্য দেখে নীপার চোখ দুটো কেমন স্থির হয়ে গেছে। একবার করে সবার মুখের ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিল।
বুঝে নিল এই মুহূর্তে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে না।
মিলি চায়ের সরঞ্জাম সেন্টার টেবিলে রেখেছে। টিনা, অদিতি উঠে গেছে।
নীপা তখনো স্থানুর মতো আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে।
তুমি কি আমার পাশে বসবে না দিদির পাশে বসবে।
না আমি ওখানে গিয়ে বসছি।
চা খাও। দেখবে ঠিক হয়ে যাবে।
আফতাবভাই নিজের জায়গায় এগিয়ে গেল।
বারান্দায় গিয়ে চোখে মুখে একটু জল দিয়ে নাও।
না, ঠিক আছে।
দাদা কিন্তু নিজের জায়গা ছেড়ে ওঠে নি। একটা কথাও বলে নি। ইসলামভাইও নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে আছে।
মিলি চা ঢালছে।
টিনা অদিতি সকলের হাতে হাতে দিয়ে দিচ্ছে।
আমার ফোনটা বেজে উঠলো। পকেটে হাত দিলাম।
ওখানে নেই এখানে।
মিত্রা আমার বালিশের তলা থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিয়েছে।
আমরা একটু শুনব। মুচকি মুচকি হাসছে।
কে ফোন করেছে ? অনিমেষদা বললো।
বিনদ।
শোনা। অনিমেষদার গলাটা গম্ভীর।
সবাই চায়ে চুমুক দিয়েছে।
মিত্রা ভয়েজ অন করতেই বিনদ হ্যালো বলে উঠলো।
বল।
বিকট একটা হাসির শব্দ। কিছুক্ষণ হাসির পর বিনদের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
আর ধৈর্য ধরতে পারলাম না।
কেন।
পেট ফুলে যাচ্ছিল।
খুব খুশি খুশি লাগছে মনে হচ্ছে।
অবশ্যই।
কেন।
কতদিন পর হাত-পা ছড়িয়ে সকলে একটু মজা করছি।
শেষ কবে মার খেয়েছিলি।
বিনদ হেসেই যাচ্ছে।
হাসি থামা। বল কি বলছিস।
তুমি ভিখাকে ছেড়ে দিলে কেন।
এমনি, ইচ্ছে হলো।
বিনদ আবার হাসে। হাসতে হাসতেই বললো।
ওয়াহিদ ফোন করেছিল আলতাফকে।
আফতাবভাই আমার মুখের দিকে তাকাল!
কেন ?
এটাও তোমাকে খুলে বলতে হবে।
ওকে বলে দে, ও আমার পার্মিসন ছাড়া কলকাতায় ঢুকেছে, বেরতে গেলে ধরা খেয়ে যাবে।
ও আমার মতো ভুল করে ফেলেছে।
তুই আর ও সমান নয়।
আমি জানি। তবু….।
তোর এই সব কাওতালির জন্য সকালে শুভ ঝাড় খেল।
অনিদার কাছে দাদাগিরি করলে ঝাড় খেতে হবে। বিনদ ঝাড় খেয়েছে, অর্জুন ঝাড় খেয়েছে, আলতাফ ঝাড় খেয়েছে….।
বক বক করিস না।
ঝাড় খাওয়ার পরই বুদ্ধি খুলে গেছে বুঝলে।
কি করে বুঝলি।
আমায় ফোন করেছিল। অর্জুনকে শুনিয়েছি, কি হাসি সকলের।
তোরা কোথায় ?
তোমার স্কুল দেখছি। দেবাদা গাইড।
আমার স্কুলে!
হ্যাঁ। দেবাদা গল্প বলছে, আর আমরা তোমাকে দেখছি। অনিদা।
বল।
তোমাকে কতদিন দেখিনি। কখন আসছো ? বিনদের গলাটা ভাড়ি হয়ে এলো।
আর কে কে আছে ?
সবাই।
ওরা কোথায় ?
স্কুলের ভেতরে, আমি স্কুলের সামনে বড়ো মাঠটায় দাঁড়িয়ে।
কি করছিস?
সত্যি বলবো না মিথ্যে বলবো।
যেটা খুশি।
রাগ করবে না।
না।
বোঁচকুল কেমন দেখতে গো ?
মিত্রা মুখে কাপর চাপা দিয়ে কোঁত কোঁত করছে। আমি একবার টেরিয়ে তাকালাম।
তনু, মিলিরাও মুচকি মুচকি হাসছে।
অনিদা।
বল।
চুপ করে আছো।
ভাবছি।
গাছ থেকে আম পেরে খেলাম, কেউ বারন করলো না বুঝলে।
কে উঠেছিল ?
অর্জুন। বেশ মিষ্টি।
মিত্রা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। পেছন থেকে হি হি করে হেসে উঠলো।
আমি কট কট করে ওর দিকে তাকালাম।
কে গো অনিদা!
তোর বৌদি।
তুমি বৌদিকে শোনাচ্ছ নাকি ?
না।
তাহলে বৌদি হাসল।
খালি বক বক করে।
এখন রাখি, পরে কথা বলবো।
রাখ।
ফোনটা কাটার সঙ্গে সঙ্গে বড়োমা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
তোর কবে বুদ্ধিশুদ্ধি হবে শুনি।
মিত্রা হেসে বড়োমাকে জড়িয়ে ধরলো।
শুনলে না। আমগাছে উঠে আম পেরেছে। মাঠে বোঁচকুল খুঁজতে এসেছে।
বেশ করেছে তোর কি।
গুণীনও ভূত তার চ্যালারাও এক একটা ভূত।
অনিমেষদা-বিধানদা-দাদা একসঙ্গে হেসে উঠলো।
অনিমেষদা হাসতে হাসতে বললো। তুই খুব সুন্দর ব্যাখ্যা করলি।
আফতাবভাই-এর চোখ-মুখের ঘোলাটে ভাবটা অনেকটা কেটে গেছে।
হাসছে না তবু যেন হাসছে।
মিত্রা, ইসি, তনু তখনো খুচ খুচ করে হেসে চলেছে।
বড়োমা উঠে দাঁড়াল।
বদের হাঁড়ি।
ছোটো চল, নাজমা চলো, দিদি চলো। বেরতে বেরতে না হলে দেরি হয়ে যাবে।
আজ একটু বেলাবেলি সকলে বেরলাম। মাঠে দিয়ে যাওয়া যাবে না। জল জমে গেছে। বাঁধের ওপর দিয়ে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে।
মিত্রাদের হাত থেকে রক্ষা পেলেও নম্রতা, অনিকা, অনিসার হাত থেকে রক্ষা পেলাম না। ওরা আমাকে ওদের মতো করে গুছিয়ে দিল।
খারপ লাগছে না। বেশ নতুন নতুন পাঞ্জাবী-চাপকান লাগিয়েছি।
বাইরে বেড়তে নেপলারা একচোট আমাকে দেখে হাসাহাসি করলো।
সুজিতদা এগিয়ে এসে বললো।
বুঝলি অনি, নীরু হাতে ঘড়ি লাগাল।
সুজিতদার দিকে তাকিয়ে হাসছি।
একবারে ফিট। নো চিনি নো চাপ। তোর বৌদিও দেখলাম খাওয়ার ব্যাপারে কোন রেস্ট্রিকসন করছে না। কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছি।
বাথরুম করতে মাঠে গেছিলে, না ডেকরেটেড বাথরুমে।
সুজিতদা হাসছে।
দু-একবার বাঁশ ঝাড়ে গেছি। চারদিক শুনশান।
কচি বয়েসটা ফিরে পাচ্ছিলে।
ছ্যাবলামো করিস না। ছেলে-বৌ আছে।
তাতে কি হয়েছে। জিজ্ঞাসা করো একবার করে সবাই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
সুজিতদা হেসে জড়িয়ে ধরলো।
নম্রতারা মুখ টিপে হাসছে।
এই টুকু টুকু পুঁচকে মেয়েগুলোকে তুই একবারে পাকিয়ে দিলি।
আমি দিলাম ?
দিলি তো।
চোখ চলেগেল খামারের দিকে।
মাম্পিরা একটা ট্রলিতে উঠে বসেছে। পিপটু সিটে বসে প্যাডেলে পা দেওয়ার চেষ্টা করছে। পা পাচ্ছে না। মাম্পি, মিকি তারস্বরে চেঁচিয়ে পিপটুকে ধমকাচ্ছে। কেউ কারুর ভাষা বুঝছে না।
চিকনা, মীরচাচাকে ওখানে দেখতে পাচ্ছি। কনিষ্করাও রয়েছে।
বড়োমারা সকলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। শুভর দাদু-ঠাকুমা, সুরোর শ্বশুর-শ্বাশুরীও এসেছেন।
এগিয়ে গিয়ে কোমড় ভাঙতে হলো।
শুভর দাদু জড়িয়ে ধরলেন।
কর্মের খাতিরে অনেক গ্রাম ঘুরেছি। তোমর গ্রামটা দেখে একটু অবাক হচ্ছি।
কেন ?
এত নিস্তব্ধতা আগে কখনো দেখি নি।
তবু এখন অনেক বেশি জনবসতি হয়েছে। লোকসংখ্যা বেরে গেছে। জনপদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার বীজও অনেক বেশি ঢুকে পড়েছে।
মিত্রা বলছিল। ও যখন প্রথম এসেছিল তখনের থেকে এখন অনেক বদলেছে।
হ্যাঁ। তখন যা গাছ ছিল এখন তার ফর্টি পার্সেন্ট উধাও।
তবু তোমার ঘর বাড়ি এখনো মাটির।
চিকনাকে বলেছি। এইটুকু অন্ততঃ রেখে দে।
বড়ো ভাল ছেলে।
সুরোর শ্বশুর শ্বাশুরীর চোখ-মুখ খুশিতে ঝকঝক করছে।
তোমার শেকড়টা দেখে সত্যি অভিভূত। সুরোর শ্বশুর বললেন।
আমি হাসছি।
ঠোক্কর খেতে খেতে বেরতে আরও আধঘণ্টা লাগল।
শুভর দাদু বললেন, অনি আমরা যদি হেঁটে যাই অসুবিধে আছে।
অনেকটা পথ।
গ্রামের পথে হাঁটতে অসুবিধে নেই। কিছুটা ফ্রেস হাওয়া ফুসফুসে ভরে নিই। কলকাতায় পয়সা দিলেও পাব না।
নদীতে জল বেরেছে। নৌক করে পার হতে হবে।
সেতো আরও মজার জিনিষ। শুভর দাদু শুভর ঠাকুমার দিকে তাকাল।
কিগো নৌকয় উঠবে নাকি ?
তুমি যাও, আমি বরং দিদিদেরে সঙ্গে যাই।
সেই ভাল। শুভর দাদু সুরোর শ্বশুরের দিকে তাকালেন।
কি অচিন্তবাবু ?
নতুন এক্সপিরিয়েন্স, গেলে মন্দ কি।
হেঁটে যাওয়ার লোক খুব একটা খারাপ হলো না। রূপায়নদা, অনুপদা ছাড়াও অনিমেষদা, মল্লিকদা, সুজিতদা যেতে চাইল।
অনিমেষদাই চিকনাকে ডাকল।
চিকনা কাছে আসতেই অনিমেষদা বললো।
হ্যাঁরে চিকনা নৌকটা কোথায় ?
কেন!
বল না।
ঘাটে বাঁধা আছে।
আমাদের একটু নদীর ওপারে দিয়ে আসেত পারবি।
কেন!
আমরা কয়েকজন হেঁটে যেতাম, সকাল থেকে বসে বসে কোমড় পিঠ ব্যাথা হয়েগেছে।
ছুঁচ্চা কোথাকার। তোর মাথায় বুদ্ধি আছে।
চিকনা আমর দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
ও বলে নি। শুভর দাদুর ইচ্ছে হয়েছে। তাই আমাদেরও একটু ইচ্ছে হলো।
না যেতে হবে না। ভিতরের রাস্তা কাদা আছে।
কলকাতার রাস্তায় জল ভেঙেছি। এখানে কিরকম কাদা আছে একটু পরখ করি।
চিকনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আপনারা নদীর ঘাটে যান আমি এদের ছেড়ে আসছি।
তাই এসো। শুভর দাদু বললো।
কথাটা বড়োমা, ছোটোমা, বৌদির কানে পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না।
বড়োমা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি অনিমেষদার মুখের দিকে তাকাল।
অনিমেষ তোমরা কি দিনে দিনে কচি হচ্ছো। বড়োমার কথা শুনে সবাই হাসছে।
আমি প্রোগ্রাম করিনি। অচিন্তবাবু, সিনিয়ার মুখার্জীর ইচ্ছে হলো।
আপনাকেও বলি, বুড়ো বয়সে সখ আছে। বড়োমা শুভর দাদুর দিকে তাকিয়েছে।
দুদিন পর মরে যাব। আর আসা হবে কিনা কে জানে। এই ফাঁকে গ্রামটাও ঘোরা হয়ে যাবে।
সময়ের মধ্যে ঢুকবে।
বড়োমা অনিমেষদার মুখের দিকে তাকাল।
আমরা ভেতরবাইর পার হয়ে পুকুর ধার, বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে নদীর পারে এলাম। আফতাবভাই সব শুনে আমাদের পিছু ধরলো। সকলে সেই কথা শুনে হাসে।
দিদিকে বলে দিল। তোমরা ট্রলিতে যাও আমরা হেঁটে যাই।
দিদি একবার মুখ টিপে হাসলো।
নদীর ধারে এলাম। নৌক বাঁধা আছে। ঝির ঝির বাতাসে নৌক তার আপন খেয়ালে দুলছে। শুভর দাদু, অচিন্তবাবু চারদিকটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আফতাবভাইয়ের চোখ মুখ দেখে বুঝলাম পরিবেশটা ভীষণ এনজয় করছে। শুভরদাদু অনিমেষদা চিকনাকে কনটিনিউ প্রশ্ন করে চলেছে। চিকনাও নৌক বাইতে বাইতে ফর ফর করে চলেছে।
মনাকাকা এক সময় পুকুরের চারদিকে বাঁশ, শাল, সেগুন, অর্জুন, নিম, আম, জাম, শিরিষ গাছ লিগিয়েছিল সেগুলো এখন বড়োসড়ো হয়ে সব দশাশই চেহারা। পেয়ারা গাছটায় বেশ পেয়ারা হয়েছে।
বুঝলেন অনিমেষবাবু, সকালে এই ছোট নদীতে নৌক চরতে খুব একটা খারপ লাগে নি। সুজিতদা বললো।
আপনার একবার চড়া হয়েগেছে ?
হ্যাঁ দিদিরা যখন চড়লো আমিও উঠে বসলাম। শহরে নৌক বিলাস বলতে গঙ্গা। তাও কতবছর আগে চড়েছি খেয়াল করতে পারি না।
তারমানে বড়োমারাও এক ফাঁকে নৌকবিলাস করে নিয়েছে ?
শুভর দাদু হাসছে।
আরে মশাই একটা থ্যাঙ্কস অন্ততঃ দিন প্ল্যানটার জন্য। শুভরদাদু বললেন।
সবাই হাসছে।
অচিন্তবাবু আপনি আগে কখনও উঠেছেন।
সেই ছাত্রাবস্থায়। তারপর একবার বেনারস গেছিলাম। যমুনায় নৌক চড়েছিলাম। একঘণ্টা।
আমি আমার লাইফে বহুবার চেপেছি। তবে স্পিডবোট। তাও আবার বন্যার সময় রেস্কিউ করার জন্য। এই নৌক চড়ার অভিজ্ঞতা খুব কম। একচ্যুয়েলি এতো ইন্টেরিয়ার ভিলেজে আমাদের মতো ফোর্সের লোকেদের ঢোকা নিষেধ ছিল। তারপরে পদোন্নতি হওয়ার পর আর এখানে সেখানে ঘোরাই বন্ধ হয়েগেল।
অনি তুমি কখনো কলার ভেলা চরেছ। শুভর দাদু আমার মুখের দিকে তাকাল।
ওর সব চড়া হয়েগেছে। খবর নিয়েছি। রূপায়ণদা বললো।
শুভর দাদু রূপায়নদার দিকে তাকাল।
তাল গাছের গুঁড়ি দিয়ে যে ডোঙা তৈরি হয় সেটাও চড়েছে। ওর সাগরেদ চিকনা, ভানু।
আমি হাসছি।
ওর কাকার সঙ্গে বার তিনেক দেখা হয়েছিল। ওনার মুখ থেকেই শুনেছি।
তারপর অনির উনামাস্টার। তিনিও কিছু গল্প বলেছিলেন।
ছোট সময়ে অনি যে খুব একটা ঠান্ডা ছেলে ছিল তা নয়।
গ্রামের ছেলেরা এরকম হয় বুঝলে রূপায়ন। তুমি খুঁজলে, আজও দু-একটা অনিকে আশেপাশে পেয়ে যাবে। শুভরদাদু বললেন।
চিকনা চলে এলো।
আমরা ধীর পায়ে নদী গর্ভে নেমে এলাম।
একে একে নৌকয় উঠলাম।
(আবার আগামীকাল)