পেহেলগাম কাণ্ডের পর ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যে একটা টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। পেহেলগামে জঙ্গী হামলার জেরে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে প্রায় সাত দশক পুরনো সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে। দুটি দেশই একে অপরের বিমানের জন্য আকাশসীমাও বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া ঘটনার দু-তিন দিন পর থেকেই সীমান্তে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়েরও খবর পাওয়া যাচ্ছে। যুদ্ধে জন্য তৎপরতার নানা ধরনের খবর যেভাবে বেড়ে চলেছে সেই পরিস্থিতিতে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি দুই দেশ সত্যিই যুদ্ধের দিকে এগচ্ছে? প্রশ্ন সহজ হলেও একে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর কৌশলগত শক্তি প্রদর্শন বলা যাবে না, অন্যদিকে ইতিহাস, সামরিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে গভীর বিশ্লেষণ ছাড়া উত্তর দেওয়াও মুশকিল। দু দেশের বৈরী সম্পর্ক তো নতুন নয়, সেই স্বাধীনতা বা দেশভাগের সময় থেকেই। আর কাশ্মীর প্রশ্নে ১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে দু’দেশের মধ্যে সরাসরি যেসব যুদ্ধ হয়েছে তা নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে।
দুই দেশের মধ্যে এই টানটান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে গোটা দুনিয়া হাত পা গুটিয়ে নেই, তারাও মাঠে নেমে পড়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকী রাশিয়াও ভারতকে যুদ্ধ এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘বদলা’র হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর তো আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ভারত উপদেশ চায় না, সঙ্গ চায়।’ প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানাচ্ছেন, “দেশ যা চাইছে, সেটাই হবে।” অন্যদিকে জাতিসংঘ যে যুদ্ধ ঠেকাতে মধ্যস্থতার চেষ্টা করবে সেকথা বলাই বাহুল্য। ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালের মতো এবারও নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হতে পারে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ কিছুকাল ধরেই আলোচিত এবং সিপেক প্রকল্পের মাধ্যমে পাকিস্তানে অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী। তবে চীন ভারতের সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। ফলে তারা সরাসরি কোনো পক্ষ নেবে কিনা বলা মুশকিল, তবে যুদ্ধ ঠেকাতে যে নীরব কূটনীতির পথেই হাটবে সেকথা ধরে নেওয়া যায়।
বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই যেমন শক্তিশালী সামরিক বাহিনী আছে, দুই পক্ষই পারমানবিক শক্তিতে বলীয়ান। ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’ ভারতকে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে রাখে। তবে যুদ্ধে জয় পরাজয়ের থেকেও অনেক বড় বিষয় হল, যুদ্ধ শেষপর্যন্ত দুই দেশেই মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। এমনকি ১৯৯৯ সালের কারগিল সংঘাতও পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করেছিল। যেটুকু জানা বা বোঝা যাচ্ছে তাতে ভারত পারমাণবিক অস্ত্র আগে ব্যবহার না করার নীতির পক্ষে ভারত। তবে পারমাণবিক হামলার শিকার হলে ভারত যে ব্যাপক আকারে প্রতিশোধমূলক জবাব দেবে সেকথা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে, পাকিস্তান ‘ফুল-স্পেকট্রাম ডেটারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে, দরকার মতো সীমিত পারমাণবিক হামলার পক্ষেই থাকবে বলে মনে হয়। পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষকেরা অবশ্য বলছেন, দুই দেশ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু করলেও ভারত পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা খুব কম, কিন্তু সীমান্ত-সংঘর্ষ যদি মাত্রাতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তবে পারমাণবিক যুদ্ধের পথে যেতে কেউই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না।
যদি সত্যি যুদ্ধ লাগে তবে পাকিস্তানের অর্থনীতি ভয়ঙ্কর অবস্থায় পৌঁছাবে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এই সময়ে পাকিস্তানের অর্থনীতি হল মাত্র তিনশো বিলিয়ন ডলারের। তাছাড়া পাকিস্তানের মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক দেনা ঠিক এই মুহুর্তে যে অবস্থায় আছে তাতে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত হবে নিজেদের জন্য আত্মঘাতীর সমান। অন্যদিকে ভারতের অর্থনীতি তিন ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি, তাছাড়া রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ, বিশ্ব বাণিজ্যে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে প্রযুক্তি খাতে সাফল্যে ভারত পাকিস্তানের থেকে অনেক এগিয়ে। এগিয়ে রেখেছে। তবে ভারতের ক্ষেত্রেও যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ব্যয়বহুল হবে বলেই বিশেষঙ্গদের মত। যদিও ভারত নিজের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থা ও বিশ্ব অর্থনীতিতে সংযোগ থেকে দেশের ক্ষতি কিছুটা হলেও সামাল দিতে পারবে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতের দাবিতে যেভাবে ফুঁসছেন তাতে তো সত্যি যুদ্ধের জল্পনা উসকে দিচ্ছে। আর সেখান থেকে এই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে, তাহলে কী ১৯৭১, ১৯৯৯ সালের মতোই ভারত সরাসরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছে? না কী সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় সেনা যেভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালিয়েছে, এবারও সেরকম একটা কিছু ঘটবে? প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্রের যুদ্ধের প্রবল সম্ভাবনায় আরও একটি প্রশ্ন কিন্তু এসেই পড়ে, যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে তার জের ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতি ও কূটনীতিকে কতটা প্রভাবিত করবে একইসঙ্গে কতটা প্রভাব ফেলবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে? ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত হওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত রকম বাণিজ্য বন্ধ করা হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য এই পদক্ষেপ এক বিরাট ধাক্কা। সিন্ধু নদীর উপর ভারত যদি বাঁধ নির্মাণ করে তাহলে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে এমন জলসংকটে পড়বে যা পাকিস্তানকে আর্থিকভাবে কার্যত অন্ধ করে দেবে। অন্যদিকে এই সময় ভারত বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এশিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে। আমেরিকা ও চিনের মধ্যে চলা বাণিজ্য যুদ্ধ ভারতকে এশিয়ায় বাণিজ্যের অন্যতম হাব হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে। এতদিন চীন ওই জায়গায় ছিল। পাশাপাশি ট্রাম্প যে নতুন শুল্কনীতি চালু করেছেন তার বোঝা এড়াতে বহু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা ভারতে ঢুকতে আগ্রহী। সেকথা ভুলে যদি ভারত প্রতিহিংসামূলক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে দেশের সেই বাণিজ্য সুযোগ ধাক্কা খেতে বাধ্য। তাই মুখে কিংবা হাবেভাবে যতই যুদ্ধের কথা তাঁরা বলুন না কেন যুদ্ধ শুরু হলে বাণিজ্যিক দিক থেকে যে বিরাট আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা তাঁরা কি তা ভুলে গিয়েছেন?