ছোট্টবেলার সেই নদীটিকে দেখে
আজ কেন এত দুঃখ সবার মনে?
সেই নদী আজ হারিয়েছে তার গতি
ব্যথা বাজে শুধু সেই নদীটির প্রাণে।
নদীকে ঘিরেই সভ্যতা বেঁচে ছিল
নদী মানেই তো জীবনের স্পন্দন
নদী থেমে গেলে কিভাবে বাঁচব আমি?
জলঙ্গী, তুমি সবার আলম্বন।
নদীর দুধারে আগামীর ছেলেবেলা
সবুজে সবুজ আমাদের রূপকথা
হাতে হাত রেখে নদীকে বাঁচাও আজ
নদী ফিরে পাক চলমান কথকতা।
প্রিয় নদী জলঙ্গীকে নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই মনে এলো পঙক্তিগুলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো দশমীর বিকেল।জলঙ্গী নদীর দুই তীরে তখন হাজার হাজার মানুষের ভীড়। আজ যে দুগ্গা পুজোর ভাসান। দুই পারের বেশ কয়েকটি গ্রামের পুজোমণ্ডপ থেকে মা দুর্গা তার সন্তান লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশকে নিয়ে হাজির ঘাটের ধারে।নৌকা করে ঘুরবে তারা।সঙ্গে আরও শ’খানেক নৌকা ভাসে জলে।পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকোয় উঠবে অনেকেই। নদীর দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকবে অসংখ্য দর্শক।মাইকে বিজয়ার গান।নদীর পার থেকে প্রায়ই শোনা যাবে কবিতার পংক্তি-“ছন্দের নদী বলে গেল কানে কানে/আমরা সবাই মেলবন্ধনে বাঁচি/ঢাকের বাদ্যি কাশফুলেদের সাথে/দিব্যি রয়েছে হৃদয়ের কাছাকাছি।” সূর্যের সোনালি আভা চারপাশকে করে তোলে মায়াময়। পাঁপড় ভাজা,বাদাম ভাজা,জিলিপি,নাগরদোলা,রঙিন বেলুন,খেলনাপুতুলের মেলবন্ধনে বন্যপাড়ার মাঠ তখন উৎসবের মেজাজে।এই পাড়া আসলে ‘স্মৃতির শেতলপাটি’।রাতের অন্ধকারে জেলেনৌকার আলোগুলো জ্বলে থাকতো।জেলেরা জাল বিছিয়ে রাখতো মাঠে-সেলাই করতো নিপুণ হাতে। এই পাড়াতেই স্নানযাত্রার মেলা বসত।বাঁকে করে জল এনে শ্রী কৃষ্ণের মাথায় ঢেলে পুণ্যার্জন করে কত মানুষ।বাঁশ বাগানের তলা দিয়ে যাবার সময় গা-ছমছম করতো।হরিনাম সংকীর্তনের সুর মন ভরিয়ে তুলত।বর্ষায় নদীর জল নদীর পাড় উপচে বারোয়ারিকে স্পর্শ করতো।বন্যার জল ভাসিয়ে দিত চারপাশ,তাই নাম বন্য পাড়া(‘বন্যা’ থেকেই ‘বন্য’ শব্দটি করে নিয়েছে গ্রামের মানুষ। কোনো কিছুই পাল্টে যায় নি।আজও বারোয়ারিতলা কত মানুষের মিলনক্ষেত্র। প্যারিস থেকে ফেরা রাজেশ দা তার সদ্য বিবাহিত বৌকে নিয়ে ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে ভাবছে এইসব কথা।ভাবছে ঝুলনের সময় মুসলিম বন্ধুরা একসঙ্গে নদীর পাড়ে ছুুুটে যেত ।নিয়ে আসত পাহাড় তৈরির ঘাসমাটি । সেজে উঠত ঝুলন।
আজও কাশফুলে হিমেল বাতাস দোলা দিয়ে যায়। ঢাকের তালে মাতে ছেলে-বুড়ো সকলে। ভট্টাচাজ্জি পরিবারের সঙ্গে আলাপচারিতায় দে পরিবার।চক্রবর্তী পরিবারের নতুন বৌ নৌকায় বসেই আলাপ করে নেয় মৈত্রবাড়ির নতুন জামাইয়ের সঙ্গে। ছোট্ট কথাও তাঁর বাবার গ্রামের বাড়িতে হাজির।সবাইকে নিয়ে সে উঠেছে নৌকায়। নৌকায় বসেই সে শোনায় বাবার লেখা কবিতা —
একটা নদী আমার দিকে
তাকিয়ে বলে, শোনো
শীতল জলে আঙুল ছুঁয়ে
স্বপ্ন তোমার বোনো
আমার কথা স্বপ্নে থাকুক
তোমার সুরে গানে
ভালোবাসায় আপন কোরো
বইবো নতুন প্রাণে
আমার কথা লিখবে তুমি
নতুন ইতিহাসে
থাকবো আমি শহর গ্রামে
তোমার পাশে পাশে।
সবুজ গাছে আমার দু’ধার
গল্প লিখে যাবে
হাজার পাখি হাজার রকম
ছন্দ ফিরে পাবে।
এসব শুনে চুপটি করে
বসব নদীর কাছে
জলঙ্গিকে আদর করে
রাখবো বুকের মাঝে।
দে বাড়ির নৌকা প্রতিবারই খুব বড় হয়। গ্রামের জনপ্রিয় ডাক্তারবাবু অবনীবাবুই অনেকদিন আগে সপরিবার নৌকায় ওঠার এই ব্যাপারটি চালু করেন।তিনিও আজ নেই।একসময় পাশ্ববর্তী প্রায় দশ-বারোটি গ্রামের মানুষ তাঁর চিকিৎসার উপরে নির্ভর করে থাকত।তাঁঁর পুত্র আজ ডাক্তার। বাবার মতোই তিনিও আপদে -বিপদে মানুষের পাশে। কয়েকটি গ্রামের মানুষ তাঁর সহৃদয় চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল একান্তভাবে।খুড়তুতো,জেঠতুতো,পিসতুতো দাদা-বৌদিদের সাথে দিদি-জামাইবাবু,তাদের ছেলেমেয়েরা মিলিত হয় দশমীর এই দিনটাতেই। কানাডায় বসে মেজদির ছেলে লাইভ ভিডিও দেখে এসবের।অথবা হায়দ্রাবাদ থেকে রাঙাদির ছেলে লেখে-‘খুব মিস করছি মামা’।অন্যদিকে শহরে-থাকা বড় ছেলে নারকেল নাড়ু,নিমকি করতে বসে গেছে গ্রামের বাড়ির দালানে।নৌকো থেকে নেমেই সবাই আসবে প্রণাম করতে।ফেলে-আসা এই গ্রামে আজও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অদ্ভুত মিল।পসরা সাজিয়ে বসে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষজন। দশমীর বিকেলের এই দৃশ্য সেই ছোটবেলা থেকেই সবাইকে বেঁধে বেঁধে থাকতে শিখিয়েছে।বিধবা মুসলিম লক্ষ্মী পিসি দীর্ঘদিন ধরেই দে পরিবারের সদস্য।তাঁর কোলেপিঠে মানুষ হয়েছে অনেকেই। আজ এই উৎসবের মুহূর্তে সেও সামিল।নবমীর সকালে বাসস্ট্যান্ড থেকে ইয়া সেখের টুকটুকিতেই বাড়ি পর্যন্ত আসা।ছোটবেলার বন্ধু বদর উদ্দিন শহরের বন্ধু এসেছে শুনেই ছুটে এসেছে বাড়ির পাশের পুজোমণ্ডপে।আব্বাস চাচা আজ আর নেই।তাঁর হাতেই তৈরি হত সবার জন্য একই ছিটকাপড়ের জামা।আজও করম মণ্ডল তৈরি করে জামা।দলিল সেখের দোকান থেকেই পুজোর আগে নতুন ফ্রিজ কেনে দে পরিবারের সেজো ছেলে।ইত্তার মন্ডল ছুটে আসে হিন্দু পরিবারগুলোর যেকোনো প্রয়োজনে। ওর ছেলে বাপ্পা বিদেশে কাজ করতে চলে গেলেও পুজোর শুভেচ্ছা জানাতে ভোলে না ক্লাসমেট নভোনীলকে । ঈদের দিন যেমন নেমতন্ন পায় দে-পরিবার তেমনি বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করতে ভোলেন না জয়নাল আবেদিন,হজরত আলীর মতো কবিরা।গ্রামের সেই মাস্টারমশাইও আজ বেঁচে নেই। তিনি সকলকে হৃদয়ের কাছাকাছি থাকার প্রেরণা জুগিয়েছেন সবসময়।দোলের দিন আবীর মেখে বের হতেন রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের সঙ্গে। তাঁকে দেখে মনে হত মেলবন্ধনের কাণ্ডারী।গ্রামের মোড়লেরা পরামর্শ নিত তাঁর।বন্যার সময় সব সম্প্রদায়ের মানুষ মিলিতভাবে বাঁধ মেরামতির কাজে নেমেছে।গ্রামের মেধাবী ছাত্র আজ সাহিত্যের অধ্যাপক। ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে উল্লিখিত নিজের গ্রামের নাম ক্লাসের ছাত্রদের বলতে পেরে তিনি যেমন আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়েন, বলেন, ভবানন্দের জন্মবৃত্তান্ত’ অংশে ভারতচন্দ্র লিখেছেন —
“ধন্য ধন্য পরগণা বাগুয়ান নাম।
গাঙ্গিনীর পূর্ব্বকূলে আন্দুলিয়া গ্রাম।।
তাহার পশ্চিম পারে বড়গাছি গ্রাম।
যাহে অন্নদার দাস হরিহোড় নাম।।”
ছাত্র-ছাত্রীরা জলঙ্গী পাড়ের গল্প শুনে বিস্মিত হয়।হরিহোড়ের রাজবাড়ী ছিল বড়গাছি গ্রামে। এখন সেখানে শুধুই মাটির ঢিপি। কালেরগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস। পাশেই নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর মন্দির।জায়গাটি নিত্যানন্দ প্রভুর পদধূলিতে ধন্য। এখানে এসেছিলেন নিত্যানন্দ।নিত্যানন্দ প্রভুর বিবাহ হয়েছিল শালিগ্রামে। এইখান থেকেই তিনি গিয়েছিলেন শালিগ্রাম। বিহারীকৃষ্ণ দাস ছিলেন রাজা হরিহোড়ের পুত্র।বিবাহ যাত্রাকালে নিত্যানন্দ নবদ্বীপ থেকে শালিগ্রাম যাবার সময় তাঁর শিষ্য এই কৃষ্ণ দাসের বাটীতে ওঠেন।এখানেই নিত্যানন্দের অধিবাস কার্যাদি সম্পন্ন হয় এবং এখান থেকেই তিনি শালিগ্রামে বিবাহ যাত্রা করেন। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু এখানে বহু লীলা করেন। এটি একটি উল্লেখযোগ্য নিত্যানন্দ লীলাক্ষেত্র। জলঙ্গী নদী, ঈশ্বরী পাটনীর সেই ঘাট আজও তাঁর স্মৃতিপটে ফিরে ফিরে আসে।
তেমনি কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিধন্য এই গ্রামের সম্প্রীতির কথা ছাত্রছাত্রীদের সামনে উপস্থাপন করে তিনি গর্ব অনুভব করেন। জলঙ্গী নদীর তীরেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর স্বপ্নের লোকসেবা শিবির। লিখেছিলেন —
“গ্রামের প্রান্তে স্বচ্ছ সলিলা নদীর তীর
সেথায় সবুজ ঘাসের উপরে বেঁধেছি নীড়।
নাহি শহরের কলকোলাহল, ধুলি ও ধোঁয়া
নাহি উদ্ধত প্রাসাদের ভিড় আকাশ-ছোঁয়া,
নীল নির্মল স্নিগ্ধ আকাশ উপরে হাসে
কী যে কোমলতা শিশিরে সজল সবুজ ঘাসে।
হেনার গন্ধে মদির স্নিগ্ধ অন্ধকার,
আকাশের মাঠে তারার ফুল কী চমৎকার!”
এই শিবিরেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন গদাধরের মন্দির শ্রীরামকৃষ্ণ পাঠাগার, নার্সারি স্কুল, বালিকা বিদ্যালয়, বেসিক ট্রেনিং কলেজ এবং আরো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।এখানে বিরাট খেলার মাঠ।সেখানে শুরু হয়েছিল গদাধরের মেলা তাঁর হাত ধরেই।আজও মাঘীপূর্ণিমায় গদাধরের মেলা হয়।
সুর-তাল-ছন্দের মেলবন্ধনে যেভাবে সৃষ্টি হয় সংগীতের,রং-তুলি-মন আর ক্যানভাসের মেলবন্ধনে যেভাবে জন্ম নেয় জীবন্ত সব ছবি,কলম-কালি-মন আর শব্দের মেলবন্ধনে যেমন নির্মিত হয় কবিতার ঘর,সেভাবেই ভালোবাসা-বন্ধুতা-শ্রদ্ধা-সহানুভূতির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠে কত সুন্দর সম্পর্ক। আজ চারদিকে যখন ভাঙনের সুর তখন এই গ্রাম যেন সম্প্রীতির প্রতিমূর্তি। নদীর দু’ধারের চিত্রকল্প যেন বলে-‘লোভ-লালসা-কামনা-বাসনা ত্যাগ করো…তবেই তো বাড়ির কাছের আরশিনগরের পড়শি মনের মানুষের সঙ্গে মিলতে পারা সম্ভব।’ধীরে ধীরে সন্ধ্যা মানে ঘাটে।বিসর্জনের বাজনা বাজে।নদীর শরীরে তখন আলোর ফোয়ারা। ছোটদের হাতের রংমশাল, ফুলঝুরি নতুন গল্প লেখে জলঙ্গীর বুকে-মেলবন্ধনের গল্প।
অমৃতাভ দে। কৃষ্ণনগর। নদিয়া। দোগাছি উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক।
পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত
লেখাটি ভালো লাগলো
স্মৃতিমেদুরতায় মাখা, অথচ তথ্যনিষ্ঠ সুন্দর লেখা